অপুদা, আজ তোমায় বিদায় জানাব না

তোমার স্মৃতির উদ্দেশ্যে কোন ভাষ্যপাঠও করব না।

তোমার সাথে, হাতে হাত ধরে, আমিও যে বড় হয়ে উঠেছি ,

আজ শুধু সেই কথাটাই আবার বলব।

ছেঁড়া কাঁথার ফাঁক দিয়ে, প্রথম যেদিন তোমায় দেখি, সেদিন আমিও নেহাত শিশু,

তাই জীবনের পথের পাঁচালি, তখনো বুঝিনি

তবু তোমার সেই কাশ বনে দৌড়নো, আজও ভুলতে পারিনি ,

ভুলিনি তোমার পালা দেখে রাজপুত্তুর সাজা ,

দুর্গাদি কি রাগটাই না করেছিল সেদিন !

আমিও কিন্তু তোমার মতোই, গোঁফ লাগিয়ে রাজা সাজা ভালো বাসতাম

আর সর্ষের তেল দিয়ে তেঁতুল মাখাউঃফ, এখনো জীভে জল ভেসে আসে।

তোমার যেমন পিসি ছিলেন, আমার ছিল ঠামি ,

আমিও ঠামির কাছে, রাক্ষস খোক্কশ, দত্যি দানোর গল্প শুনে ,

স্বপ্নের রাজ্যে অনেক ঘুরেছি।

তোমার পিসির মতোই, আমার ঠামিও আমায় ছেড়ে চলে গেছেন,

সেই সময়ে আমি তার কাছেও থাকতে পারিনি।

একে একে অনেকের চলে যাওয়ার মধ্যে দিয়েই

তুমি আমি , দুজনেই বড় হয়ে গেলাম কি করে বলতো ?

দুর্গাদির চলে যাওয়াটা কিন্তু, আমি আজও মানতে পারিনি। 

আস্তে আস্তে, কাশীর ঘাটের ৬৪ ধাপ সিড়ি,

কৈশোর থেকে যৌবনের ধাপগুলোর মধ্যে সামঞ্জস্য টেনে আনল।

তারপর যখন আবার এলে কলকাতায়, কলেজে পড়তে,

একবার ভেবেছিলাম, তোমার সাথে দেখা করলে হত। 

সে সৌভাগ্য আর হয়নি।

তারপরেই হঠাত যখন দেখি, তোমার মা, তোমারই পথ চেয়ে,

অপেক্ষায় আপ্লুত হয়ে, আস্তে আস্তে অনেক দূরে চলে যাচ্ছেন,

তখন কিন্তু আমার মনটাও, ভেঙেগিয়েছিল।

ভাঙবে না? আমিও যে মাকে ছেড়ে অনেকদূরে পড়তে গিয়েছিলাম।

তবুও কত শক্ত তুমি। তোমায় দেখেই তো শিখলাম,

বাস্তবতা আর মানবিকতাকে একসাথে বেধে ফেলা যায়।

আচ্ছা তোমার ওই রেল লাইনের ধারের বাড়ীটার কথা মনে পরে ?

সেই ছাদের ঘর ? ওরকম একটা ঘরে না থাকলে,

বোধহয় তোমার আর সেই আশ্চর্য উপন্যাসটা লেখাই হত না।   

সন্ধ্যেবেলার অন্ধকারে, বাঁশি বাজানোর যে তৃপ্তি,

সেটা কি আজ আর কেউ বুঝবে ?

সত্যি করে একটা কথা বল তো,

পুলুদা যখন তোমায় জোর করে, তার গ্রামের বাড়ীতে নিয়ে গেল,

তখন কি একবারও তোমার মনে কোন আশঙ্কা জেগেছিল,

যে জীবনটা এবার ধারা পালটাতে চলেছে?

অপর্ণাদিকে কিন্তু তোমার সাথে দারুণ মানিয়েছিল,

সত্যি, ও না থাকলে, তোমার জীবনটা হয়ত, ছন্দ হারিয়ে ফেলত।

কিন্তু সেও যে, তোমার থেকে দূরে চলে যাবে ,

তা আর তুমি জানবে কি করে বল ?

সেদিন তোমায় প্রথম রাগতে দেখলাম, তোমার দুঃখ দেখলাম,

আর দেখলাম, প্রাপ্ত বয়স্ক অপুও কাঁদতে পারে।

তখন ঠিক তোমার কার উপর রাগ হয়েছিল, গো ? কাজলের উপর ?

নাকি নিজের উপর ?  নাকি, সেই সমস্ত লোকগুলোর উপর,

যারা একে একে, নিজেদের ইচ্ছে মতো তোমায় ছেড়ে দূরে চলে গেছে ?

কিন্তু তবুও তুমি শক্ত রয়ে গেলে,

বাস্তবতা তোমার মানবিকতাকে আরো শক্ত করেছিল যে।

তোমার থেকেই তো শক্ত হওয়া শিখলাম।

অনেক অভিমান ভেঙেও যখন,

তুমি আবার কাজলের কাছে ফিরলে,

তখনই তো তুমি  প্রমাণ করলে,

অপূর্ব কুমার রায়, কোন কাপুরুষ নয়,

তার কাঁধে, কাজলকে বইবার শক্তি আছে।

পৃথিবীর সব লাঞ্ছিত অপুদের তুমি দেখালে,

তাদের কাজলকে, তাদের অভিমানকে,

তাদের দুঃখকে, তাদের অনিশ্চয়তাকে,

তারা সবাই, তোমারই মতো হাসি মুখে,

কাঁধে করে চলতে পারে, ভবিষ্যতেরদিকে।

তাই, আজ যখন, আমাদের ছেড়ে তুমি, অনেক দূরে চলে যাচ্ছ,

তখন আর তোমায় বাধা দেব না, পিছু ডাকব না,

তোমার সেই আশ্চর্য উপন্যাসটার মধ্যে দিয়েই,

তোমায় মনে রাখব ।

Print Friendly, PDF & Email
Previous articleHAPPY NEW YEAR
Next articleON STARRY NIGHT
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments