বুড়ো শিবপুর গাঁয়ে কারুর অ্যালার্মের দরকার পরে না। বহুযুগ ধরে গ্রামের মোরগশ্রেণী এই দায়িত্ব টা পালন করে এলেও ইদানিং মানে বছর তিনেক ধরে কাশীরাম প্রামানিক অতি যত্নসহকারে এই কাজটি করে আসছে। কাশীরামের ঘুম ভাঙে ঠিক ভোর তিনটে-সাড়ে তিনটে নাগাদ। উঠতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু এই ভোর রাত থেকে এমন কাশির বেগ উঠতে থাকে যে বিছানায় শুয়ে থাকা যায়না। তাই উঠে পড়তে হয়।

এই সময়টাতে তার কাশির চোটে ঘুম ভাঙে তার এবং আশেপাশের তিন-চারটে বাড়ির। এরপর যখন সে প্রাতকৃতের জন্য নদীর পাড়ে যায় তখন এক এক করে রাস্তার ধারের সবকটি বাড়িতেই তার কাশির আওয়াজ ভোরের সূচনা করে।

দু দিন আগে ওপাড়ার ব্রজখুড়ো কাশিরাম কে পাকড়াও করে। ‘ বলছি বাবা কাল ভোরে একটু ওপাড়া দিয়ে যেতে হবে যে। মানে ওই যখন নদীর পাড়ে যাবে তখন।’

কাশীরাম ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে ছিল ব্রজখুড়োর দিকে। এতে খুড়ো একগাল হেসে তিন-চার পিস অবশিষ্ট দাঁত বের করে বলেছিল, ‘আসলে কাল একবার শহরে যাব। তাই ভোর চারটের ফার্স্ট ট্রেন টা ধরতেই হবে। তাই বলছিলাম কাল যখন নদীতে যাবে,একটু কষ্ট করে যদি ওপাড়া হয়ে যাও খুব উপকার হয় বাবা।’

কাশীরাম গত চারবছর ধরে নয় নয় করেও তিনশ ছাপান্নটা ডাক্তার, শ’দেড়েক কবিরাজ আর ডজনখানেক হাকিম দেখিয়েছে। এমনকি ওঝা,কাপালিক,মা মনসা,মঙ্গলচণ্ডী, বিপত্তারিনী করতেও ছাড়ে নি। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। কাশি যে কে সেই।

কি না করেনি সে। বিধু ডাক্তারের কথামতো বেলা বারোটার সময় খাঁ খাঁ রোদে ঝাড়া দু ঘন্টা সূর্যের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে ছিল। মাথাঘুরে পড়ে ভিরমি গিয়েছিল কিন্তু কাশি যায় নি।

সত্য ওঝার কথায় মায়ের মন্ত্রপুত ফুল মুখে নিয়ে, দাঁতে দাঁত চেপে মুখ বুজে হাজার এক বার মায়ের নাম জপ করেছিল। কাশির দমকে বুকে হাতুড়ির বাড়ি অনুভব করলেও মুখফুটে একবারও কাশে নি।সব সহ্য করে নাম কমপ্লিট করেছিল। কিন্তু লাভ কি হল! নাম শেষ হবার পর,এতক্ষণ ধরে চেপে রাখা কাশিগুলো একজোট হয়ে যে মোক্ষম কাশির জন্ম দিল তাতে তার মুখ দিয়ে মায়ের মন্ত্রপড়া ফুলের সাথে, উপরের পাটির নড়বড়ে দাঁতটা সুদ্ধ উঁপড়ে এসে দুহাত দূরে পড়েছিল।

কাশির চোটে কোনো কাজকম্মোও করতে পারে না সে। এতগুলো ডাক্তার দেখানোর ফলে ডাক্তারি সম্পর্কে মোটামুটি একটা আইডিয়া চলে এসেছিল। তাই সনাতন ডাক্তারের কাছে কম্পাউন্ডারির চাকরিতে ঢুকেছিল একবার। কিন্তু কপালে সইল না। কেষ্টখুড়ো কে কড়াডোজের ইঞ্জেকশন দিচ্ছিল কাশী। কিন্তু ওই। চরমতম মুহূর্তে এল কাশির বেগ। আর ইঞ্জেকশন গিয়ে বসল কেষ্টখুড়োর গিন্নির কোমরে। সাতদিন ধরে বিছানায় পড়ে গোঁ গোঁ করেছিলেন কেষ্টগিন্নি। সে যাত্রায় বেঁচে গেছিলেন। কিন্তু এখনো পর্যন্ত কাশীকে দেখলে ভিরমি যান।

বিকেলবেলা নিধু চক্কোত্তির দাওয়ায় বসে নিজের দুঃখের কথা বলছিল কাশী। ‘ কি না করলাম খুড়ো। কিচ্ছু লাভ হল না। এই কাশিই কাশীরামের কাল হয়ে দাঁড়াল। খুড়ো গো, একটা বাপও তার মেয়ে দিলে না। লোকে দেখলে পরে ভয়ে পালিয়ে যায়। ভাবে কি না যেন রোগ নিয়ে ঘুরছি। বাড়ির লোক অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। না খুড়ো। এ জীবন আর রেখে লাভ নেই।’

নিধু চক্কোত্তির এসব শুনে শুনে মুখস্থ হয়ে গেছে। তাই তিনি এদিকে কান না দিয়ে কি যেন চিন্তা করছিলেন। কাশীরাম তার রেকর্ড থামালে বললেন,’ আমার সাথে একটিবার গোরুমারাচর গাঁয়ে চল কাশী। গতকাল মুখুজ্যেদের বৈঠকখানায় গিয়ে শুনলাম ওখানে নাকি এক মহাপুরুষের আবির্ভাব হয়েছে। ভৈরবানন্দ মহারাজ। সাক্ষাৎ ভৈরব। একবার তার চরণে আশ্রয় নিয়ে শেষবারের মতো একটা চেষ্টা করে দেখ না।’

কাশী কোনো আগ্রহ দেখায়নি। কেবল উদাসভাবে বলেছিল,’তাই চলো। এত কিছু যখন করলাম তখন এটাই বা কেন বাদ রাখি।’

শুভদিন দেখে কাশীরাম ও নিধুখুড়ো হাজির হল বাবা ভৈরবজীর আখড়ায়। অন্য সাধুদের থেকে কিছুমাত্র আলাদা না। ঘন্টা দেড়েক অপেক্ষার পর কাশীর নম্বর এল। হ্যাঁ, এইখানে একটু নতুনত্ব। ভিড় কন্ট্রোল করতে বাবা আগত ভক্তদের নম্বর লেখা টোকেন দেন। সেই নম্বর অনুযায়ী ডাক পরে ভক্তদের।

‘বল। কী সমস্যা?’ বাবা চোখ বুজেই বললেন।

কাশীরাম সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে উঠে বসে কড়জোড়ে বাবাকে তার সমস্যার কথা বলল। শুনে বাবা কিছুক্ষণ চোখ বুজেই রইলেন। তার পর ধীরে ধীরে চোখ খুললেন।

‘ কাশি গেছিস কখনো?’

‘ আজ্ঞে?’ কাশী ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়।

‘বলছি কাশি, মানে বাবা বিশ্বনাথের কাছে গেছিস কোনদিন?’

‘ আজ্ঞে না বাবা। বাপের জন্মে কখনো কাশি যায়নি।’

‘হুম।’ বাবা আবার চোখ বুজলেন। বিড়বিড় করে কিছু বললেন। তারপর হঠাৎ চোখ খুলে কটমট করে চাইলেন কাশীর দিকে,’ বাপের জন্মে না। তোর আগের জন্মে গেছিলিস।’

বাবাজী আবার চুপ।

‘ ঘোর পাপ। ঘোর পাপ করেছিলিস। বাবার মাথায় তুই জল মেশানো দুধ ঢেলেছিলিস। অভিশাপ। হুঁ হুঁ বাবা, যাবে কোথায়! বাবা বিশ্বনাথের অভিশাপ।’

‘ মুক্তি লাভের উপায় বাবা? ‘

‘ যজ্ঞে আহুতি দিতে হবে। তারপর সেই যজ্ঞের ছাই মাদুলিতে পুরে শনিবার মধ্যাহ্নে কালো ষাঁড়ের গলায় পড়াতে হবে। আর মাদুলি পড়ানোর পর ষাঁড়ের শিং ধরে তিনবার বাবা বিশ্বনাথের নাম নিলেই মুক্তি। মোট ১০০১ টাকা খরচ।’

শনিবার বেলা বারোটার সময় মাদুলি হাতে কাশী ঘোষবাবুদের মাঠে এসে হাজির হল। এখানেই ঘোষবাড়ির বিখ্যাত ষাঁড়, কালোকুচকুচে নন্দী চড়ে বেড়ায়। সাক্ষাৎ বাবা বিশ্বনাথের এই বাহনটিকে সাড়া বুড়োশিবপুর ডরায়। ঘোষেদের রাখাল ছাড়া আর কেউ নন্দীর ছায়া মাড়ানোর সাহস পাই না।

কাশী বাবা বিশ্বনাথের নাম নিয়ে কাঁপতে কাঁপতে নন্দীর কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। নন্দী আপনমনে ঘাস চিবোচ্ছিল। কাশীকে বিশেষ পাত্তা দিল না। কাশী হাতে করে একটা আস্ত লাউ নিয়ে এসেছিল। সেটা নন্দীর দিকে বাড়িয়ে দিতে নন্দী মুখ তুলে চাইল। অনেকক্ষন ধরে ঘাস চিবিয়ে মুখটা কেমনযেন ভোঁতা হয়ে গেছিল নন্দীর। তাই কচি লাউ দেখে চোখটা চকচক করে উঠল। দুবার শুঁকে লাউ এ মুখ লাগাল সে। এই সুযোগে কাশীরাম খুব সাবধানে মাদুলিটা নন্দীর গলায় পড়িয়ে দিল। লাউটা বেশ সরেস। তাই নন্দীও বিশেষ আপত্তি করল না। কিন্তু তারপরেই ঘটল অঘটন।

মাদুলি পড়ানোর পর যেই না কাশী নন্দীর শিং এ হাত রাখল, নন্দীর সেটা মোটেও পছন্দ হল না। প্রথমে কাশীর পেটে মারল এক মোক্ষম গুঁতো। তারপর পিছন ফিরে ল্যাজে করে কাশীর গলায় এক বাড়ি। এটুকুই যথেষ্ট ছিল।

‘ আঁক’ করে কয়েকহাত দূরে ছিটকে পড়ল কাশী। দুবার ওঠার চেষ্টা করল। মাথা ভনভন করছে। কান শনশন করছে। গলাটা কি আদৌ শরীরের সাথে লেগে আছে! দুবার কথা বলার চেষ্টা করল সে। ঘর্ঘর আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই বের করতে পারল না। বুঝতে পারল জ্ঞান হারাচ্ছে। ঝাপসা চোখে দেখল নন্দী তার দিকে ফিরে আপনমনে লাউ খাচ্ছে। একবার তারদিকে চেয়ে ফিক করে হাসল বলেও মনে হল। তারপর ধীরে ধীরে কাশীর চোখ বুজে এল।

ওই ‘আঁক’ টাই ছিল কাশীরামের মুখের শেষ কথা। যদিও ‘আঁক’ টাকে আক্ষরিক অর্থে কথা বলা চলে কি না এ নিয়েও যথেষ্ট সংশয় আছে। না, কাশী বেঁচে আছে। কিন্তু কথা বলতে পারে না। কেবল আওয়াজ। ঘর্ঘর আর ঘর্ঘর। নন্দীর ল্যাজের বাড়ি তার বাকশক্তি চিরকালের মতো কেড়ে নিয়েছে। যদিও ঘোষেরা এখনো চেষ্টা করে যাচ্ছে। অনেক ডাক্তারও দেখিয়েছে। অনেকে আশাও দিয়েছে।

কিন্তু হ্যাঁ। বাবাজীর কৃপা নাকি বাবা বিশ্বনাথের লীলা জানা নেই, নন্দীর ল্যাজের বাড়িতে কথার সাথে সাথে চিরকালের মতো কাশিও লোপ পেয়েছিল কাশীর।

সমাপ্ত

Print Friendly, PDF & Email
Previous articleলড়াই
Next articleহারুর বিপদ
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments