“গণতন্ত্রের বিকল্প হল উন্নততর গণতন্ত্র।”— এই শ্লোগানটি বহু কথিত। কিন্তু, এই “উন্নততর গণতন্ত্র” বলতে কি বোঝায়? এক কথায় গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থাকে আরো উন্নত ও মজবুত করে গড়ে তোলা। কারো কারো মতে, “উন্নততর গণতন্ত্র ব্যবস্থা” হল গণতন্ত্রের এমন আধুনিক রূপ, যে ব্যবস্থায় ধণী ও দরিদ্রের বৈষম্য অনেকটা কমে যাবে, সমাজের সকল স্তরের মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে শাসন ব্যবস্থায় বা রাষ্ট্র গঠনে অংশ নেবে। কৃষক, মজুর প্রভৃতি সমাজের নিচু স্তরের মানুষের জীবনযাত্রার মান আরও উন্নত হবে। সকলের জন্য শিক্ষা, বাসস্থান, বিনামূল্যে চিকিৎসা ও কাজের অধিকার সংবিধানিক স্বীকৃতি পাবে। দেশের সকল শ্রেণীর মানুষকে একাত্ম করাই অর্থাৎ শ্রেণীবিভাজন দূর করে রাষ্ট্র পরিচালনা করাই হল “উন্নততর গণতন্ত্র”।
বাংলা ভাষায় “গণতন্ত্র” শব্দটির ইংরেজি অর্থ ডেমোক্রেসি (Democracy)। ব্যুৎপত্তিগতভাবে গণতন্ত্র বা ডেমোক্রেসি শব্দটি এসেছে গ্রীক শব্দ থেকে, যার অর্থ “জনগণের শাসন” শব্দটির উৎপত্তি (demos) “জনগণ” ও (Kratos) “ক্ষমতা” থেকে। খ্রিষ্টপূর্ব ৫ম শতকে অ্যাথেন্স ও অন্যান্য গ্রিক নগররাষ্ট্রে বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে বোঝাতে শব্দটির প্রথম ব্যবহার হয়। প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে ক্লিসথেনিস নতুন ধরনের সরকার চালু করেন এবং সেই সঙ্গে বিশ্বের প্রথম গণতন্ত্র সৃষ্টি হয় গ্রিসের ছোট একটি শহর-রাষ্ট্র এথেন্সে। এই শহর-রাষ্ট্রটি ছিলো এথেন্স শহর এবং তার আশপাশের গ্রামাঞ্চল নিয়ে গঠিত।
রাষ্ট্রব্যবস্থা পরিচালনার জন্য বিভিন্ন উপজাতির মধ্য থেকে নেতাদের বেছে নেওয়ার যে প্রাচীন রীতি চালু ছিলো, ক্লিসথেনিস তার অবসান ঘটান। তার বদলে তিনি মানুষের নতুন জোট তৈরি করেন এবং প্রতিটি জোটকে ডিময় (Demoi) অথবা প্যারিশ (Parish)- এ বিভক্ত করেন। প্রতিটি মুক্ত নাগরিককে রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়ে শহর-রাষ্ট্রের সরকার পরিচালনায় সরাসরি অংশগ্রহণের অধিকার দেয়া হয়। সাধারণভাবে এই ঘটনাকেই গণতন্ত্রের প্রথম উন্মেষরূপে গণ্য করা হয়, যার পরে নাম হয় ডেমক্রেশিয়া (Democratia) যার অর্থ হচ্ছে জনগণের (demos) শক্তি (Kratos)। প্রাচীন ভারতেও কয়েকটি জনপদ গণতান্ত্রিক ছিল, যেমন “লিচ্ছিবি”।
“গণতন্ত্র” বলতে কোনো রাষ্ট্রের এমন একটি শাসনব্যবস্থাকে বোঝায়, যেখানে নীতিনির্ধারণ বা সরকারি প্রতিনিধি নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রত্যেক নাগরিক বা সদস্যের সমান ভোটাধিকার থাকে। গণতন্ত্রে আইন প্রস্তাবনা, প্রণয়ন ও তৈরীর ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের অংশগ্রহণের সমান সুযোগ রয়েছে, যা সরাসরি বা নির্বাচিত প্রতিনিধির মাধ্যমে হয়ে থাকে। “গণতন্ত্র” পরিভাষাটি সাধারণভাবে একটি রাজনৈতিক রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেই প্রয়োগ করা হলেও অন্যান্য সংস্থা বা সংগঠনের ক্ষেত্রেও এটি প্রযোজ্য হতে পারে, যেমন বিশ্ববিদ্যালয়, শ্রমিক ইউনিয়ন, রাষ্ট্র-মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি।
রুশ বিপ্লবের পরবর্ত্তীকালে পৃথিবীব্যাপী গণতন্ত্রের প্রসারলাভ ঘটে। পৃথিবীর অনেক দেশেই রাজতন্ত্রের পতন হয় এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন উপায়ে গণতন্ত্রকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। কিন্তু, সময়ের সঙ্গে তাল রেখে সব কিছুর পরিবর্তন বা আধুনিকিকরন হলেও, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সেই আদি রূপের কোন রকম পরিবর্তন হয়নি।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায়, দেশের শাসন ব্যবস্থা গণতান্ত্রিক নির্বাচন বা ভোট পদ্ধতির মাধ্যমে গড়ে উঠে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায়, একটি ভোট দেবার অধিকার হল, সে দেশের মানুষের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক অধিকার। কারন এই ভোট দেবার অধিকার থেকে সে তার পছন্দ মত দল বা প্রার্থীকে নির্বাচিত করতে পারে, যারা দেশের পরবর্তী শাসনব্যবস্থা পরিচালনা করে। কিন্তু, বাস্তবে সত্যই কি তাই হয়?
নতুন নির্বাচন পদ্ধতি
ধরুন, আপনি “ক” দলের সমর্থক। আপনার কেন্দ্রে “ক” দলের প্রার্থী কে হবে, তা ঠিক করবে “ক” দলের নেতৃত্ব বা হাইকমান্ড। দলের নেতৃত্ব বা হাইকমান্ডের নির্বাচিত প্রার্থীকে আপনার পছন্দ নাও হতে পারে (আপনার মতে সে অযোগ্য বা অসৎ)! তাহলে আপনার প্রিয় দলকে জেতাতে গিয়ে, আপনি কি আপনার অপছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেবেন? আবার ধরুন, “খ” দলের নির্বাচনে জয়লাভ আপনি চান না। কিন্তু, “খ” দলের প্রার্থী আপনার এলাকার উন্নতির জন্য অনেক কিছু করেছেন, অথবা সে ভোটে জিতলে আপনার এলাকার আরো উন্নতি হবার আশা করেন। অথবা, আপনার প্রিয় “ক” দলের প্রার্থীর থেকে “খ” দলের প্রার্থী অনেক বেশী যোগ্য বা সৎ। “খ” দলের প্রার্থীকে ভোট দিয়ে জিতালে, “খ” দলেরও কিন্তু একটি আসন বেশী হয়ে গেল। “ভালো দলের সব প্রার্থীই ভালো, আবার খারাপ বা বিরোধী দলের সব প্রার্থীই খারাপ”— এটা মানার কোন যুক্তি নেই। আবার এরকমও হতে পারে, আপনার কেন্দ্রের কোন প্রার্থীকেই আপনার পছন্দ নয়। তখন কি করবেন? কাকে ভোট দেবেন? “নোটা”-তে (NOTA=“None of the above”) ভোট দেবেন? আপনি “নোটা”-তে ভোট দিলে বা ভোট না দিলেও, কিন্তু আপনার কেন্দ্র থেকে একজন প্রার্থী বা দল নির্বাচিত হবেই। শুধু তাই নয়, আপনার কেন্দ্রের একটা বড় অংশের মানুষেরা যদি ভোট দানে বিরত থাকে, তবুও কিন্তু আপনার কেন্দ্র থেকে একজন প্রার্থী বা দল নির্বাচিত হবেই। কোন কোন সময় দেখা যায়, কোন কেন্দ্রে ৪০ শতাংশেরও কম ভোট পরেছে, বা কোনো অঞ্চলের মানুষেরা ভোট বয়কট করেছেন, তবুও কিন্তু ঐ কেন্দ্র থেকে একজন প্রার্থী বা দল নির্বাচিত হয়। তাহলে বাকি ৬০ শতাংশ মানুষের ভোট দেবার অধিকারের প্রকৃত মূল্য কোথায়?
২০১৬ সালে পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে এক নির্বাচনী জনসভায় তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন যে, “আলাদা করে প্রার্থী দেখবেন না। ২৯৪ টা আসনে আমিই প্রার্থী। আমাকে দেখেই ভোট দিন।” পশ্চিমবঙ্গের বিশাল সংখ্যক মানুষ যে, তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখেই ওই ২৯৪ টি আসনে তৃণমূল প্রার্থীদের বিপুল ভোট দিয়েছিলেন, তা বোঝার জন্য খুব একটা জ্ঞানী হবার প্রয়োজন নেই। ভারতবর্ষে ২০১৪ পার্লামেন্ট নির্বাচনে মোদী ম্যাজিক যে বিজেপিকে বিপুল ভোট জিততে সাহায্য করেছিল, সেটা অনিস্বীকার্য।
ভারতবর্ষের বিভিন্ন দলগুলির দিকে লক্ষ্য করুন, দেখবেন এই দলগুলির একজন বা দুজন নেতা-নেত্রীর উপর নির্ভর করে দলের বাকি প্রার্থীরা ভোট পায়। অর্থাৎ, প্রার্থীরা যতটা না নিজের কারিস্মায় ভোট পায়, তার থেকে অনেক বেশি ভোট পায়, ওই দলের প্রধান নেতা-নেত্রীর নামে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, জয়ললিতা, লালুপ্রসাদ যাদব, মায়াবতী, মুলায়ম সিং যাদব, চন্দ্রবাবু নাইডু, চন্দ্রশেখর রাও— এইসব নেতাদের নামেই তাদের দলের প্রার্থীরা বেশিরভাগ সময় ভোট পায়। এইসব দলের যে সব প্রার্থীরা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে, সেই কেন্দ্রের অনেক ভোটাররাই সেই কেন্দ্রের প্রার্থীর ব্যাপারে বেশিরভাগ সময়ে প্রায় কিছুই জানেনা বললেই চলে। তারা শুধু দল বা সেই দলের নেতা-নেত্রীর নামেই ভোট দেয়। এই সুযোগে বেশিরভাগ সময় অযোগ্য বা অসৎ প্রার্থীরা ভোটে নির্বাচিত হয়ে যায়। জয়ললিতার মৃত্যুর পর তার দল এআইএডিএমকে-এর কি অবস্থা হয়েছিল, তা আমরা সবাই জানি! এআইএডিএমকে দল দুই ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছিল। দুই দলের নেতারা তাদের যোগ্যতা প্রমান করার চেয়ে, জয়ললিতাজী কার বেশি কাছের ছিল, তাই প্রমান করতে বেশি ব্যস্ত ছিল।
আবার, বর্তমান নির্বাচন পদ্ধতিতে প্রার্থী দলের নামে যেমন ভোট পায়, তেমনি প্রার্থীর নামেও দল অনেক সময় জেতে। ভালো করে লক্ষ্য করে দেখুন, প্রায় প্রত্যেক দলেরই সামনের সারির কয়েকজন নেতা বা নেত্রী ভালো বা যোগ্য, বাকি সবই অযোগ্য বা অসৎ। তাই প্রার্থী যেন অযোগ্য হওয়া স্বত্বেও, দলের নামে ভোটে না জেতে, সেই ব্যবস্থা করতে হবে। অর্থাৎ, প্রার্থীকে জিততে হবে নিজ যোগ্যতায়, দল বা দলের নেতা-নেত্রীর নামে নয়। সেইজন্য, বর্তমান নির্বাচন পদ্ধতির পরিবর্তে এমন নির্বাচন পদ্ধতি প্রনয়ন করতে হবে, যাতে “প্রার্থী” এবং “দল” দুটো পৃথক হয়। অর্থাৎ, একজন ভোটার নিজের ইচ্ছে মতো একসঙ্গে “প্রার্থী” এবং “দল” উভয়কে আলাদা আলাদা ভাবে নির্বাচিত করতে পারবো। বর্তমানে যেমন প্রার্থীকে ভোট দেবার অর্থ দলকে ভোট দেওয়া, অথবা দলকে ভোট দেবার অর্থ প্রার্থীকে ভোট দেওয়া, সেই ব্যবস্থার পরিবর্তন আনতে হবে।
১ নং চিত্র: “ক”-এর “দল” এবং “খ”-এর “প্রার্থী” দুটিতে এক সঙ্গে ভোট দেওয়া
এবার, ১নং চিত্রের মডেলটি লক্ষ্য করুন। ধরুন, আপনি “ক” দলের সমর্থক। কিন্তু, “ক” দলের প্রার্থীকে আপনার তেমন একটা পছন্দ নয়। আবার, “খ”, “গ”, বা “ঘ” দলের জয়ও আপনি চান না। কিন্তু, “খ” দলের প্রার্থী “শ্যাম”-কে আপনার পছন্দ। ১নং চিত্রে “দল” এবং “প্রার্থী”- দুটি পৃথক কলম আছে। আপনি “ক”-এর “দল” এবং “খ”-এর প্রার্থী “শ্যাম” দুটিতে ছাপ দিন (বৈদ্যুতিক ভোটযন্ত্রে নির্দিষ্ট সূইচ দুটি টিপুন)। এইভাবে আপনি আপনার “প্রিয় দল” এবং “প্রিয় প্রার্থী”-কে একসঙ্গে আলাদাভাবে নির্বাচিত করতে পারেন। আবার, আপনার কেন্দ্রের কোন প্রার্থীকে আপনার পছন্দ না হলে, শুধুমাত্র আপনার প্রিয় দলকে ভোট দিন। প্রার্থীর কলমে “কোনো প্রার্থীকেই নয়”-তে ছাপ দিন (বৈদ্যুতিক ভোটযন্ত্রে নির্দিষ্ট সূইচটি টিপুন)। অনুরূপভাবে, আপনার কেন্দ্রের কোন দলকে আপনার পছন্দ না হলে, শুধুমাত্র আপনার প্রিয় প্রার্থীকে ভোট দিন। দলের কলমে “কোনো দলকেই নয়”-তে ছাপ দিন (বৈদ্যুতিক ভোটযন্ত্রে নির্দিষ্ট সূইচটি টিপুন)। যদি আপনার কেন্দ্রের কোন “প্রার্থী” এবং “দল”— উভয়কেই আপনার অপছন্দ হয়, তবে প্রার্থীর কলমে “কোনো প্রার্থীকেই নয়” এবং দলের কলমে “কোনো দলকেই নয়” ছাপ দিন (বৈদ্যুতিক ভোটযন্ত্রে নির্দিষ্ট সূইচ দুটি টিপুন)। এইভাবে আপনি “প্রার্থী” এবং “দল” দুটো পৃথক ভাবে নির্বাচিত করতে পারবেন এবং আপনার অপছন্দের “প্রার্থী” বা “দল”-কে নির্বাচিত হওয়া থেকে রুখতে পারবেন। বর্তমান নির্বাচন পদ্ধতিতে যা কখনোই সম্ভব নয়।
নির্বাচনে জয়–পরাজয় নির্ধারণ
এবার দেখা যাক, কিভাবে নির্বাচনে জয়-পরাজয় নির্ধারিত হবে। কোন কেন্দ্রে “দল”-এর কলমে যে দল বেশী ভোট পাবে, সেই দল জিতবে। কিন্তু, “দল”-এর কলমে যদি “কোনো দলকেই নয়”-তে বেশী ভোট পড়ে, তাহলে ঐ কেন্দ্র থেকে কোন দল জিতবে না। অনুরুপভাবে, “প্রার্থী”-এর কলমে যে দলের প্রার্থী বেশী ভোট পাবে, সেই প্রার্থী জিতবে। কিন্তু, “প্রার্থী”-এর কলমে যদি “কোনো প্রার্থীকেই নয়”-তে বেশী ভোট পড়ে, তাহলে ঐ কেন্দ্র থেকে কোন প্রার্থী জিতবে না।
এবার আলোচনা করা যাক দেশের সরকার কিভাবে গঠন হবে। দেশের বর্তমান লোকসভায় আসন সংখ্যা ৫৪৩ টি। “প্রার্থী” এবং “দল” দুটো পৃথক ভাবে নির্বাচিত হওয়ায় পাঁচ রকমের অবস্থা (combination) দেখা যেতে পারে। নিন্মে এই পাঁচ রকমের অবস্থাগুলি আলোচনা করা হল:—
(১) কোন কেন্দ্রে যদি একই দলের “প্রার্থী” ও “দল” জেতে, তবে ওই প্রার্থী ৫ পয়েন্ট পাবে। ১ নং চিত্রে দেখুন “ক” দলের প্রার্থী “রাম”। এখন ঐ কেন্দ্রে থেকে যদি দল হিসাবে “ক” দল এবং প্রার্থী হিসাবে “ক” দলের প্রার্থী “রাম” জেতে, তবে রামের পয়েন্ট হবে ৫। অর্থাৎ, ঐ কেন্দ্র থেকে “প্রার্থী” এবং “দল”-এর প্রতিনিধি হিসাবে রাম সংসদে বা বিধানসভায় যাবে এবং তার পয়েন্ট হবে ৫। এরা হবেন “পূর্ণ সংসদ/বিধায়ক”।
