“সাঁঝ নামলেই অমন জমজমাট গাঙপাড়টা শ্মশানের মতো খাঁখাঁ করে ,সবই আমার কপালের দোষ গো দিদিমণি, ” , গভীর অনুশোচনা আর একরাশ অভিমান ঝরে পড়লো পরাশর এর ভিতর থেকে॥
যখন থেকে নসিপুরে মামার বাড়ি ঘুরতে এসেছি, বিকেল হলেই গাঙপাড়ে এসে হাজির হতাম…এখান কার খোলা বাতাস, নদীপারের চাষজমি আর পাড় বরাবর আমগাছে দোলাচল ,সবকিছু মন্ত্র মুগ্ধের মতো টানতো আমায়। দিদা সবসময় আমায় বলতেন “রিনি,মা যাসনে ওখানে, ওই নদীপাড়ের হওয়া ভালো নয় রে মা।”
কিন্তু তাকে কে বোঝাবে যে আমি কি মায়ার বাঁধনে বাধা পড়েছি।গ্রামের অন্যান্য সকলের মতো পরাশরও আমায় নিষেধ করেছিল ওখানে আসতে, বছর ত্রিশের বলিষ্ঠ চেহারার সুঠাম পুরুষ সে, গায়ে গেঞ্জি আর পাজামা, কাঁধে একটা লাল রঙের গামছা আর ডান হাতে মোটা একটা রুপোর কড়া।অথচ সব জেনেও আমি ওকে বলতাম ” তাহলে তুমি এখানে কেন আসো “?
পরাশর এর মুখ মলিন হয়ে যেত আমার সেই প্রশ্নে…বলতো “জানোই তো দিদিমনি,আমার উপায় নেই না এসে। আমি যে মাঝি, আমায় ছাড়া নদী কেমনে চলবে ?”
এখন তো সূর্য্য পশ্চিমে ঢলার সাথে সাথে দৈনন্দিন কর্মসূচির মতোই নদীপাড়ে সময় কাটানো আমার নিত্যদিনের অভ্যাস।গাছতলায় বসে পরাশর মাঝির সাথে কথা বলে তার জীবনে ঘটে যাওয়া অদ্ভুত সব কাহিনী শোনার মধ্যে যে অমোঘ একটা টান কাজ করে তা বলে বোঝানো ভার।
পরাশর ভাটার টানে তলিয়ে যাওয়া নদীর তিরতির জলের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে বলতে শুরু করলো…….”দিদিমণি অনেক তো গল্প শুনিয়েছি,আজ তবে শোনো আমার জীবনের সবথেকে মোহময়ীর কথা। তা বছর দশেক আগেকার কথা…তখন ভাটার টানে নদীর জল এতোটাও নেমে যেতনা, তাই ডিঙি নৌকা নিয়ে মোহনা পর্যন্ত সহজেই যাওয়া যেত।আমি তখন সাঁঝ গড়ালেই ডিঙি নিয়ে রওনা দিতাম সমুদ্রের দিকে….কিছু বড়ো জাহাজ যেত পাশের বড় বড় গ্রাম শহরের দিকে, যাদেরকে গ্রাম থেকে পাঠানো সামগ্রী অন্যান্য গাঁয়ে রফতানীর জন্য দিয়ে আসতে হতো।কখনো কখনো জমিদার মশাইয়ের অতি দামি দ্রব্যাদি দিয়ে আসার দায়িত্ব পড়তো আমার কাধে।আমি ভাটার টানের সাথে ডিঙি নিয়ে বেরিয়ে পড়তাম, আবার উজানের সাথে ফিরে আসতাম।মোহনা পর্যন্ত এই নদীপথ ছিল তির্যক বাঁকে ভর্তি, তবে সবার সাধ্যে ছিলোনা এখানে নৌকা চালানো, তাও আবার সন্ধ্যার অন্ধকারে।”
এতটা বলে পরাশর খানিক চুপ হলো, তারপর কি যেন ভেবে বলতে শুরু করলো “ঘাট থেকে নৌকা ছাড়ার পর মাইল খানেকের মাথায় একটা বাঁক আসতো,হাঁসুলির মতো,নদীর পাড়টা ওখানে যেন ত্রিকোণ হয়ে টিকলো নাকের মতো এগিয়ে এসেছে….বাঁক না পরোলে এধার থেকে ঐধারে দেখা যায়না।লোকে এটাকে বলতো পোড়াবাঁক,কারণ ওই বাকের ধারে ছিল একটা শ্মশান,আশেপাশের পাঁচটা গাঁয়ের লোক সেখানেই আসতো মড়া পোড়াতে। প্রায় দিনই যেতে আসতে দুচারটে মড়া পোড়ানো দেখা আমার চোখে সয়ে গিয়েছিল। তবে আমার প্রিয় ছিল ওই ত্রিকোণ পাড়টাকে ধরে আগলে রাখা একটা বড় বটগাছ ,ওর ডালপালা গুলো সবুজ ছাতার মত নদীর উপর দিয়ে যেন হাত নাড়াতে থাকতো। মোটা পাতলা অজস্র ঝুড়ি ডাল থেকে নেমে খোলা চুলের মতো গাঙের হওয়ায় দুলতে থাকতো।'”
