আমেরিকার শরৎ :

“শরতে আজ মেতেছে ভুবন মিষ্টি রঙের খেলায় 

সূর্যের তীর্যক ছটা পড়েছে গাছের পাতায়। 

দূরে ঐ নীল আকাশে রামধনু উঠেছে দিগন্তে

সবুজের শোভায় মন হারিয়েছে সুদূর প্রান্তে।”

আমেরিকায় আছি বেশ কয়েক বছর হয়ে গেল। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটা শরৎ এখানে কেটেছে। দেশে ছয় ঋতুর বৈচিত্র আমরা দেখতে পাই কিন্তু আমেরিকায় গ্রীষ্ম শীত শরৎ এবং বসন্ত এই চারটি ঋতুই দেখা যায়। আমেরিকায় শরৎকালকে বলা হয় ফল সেশন। আনুষ্ঠানিকভাবে আমেরিকাতে ফল সেশন শুরু হয় সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সোমবার থেকে। ফল সেশনে দেখা যায় গাছের পাতার রং বদলাতে। এইজন্য আমেরিকাতে এরা এই সময়কে ফল কালার্স বলে। ফল কালার্স এর পূর্ণবিকাশ দেখা যায় অক্টোবর মাসে যদিও ফল সেশন শুরু হয়ে যায় সেপ্টেম্বর মাস থেকেই। শরৎ মানেই গাছের পাতা ঝোড়ে পড়ার পালা। দেশে থাকাকালীন দেখেছি শরৎ মানেই নীল আকাশের বুকে সাদা মেঘের ভেসে বেড়ানো, শরৎ মানেই দেবীর আগমন। চারদিকে কাশফুলের মেলা। সব মিলিয়ে শরৎকাল সবার খুবই প্রিয়। এক-এক ঋতুতে ভিন্ন ভিন্ন ফুলে ও ফলে , ফসলে ও সৌন্দর্যে সেজে ওঠে প্রকৃতি। আমেরিকায় এসময় হালকা শীতের আমেজ এবং কিছুটা গ্রীষ্মের উষ্ণতার মাঝে আমরা শরৎকে আহ্বান জানাই। আমেরিকার বেশ কয়েকটা রাজ্যে ফল কালার্স দেখার অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি ইতিমধ্যে। বিশেষ করে আমেরিকার উত্তরের রাজ্যগুলোতে দেখা যায় গাছের পাতা কমলা লাল হলুদ সবুজ সব মিলিয়ে বিচিত্র রঙে সেজে উঠেছে। ঘরের জানলা খুললেই দেখা যায় প্রকৃতির এই অপরূপ রূপ। এই সময় অনেকেই বনভোজনে যায় কিংবা ভ্রমণেও যায় অনেকে। বিশেষ করে পাহাড়ি অঞ্চল গুলোয় পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে রংবেরঙের গাছের পাতা দেখার মজাই আলাদা। আমেরিকায় শরৎকালের যেটা বিশেষ আকর্ষণ সেটা হল এখানকার ম্যাপেল গাছ। ম্যাপেল গাছের পাতার রং হলুদ কমলা লাল হয়ে চারিদিক ভরে যায়। কিছু পাতা আবার ঝোড়ে পড়তেও দেখা যায়। সব মিলিয়ে প্রকৃতিকে মনে হয় যেন বিধাতা নিজের হাতে তুলি দিয়ে এঁকে রেখেছেন। মিশিগানের ফল কালার্স দেখতে গিয়েছিলাম আমরা। মিশিগানের রাস্তায় গাড়ি নিয়ে গেলে দেখা যায় রাস্তার দুই ধারে সারি সারি গাছ সব রঙের খেলায় মেতে উঠেছে। ঠিক যেমন শান্তিনিকেতনে বসন্তকালে পলাশ ফুলের রঙে ছেয়ে যায় চারিদিক ঠিক সেইরকম এখানেও শরতে গাছের পাতায় আবির ঢেলে রেখে দিয়েছে প্রকৃতি। বিশেষ করে কোন লেক বা নদীর ধারে গেলে দেখা যায় গাছের রঙিন পাতার ছায়া পড়ছে জলের উপর, সেই অপূর্ব দৃশ্য না দেখলে সত্যিই বোঝানো যায় না। ম্যাপেল গাছের পাতা নিয়ে প্রবাসীরা একটু বেশি ইমোশনাল। কারণ এই ম্যাপেল গাছের পাতা সাধারণত বলিউড কিংবা হলিউড সিনেমায় দেখতে পাওয়া যায়। তাই প্রবাসীরা ম্যাপেল গাছের পাতা দেখলেই ক্যামেরা নিয়ে ছবি তুলতে শুরু করে। বিদেশীরা যেহেতু জন্ম থেকেই এই ফল কালার্স দেখতে অভ্যস্ত সেজন্য তাদের মধ্যে খুব একটা মাতামাতি দেখা যায় না। তারপরও বেশকিছু বিদেশি আছে যারা প্রকৃতিকে ভালোবাসে । এখনো ফল কালার্স এলে ভ্রমণে বেরিয়ে পড়ে তারা। আমরাও তাদের মধ্যে ব্যতিক্রম নই। আমরা যেমন ভ্রমণে যেতে ভালোবাসি আবার প্রকৃতিকে উপভোগ করতেও পছন্দ করি। 