(২) কোন কেন্দ্র থেকে একটি দলের “দল” ও অন্য দলের “প্রার্থী” জেতে, তবে ঐ কেন্দ্রের “দল” ২ পয়েন্ট পাবে এবং “প্রার্থী” ২ পয়েন্ট পাবে। ১ নং চিত্র অনুযায়ী, যদি ঐ কেন্দ্রে থেকে দল হিসাবে “ক” দল এবং প্রার্থী হিসাবে “খ” দলের প্রার্থী “শ্যাম” জেতে, তবে দল হিসাবে “ক” দল ২ পয়েন্ট পাবে এবং প্রার্থী হিসাবে “খ” দলের প্রার্থী “শ্যাম” ২ পয়েন্ট পাবে। এক্ষেত্রে যেহেতু, “ক” দল হিসাবে জিতেছে, প্রার্থী হিসাবে নয়, তাই “ক” দল শুধু ২ পয়েন্ট পাবে, কিন্তু ঐ কেন্দ্র থেকে “ক” দলের কোন প্রতিনিধি সংসদে বা বিধানসভায় পাঠাতে পারবে না। অর্থাৎ, ঐ কেন্দ্র থেকে “প্রার্থী” হিসাবে “খ” দলের প্রার্থী “শ্যাম” সংসদে বা বিধানসভায় যাবে এবং তার পয়েন্ট হবে ২। এরা হবেন “আংশিক সংসদ/বিধায়ক”। এদের ক্ষমতা বা সুযোগ-সুবিধে একজন “পূর্ণ সংসদ/বিধায়ক” মতোই হবে, শুধুমাত্র এদের ভোটিং ক্ষমতা ২ হবে। পরে এই বিষয়ে আরও বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।
(৩) কোন কেন্দ্র থেকে একটি দলের “প্রার্থী” জেতে, কিন্তু ঐ কেন্দ্র থেকে কোন দলের “দল” না জেতে, তবে ঐ বিজয়ী “প্রার্থী”, ঐ কেন্দ্রের প্রতিনিধি হিসাবে সংসদে বা বিধানসভায় যাবে। ১ নং চিত্র অনুযায়ী ঐ কেন্দ্রে থেকে যদি প্রার্থী হিসাবে “ক” দলের প্রার্থী “রাম” জেতে, কিন্তু ঐ কেন্দ্র থেকে দল হিসাবে “কোনো দলকেই নয়”-তে বেশী ভোট পড়ে, তাহলে ঐ কেন্দ্র থেকে কোন দল জিতবে না, তবে প্রার্থী হিসাবে “ক” দলের প্রার্থী “রাম” ২ পয়েন্ট পাবে। অর্থাৎ, ঐ কেন্দ্র থেকে প্রার্থী হিসাবে “ক” দলের প্রার্থী “রাম” ২ পয়েন্ট নিয়ে সংসদে বা বিধানসভায় গেলেও, দল হিসাবে কোন দলই কোন পয়েন্ট পাবে না। এইসব বিজয়ী প্রার্থীরা হবেন “আংশিক সংসদ/বিধায়ক”।
(৪) কোন কেন্দ্র থেকে একটি দলের “দল” জেতে, কিন্তু ঐ কেন্দ্র থেকে কোন দলের “প্রার্থী” না জেতে। ১ নং চিত্র অনুযায়ী ঐ কেন্দ্রে থেকে যদি দল হিসাবে “ক” দল জেতে, কিন্তু ঐ কেন্দ্র থেকে প্রার্থী হিসাবে “কোনো প্রার্থীকেই নয়”-তে বেশী ভোট পড়ে, তাহলে ঐ কেন্দ্র থেকে কোন প্রার্থী জিতবে না, তবে দল হিসাবে “ক” দলের পয়েন্ট ক্ষমতা হবে ২। তবে “ক” দল তাদের কোনো প্রার্থীকে সংসদে বা বিধানসভায় পাঠাতে পারবে না। এক্ষেত্রে “প্রার্থী”-এর কলমে দ্বিতীয় স্থান প্রাপ্ত প্রার্থী বিজয়ী ঘোষিত হবে, কিন্তু তার পয়েন্ট ক্ষমতা হবে ১। অর্থাৎ, ঐ কেন্দ্র থেকে “প্রার্থী”-এর কলমে দ্বিতীয় স্থান প্রাপ্ত প্রার্থী হিসাবে প্রতিনিধি সংসদে বা বিধানসভায় গেলেও, প্রার্থীর পয়েন্ট ক্ষমতা হবে ১। এরা হলেন “দ্বিতীয় শ্রেণীর সংসদ/বিধায়ক”, পরে এদের নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করছি।
(৫) কোন কেন্দ্র থেকে যদি কোন দলের “দল” এবং কোন দলের “প্রার্থী” না জেতে, অর্থাৎ ঐ কেন্দ্র থেকে দলের কলমে “কোনো দলকেই নয়” এবং প্রার্থী কলমে “কোনো প্রার্থীকেই নয়”-তে বেশী ভোট পড়ে, তবে ঐ কেন্দ্র “প্রার্থী”-এর কলমে দ্বিতীয় স্থান প্রাপ্ত প্রার্থী বিজয়ী ঘোষিত হবে, কিন্তু এক্ষেত্রেও তার পয়েন্ট ক্ষমতা হবে ১। অর্থাৎ, ঐ কেন্দ্র থেকে “প্রার্থী”-এর কলমে দ্বিতীয় স্থান প্রাপ্ত প্রার্থী, প্রতিনিধি হিসাবে সংসদে বা বিধানসভায় গেলেও, প্রার্থীর পয়েন্ট ক্ষমতা হবে ১। অর্থাৎ এরা হবেন “দ্বিতীয় শ্রেণীর সংসদ/বিধায়ক”। কিন্তু, দল হিসাবে কোন দলই কোন পয়েন্ট পাবে না।
(৪) এবং (৫) নম্বর ক্ষেত্রে যারা দ্বিতীয়স্থানে থেকে নির্বাচিত হবেন, এরা হলেন “দ্বিতীয় শ্রেণীর সংসদ/বিধায়ক”, তাই এইসব সংসদ/বিধায়কদের কোনো মন্ত্রী বা সরকারের কোনো গুরুত্বপূর্ণ কমিটিতে নিযুক্ত করা যাবেনা, এদের ভাতা বা বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা একজন “পূর্ণ বা আংশিক সংসদ/বিধায়ক”- এর থেকে অনেক কম হবে। এছাড়া ওই কেন্দ্রের যে সকল প্রার্থী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন, তাদেরকে পরবর্তী ১০ বছর কোনো প্রকার নির্বাচনে প্রতিন্দন্দ্বিতা করতে দেওয়া যাবে না, কারণ তারা প্রত্যেকেই জনগণ দ্বারা প্রত্যাক্ষিত হয়েছেন।
দল এবং প্রার্থী | আসন | পয়েন্ট | মোট পয়েন্ট |
“প্রার্থী” এবং “দল” উভয়ই জিতেছে (৫) | ৩০০ | ৫ | ১,৫০০ |
“প্রার্থী” জিতেছে, কিন্তু “দল” জেতেনি (২) | ৮০ | ২ | ১৬০ |
“প্রার্থী” জেতেনি, কিন্তু “দল” জিতেছে (২) | ১০০ | ২ | ২০০ |
প্রার্থী এবং দল কেউ জেতেনি (১) | ৬৩ | ১ | ৬৩ |
মোট | ৫৪৩ | ১,৯২৩ |
১ নং টেবিল: “দল” এবং “প্রার্থী”-এর পয়েন্ট বিভাজন
এবার উপরের ১নং টেবিলটি ভাল করে লক্ষ্য করুন। ধরুন, লোকসভার মোট ৫৪৩ টি আসনের মধ্যে ৩০০ টি আসনে “দল” এবং “প্রার্থী” উভয়ই জিতেছে। অর্থাৎ, ওই ৩০০ টি আসনের প্রার্থীদের মোট পয়েন্ট মূল্য হবে (৩০০ x ৫) = ১৫০০।
আবার, ৮০ টি আসনে শুধু “প্রার্থী” জিতেছে, কিন্তু “দল” জেতেনি। অর্থাৎ, এই ৮০ টি আসনে “কোনো দলকেই নয়”-তে বেশী ভোট পরেছে। ওই ৮০ টি আসনে প্রার্থীদের মোট পয়েন্ট মূল্য হবে (৮০ x ২) = ১৬০।
আবার ১০০ টি আসনে “দল” জিতেছে, কিন্তু কোনো “প্রার্থী” জেতেনি। অর্থাৎ, এই ১০০ টি আসনে “কোনো প্রার্থীকেই নয়”-তে বেশী ভোট পরেছে। ওই ১০০ টি আসনের বিভিন্ন দলের মোট পয়েন্ট মূল্য হবে (১০০ x ২) = ২০০।
বাকি ৬৩ টি আসনে “কোনো দলকেই নয়” এবং “কোনো প্রার্থীকেই নয়”-তে বেশী ভোট পড়েছে। অর্থাৎ, এই ৬৩ টি আসনে কোনো “দল” এবং “প্রার্থী” জেতেনি। ওই ৬৩ টি আসনে “দ্বিতীয় শ্রেণীর সংসদ/বিধায়ক” প্রার্থীদের মোট পয়েন্ট মূল্য হবে (৬৩ x ১) = ৬৩।
সুতরাং, কোন দলের সরকার গঠন করতে হলে দল ও প্রার্থী মিলিয়ে মোট পয়েন্ট লাগবে:- [(৩০০ x ৫) + (৮০ x ২) + (১০০ x ২) + ৬৩] / ২ = [১৫০০ + ১৬০ + ২০০ + ৬৩] / ২ = ১৯২৩ / ২ = ৯৬১.৫ টি বা ৯৬২ টি (মোট পয়েন্ট জোড় হলে অর্ধেকের থেকে ১ বেশী পয়েন্ট)। যে সকল কেন্দ্রে “দল” বা “প্রার্থী” কেউ জিতেনি, প্রয়োজনে নির্বাচনের পর ঐ সকল কেন্দ্রে কেন কোন “দল” বা “প্রার্থী” কেউ জিতেনি, তা খাতিয়ে দেখার জন্য একটি তদন্ত কমিটি গঠন করতে হবে। ঐ তদন্ত কমিটি সুপারিশ খাতিয়ে দেখে, প্রয়োজনে আবার ঐ সমস্ত কেন্দ্রে নির্বাচন করতে হবে।
এই ব্যবস্থার সুবিধা
এইবার এই ব্যবস্থার সুবিধাগুলি নিন্মে আলোচনা করা হল:
(১) আপনার প্রিয় দলের প্রার্থীকে যদি আপনার পছন্দ না হয়, শুধুমাএ আপনার প্রিয় দলকে ভোট দিয়ে জেতাতে পারেন। আবার অন্য কোন দলের প্রার্থীকে যোগ্য মনে হলে, আপনার প্রিয় দলের সাথে ওই যোগ্য প্রার্থীকেও একসাথে ভোট দেতে পারেন। অযোগ্য বা অসৎ প্রার্থীকে এইভাবে জেতা থেকে আপনি রুখতে পারেন, বর্তমান প্রক্রিয়ায় যা সম্ভব নয়।
(২) বর্তমান নির্বাচন প্রক্রিয়ায় অনেক প্রার্থী দলের নামে বা দলের নেতা-নেত্রীর নামে ভোট জেতে। এই ব্যবস্থায় প্রার্থীকে দলের নামে বা দলের নেতা-নেত্রীর নামে নয়, নিজের যোগ্যতায় নির্বাচিত হতে হবে। কারন, ঐ কেন্দ্রে তার দল জিতলেও, প্রার্থী নিজে নাও জিততে পারে। তাই সব দল যেমন প্রার্থী নির্বাচনে আরো বেশি সজাগ হবে, তেমনি আবার প্রার্থীরাও নিজেকে প্রমান করতে সদা প্রস্তুত থাকবে। অযোগ্য প্রার্থীর সংখ্যা অনেক কমে যাবে।
(৩) অনেক সময় দেখা যায়, কোন কেন্দ্রে ঐ দলের প্রার্থী কে হবে, তাই নিয়ে দলের মধ্যে বিবাদের সূচনা হয়। এর ফলে, অনেক সময় দলের ভাঙ্গন পর্যন্ত হয়ে যায়। এই ব্যবস্থায় যেহেতু দল ও প্রার্থী আলাদা, সেইহেতু একই দলের একাধিক প্রার্থী (২নং চিত্রটি লক্ষ্য করুন, “রাম” এবং “কমল” উভয়ই “ক” দলের প্রার্থী হিসাবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে) নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করিতে পারে। ফলে, অনেক দলের অনিবার্য ভাঙ্গন রোধ হবে। দলগুলি নিজেদের ভাঙ্গন রোধ করে আরো শক্তিশালী হবে। নির্দল বা গোঁজ প্রার্থীর সংখ্যা অনেক কমবে।
২ নং চিত্র: রাম ও কমল উভয়ই “ক” দলের প্রার্থী হিসাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে
(৪) সরকারে যেমন যোগ্য লোকের প্রয়োজন, ঠিক তেমনি বিরোধী দলেও যোগ্য লোকের দরকার, যারা সরকারকে তাদের ভুলগুলির প্রতি দৃষ্টিপাত করাতে পারবে। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আপনি একসঙ্গে আপনার প্রিয় দল এবং আপনার প্রিয় দলের প্রার্থীর চেয়ে অন্য কোন দলের সৎ বা যোগ্য প্রার্থীকে নির্বাচিত করতে পারেন। ফলে সরকার এবং বিরোধী সব দলেই অযোগ্য বা অসৎ প্রার্থীর সংখ্যা কমবে।
(৫) অনেক সময় দেখা যায়, কোন কেন্দ্রের কিছু এলাকার মানুষেরা বিভিন্ন কারনে বা দাবিতে ভোট বয়কট করেন। কিন্তু, বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, ঐ সকল ভোট বয়কটকারীরা উপেক্ষিত হয়ে থাকেন। কারন তাদের ছাড়াও ঐ কেন্দ্রে প্রার্থীদের জয়-পরাজয় নির্ধারন আটকায় না। এই ব্যবস্থা প্রবর্তিত হলে কোন দল বা প্রার্থী— ঐ এলাকার মানুষদের উপেক্ষা করতে পারবে না। কারন, ঐ সকল এলাকার মানুষেরা “দল”-এর কলমে যদি “কোনো দলকেই নয়” বা “প্রার্থী”-এর কলমে “কোনো প্রার্থীকেই নয়” ছাপ দেয়ে, তবে ঐ কেন্দ্র থেকে কোন দল বা প্রার্থীকে নির্বাচিত হওয়া থেকে রুখতে পারবে। সেইজন্য, সব দল বা প্রার্থীকেই— ঐ সকল ভোট বয়কটকারীর মতামতকে গুরুত্ব দেতে বাধ্য হবে। এরফলে, মানুষের ভোট দেওয়ার গণতান্ত্রিক অধিকার আরো বৃদ্ধি পাবে।
(৬) অনেক সময় দেখা যায়, কোন নির্বাচনী জোটের মধ্যে, কোনো কেন্দ্রে কোন দল নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে, তা নিয়ে বিবাদ দেখা দেয়। ধরুন, “খ” ও “গ” দল জোট বেঁধে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। কোন একটি কেন্দ্রে, কোন দল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে, তা নিয়ে “খ” ও “গ” দলের মধ্যে বিবাদের সূচনা হল। এই ব্যবস্থার ফলে একটি দলের প্রতীক নিয়ে, অন্য দলের প্রার্থী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারে। ৩নং চিত্রে দেখুন, “খ” দল হিসাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে, কিন্তু প্রার্থী হিসেবে রয়েছে “গ” দলের “যদু”। যদি ঐ কেন্দ্রে “খ” দল জেতে, তবে “খ” দলের ২ পয়েন্ট পাবে। আবার, প্রার্থী হিসাবে “যদু” জিতলে, “গ” দলের ২ পয়েন্ট পাবে। এইভাবে একটি কেন্দ্র থেকে দুটি দল জোট বেঁধে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারে, যাতে দুইটি দলেরই পয়েন্ট থাকবে।
৩ নং চিত্র: “খ” দল হিসাবে, কিন্তু প্রার্থী হিসেবে রয়েছে “গ” দলের “যদু”
(৭) বর্তমানে অনেক সময় দেখা যাচ্ছে, ভোট জেতার পরে, প্রার্থী বড় দলে বা সরকার পক্ষের দলে যোগ দিচ্ছে, কিন্তু তারা সরাসরি পূর্বের দল ত্যাগ করছেন না, বা সংসদ/বিধায়ক পদে পদত্যাগ করছেন না। ফলে তারা দলত্যাগী আইন আওতায় পড়ছেন না, দলের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতক করেও দিব্বি সংসদ/বিধায়ক পদে থেকে যাচ্ছেন। আবার ভোটার পরে কোনো দল সংখ্যাগরিষ্ট না হলে, সংসদ/বিধায়ক কেনাবেচা শুরু হয়ে যায়। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসের অনেক নেতাই এখন সরাসরি তৃণমূলে কংগ্রেসে যোগদান করেনি, খাতায়কলমে তারা এখন কংগ্রেসের বিধায়ক, কিন্তু লোকাল এরিয়ায় তারা তৃণমূল কংগ্রেস করছে, তৃণমূল কংগ্রেসের মিটিং মিছিলে যোগদান করছে। কিন্তু যেহেতু তারা কংগ্রেসের বিধায়ক পদ থেকে ইস্তফা দেয়নি বা বিধানসভায় এখনো কংগ্রেস ছাড়ার বিষয়ে অস্বীকার করছে, তাই কংগ্রেস দল তাদের বিরুদ্ধে কোনো রকম ব্যবস্থা নিতে পারছে না। এই নতুন সিস্টেম চালু হলে, দল চাইলে যে কোনো সময় ওইসব বিধায়ক বা সংসদকে দল থেকে বহিস্কার করতে পারে। দল যদি সংসদ/বিধায়কে দল থেকে নির্বাসিত করে তবে ওই সংসদ/বিধায়ক দ্বিতীয় শ্রেণীর সংসদ/বিধায়ক-এ পরিণত হবে। অর্থাৎ, ওই প্রার্থীর পয়েন্ট ক্ষমতা ১ হয়ে যাবে। এরফলে সংসদ/বিধায়কেরা এবার থেকে দল বিরোধী কাজ করা থেকে বিরত হবে। ভোটার পরে সংসদ/বিধায়ক কেনাবেচা অনেক কমে যাবে।
(৮) ভোটের পরে কোনো দল সংখ্যাগরিষ্ট না পেলে, বিজয়ী নির্দল প্রার্থীদের দর অনেক বেড়ে যায়, বেশিরভাগ সময় মোটা অর্থ বা অনৈতিক প্রলোভনের বিনিময়ে এরা কোনো দলকে সর্মথন করে। যা কখনই আদর্শ হতে পারে না। এই নতুন ব্যবস্থায় যেহেতু দল এবং প্রার্থী আলাদা, তাই নির্দল প্রার্থীরা শুধুমাত্র প্রার্থী পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবে এবং জিতলে ২ পয়েন্ট পাবে, তাই নির্দল প্রার্থীদের ভূমিকা অনেকটা হ্রাস পাবে, যেটা গণতন্ত্রে পক্ষে শুভলক্ষন। এছাড়া এই ব্যবস্থা প্রবর্তন হলে, নির্দল প্রার্থীদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সংখ্যা অনেক হ্রাস পাবে।
এই ব্যবস্থার অসুবিধা
এইবার এই ব্যবস্থার অসুবিধাগুলি নিন্মে আলোচনা করা হল:
(১) দেশের সরকার সঠিক ভাবে চালানোর জন্য যেমন যোগ্য ও যর্থেষ্ট পরিমানে প্রার্থী প্রয়োজন, ঠিক তেমনি বিরোধী দলেও যোগ্য প্রার্থীর প্রয়োজন, যারা সরকারকে তাদের ভুলত্রূটিগুলির প্রতি দৃষ্টিপাত করাতে পারবে। যদি এই ব্যবস্থায় দেশের অধিকাংশ মানুষ দলের কলমে “কোনো দলকেই নয়” এবং প্রার্থী কলমে “কোনো প্রার্থীকেই নয়” বেছে নেয়, এবং তার ফলে দেশের অধিকাংশ কেন্দ্র থেকে দল বা প্রার্থীরা নির্বাচিত হবে না, এরফলে দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা গুরুত্ব হারাবে। সেক্ষেত্রে, দ্বিতীয় শ্রেণীর সংসদ/বিধায়কের সংখ্যা বেড়ে যাবে, যা কখনই কাম্য নয়।
(২) এই “উন্নততর গণতান্ত্রিক” ব্যবস্থার ফলে একই পয়েন্ট পেয়ে সংসদে/বিধানসভায় দুটি দলের প্রতিনিধি সংখ্যা ভিন্ন হতে পারে। মনে করুন, সংসদে বা বিধানসভায় “ক” দলের ৫ জন পূর্ণ সংসদ/বিধায়ক এবং ৫ জন “আংশিক সংসদ/বিধায়ক” আছে, সুতরাং “ক” দলের মোট পয়েন্ট হবে :- (৫ x ৫) + (৫ x ২) = ২৫ + ১০ = ৩৫ পয়েন্ট। আবার, “খ” দলের ৩ জন “পূর্ণ সংসদ/বিধায়ক” এবং ১০ জন “আংশিক সংসদ/বিধায়ক” আছে, সুতরাং “খ” দলের মোট পয়েন্ট হবে :- (৩ x ৫) + (১০ x ২) = ১৫ + ২০ = ৩৫ পয়েন্ট। অতএব, এখানে দেখা যাচ্ছে, “ক” দলের পয়েন্ট (৩৫) এবং “খ” দলের পয়েন্ট (৩৫) সমান হলেও, যেখানে “ক”-দলের সংসদে প্রতিনিধি সংখ্যা (৫ + ৫) = ১০ জন, সেখানে কিন্তু “খ”-দলের প্রতিনিধি সংখ্যা (৩ + ১০ ) = ১৩ জন। তাই এইরূপ অবস্থা যাতে সৃষ্টি না হয়, সেইজন্য প্রতিটি দলের নেতৃত্ব বা হাইকমান্ড উপযুক্ত “প্রার্থী” নির্বাচনে আরো অনেক বেশী যত্নবান হবেন। এর ফলস্বরূপ, বিভিন্ন দলের পক্ষ থেকে অপরাধী বা দাগী প্রার্থীদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করার সংখ্যা হ্রাস পাবে। দেশের সাধারন মানুষ আরো বেশী পরিমানে ভালো ও উপযুক্ত প্রার্থীদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করতে দেখতে পাবে।
(৩) মনে করুন, কোনো দল ২টি আসনে “দল” হিসাবে জয়লাভ করেছে, কিন্তু প্রার্থী পদে কেউ জয়লাভ করেনি, তাই ওই দলের পয়েন্ট হবে ২ x ২ = 8, কিন্তু সংসদে বা বিধানসভায় ওই দলের কোনো সংসদ/বিধায়ক থাকবে না। তাই দুটি আসনে “দল” হিসাবে জয়লাভ করা স্বত্বেও, সংসদে বা বিধানসভায় তাদের দল কোনো বক্তব্য তুলে ধরতে পারবে না। সংসদে বা বিধানসভায় কোনো কারনে ভোটাভোটি হলে, ঐ দলের কোনো একজন প্রতিনিধি শুধুমাত্র ৪ ভোট দেবার অধিকারী হবেন। তবে এর ফলে দলগুলি প্রার্থীদের নির্বাচনে আরো বেশি দায়িত্বশীল হবেন। এইক্ষেত্রে, কোনো দলের “দল” হিসাবে ১০ পয়েন্ট বা তার বেশি পেলে এবং ঐ দলের কোনো প্রতিনিধি সংসদ/বিধানসভায় না থাকলে, ঐ দলের নির্বাচিত কোনো প্রার্থীকে সংসদ/বিধায়ক করা যাতে পারে। এতে ঐ দলের বক্তব্য তারা সংসদ/বিধানসভায় তুলে ধরতে পারবে। কিন্তু ঐ দলের নির্বাচিত প্রার্থীর সুযোগ-সুবিধা হবে “দ্বিতীয় শ্রেণীর সংসদ/বিধায়ক” মতন।
কোন আসনে পুনর্নির্বাচন হলে কি হবে
কোনও কারনে, যেমন ঐ কেন্দ্রের বিজয়ী প্রার্থী মারা গেলে বা বিজয়ী প্রার্থী পদত্যাগ করলে , অথবা অন্য কোন কারনে ঐ আসনে পুনর্নির্বাচন হলে কি হবে? যদি ঐ আসনে দল হিসাবে কোন দল জিতে থাকে, তবে ঐ আসনে শুধুমাত্র প্রার্থীপদে নির্বাচন হবে, “দল”-এর কোন নির্বাচন হবেনা। আবার, পূর্ববর্তী নির্বাচনে যদি “কোনো দলকেই নয়”-তে বেশি ভোট পরে বা কোন দলই না জিতে থাকে, তবে ঐ কেন্দ্রে “প্রার্থী” এবং “দল” দুটি ক্ষেত্রেই ভোট হবে।
(১) যদি “প্রার্থী” এবং “দল” দুটি ক্ষেত্রেই ভোট হয়, তবে উপরে বর্ণিত পদ্ধর্তি অনুসরণ করা হবে:
(ক) একই দলের “প্রার্থী” এবং “দল” জয়লাভ করলে, ঐ প্রার্থী “পূর্ণ্য সংসদ/বিধায়ক” হিসাবে ৫ পয়েন্ট নিয়ে সংসদে বা বিধানসভায় যাবে।
(খ) একটি দলের “দল” ও অন্য দলের “প্রার্থী” জেতে, তবে ঐ কেন্দ্রের “দল” ২ পয়েন্ট পাবে এবং “প্রার্থী” ২ পয়েন্ট নিয়ে “আংশিক সংসদ/বিধায়ক” হিসাবে সংসদে বা বিধানসভায় যাবে।
(গ) যদি কোন “প্রার্থী” জেতে, কিন্তু ঐ কেন্দ্র থেকে কোন দলের “দল” না জেতে, তবে ঐ প্রার্থী “আংশিক সংসদ/বিধায়ক” হিসাবে ২ পয়েন্ট নিয়ে সংসদে বা বিধানসভায় যাবে।
(ঘ) ঐ কেন্দ্র থেকে একটি দলের “দল” জেতে, কিন্তু ঐ কেন্দ্র থেকে কোন দলের “প্রার্থী” না জেতে, তবে “প্রার্থী”-এর কলমে দ্বিতীয় স্থান প্রাপ্ত প্রার্থী বিজয়ী ঘোষিত হবে, ১ পয়েন্ট নিয়ে “দ্বিতীয় শ্রেণীর সংসদ/বিধায়ক” হিসাবে সংসদে বা বিধানসভায় যাবে, আর বিজয়ী দল ২ পয়েন্ট পাবে।
(ঙ) যদি ঐ কেন্দ্র থেকে কোন “দল” এবং “প্রার্থী” না জেতে, তবে দ্বিতীয় স্থান প্রাপ্ত প্রার্থী ১ পয়েন্ট নিয়ে “দ্বিতীয় শ্রেণীর সংসদ/বিধায়ক” হিসাবে সংসদে বা বিধানসভায় যাবে।
(২) যদি শুধুমাত্র “প্রার্থী” নির্বাচন হয়, “দল” নির্বাচন না হয়, তবে:
(ক) যদি ঐ কেন্দ্রের পূর্ববর্তী জয়ী দলের প্রার্থী নির্বাচনে জয়লাভ করে, তবে ঐ প্রার্থী “পূর্ণ্য সংসদ/বিধায়ক” হিসাবে ৫ পয়েন্ট নিয়ে সংসদে বা বিধানসভায় যাবে।
(খ) যদি পূর্ববর্তী জয়ী দলের পরিবর্তে, অন্য কোন দলের “প্রার্থী” নির্বাচনে জয়লাভ করে, তবে ঐ কেন্দ্রের নতুন বিজয়ী “প্রার্থী” ২ পয়েন্ট নিয়ে “আংশিক সংসদ/বিধায়ক” হিসাবে সংসদে বা বিধানসভায় যাবে।
(গ) যদি ঐ কেন্দ্র থেকে কোন “প্রার্থী” না জেতে, তবে দ্বিতীয় স্থান প্রাপ্ত প্রার্থী ১ পয়েন্ট নিয়ে “দ্বিতীয় শ্রেণীর সংসদ/বিধায়ক” হিসাবে সংসদে বা বিধানসভায় যাবে।
কিছু কিছু অসুবিধা বা ত্রূটি থাকা স্বতেও, বর্তমান গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা থেকে “উন্নততর গণতান্ত্রিক” ব্যবস্থা যে আরো অনেক বেশী শক্তিশালী ও “উন্নততর গণতান্ত্রিক” সমাজ ব্যবস্থা, তা উপরোক্ত আলোচনা থেকে নিশ্চয় বুঝতে পারছেন। এই “উন্নততর গণতান্ত্রিক” ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রতিটি মানুষের ভোটের সঠিক মূল্যায়ন করা সম্ভব। কিন্তু, যারা এতদিন দলের নাম ভাঙ্গিয়ে ভোটে জিতে আসছেন, তারা কি কখনও এই ব্যবস্থাকে সমর্থন করবেন? আপনাদের কি মত!