একটু থেমে পরাশর খানিক খোলা বাতাস প্রাণ ভরে বুকে টেনে …দুহাতে ভর দিয়ে পিছন দিকে খানিক শরীরটাকে হেলিয়ে ,চোখটা বন্ধ করে মাথাটা উপর দিকে করে আবার বলতে লাগলো,”পূর্ণিমার এক রাতে নৌকো বাইতে বাইতে এগিয়ে চলেছি মোহনার দিকে,অমন সময় প্রায় হাত পঞ্চাশেক দূরে নদীপারের সেই গাছ তলায় নজরে এলো এক ছায়া মূর্তি। চারিদিক জ্যোৎস্নার আলোয় মোটামুটি দেখা গেলেও গাছের তলার দিকটা ছায়াটা একটু বেশিই গাঢ়…বুঝতে পারলাম না মূর্তিটি নারী না পুরুষের। আরো খানিক এগিয়ে যেতে নজরে এলো একরাশ অবিন্যস্ত খোলা চুল পাগলা হওয়ার সাথে তাল মিলিয়ে উড়ে চলেছে…..সেই আলোআঁধারীতেই কাজলকামিনীর ওই টানা টানা চোখ আজও আমার মনে লেগে আছে গো দিদিমণি”।ভিতর থেকে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে ওর। আমিও অবাক হয়ে শুনে যাচ্ছি। কই এতদিন তো পরাশর আমায় এই গল্প শোনায়নি।আমি অবাক পানে চেয়ে থাকি কেবল ওর দিকে।
“জানো দিদিমণি সেদিনের পর থেকে মনটা কেমন হয়ে গেল। কোনো কাজে মন লাগতো না, খালি মনে হত কেমন করে ওর একটিবার দেখা পাবো।প্রতিদিন পাগলের মতো ঘাট থেকে মোহনা পর্যন্ত বারেবারে বিনা কারণে নৌকো বাইতে লাগলাম…যদি একটিবার দেখা পাই। দেখতে দেখতে একমাস কেটে গেল, কিন্তু ওর দেখা পেলামনা।সেদিনও ছিল পূর্ণিমার রাত…বিগত মাসের কথা ভাবতে ভাবতে নৌকা নিয়ে এগিয়ে চলেছি….অমন সময়ে আধা কিলোমিটার দূর থেকে নজরে এলো এক অগ্নিকুণ্ড। বোধ হয় কেউ মড়া পোড়াতে এসেছিলো। খানিক বাদে গাছটার কাছে এসে পৌঁছাতেই বুকের বাদিকটা আবার কেঁপে উঠলো। নিশুতি রাতে নির্জন গাঙ পাড়ে সেই মনমোহিনী একই ভঙ্গিতে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে…আমি নৌকার গতি ধীর করে দিলাম। আর ও গাছের ছায়া থেকে বেরিয়ে আমার নৌকার সাথে সাথে নদীর পাড় বরাবর চলতে লাগলো। পরিষ্কার চাঁদের আলোয় এবারে ওকে দেখে আমার হৃদপিন্ড স্তব্ধ হয়ে গেলো। গায়ের রং মাজা পেতলের মতো,তার টিকলো নাক, পান পাতার মতো মুখ, পুরুষ্ট ঠোঁট আর হরিনের মতো সেই কাজলকালো টানটানা দৃষ্টি, দু হাতে পায়ে আর গলায় রুপোর কড়াগুলি চাঁদের আলোয় চিকচিক করছে।খোলা চুল গুলো অবাধ্য শিশুর মতো হওয়ার সাথে উড়ে এসে ওর মুখের মধ্যে আটকে যাচ্ছে, আর ও নিজের দুহাত দিয়ে তাদেরকে থামানোর ব্যর্থ শাসন করে যাচ্ছে। এদিকে ওকে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই সামনের বাঁক চলে এলো….আর আমি ধীরে ধীরে নৌকা নিয়ে বাঁকের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেলাম ।
এতক্ষনে বাঁক পেরোতেই হৃদপিন্ডটা যেন শতাধিক জোরে ধুকপুক করতে শুরু করলো। একবার মনে হলো ফিরে যাই, কিন্ত ওদিকে মোহনায় বড় জাহাজটা তখন আমার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে।অগত্যা বুকে পাথর বেঁধে এগিয়ে চললাম।”
এত অবধি বলে পরাশর উঠে দাঁড়ালো।আমি বললাম “কিগো তারপর কি হলো বলবেনা ?”
ও কোনো রূপ ভ্রূক্ষেপ না করে আমায় বললো “আজও পূর্ণিমা গো দিদিমণি , কোনোদিন জ্যোৎস্নার আলোয় নদীতে নৌকায় ঘুরেছ? যাবে আমার সাথে ?”
বহুদিনের সুপ্ত বাসনা যেমনি হটাৎ করে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, বহুবছরের প্রতীক্ষার পর সুপ্ত বীজও জল পেয়ে যেরূপ অঙ্কুরদগমের জন্য ছটফটিয়ে ওঠে আমার মনের অদম্য ইচ্ছাগুলোও তেমনিভাবে হঠাৎ করে জাগ্রত হয়ে উঠলো । সাতপাঁচ না ভেবেই বললাম “চলো যাবো”।
পরাশর বললো “ভাটা আসলো বলে, চলো এই বেলায় নেমে পরি…যেতে যেতে তোমায় বাকি কাহিনী বলবোখন”.
নদীর বুকে বেয়ে আমাদের নৌকো এগিয়ে চললো। নদীর জল কুলকুল শব্দে বয়ে চলেছে, উদ্দাম হওয়ায় যেন শ্বাস নেওয়াও ভার। পড়ন্ত বিকেলে সূর্যের আলোও যেন প্রায় নিভু নিভু….পরাশর আবার বলতে শুরু করলো ” সেই থেকে দিদিমণি প্রত্যেক পূর্ণিমার রাতে ওকে দেখতে যাই ওই নদীপারে। ওদিন থেকে হাতে কোনো কাজ নিলে সময়ের আগেই বেড়িয়ে পড়তাম। প্রথমে তিনবার সাহসে কুলায় নি ওর সাথে কথা বলার জন্য। নামও জানার চেষ্টা করিনি, নিজে থেকেই ওর নাম দিয়েছিলাম মোহিনী। পরবর্তী কালে ওকে সেই নামেই ডাকতাম।
চতুর্থবার দেখা করতে গিয়ে, দোটানায় পড়েও অবশেষে ঠিক করলাম পোড়াবাঁকের ঘাটে গিয়ে নৌকা লাগাবো। মোহিনীকে সামনে বসিয়ে সব কিছু জিজ্ঞেস করবে, দরকার হলে আমার সাথে ওকে নিয়ে আসবো। যেমন ভাবা তেমন কাজ। নৌকা গিয়ে লাগলাম পোড়াবাঁকের ঘাটে। তারপর এগিয়ে গেলাম ঘাটের দিকে। ও গাছতলায় দাঁড়িয়ে ছিল, তবে আমায় দেখে ওর মুখে বিস্ময়ের থেকে বেশি উৎফুল্লতাই নজরে আসলো বেশি। আমার মনটাও অজানা আনন্দে ভরে উঠলো।আমি ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম ওর দিকে…কোনো কথা না বলে খপ করে ওর হাত দুটো নিজের দুহাতে ভরে নিলাম। মোহাচ্ছন্ন এর মত বললাম “”মোহিনী তুমি যাবে আমার সাথে।”” ও একটা অদ্ভুত হাসি হেসে কিছু না বলেই আমার আরো কাছে এগিয়ে আসতে থাকলো….একটা মিষ্টি সুবাস ভেসে এলো নাকে………অদ্ভুত এক ভালো লাগার রেশ কাজ করতে শুরু করেছে আমার মধ্যে… হওয়ায় ওর চুলগুলো উড়ে এসে আমার চোখে ,কপালে হাতছানি দিয়ে যাচ্ছে……… ওর উত্তপ্ত নিঃশ্বাস আমার মুখে এসে পড়ছে…..ধীরে ধীরে আমার দুচোখ বন্ধ হয়ে আসলো।
যখন জ্ঞান এলো দেখি গাছের তলায় পরে আছি, মোহিনীর একটা কড়া আমার হাতে পরানো।আমি উদ্ভ্রান্তের মতো মোহিনী মোহিনী বলে ছুটতে ছুটতে ঘাটপারে আসলাম। এসে আমার দু পা সেখানে আটকে গেলো।”
পরাশর চুপ করে যেতেই, আমি ওকে কিছু বলতে যাবো তার আগেই ও হাতের তর্জনী তুলে সামনের দিকে দেখালো। পূর্ণিমার আলোয় প্রায় পঞ্চাশ গজ দূর থেকে নজরে এলো সেই বটগাছটা , মাথা তুলে যেন নদীর মাঝে দাঁড়িয়ে আছে। এদিকে বাঁকটা এতটাই তীক্ষ্ণ যে বাঁকের ঐপারে কি আছে বোঝা যায়না, খালি দূর থেকে কিছু একটা যেন গাছের কাছে দাঁড়িয়ে আছে বলে মনে হচ্ছে। গভীর শ্বাস নিয়ে চাপা স্বরে পরাশর আবার বলতে লাগলো “মোহিনী কে আমি যথার্থই ভালোবেসেছিলাম গো, হয়তো ও আমাকে …..তাই হয়তো নিজের কড়াটা আমায় পরিয়েছিলো।
জানো তো দিদিমণি সেই সময় বিভিন্ন যাত্রীদের বা মালবাহী নৌকা ,ডিঙি গুলোকে ঠগীরা প্রায়ই লুট করতো। কিন্তু আমাদের এই নদীপথের বাঁক গুলোর জন্য লুটেরারা প্রকাশ্যে আক্রমণ করার খুব একটা সাহস পেতোনা…একমাত্র নদী পাড়ের কোনো নির্জন ঘাটে কেউ নৌকা না ভেড়ালে। বিনা কারণে কেউ তো আর এমনি ঘাটে এসে দাঁড়াবেনা….তাই ওরা বেছে নিয়েছিল মোক্ষম অস্ত্র। নানা নির্জন ঘাটে দাঁড় করিয়ে রাখতো কোনো মোহময়ীকে…..যাকে দেখে মাঝিরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাদের দিকে এগিয়ে যায়, ঠিক যেমন মরণকালে জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডের দিকে পতঙ্গ ধাবিত হয়।এরপর নির্জন ঘটে তারা নৌকা নিয়ে পৌঁছালেই , তাদের মেরে যথাসর্বস্ব নিয়ে পালিয়ে যেত।”
আমাদের নৌকা ততক্ষনে গাছের কাছে পৌঁছে গেছে। পরিষ্কার চাঁদের আলোয় গাছ তলায় প্রতিমূর্তি দেখে আমার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো। খোলা চুল আর একহাতে, গলায় ,পায়ে রুপোর কড়া পরে দাঁড়িয়ে আছে মোহিনী। ওর দৃষ্টি পরাশর এর দিকে…মুখে ম্লান হাসি নিয়ে গাছ থেকে একটা ঝোলানো দড়ি ধরে দাঁড়িয়ে আছে। ঘাটে নৌকা লাগিয়ে পরাশর এগিয়ে গেলো গাছের দিকে। আমি পাথরের মতোই ঘাটে দাঁড়িয়ে রইলাম।ওখান থেকে পরাশরকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি।
ও আবার বলতে লাগলো “দিদিমণি, সেদিন মোহিনী আমায় ছেড়ে যায়নি। আমার প্রাণ বাঁচাতে কেবল কোনো সুগন্ধি ওষুধ দিয়ে আমায় অজ্ঞান করে দিয়েছিল।ওর সাথীরা আমাকে মৃত ভেবে আমার নৌকা আর জিনিস নিয়ে গেলেও ও আমার দেহ লোপাটের অজুহাত দেখিয়ে পিছে রয়ে গিয়েছিল। আর হতভাগা আমি জ্ঞান ফেরার পর ওকে দোষী ভেবে এই গাছেই , ওর গলায় দড়ি দিয়ে ওকে ঝুলিয়ে…..” বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়লো ও।
আমি বিস্ফারিত দৃষ্টিতে ওদের দিকে চেয়ে আছি। মোহিনী এগিয়ে এসে ওর হাত দুটো পরাশর এর কাঁধে রাখলো। পরাশর মুখ তুলে আমার দিকে চেয়ে চেঁচিয়ে বললো “এতদিন বুকে ভার নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম গো দিদিমণি, আর পারছিনা। মোহিনী বড় একা এখানে, আমি ছাড়া ওর কেউ নাই।”
ইতিমধ্যে গাছের দড়িটা সাপের মতো বাকতে বাকতে ক্রমশ নীচের দিকে নেমে আসছে, ক্ষুধিত পাষানের মতো ক্রমশ পরশরের দেহ আর গলাটাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে…….। অথচ পরাশর এর মুখ লেশমাত্র বিকৃত হলোনা, পরিবর্তে অদ্ভুত এক প্রশান্তি তার চোখে মুখে। দেখতে দেখতে ওর বলিষ্ঠ দেহখানি উপরে উঠে শূন্যে ঝুলতে লাগলো……মুহূর্তের জন্য ঝুলন্ত পাদুটি বার কয়েক থরথর করে কেঁপে স্থির হয়ে গেল।
রাতের আঁধারে এই দৃশ্য দেখে আমার স্নায়ু আর স্থির রইলনা….তৎক্ষণাৎ মূর্ছনা পেয়ে ওখানেই লুটিয়ে পড়লাম। পরদিন জ্ঞান আসতেই নিজেকে বাড়ির বিছানায় পেলাম। সব কিছু শুনে দিদা হা করে আমার দিকে খানিক চেয়ে থেকে, তারপর আমায় জড়িয়ে ধরে হাউহাউ করে কেঁদে উঠলেন। পাশে বসে থাকা দাদু খালি আমায় বললেন “দিদিভাই, তুমি পরাশরকে নিয়ে যা বললে সবই ঠিক।ও সত্যি একটি লুটেরা মেয়েকে গলায় দড়ি দিয়ে ওই গাছে ঝুলিয়ে দিয়েছিল ,এর জন্য জমিদার মশাই তাকে পুরস্কারও দেন,তবে……”
আমি প্রায় চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলাম “তবে কি দাদাই ?”
–––” তবে দশ বছর আগে…..ওই ঘটনার একমাস পরেই পূর্ণিমার রাতে পরাশর ওই গাছের ডালে গিয়ে নিজে গলায় দড়ি দেয়। ”
এরপর দাদাইএর কোনো কথা আমার কানে এসে পৌঁছায়নি।শুধু পাশের জানালা দিয়ে দূরের নদীটা নজরে আসতে মনে হলো………হয়তো আগামী দিনে পূর্ণিমার কোনো রাতে পরাশর গাঙ পারে নৌকা নিয়ে ওর মন মোহিনীর কাছে ফিরে যাবে, আর গাঙপারের বাতাসে মাথা দোলাতে দোলাতে একমাত্র ওই গাছটা ওদের অব্যক্ত প্রেমের সাক্ষী হয়ে থাকবে।”সাঁঝ নামলেই অমন জমজমাট গাঙপাড়টা শ্মশানের মতো খাঁখাঁ করে ,সবই আমার কপালের দোষ গো দিদিমণি, ” , গভীর অনুশোচনা আর একরাশ অভিমান ঝরে পড়লো পরাশর এর ভিতর থেকে॥
যখন থেকে নসিপুরে মামার বাড়ি ঘুরতে এসেছি, বিকেল হলেই গাঙপাড়ে এসে হাজির হতাম…এখান কার খোলা বাতাস, নদীপারের চাষজমি আর পাড় বরাবর আমগাছে দোলাচল ,সবকিছু মন্ত্র মুগ্ধের মতো টানতো আমায়। দিদা সবসময় আমায় বলতেন “রিনি,মা যাসনে ওখানে, ওই নদীপাড়ের হওয়া ভালো নয় রে মা।”
কিন্তু তাকে কে বোঝাবে যে আমি কি মায়ার বাঁধনে বাধা পড়েছি।গ্রামের অন্যান্য সকলের মতো পরাশরও আমায় নিষেধ করেছিল ওখানে আসতে, বছর ত্রিশের বলিষ্ঠ চেহারার সুঠাম পুরুষ সে, গায়ে গেঞ্জি আর পাজামা, কাঁধে একটা লাল রঙের গামছা আর ডান হাতে মোটা একটা রুপোর কড়া।অথচ সব জেনেও আমি ওকে বলতাম ” তাহলে তুমি এখানে কেন আসো “?
পরাশর এর মুখ মলিন হয়ে যেত আমার সেই প্রশ্নে…বলতো “জানোই তো দিদিমনি,আমার উপায় নেই না এসে। আমি যে মাঝি, আমায় ছাড়া নদী কেমনে চলবে ?”
এখন তো সূর্য্য পশ্চিমে ঢলার সাথে সাথে দৈনন্দিন কর্মসূচির মতোই নদীপাড়ে সময় কাটানো আমার নিত্যদিনের অভ্যাস।গাছতলায় বসে পরাশর মাঝির সাথে কথা বলে তার জীবনে ঘটে যাওয়া অদ্ভুত সব কাহিনী শোনার মধ্যে যে অমোঘ একটা টান কাজ করে তা বলে বোঝানো ভার।
পরাশর ভাটার টানে তলিয়ে যাওয়া নদীর তিরতির জলের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে বলতে শুরু করলো…….”দিদিমণি অনেক তো গল্প শুনিয়েছি,আজ তবে শোনো আমার জীবনের সবথেকে মোহময়ীর কথা। তা বছর দশেক আগেকার কথা…তখন ভাটার টানে নদীর জল এতোটাও নেমে যেতনা, তাই ডিঙি নৌকা নিয়ে মোহনা পর্যন্ত সহজেই যাওয়া যেত।আমি তখন সাঁঝ গড়ালেই ডিঙি নিয়ে রওনা দিতাম সমুদ্রের দিকে….কিছু বড়ো জাহাজ যেত পাশের বড় বড় গ্রাম শহরের দিকে, যাদেরকে গ্রাম থেকে পাঠানো সামগ্রী অন্যান্য গাঁয়ে রফতানীর জন্য দিয়ে আসতে হতো।কখনো কখনো জমিদার মশাইয়ের অতি দামি দ্রব্যাদি দিয়ে আসার দায়িত্ব পড়তো আমার কাধে।আমি ভাটার টানের সাথে ডিঙি নিয়ে বেরিয়ে পড়তাম, আবার উজানের সাথে ফিরে আসতাম।মোহনা পর্যন্ত এই নদীপথ ছিল তির্যক বাঁকে ভর্তি, তবে সবার সাধ্যে ছিলোনা এখানে নৌকা চালানো, তাও আবার সন্ধ্যার অন্ধকারে।”
এতটা বলে পরাশর খানিক চুপ হলো, তারপর কি যেন ভেবে বলতে শুরু করলো “ঘাট থেকে নৌকা ছাড়ার পর মাইল খানেকের মাথায় একটা বাঁক আসতো,হাঁসুলির মতো,নদীর পাড়টা ওখানে যেন ত্রিকোণ হয়ে টিকলো নাকের মতো এগিয়ে এসেছে….বাঁক না পরোলে এধার থেকে ঐধারে দেখা যায়না।লোকে এটাকে বলতো পোড়াবাঁক,কারণ ওই বাকের ধারে ছিল একটা শ্মশান,আশেপাশের পাঁচটা গাঁয়ের লোক সেখানেই আসতো মড়া পোড়াতে। প্রায় দিনই যেতে আসতে দুচারটে মড়া পোড়ানো দেখা আমার চোখে সয়ে গিয়েছিল। তবে আমার প্রিয় ছিল ওই ত্রিকোণ পাড়টাকে ধরে আগলে রাখা একটা বড় বটগাছ ,ওর ডালপালা গুলো সবুজ ছাতার মত নদীর উপর দিয়ে যেন হাত নাড়াতে থাকতো। মোটা পাতলা অজস্র ঝুড়ি ডাল থেকে নেমে খোলা চুলের মতো গাঙের হওয়ায় দুলতে থাকতো।'”
একটু থেমে পরাশর খানিক খোলা বাতাস প্রাণ ভরে বুকে টেনে …দুহাতে ভর দিয়ে পিছন দিকে খানিক শরীরটাকে হেলিয়ে ,চোখটা বন্ধ করে মাথাটা উপর দিকে করে আবার বলতে লাগলো,”পূর্ণিমার এক রাতে নৌকো বাইতে বাইতে এগিয়ে চলেছি মোহনার দিকে,অমন সময় প্রায় হাত পঞ্চাশেক দূরে নদীপারের সেই গাছ তলায় নজরে এলো এক ছায়া মূর্তি। চারিদিক জ্যোৎস্নার আলোয় মোটামুটি দেখা গেলেও গাছের তলার দিকটা ছায়াটা একটু বেশিই গাঢ়…বুঝতে পারলাম না মূর্তিটি নারী না পুরুষের। আরো খানিক এগিয়ে যেতে নজরে এলো একরাশ অবিন্যস্ত খোলা চুল পাগলা হওয়ার সাথে তাল মিলিয়ে উড়ে চলেছে…..সেই আলোআঁধারীতেই কাজলকামিনীর ওই টানা টানা চোখ আজও আমার মনে লেগে আছে গো দিদিমণি”।ভিতর থেকে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে ওর। আমিও অবাক হয়ে শুনে যাচ্ছি। কই এতদিন তো পরাশর আমায় এই গল্প শোনায়নি।আমি অবাক পানে চেয়ে থাকি কেবল ওর দিকে।
“জানো দিদিমণি সেদিনের পর থেকে মনটা কেমন হয়ে গেল। কোনো কাজে মন লাগতো না, খালি মনে হত কেমন করে ওর একটিবার দেখা পাবো।প্রতিদিন পাগলের মতো ঘাট থেকে মোহনা পর্যন্ত বারেবারে বিনা কারণে নৌকো বাইতে লাগলাম…যদি একটিবার দেখা পাই। দেখতে দেখতে একমাস কেটে গেল, কিন্তু ওর দেখা পেলামনা।সেদিনও ছিল পূর্ণিমার রাত…বিগত মাসের কথা ভাবতে ভাবতে নৌকা নিয়ে এগিয়ে চলেছি….অমন সময়ে আধা কিলোমিটার দূর থেকে নজরে এলো এক অগ্নিকুণ্ড। বোধ হয় কেউ মড়া পোড়াতে এসেছিলো। খানিক বাদে গাছটার কাছে এসে পৌঁছাতেই বুকের বাদিকটা আবার কেঁপে উঠলো। নিশুতি রাতে নির্জন গাঙ পাড়ে সেই মনমোহিনী একই ভঙ্গিতে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে…আমি নৌকার গতি ধীর করে দিলাম। আর ও গাছের ছায়া থেকে বেরিয়ে আমার নৌকার সাথে সাথে নদীর পাড় বরাবর চলতে লাগলো। পরিষ্কার চাঁদের আলোয় এবারে ওকে দেখে আমার হৃদপিন্ড স্তব্ধ হয়ে গেলো। গায়ের রং মাজা পেতলের মতো,তার টিকলো নাক, পান পাতার মতো মুখ, পুরুষ্ট ঠোঁট আর হরিনের মতো সেই কাজলকালো টানটানা দৃষ্টি, দু হাতে পায়ে আর গলায় রুপোর কড়াগুলি চাঁদের আলোয় চিকচিক করছে।খোলা চুল গুলো অবাধ্য শিশুর মতো হওয়ার সাথে উড়ে এসে ওর মুখের মধ্যে আটকে যাচ্ছে, আর ও নিজের দুহাত দিয়ে তাদেরকে থামানোর ব্যর্থ শাসন করে যাচ্ছে। এদিকে ওকে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই সামনের বাঁক চলে এলো….আর আমি ধীরে ধীরে নৌকা নিয়ে বাঁকের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেলাম ।
এতক্ষনে বাঁক পেরোতেই হৃদপিন্ডটা যেন শতাধিক জোরে ধুকপুক করতে শুরু করলো। একবার মনে হলো ফিরে যাই, কিন্ত ওদিকে মোহনায় বড় জাহাজটা তখন আমার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে।অগত্যা বুকে পাথর বেঁধে এগিয়ে চললাম।”
এত অবধি বলে পরাশর উঠে দাঁড়ালো।আমি বললাম “কিগো তারপর কি হলো বলবেনা ?”
ও কোনো রূপ ভ্রূক্ষেপ না করে আমায় বললো “আজও পূর্ণিমা গো দিদিমণি , কোনোদিন জ্যোৎস্নার আলোয় নদীতে নৌকায় ঘুরেছ? যাবে আমার সাথে ?”
বহুদিনের সুপ্ত বাসনা যেমনি হটাৎ করে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, বহুবছরের প্রতীক্ষার পর সুপ্ত বীজও জল পেয়ে যেরূপ অঙ্কুরদগমের জন্য ছটফটিয়ে ওঠে আমার মনের অদম্য ইচ্ছাগুলোও তেমনিভাবে হঠাৎ করে জাগ্রত হয়ে উঠলো । সাতপাঁচ না ভেবেই বললাম “চলো যাবো”।
পরাশর বললো “ভাটা আসলো বলে, চলো এই বেলায় নেমে পরি…যেতে যেতে তোমায় বাকি কাহিনী বলবোখন”.
নদীর বুকে বেয়ে আমাদের নৌকো এগিয়ে চললো। নদীর জল কুলকুল শব্দে বয়ে চলেছে, উদ্দাম হওয়ায় যেন শ্বাস নেওয়াও ভার। পড়ন্ত বিকেলে সূর্যের আলোও যেন প্রায় নিভু নিভু….পরাশর আবার বলতে শুরু করলো ” সেই থেকে দিদিমণি প্রত্যেক পূর্ণিমার রাতে ওকে দেখতে যাই ওই নদীপারে। ওদিন থেকে হাতে কোনো কাজ নিলে সময়ের আগেই বেড়িয়ে পড়তাম। প্রথমে তিনবার সাহসে কুলায় নি ওর সাথে কথা বলার জন্য। নামও জানার চেষ্টা করিনি, নিজে থেকেই ওর নাম দিয়েছিলাম মোহিনী। পরবর্তী কালে ওকে সেই নামেই ডাকতাম।
চতুর্থবার দেখা করতে গিয়ে, দোটানায় পড়েও অবশেষে ঠিক করলাম পোড়াবাঁকের ঘাটে গিয়ে নৌকা লাগাবো। মোহিনীকে সামনে বসিয়ে সব কিছু জিজ্ঞেস করবে, দরকার হলে আমার সাথে ওকে নিয়ে আসবো। যেমন ভাবা তেমন কাজ। নৌকা গিয়ে লাগলাম পোড়াবাঁকের ঘাটে। তারপর এগিয়ে গেলাম ঘাটের দিকে। ও গাছতলায় দাঁড়িয়ে ছিল, তবে আমায় দেখে ওর মুখে বিস্ময়ের থেকে বেশি উৎফুল্লতাই নজরে আসলো বেশি। আমার মনটাও অজানা আনন্দে ভরে উঠলো।আমি ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম ওর দিকে…কোনো কথা না বলে খপ করে ওর হাত দুটো নিজের দুহাতে ভরে নিলাম। মোহাচ্ছন্ন এর মত বললাম “”মোহিনী তুমি যাবে আমার সাথে।”” ও একটা অদ্ভুত হাসি হেসে কিছু না বলেই আমার আরো কাছে এগিয়ে আসতে থাকলো….একটা মিষ্টি সুবাস ভেসে এলো নাকে………অদ্ভুত এক ভালো লাগার রেশ কাজ করতে শুরু করেছে আমার মধ্যে… হওয়ায় ওর চুলগুলো উড়ে এসে আমার চোখে ,কপালে হাতছানি দিয়ে যাচ্ছে……… ওর উত্তপ্ত নিঃশ্বাস আমার মুখে এসে পড়ছে…..ধীরে ধীরে আমার দুচোখ বন্ধ হয়ে আসলো।
যখন জ্ঞান এলো দেখি গাছের তলায় পরে আছি, মোহিনীর একটা কড়া আমার হাতে পরানো।আমি উদ্ভ্রান্তের মতো মোহিনী মোহিনী বলে ছুটতে ছুটতে ঘাটপারে আসলাম। এসে আমার দু পা সেখানে আটকে গেলো।”
পরাশর চুপ করে যেতেই, আমি ওকে কিছু বলতে যাবো তার আগেই ও হাতের তর্জনী তুলে সামনের দিকে দেখালো। পূর্ণিমার আলোয় প্রায় পঞ্চাশ গজ দূর থেকে নজরে এলো সেই বটগাছটা , মাথা তুলে যেন নদীর মাঝে দাঁড়িয়ে আছে। এদিকে বাঁকটা এতটাই তীক্ষ্ণ যে বাঁকের ঐপারে কি আছে বোঝা যায়না, খালি দূর থেকে কিছু একটা যেন গাছের কাছে দাঁড়িয়ে আছে বলে মনে হচ্ছে। গভীর শ্বাস নিয়ে চাপা স্বরে পরাশর আবার বলতে লাগলো “মোহিনী কে আমি যথার্থই ভালোবেসেছিলাম গো, হয়তো ও আমাকে …..তাই হয়তো নিজের কড়াটা আমায় পরিয়েছিলো।
জানো তো দিদিমণি সেই সময় বিভিন্ন যাত্রীদের বা মালবাহী নৌকা ,ডিঙি গুলোকে ঠগীরা প্রায়ই লুট করতো। কিন্তু আমাদের এই নদীপথের বাঁক গুলোর জন্য লুটেরারা প্রকাশ্যে আক্রমণ করার খুব একটা সাহস পেতোনা…একমাত্র নদী পাড়ের কোনো নির্জন ঘাটে কেউ নৌকা না ভেড়ালে। বিনা কারণে কেউ তো আর এমনি ঘাটে এসে দাঁড়াবেনা….তাই ওরা বেছে নিয়েছিল মোক্ষম অস্ত্র। নানা নির্জন ঘাটে দাঁড় করিয়ে রাখতো কোনো মোহময়ীকে…..যাকে দেখে মাঝিরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাদের দিকে এগিয়ে যায়, ঠিক যেমন মরণকালে জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডের দিকে পতঙ্গ ধাবিত হয়।এরপর নির্জন ঘটে তারা নৌকা নিয়ে পৌঁছালেই , তাদের মেরে যথাসর্বস্ব নিয়ে পালিয়ে যেত।”