     আমেরিকায় ফল কালার্স দেখার জন্য বিখ্যাত জায়গা হল ভার্মন্ট রাজ্য । একবার সবাই মিলে প্ল্যান করলাম ভার্মন্ট ঘুরতে যাব। কারন আমেরিকায় এসেছি আর ভারমন্ট এর ফল কালার্স দেখবো না সেটা তো হতে পারে না। আবার ভাগ্যক্রমে কর্মসূত্রে সেই সময় ছিলাম বস্টনে। বস্টন থেকে ভার্মন্ট যেতে সময় লাগে সাড়ে তিন ঘণ্টা গাড়িতে। তাই একদিন হঠাৎ প্ল্যান করে ফেললাম ভারমন্ট ঘুরতে যাব। সময়টা ছিল অক্টোবর। তাই সব মিলিয়ে সময় এবং জায়গা আমাদের জন্য অনুকূল হয়ে গেল। গাড়ি নিয়ে সকালে বেরিয়ে গেলাম ভার্মন্ট এর উদ্দেশ্যে। পাহাড়ের অলিগলি রাস্তায় গাড়ি ছুটছে, চারিদিকে দেখছি গাছের পাতার রং সবুজ ছাড়া আছে হলুদ কমলা আর লাল। চারিদিকে শুধু রঙিন গাছ আর গাছ। এখানে একটি বিখ্যাত খাবার হল আপেল পাই আর ম্যাপেল সিরাপ। আমরা একটি দোকানে ঢুকে আপেল পাই আর ম্যাপেল সিরাপ কিনলাম। বেশ সুন্দর খেতে। নতুন ধরনের অভিজ্ঞতা অর্জন করলাম । আপেল পাই খেতে খেতে পাহাড়ের গা বেয়ে এগিয়ে গেলাম প্রকৃতিকে দেখার জন্য। পাহাড়ের উচু নিচু রাস্তায় কখনো দেখা যায় সুদূর প্রান্তে বিস্তীর্ণ মাঠ যেখানে খেলা করছে হরিণ শাবক। রাস্তায় দেখলাম কিছু স্টেট পার্ক। পার্ক গুলো মূলত বন জঙ্গল ঘেরা পাহাড় এবং লেকের সংমিশ্রণে তৈরি। একটি পার্কে গাড়ি থামিয়ে সামনে এগোতেই দেখলাম বিশাল নিলাভ লেক। দেখে মনটা প্রশান্তিতে ভরে গেল। চারিদিকে দেখলাম মৌমাছির গুনগুন শব্দ আর প্রজাপতির এক ডাল থেকে এক ডালে ঘুরে বেড়ানো। ম্যাপেল গাছের পাতা চারিদিকে ছড়িয়ে আছে। সব মিলিয়ে মনে হচ্ছে যেন অন্য এক জগতে চলে এসেছি।

শরৎকাল হল আমেরিকায় উৎসবের কাল। শরৎকালে এখানে ফল কালার্স দিয়ে উৎসব শুরু হয়। অক্টোবরের মাঝামাঝি সময় থেকে হ্যালোইন উৎসবের প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। তারপর অক্টোবরে আপেল পিকিং হলো আরেকটি উৎসব। এই সময়ে বিভিন্ন ফার্মে মানুষ আপেল পিকিং করতে যায়। ফার্মগুলো জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত থাকে এই আপেল পিকিং এর সময়। আর হ্যালোইন আসতে না আসতেই শুরু হয়ে যায় কুমড়ো দিয়ে সাজানো ঘরবাড়ি। 

দেশে থাকাকালীন দেখেছি গ্রীষ্মের কাঠফাটা রোদ আর বর্ষায় মুষলধারে বৃষ্টির পর শরৎ আসে আলোছায়ার প্রকৃতি নিয়ে। এই মেঘ, আবার বৃষ্টি, তো কিছুক্ষণ পরই রোদ। শরতের অন্যতম বড় আকর্ষণ কাশফুল।  আর বাঙালির প্রাণের উৎসব তো রয়েছেই- দুর্গাপূজা। দেবীর আরাধনায় বাঙালি উৎসবে মেতে ওঠে,চারিদিকে দেখা যায় উৎসব মুখরতা। শরৎকাল বর্ণনা প্রসঙ্গে বিভিন্ন কবি সাহিত্যিক তাদের লেখায় খুব সুন্দর ভাবে শরতের বর্ণনা করেছেন।মহাকবি কালিদাস শরৎ বর্ণনায় লিখেছেন

“প্রিয়তম আমার, ঐ চেয়ে দেখ,

নব বধুর ন্যায় সুসজ্জিত শরৎকাল সমাগত”

এভাবেই শরৎ আসে দেশ এবং বিদেশের বিভিন্ন জায়গায়। প্রকৃতি যেমন শরতের রঙের ছোঁয়ায় রাঙ্গা হয়ে ওঠে তেমনি শরৎ এলে মানুষের মনও শরতের রঙে রঙিন হয়ে ওঠে। রঙের আঙিনায় দিগ্বিদিক ভরে ওঠে আনন্দ আবেশে।

Print Friendly, PDF & Email
Previous articleমুর্তি ও কম তেলের কষা মাংস
Next articleচৌধুরী বাড়িতে ধুন্ধুমার
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments