আকাশ খুঁজতে বেরোলাম অবশেষে। আড্ডা মারার লোক পাই না, বলিরেখা ধরেছে বাগানের সবুজে। কড়িকাঠে আর বইয়ের তাকে একঘেয়েমির চাদর। নদী আর সমুদ্র বড় ব্যস্ত,ছুটিছাটা ছাড়া দেখা হওয়ার কথা নয়। শহর বলে যে জিনিসটা দেখা যায়, সে আসলে নিরুত্তাপ এক গোবেচারা ভদ্রলোক, যার ছন্দবিহীন মনে কবিতা ঢেউ তোলে না। সে যেন নিজেকেই ভুলতে বসেছে হিসেবের আস্থায়। মন কেমন কি, তা সে জানবে কি করে?
হাঁটলাম। জিরোলাম। ভিজলাম। আবার হাঁটলাম। আকাশের খোঁজ পাওয়া যাবে একদিন। সেই আকাশ, যার কথা পড়েছিলাম ছেলেবেলার বইয়ে। যার রং পুরনো হয় না কোনদিন। প্রতিদিন যে দেখা দেয় নতূন হয়, যার সোনালী মলাটে মোড়া দিগন্তে রাখা থাকে রূপকথার স্পর্শ আর মনখারাপের গান। বৃষ্টিস্নাত ঠোঁট যদি নাও বলে, বোঝা যায় সে ভাষা চোখের দৃষ্টিতে।
বন ফুরালো। বসন্ত এলো। অস্পষ্ট এক পার্থিব বাষ্প যেন পুনর্মিলিত হয় রাতের অন্ধকারে আমার অন্তরে। বুঝি, আমারই দীর্ঘশ্বাস! আকাশ আজও আমায় দেখা দিল না। গাছ দেখি, নিষ্প্রাণ। নদী দেখি, ভাসমান। স্রোত দেখি, চঞ্চল। পাখি দেখি, অবিচল। আকাশ দেখতে পাই না, এ কোন নির্বাসন?
সামনে কে?
“কে তুমি? কোথায় যাচ্ছ, আনমনে ?”
“মানুষ আমি। যাচ্ছি আকাশের সন্ধানে ”
“কি বললে? আকাশের খোঁজ! কেউ কি জানে?”
“তবে কোথায় যাব, দেখা কি পাব না!…হয় না বিশ্বাস?”
“অবিশ্বাসের কথাই বটে! তা খুঁজে পেলে আকাশ?”
“না। এখনো খুঁজে পাইনি। এই নিয়ে তিনখানা উপন্যাস”
“তোমার দুচোখে শুধু মনের ঠিকানা, পাবে না দেখা এ কথাও জানা”
“কেন বলছ এ কথা? তুমি কি পেয়েছ দেখা?”
“দেখেছি বহুবার। রোজ দেখেছি আগে। তোমার পথ চেয়ে বসে থাকে, অনুরাগে”
“এ কি বলছ? আমার জন্যে? সে ভেবে যায় অবিশ্রান্ত?”
“তোমার বারান্দার, ঘরের পাশেই অপেক্ষারত, আজ সে ক্লান্ত”
“আমার ঘরে? কিন্তু দেখিনি তাকে? আমি কি অন্ধ?”
“ছিলে কাছেই, কিন্তু দেখনি। তাকাতে, অথচ চোখ ছিল বন্ধ”
ঘুম ভেঙ্গে যায়। আমার ঘরের সামনের ঝুল বারান্দা। আকাশ উঁকি মারে দুলে ওঠা কিছু উড়ালি ফুলের ফাঁক দিয়ে। স্নিগ্ধ আলোর রেখা তখন আমার গাল বেয়ে পিছলে পড়ে রোজকার মতই, যেন কৈশোরের প্রথম হাসি। কোমল চোখে তাকাই বাইরের দিকে। আজকাল আমি দেখতে পাই। সূর্য তখন চেয়ে থাকে বিহ্বল চোখে, দৃষ্টি খুঁজে পাই। আকাশ, তোমায় খুঁজে পেয়েছি অবশেষে। চিরনতূন। আকাশ পুরনো হয় না। আমি দেখতে পাই। সকলেই কি দেখতে পায়?