আমাদের নৌকা ততক্ষনে গাছের কাছে পৌঁছে গেছে। পরিষ্কার চাঁদের আলোয় গাছ তলায় প্রতিমূর্তি দেখে আমার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো। খোলা চুল আর একহাতে, গলায় ,পায়ে রুপোর কড়া পরে দাঁড়িয়ে আছে মোহিনী। ওর দৃষ্টি পরাশর এর দিকে…মুখে ম্লান হাসি নিয়ে গাছ থেকে একটা ঝোলানো দড়ি ধরে দাঁড়িয়ে আছে। ঘাটে নৌকা লাগিয়ে পরাশর এগিয়ে গেলো গাছের দিকে। আমি পাথরের মতোই ঘাটে দাঁড়িয়ে রইলাম।ওখান থেকে পরাশরকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি।
ও আবার বলতে লাগলো “দিদিমণি, সেদিন মোহিনী আমায় ছেড়ে যায়নি। আমার প্রাণ বাঁচাতে কেবল কোনো সুগন্ধি ওষুধ দিয়ে আমায় অজ্ঞান করে দিয়েছিল।ওর সাথীরা আমাকে মৃত ভেবে আমার নৌকা আর জিনিস নিয়ে গেলেও ও আমার দেহ লোপাটের অজুহাত দেখিয়ে পিছে রয়ে গিয়েছিল। আর হতভাগা আমি জ্ঞান ফেরার পর ওকে দোষী ভেবে এই গাছেই , ওর গলায় দড়ি দিয়ে ওকে ঝুলিয়ে…..” বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়লো ও।
আমি বিস্ফারিত দৃষ্টিতে ওদের দিকে চেয়ে আছি। মোহিনী এগিয়ে এসে ওর হাত দুটো পরাশর এর কাঁধে রাখলো। পরাশর মুখ তুলে আমার দিকে চেয়ে চেঁচিয়ে বললো “এতদিন বুকে ভার নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম গো দিদিমণি, আর পারছিনা। মোহিনী বড় একা এখানে, আমি ছাড়া ওর কেউ নাই।”
ইতিমধ্যে গাছের দড়িটা সাপের মতো বাকতে বাকতে ক্রমশ নীচের দিকে নেমে আসছে, ক্ষুধিত পাষানের মতো ক্রমশ পরশরের দেহ আর গলাটাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে…….। অথচ পরাশর এর মুখ লেশমাত্র বিকৃত হলোনা, পরিবর্তে অদ্ভুত এক প্রশান্তি তার চোখে মুখে। দেখতে দেখতে ওর বলিষ্ঠ দেহখানি উপরে উঠে শূন্যে ঝুলতে লাগলো……মুহূর্তের জন্য ঝুলন্ত পাদুটি বার কয়েক থরথর করে কেঁপে স্থির হয়ে গেল।
রাতের আঁধারে এই দৃশ্য দেখে আমার স্নায়ু আর স্থির রইলনা….তৎক্ষণাৎ মূর্ছনা পেয়ে ওখানেই লুটিয়ে পড়লাম। পরদিন জ্ঞান আসতেই নিজেকে বাড়ির বিছানায় পেলাম। সব কিছু শুনে দিদা হা করে আমার দিকে খানিক চেয়ে থেকে, তারপর আমায় জড়িয়ে ধরে হাউহাউ করে কেঁদে উঠলেন। পাশে বসে থাকা দাদু খালি আমায় বললেন “দিদিভাই, তুমি পরাশরকে নিয়ে যা বললে সবই ঠিক।ও সত্যি একটি লুটেরা মেয়েকে গলায় দড়ি দিয়ে ওই গাছে ঝুলিয়ে দিয়েছিল ,এর জন্য জমিদার মশাই তাকে পুরস্কারও দেন,তবে……”
আমি প্রায় চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলাম “তবে কি দাদাই ?”
–––” তবে দশ বছর আগে…..ওই ঘটনার একমাস পরেই পূর্ণিমার রাতে পরাশর ওই গাছের ডালে গিয়ে নিজে গলায় দড়ি দেয়। ”
এরপর দাদাইএর কোনো কথা আমার কানে এসে পৌঁছায়নি।শুধু পাশের জানালা দিয়ে দূরের নদীটা নজরে আসতে মনে হলো………হয়তো আগামী দিনে পূর্ণিমার কোনো রাতে পরাশর গাঙ পারে নৌকা নিয়ে ওর মন মোহিনীর কাছে ফিরে যাবে, আর গাঙপারের বাতাসে মাথা দোলাতে দোলাতে একমাত্র ওই গাছটা ওদের অব্যক্ত প্রেমের সাক্ষী হয়ে থাকবে।