ফ্যাক্টরির কাজে ব্যস্ত থাকায় কদিন মৌরিনের সঙ্গে দেখা হয় নি। মৌরিনকে আমার পছন্দ, বাকি জীবনটা ওর সঙ্গেই কাটাতে চাই, কিন্তু ওর বাবার কথা ভাবলেই গুটিয়ে যাই।  মনে শত চিন্তা আসে, ভাবি অচেনা দেশে অজানা বিপদে জড়িয়ে পড়ছি না তো? ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না কি করা উচিত।

সেদিন কাজ থেকে ক্লান্ত শরীরে ফিরে কোন রকমে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছি। গভীর রাতে দরজায় মৃদু ঠক ঠক করাঘাত। প্রথমে ভাবলাম স্বপ্ন,  একটু পরে আবার ঠক ঠক আওয়াজ ।  এতো রাতে কার দরকার পড়ল আমাকে? বিরক্ত হয়ে দরজা খুলে চমকে গেলাম। বাইরে অন্ধকারে কালো চাদর আবৃত মুখ ঢাকা দুটো ছায়া মূর্ত্তি। দুজনে আমাকে ঠেলে হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। আমার হাত পা কেঁপে উঠল, না জানি কোন বিপদ এলো গভীর রাতে? চেনা নারী কণ্ঠে চাপাস্বরে একজন বললো আলোটা নিভিয়ে দাও। বলতে যাচ্ছিলাম, কেন? তার আগেই সে মুখের ওপর থেকে কালো চাদর সরাতেই চমকে উঠলাম এযে মৌরিন সাথে তার বাবা, সলমন। দুজনের তর্জনী ঠোঁটের ওপর, আওয়াজ যাতে না করি।  আলো নিভিয়ে ফিসফিস করে বললাম, এতো রাতে হটাৎ এভাবে ? ব্যাপার কি?

বাইবেল চুরি হয়ে গেছে, ঘোর বিপদ আমাদের এখন থেকে পালতে হবে এই রাতেই, মৌরিন বললো।

বাইবেল চুরির সাথে আমার কিসের বিপদ?

সে বিরাট গল্প, যেতে যেতে বলব, সলমন বলে।

আমার মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে শুধু বললাম, যাবোটা কোথায়? সেখানে করবো কি? অনেক কষ্টার্জিত চাকরি এমনি ছেড়ে চলে যেতে পারি না।

সলমন বলে, কঙ্গো থেকে পালিয়ে আথি নদীর তীরে এই ছোট্ট কারখানা শহরকে বেছে নি যাতে বাইরের লোকের নজর এড়িয়ে থাকতে পারি। এখানে বসবাস কালিন জর্জের সঙ্গে আলাপ হয় প্রায়ই যেতাম ওর বাড়িতে । জর্জ বৃদ্ধ বাতের ব্যাথায় বিশেষ নড়াচড়া করতে পারে না, একা থাকে, ওর বাড়ি আর বাগান পরিষ্কার করে দিতাম, কিছু দরকার থাকলে শহর থেকে এনে দিতাম। মৌরিনও মাঝে মধ্যে গিয়ে ওর খবর নিত, রান্না করে দিয়ে আসত। ওর সঙ্গে আমার সম্পর্ক খানিক বন্ধুত্ব আর খানিক নিজের গুপ্ত স্বার্থ, যার ব্যাপারে জর্জ কিছুই জানতো না।

দুদিন আগে মৌরিনকে নিয়ে গেছিলাম শহরে টাকা জোগাড়ে , ফিরে দেখি আমার বাড়ির তালা ভাঙা,  ভিতরে সব তছনছ , বাইবেল হাপিস। ছুট্টে গেলাম জর্জের বাড়ি, যা দেখলাম কান্নায় বুক ফেটে যাবার জোগাড়। বেচারাকে অনেক যন্ত্রনা ভোগ করতে হয়েছে মৃত্যু পর্যন্ত, শুধু সে আমার বন্ধু বলে।  জর্জ আমার অতীত জীবন সম্পর্কে কিছুই জানতো না ওকে জেরা করে যখন কিছুই জানতে পারে নি, মেরে ফেলেছে। সারাদিন আমরা গ্রামের বাইরে পাহাড়ের জঙ্গলে লুকিয়ে ছিলাম, রাত্রি নিশুতি হবার পরে তোমার কাছে এসেছি।  তুমি আমাদের বাড়িতে যেতে একথা যদি ওরা জেনে থাকে তাহলে তোমারও  বিপদ আসন্ন, যদিও তুমি কিছুই জান না, তাই বলছি বেশি সময় নেই, আমাদের এখনই বেরোতে হবে।

ভাবলাম, হে ভগবান! কোন সঙ্কটে ফেললে? গড়েছো এমন ভীতু করে যে জন্মস্থান ছেড়ে নড়তেই পারি না। যাওবা বিদেশে করে খাচ্ছিলাম কোথাকার উটকো ঝামেলায় জড়িয়ে দিলে। প্রাণের ভয় বড় ভয়, মরতে কেন যে মৌরিনকে চিনেছিলাম। মুখে শুধু বললাম, জিনিস পত্র নিয়ে যাবো কি করে?

যেটুকু না হলেই নয় সেটুকু মাত্র, হাঁটতে হবে সারা রাত পাহাড় জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে বাস রাস্তা পর্যন্ত, ভোরের প্রথম বাস ধরতে হবে।

বাস তো সকালে এখন থেকেই পেতে পারি?

সলোমন চাপা ধমকে বলে, তুমি কি শত্রূকে জানিয়ে পালাতে চাও? আমরা মাঠের ওপারে বড় গাছটার পেছনে অপেক্ষা করছি, তাড়াতাড়ি। অস্ত্র থাকলে সঙ্গে নিও।

আমার হাত পা কাঁপছে, হৃৎপিণ্ড মনে হয় গলায় উঠে এসেছে, মুখ দিয়ে বেরিয়ে পড়লো বলে।  এখানে থাকলে শত্রূর হাতে মরব, পালতে গিয়ে জংলী জানোয়ারের হাতে । সলোমন যে  হাঁটা রাস্তার কথা বললো তা গেছে সাভো অরণ্যের মধ্যে দিয়ে। হাতি, চিতা, সিংহ, গন্ডার বুনো মোষ সবাই আছেন একজন দয়া করে দেখা দিলে ওখানেই সব শেষ।  যতগুলো দেবদেবীর নাম জানতাম সকলকে মনে মনে ১০০ বার স্মরণ করে, যা থাকে কপালে, এডভেঞ্চার করেই মরব।  ঝোলা, টাকাপয়সা আর একফুটের ছুরিটা সঙ্গে করে পথে নামলাম ।

চলবে ……..

Print Friendly, PDF & Email
Previous articleGHATSILA — A WONDERFUL WEEKEND RETREAT
Next articleপাঁচশো টাকা
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments