বংশ মর্যাদা

অসীম কুমার চট্টোপাধ্যায় ( ভবঘুরে )

রাজীব আর মিতালীর প্রেমের খবর  দু বাড়ির কেউ বুঝতেই পারে নি ।  ওরা যখন সিদ্ধান্ত নিল  যে বিয়ে করবে তখনই  রাজীব গেল মিতালীদের  বাড়ি । মিতালীর বাবা  দিবাকর চক্রবর্তী তখনও অফিস থেকে বাড়ি ফেরেন নি । ভাইরা ছোট । হ্যারিকেনের আলোতে বিছানায় বসে পড়াশুনো করছে । শহরতলির এ দিকটায় লোড শেডিংয়ের  মাত্রা এত বেড়ে গেছে যে কারেন্ট কখন আসে আর যায় বলা খুবই দুস্কর । নিয়ম  করে প্রতিদিন সন্ধ্যের পরে লোড শেডিংয়ের তান্ডব চলতে থাকে । মানুষের কাজ কর্মের  দফারফা । সব চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত  পড়ুয়ারা । হ্যারিকেনের ব্যবহার আবার ফিরে  এসেছে  । মিতালী  সবার বড় । তার তত্বাবধানে চলেছে ভাইদের পড়াশুনো । আসলে পড়ছে না কিছুই ।সবার সামনে একটা করে বই খোলা । চলছে গল্প আর আঁকি বুকি খেলা । তবে কান খাড়া আছে  দরজার দিকে । কলিং বেলের শব্দ হলেই শুরু হব পড়া । সবাই একসাথে । খোলা বইয়ের পাতা থেকে মুদ্রিত অক্ষর রাশি আছড়ে পড়বে বন্ধ দরজার পিঠে | যাতে বন্ধ দরজার ওপার থেকেও শোনা যায় পড়া নামক চিৎকার । পাশের ঘরে মিতালীর মা এক মিটার চটের ওপর লাল আর সবুজ সুতো দিয়ে জোড়া টিয়াপাখি বুনে চলেছে । রাজীব দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বলল, আসবো?

ঘাড় ঘুরিয়ে রাজীবকে দেখে মিতালীর মা বললেন, এস।  হাতের কাজটা  সরিয়ে  রাখলেন। একটা চেয়ার টেনে বসে পড়লো রাজীব । কোনো রকম ভনিতা না করে বলল , আমি মিতালীকে ভালোবাসি । মিতালীও আমাকে ভালোবাসে । আমরা বিয়ে করতে চাই । মিতালীর মা র মনে হল পাথরের চাঁই  ভেঙে পড়লো  মাথার ওপর । এক মিনিট কোনো কথা বলতে পারলেন না । একটু ধাতস্ত হয়ে   বললেন, বিয়ে করবে তা খাওয়াবে কী  ?

কেন , আমি তো এখন চাকরি করি ।

কত টাকা মাইনে পাও ?

দুজনের চলে যাবে । তাছাড়া , বাবাও তো চাকরি করেন ।

তুমি কী  তোমার বাবার ভরসায় বিয়ে করছো ?

না , তা কেন ?

কোথায় কাজ কর তুমি ?

একটা ওষুধের কোম্পানিতে ।

শোনো , তোমাকে সোজা কথাটা  সোজা ভাবেই বলি ।

তুমি তো জানো যে তোমরা আমাদের পাল্টি ঘর নও । আমার বাবা ছিলেন ব্রাহ্মণ পুরোহিত । কায়স্থের ঘরে মেয়ের  বিয়ে দেওয়ার কথা আমরা স্বপ্নেও ভাবতে পারি না । দেশ থেকে তো জাত -পাতের ব্যাপারটা উঠে যায় নি । যেদিন যাবে সেদিন ভাববো অন্য কথা । তোমার কথা বলা হয়ে থাকলে , তুমি এখন আসতে  পার । ভবিষ্যতে আমার মেয়েকে বিয়ে করার দুঃস্বপ্ন দেখ না । মনে রেখ কথাটা  ।

মনে থাকবে । আসছি ।

চলে গেল রাজীব । রাগে  গজগজ করতে লাগলেন মিতালীর মা । এই সময় পাশের ঘর থেকে ছোট ছেলে এসে বলল , মা , ঘুম পেয়েছে । মা বললেন , এখনই ঘুমাবে না । আর একটু পরে তোমাদের বাবা ফিরবেন । তাকে জল খাবার দিয়ে তোমাদের খেতে দেব । এখন যাও কালকের স্কুলের পড়াটা আর একবার দেখে নাও ।

সেদিন সকাল থেকেই আকাশ কালো করে অন্ধকার নেমে এল  । বেলা বাড়ার সাথে সাথে শুরু হল মুষুল ধারে  বৃষ্টি । শ্রাবনের ধারা । নর্দমা ভর্তি হয়ে জল উপচে পড়ছে রাস্তায় । আজ স্কুলে রেইনি  ডে । কি আনন্দ আজকে স্কুলে যেতে হবে না । বড়ছেলে রান্নাঘরে গিয়ে মার কাছে আবদার করলো খিচুড়ি করার । মা মিতালীকে ডেকে  নিল  রান্না ঘরে ।  বৃষ্টির মধ্যেই ছাতা নিয়ে বাবা বেরিয়ে গেল অফিসে । শুরু হয়ে গেল লুডু খেলা । দুপুরে খিচুড়ি আর ডিম ভাজা খেয়ে সব শুয়ে পড়লো বিছানায় । মা গেল বাথরুমে স্নান করতে । বলে গেল , তোরা ঘুমাবি  না কিন্তু , আমি স্নান করে আসছি । স্নান করে এসেই মা চিৎকার জুড়ে দিয়েছে , পই পই  করে বলে গেলাম ঘুমাবি না । সব কটা  ঘুমিয়ে পড়লো । মার হাঁক ডাকে সবাই লাফিয়ে উঠলো বিছানায়। মা একই রকম চিৎকার করে বলছে ,

তোদের দিদি কোথায় ?

এই সেরেছে ! আমরা জানবো  কী  করে দিদি কোথায় ? হয় পাশের ঘরে আছে , নাহলে বাথরুমে গেছে ।

মা বলল , কোথাও নেই । আমি সব জায়গা দেখেছি । বড় খোকা , তুই এখুনি দৌড়ে যা বাস স্ট্যান্ডে । গিয়ে দেখ দেখা  যায় কি না |

মেজটা বলল , দিদি বাস স্ট্যান্ডে কী  করতে যাবে ?

সে টা তোর না জানলেও চলবে ।

ভয়ে সবাই চুপ । কিছুক্ষন বাদে বড় ভাই  ফিরে এল । বলল , মা ভালো করে দেখলাম , কোথাও দিদিকে দেখতে পেলাম না । হাউ হাউ করে কাঁদতে আরাম্ভ করে দিল মা । মা কে কাঁদতে দেখে সব ছেলেরা অবাক । চুপ করে বসে সব দেখতে লাগলো তাদের মায়ের অসহায় কান্না ।

দিবাকর বাবু  অফিস থেকে এসে সব শুনলেন । আবার বেরিয়ে পড়লেন রাজীবের বন্ধুদের সাথে দেখা করতে । দেখা পেলেন দু চার জনের । সবার একই কথা । কেউ জানে না । উল্টে দু – এক জন জানতে চাইলো , কী  হয়েছে কাকু ?

দিবাকর বাবু বললেন , আজ দুপুর থেকেই  মেয়ে কে পাওয়া যাচ্ছে না  ।  কোনো এক সময় সে বেরিয়ে গেছে । বাড়ির কেউ বুঝতে পারে নি ।

তা এর সাথে রাজীবের সম্পর্ক কী  ?

কয়েকদিন আগে রাজীব এসেছিল আমাদের বাড়ি । তোমার কাকীমাকে  বলে ছিল যে সে আমার মেয়ে কে বিয়ে করতে চায় ।

রাজীবের  বাড়িতে খোঁজ করেছিলেন ?

না । তোমরা ওর বন্ধু । তাই তোমাদের কাছে আগে এসেছি ।

সরি কাকু , আমরা এসব কিছুই জানি না ।

এরপর দিবাকর বাবু গেলেন রাজীবদের বাড়ি । রাজীবের বাবা বললেন ,   আপনার মেয়ের ব্যাপারে আমরা কিছু জানি না । অফিসের কাজে সে মুম্বাই গেছে । ফিরতে দেরি হবে । এই টুকুই আমরা জানি । আপনার মেয়ে রাজীবের সাথে কেন যাবে ?  দেখুন , অন্য কারো সাথে অন্য  কোথাও গেছে কি না ?

সুযোগ পেয়ে রাজীবের বাবা দু টো   কথা শোনাতে ছাড়লেন না । একটু উপহাসের সুরেই বললেন , মেয়ে বড় হয়েছে । লক্ষ রাখুন । ওর মা কী  করেন বাড়িতে বসে ? মেয়ে ওনার সামনে দিয়ে চলে গেল আর উনি বুঝতেই পারলেন না । এ সব আষাঢ়ে গল্প কেউ বিশ্বাস করবে ?

দিবাকর বাবুর মনে হল এর চেয়ে দু ঘা জুতোর বাড়ি মারলে বোধ হয় ভালো হত  ছিঃ! ছিঃ ! এত অপমান । নিঃশব্দে মাথা নিচু করে বেরিয়ে এলেন দিবাকর বাবু ।

লজ্বায় মিতালীর মা চলে গেছিল তার বোনের বাড়ি মেদিনীপুরে । কিছুতেই মানতে পারছেন না তার মেয়ের এই  দুঃসাহসিক কাজ । রাজীব আসার পরের দিন তিনি মেয়েকে ডেকে জানতে চেয়ে ছিলেন পুরো বিষয়টা । মেয়ে তো আকাশ থেকে পড়েছিল । কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল , সব মিথ্যে কথা । সে কিছু করলে  সে তো সবার আগে মা কেই বলবে । অনেকক্ষন মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে মিতালীর মা বোঝার চেষ্টা করেছিলেন তার মেয়ে সত্যি কথা বলছে না মিথ্যে কথা বলছে । কেন জানিনা তার মনে হল যে মিতালী সব সত্যি কথা বলছে । আজ মিতালি পালিয়ে যাবার পর তিনি তৎপর হলেন মিতালীর বইয়ের  তাক তন্ন তন্ন করে খোঁজার । যদি কোনো চিঠি পত্র পান । পেলেন একটা মোটা ডাইরি । তিনি জানতেন মিতালি ডাইরি লেখে । কিন্তু সেদিন তার এই কথাটা  মাথায় আসে নি । ডাইরির পাতা উল্টাতেই  বেরিয়ে পড়লো একগাদা ভাঁজ করা চিঠি । একটা একটা করে সব কটা  চিঠি পড়লেন । ডাইরির পাতাগুলো দেখলেন উল্টে পাল্টে । গুম হয়ে থাকলেন অনেকক্ষন  । যা জানার সবই জানলেন । যা বোঝার সবই বুঝলেন । কিন্তু বড্ড দেরি করে ফেলেছেন । এখন আর জেনে বুঝে কোনো লাভ নেই । মাটিতে মিশিয়ে দিয়ে গেছে তার মুখ । আত্মীয়-স্বজন , পাড়া  প্রতিবেশীর  কাছে তার মাথা হেঁট হয়ে গেল । ছিঃ ছিঃ ছিঃ ! ব্রাহ্মণের মেয়ে হয়ে তুই শেষে কি না বিয়ে করলি একটা কায়স্থের  ছেলেকে ?  মিতালীর দাদু বেঁচে থাকলে তো আত্মহত্যা করতেন । আর ভাবতে পারছেন না তিনি । পরের দিন ভোর হতে না হতেই ছোট ছেলে কে নিয়ে চলে গেলেন ছোট বোনের বাড়ি মেদিনীপুরে ।

দিবাকরবাবুকে অনেকেই বলে ছিল থানায় জানাতে ।  বাড়ির কেচ্ছা রাস্তায় নামাতে চান নি তিনি । একদম মুখ বন্ধ করে বাড়ি আর অফিস করে গেছেন । তার কেবলই  মনে হচ্ছে রাজীবের বন্ধুরা সত্যি কথা বলে নি । ওরা  সব জানে । দিবাকর বাবুর এক বিশিষ্ট বন্ধু ছিলেন  জ্ঞানদাচরণ মুখার্জি । সেদিন সন্ধ্যে বেলায় অফিস থেকে ফিরে  গেলেন জ্ঞানদাচরণ বাবুর বাড়ি । পুরনো  দিনের বন্ধু । খুব ভালো সম্পর্ক দুজনের । দিবাকরবাবুকে দেখে হৈচৈ জুড়ে দিয়েছে জ্ঞানদা বাবু । গিন্নি ছুটে এলেন রান্নাঘর থেকে । বললেন ,

বাবা ! দিবাকরদা, কত দিন পরে এলেন । রাস্তা টাস্তা  ভুলে না কি ?

ভুলে ঠিক না । আসলে

কী  আসলে ?

কী  ভাবে বলবো সেটাই বুঝতে পারছি না  ।

মেয়ের বিয়ে ঠিক হলো ?

তাহলে তো বৌঠান , সবার আগে আপনি জানতেন । সে সুখ আমার কপালে নেই ।

একটু ধমকের সুরেই জ্ঞানদা বাবু বললেন , সোজাসুজি বলতো কী  ব্যাপার ?

স্ত্রীকে বললেন , তুমি যাও, দিবাকরের জন্য চা, জলখাবার নিয়ে এস ।

জ্ঞানদাবাবু বুঝতে পারছিলেন যে দিবাকর অনামিকার সামনে কথাটা বলতে দ্বিধা বোধ করছে । সেই জন্য কায়দা করে অনামিকাকে পাঠিয়ে দিলেন রান্নাঘরে ।

সবটা শুনে পাথর হয়ে গেলেন জ্ঞানদাবাবু । শেষের দিকের একটু কথা অনামিকার কানে গেছে । কিন্তু এতটুকু কৌতূহল না দেখিয়ে বললেন , নিন , জলখাবারটা আগে খেয়ে নিন ।

রান্নাঘরে ফিরে  যাচ্ছিল অনামিকা । দিবাকর ডাকলেন , আপনি বসুন বৌঠান । আমার মেয়ে গত পাঁচ দিন ধরে মিসিং । মানে আমি বলতে চাইছি যে সে বাড়ি থেকে চলে গেছে । অনুমান করছি প্রেম ঘটিত ব্যাপার । পাড়ারই একটি ছেলের সাথে । ছেলেটিকে আপনি ভালোভাবে চেনেন । রাজনাথ দাসের ছেলে রাজীব ।

রাজীব  ! মানে আমাদের বঙ্কার  বন্ধু ? কই বঙ্কা তো আমাদের কিছু বলেনি । ও জানে ?

আমার নিশ্চিত  ধারণা যে বঙ্কা , শিবু আর খোকন তিনজনেই জানে । আমি অনেক করে জিজ্ঞাসা করলাম কিন্তু একজনও কিছু বলল না । পরিষ্কার অস্বীকার করলো ।

জ্ঞানদাবাবু বললেন , ঠিক আছে । বঙ্কা  আসুক , আমি দেখছি ।

আরও  কিছুক্ষন থেকে চলে এলেন দিবাকরবাবু ।

তাহলে কী  ঠিক করলি ? মিতালীর ছোট মাসি জানতে চাইলো ।

মিতালীর মা বলে দিল , ওই মেয়ের সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই । ও তো আমাদের কথা এক বারও ভাবে নি । আমাকে মিথ্যা কথা বলেছিল । যে মেয়ে বে  জাতের  ছেলেকে বিয়ে করতে পারে তার মুখ দেখাও  পাপ । তুই একবার চিন্তা কর অনু, বাবা বেঁচে থাকলে কী  হত ? তোর মনে আছে জ্যাঠতুতো দাদার কথা ?

কে নবীন দাদা ?

হ্যাঁ রে । নবীনদাদা | মা কে এসে বলেছিল ,  খুড়ীমা , একটা কথা তোমাকে অনেকদিন ধরে বলবো ভাবছিলাম কিন্তু কী  ভাবে বলবো বুঝতে পারছিলাম না । পাছে দেরি হয়ে যায় তাই আজকেই বলছি ।

মা বলল , কী  এমন জরুরি কথা ?

আমি একটা মেয়ে কে ভালোবাসি । সে ও আমাকে ভালোবাসে ।

সে তো বুঝলাম তা মেয়েটা কে ? আমি চিনি তাকে ?

চেনো । সুবর্ণা ।

সুবর্ণা , মানে আমাদের মাইতি বাবুর ছোট মেয়ে সুবি ?

হ্যাঁ ।

আর বলতে হয় নি  । বাবা তখন ঠাকুর ঘরে নারায়ণ শিলাকে স্নান  করাচ্ছিলেন  । পুজোয় বসলে , তুই তো জানিস , পুজো শেষ না করে বাবা কোনোদিন ওঠেন না । বাবা  শুনতে  পেয়েছিলেন নবীনদাদার কথা । আমিও শুনতে পেয়েছিলাম । আমি তখন বাবার পাশে বসে চন্দন ঘষে ঘষে বাটিতে রাখছি । বাবা তাকালেন আমার দিকে । তাকালেন নারায়ন শিলাগুলোর দিকে । চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করে কী  সব বললেন তারপর পুজো ছেড়ে বেরিয়ে এলেন । দরজার বাইরে থাকতো বাবার খড়ম জোড়া । ওই খড়ম দিয়ে কি মারটাই না মারলে নবীনদাদাকে । বললেন, হারামজাদা , বংশের নাম ডুবাবি । বামুনের ছেলে বিয়ে করবি কায়েতের  ঘরে ? বের হয়ে  যা তুই বাড়ি থেকে । তোর মুখ দেখাও পাপ  । যে বাড়িতে নারায়ন শিলা আছে , সে বাড়িতে তোর মত বিধর্মীর কোন স্থান নেই । জ্যেঠু ,জ্যেঠি কেউ একটা কথাও  বলেনি । এরপর নবীনদাদা সেই যে বাড়ি ছাড়লো আর কোনো দিন বাড়ি ফিরে  আসে নি । শুনেছি সন্ন্যাস নিয়ে নদিয়ায় চলে গেছে । জীবনে আর বিয়ের  নাম মুখে উচ্চারণ করে নি । আমিও সেই বাবার মেয়ে । ওই বাবার রক্ত আমার শরীরে । জীবনে এই মেয়ের মুখ আমি দর্শন করবো না ।

দিবাকর বাবু পড়েছেন মহা ফ্যাসাদে । কোনোদিন রান্নাবান্না করেন নি । বিয়ের পর থেকেই মিতালীর  মা ই সব সামলেছে । একই সাথে রান্নাবান্না আর ছেলে পুলে মানুষ করা । তিনি শুধু  মাসের টাকাটা দিয়েই খালাস । কোনো কিছুই খোঁজ রাখতেন না । মেয়ের ওপর রাগ দেখিয়ে তিনি চলে গেছেন তার বোনের বাড়ি । এখন দিবাকর বাবু কোন দিক সামলাবেন , ঘর না অফিস ?  স্ত্রী চারুলতার বড্ড পিটপিটানি । বাইরের লোক রান্নাঘরে ঢুকতে পারবে না । রান্না ঘর অশুদ্ধ  হয়ে যাবে । পরিষ্কার বলে দিয়েছে , যত  দিন আমি বাঁচবো , রাঁধুনি এই বাড়িতে ঢুকতে পারবে না । পাঁচুর মা বাসন মেজে , ঘর মুছে দিয়ে যায় সকাল বেলায় । তারপর চারুলতা তুলসী জল দিয়ে সমস্ত বাসন ধোবে । সারা বাড়িতে ছেটাবে গঙ্গা জল । বলে , ছোট ছোট বাচ্চারা  থাকে , একটু  শুদ্ধ মত থাকাই ভালো ।

কী  বলবে দিবাকর ভেবে পায়  না । এখনকার দিনে এত ছুঁচিবাই হলে চলে ? কে শুনবে কার কথা ? বাসন মাজার বৌটা বলে ছিল , বাবু , আমার মেয়ে ভালো রান্না করে । ও তো বাড়িতে বসেই আছে । ওকে বলবো যে কয়দিন গিন্নি মা না আসছেন সে ক ‘ দিন ও দুবেলা রান্না করে দিয়ে যাক । চারুলতার কথা ভেবে দিবাকর আর সাহস পায়  নি  হ্যাঁ বলতে । একবার যদি এই কথা চারুর কানে যায় তাহলে দক্ষযজ্ঞ বাঁধিয়ে দেবে । সেদিন গেছিল সকালে গ্যাস জ্বালিয়ে চা করতে । গরম জল চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে একাকার  কান্ড । মাঝখান থেকে হাতে লেগে চায়ের কাপটা গেল ভেঙ্গে । পাঁচুর মা এসে সব পরিষ্কার করে । তারপর থেকে দু বেলা  বাইরেই চা খেয়ে নেয় । ছেলেদের বলে দিয়েছেন সকালে খিচুড়ি আর রাত্রে  সেদ্ধ  ভাত । আর অন্য  কিছু হবে না । মুড়ি ,পাউরুটি ,বিস্কুট সব কেনা থাকবে , খিদে পেলে খেয়ে নেবে ।

অফিস থেকে এসে গ্যাস জ্বালিয়ে ভাতের হাঁড়িটা বসিয়ে দিয়েছে অভেনে , ঠিক সেই সময় এসে হাজির জ্ঞানদাচরণ আর তার স্ত্রী । দিবাকরকে রান্নাঘরে ওই অবস্থায় দেখে সে তো হেসেই খুন । বলে , দাদা , সব পুরুষ মানুষেরই একটু আধটু রান্না শেখা  উচিত । মেয়েদের তো আপনারা একদম দাসী বাদী করে রেখে দিয়েছেন । দু দিন যে বাপের বাড়ি গিয়ে বিশ্রাম নেবে তার উপায় নেই ।   আপনি উঠুন  এখান থেকে । আমি দেখছি । আর বলছি দিদিভাই যতদিন না আসছে আমি দুবেলা রান্না করে আমার কাজের ছেলে মদন কে দিয়ে পাঠিয়ে দেব । বাচ্চা গুলো তো খাবে না কি ? আপনি ওর সাথে কথা বলুন আমি চা পাঠিয়ে দিচ্ছি ।

জ্ঞানদা বাবু বললেন , তুমি ঠিকই ভেবেছ । বঙ্কা জানে ব্যাপার টা  । শুধু বঙ্কা কেন বঙ্কা , শিবু  আর খোকন তিনজনেই জানে । জানে মানে রেজিস্ট্রি হয়ে গেছে গত মাসে ।তোমার মেয়ে মিতালীর এক বন্ধু আরাধনা আর এই তিন মক্কেল সাক্ষী হিসাবে সই  করেছে ।  ভেতরে ভেতরে অনেকদিন ধরেই পরিকল্পনা চলছিল । রাজীবের অফিসের একটা ব্রাঞ্চ আছে মুম্বাইতে । ওখানেই গেছে । কিন্তু আমি আশ্চর্য হচ্ছি একটা কথা ভেবে চারুলতা কিছুই বুঝতে পারলো না কেন ? মিতালি ওর জিনিসপত্র একটা সুটকেসে গুছিয়ে নিয়েছে । এরা  তো ট্রেনে উঠিয়ে দিয়ে এসেছে ওদের । চারুর চোখ এড়িয়ে সুটকেস নিয়ে মিতালি বাড়ি থেকে বেরলো কী  ভাবে ?

সুযোগটা পেয়েছিল কাকতালীয় ভাবে । আমি যতদূর শুনেছি  বৃষ্টির জন্য ছেলেরা বাড়িতে ছিল । দুপুরে খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়েছে । চারু গেছিল স্নানে । ছেলেদের বলেছিল জেগে থাকতে । সব কটাই ঘুমিয়ে   পড়েছে । এই সুযোগে মিতালি বেরিয়ে পড়েছে ।

যাক গে  , যা হবার তা তো হয়েছে । এখন তোমাদের কি ইচ্ছা ? মেয়ে জামাইকে নিয়ে এসে সামাজিক মতে বিয়ে দেবে না দেবে না ?

চারুর এখন যা মানসিক অবস্থা তাতে বিয়ে দেওয়ার কোনো প্রশ্নই নেই । কবে সে শান্ত হবে জানি না ।   দেখি , আসুক তো আগে ।

মুম্বাইয়ের চার্চ গেটের থেকে  কিছুটা দূরে রাজীবের অফিস । মালিক মাড়োয়ারি । নতুন ব্রাঞ্চ । মাত্র পাঁচজন স্টাফ । কলকাতা অফিস থেকে এখানে কেউই আসতে  চায় না । তার দুটো কারন । এক তো বাড়ি ছেড়ে এতদূরে থাকা আর দুই , এখানে খরচ অনেক বেশি । এত অল্প মাইনে তে সামলানো মুশকিল । রাজীব স্বেচ্ছায় আসতে  চাওয়ায় মালিক খুব খুশি । থাকার ব্যবস্থা সে নিজেই করে দিয়েছে । মাইনেও দিয়েছে বাড়িয়ে । থাকা খরচ নেই । মাইনে  যা পায়  তাতে দুটো পেট ভালোভাবেই চলে যায় ।

মাস দুয়েক বাদেই মিতালি লক্ষ করলো পরপর দুমাস তার পিরিয়ড হয় নি । মাঝে মাঝে শরীরটা ঝিম মারছে । গা গুলাচ্ছে । সেদিন তো বেশ খানিকটা বমি হয়ে গেল । রাত্রি বেলায় রাজীবকে জানালো পিরিয়ড বন্ধ হওয়ার কথা । রাজীব একটা মাথা মোটা । বলে , জল হাওয়া পাল্টাবার জন্য শরীর খারাপ হতে পারে । শরীর খারাপ হয়েছে বলে মনে হয় তোমার পিরিয়ড বন্ধ হয়েছে । হেসে ফেলেছিল মিতালি তার বরের জ্ঞানের  বহর দেখে । বলে ছিল , এটা  অন্য কারন । তুমি বুঝবে না ।

বুঝিয়ে দাও । তোমাদের মেয়েদের ব্যাপার আমরা ছেলেরা বুঝবো কী  করে ?

ওকে , কালকে সকালে দেখাবো ।

কী  দেখাবে ?

একটা ম্যাজিক । পরের দিন সকালে একটা  কাঁচের শিশিতে প্রথম পাস্ করা ইউরিন খানিকটা ধরে রাখলো মিতালী । একটা কাচের ছোট বাটি এনে রাখলো টেবিলের ওপর । রাজীবকে বলল , এবার দেখ । আমি প্রথমে এক টেবিল চামচ চিনি এই বাটিতে রাখছি । এরপর এই শিশি থেকে এক টেবিল চামচ ইউরিন এই বাটিতে ঢালছি । যদি চিনি দলা বাঁধে তাহলে আমি প্রেগন্যান্ট আর যদি  দলা না বাঁধে তাহলে আমি প্রেগন্যান্ট  নই  । একটু বাদেই দেখা গেল চিনি দলা বেঁধেছে । চিৎকার করে উঠলো রাজীব ,তাহলে তুমি মা হতে চলেছ ? মিতালীকে জড়িয়ে ধরে কোলে তুলে নিল । মিতালি বলল , ছাড় ,ছাড় ,  এটা  হোম মেড টেস্ট হলো । আজ অফিস থেকে  ফেরার পথে একটা প্রেগ কালার  টেস্ট কিট  কিনে আনবে ।

ওটা দিয়ে কী  হবে ?

মজা করে মিতালি বলল , ওষুধের কম্পানিতে কাজ কর ,কিছু তো জানা উচিত । এখনকার অল্প বয়সী মেয়েরা তো কিট  পকেটে নিয়ে ঘুরে বেড়ায় । সন্দেহ হলেই নিজেরা টেস্ট করে নেয় ।

বলো কী  ? আজ কালকার মেয়েদের এই অবস্থা ?

হ্যা মশাই , সবাই তো আর আপনার মত সুবোধ বালক নয় । কাজেই মেয়েদের দরকার পড়ে ।

পরের দিনের টেস্টেও পজিটিভ কালার এলো । এর পর ডাক্তারের সাথে এপয়েন্টমেন্ট করা ।

কি ভাবে এতগুলো মাস কেটে গেল তা না বুঝতে পারলো মিতালি না বুঝতে পারলো রাজীব । দিন যত  এগিয়েছে রাজীব তত বেশি যত্ন নিয়েছে মিতালীর । শুধু অফিসের সময়টুকু বাদ দিয়ে সারা দিন  বাড়িতে । সব কাজ নিজের হাতে সামলাচ্ছে । মিতালীকে প্রায় কিছুই করতে দেয়  না । অফিসে বস কে সব বলেছে । বস ভালো মানুষ। রাজীব কে খুব ভালোবাসেন । সব রকম সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন । বলেছেন , মিতালীর এবং বাচ্চার হসপিটাল খরচ কম্পানি বহন করবে । দেখতে দেখতে এসে গেল নির্দিষ্ট দিন । ডাক্তার ভেবেছিলেন সিজার করতে হবে । হয় নি । একদম নরমাল ডেলিভারি । খুব সুন্দর ফুটফুটে ছেলে হোল। ছেলের নাম রাখলো  রূপক ।

দিন পনের  বাদে চারুলতা বাড়িতে ফিরে  আসলো  রাতের অন্ধকারে যাতে কেউ দেখতে না পায় । পাঁচুর মা যখন কাজে আসতো চারুলতা তার ঘরে দরজা জানলা বন্ধ করে চুপটি করে বসে থাকতো । বাইরের কারোর সাথে দেখা সাক্ষাৎ পর্যন্ত করতো না । অনামিকাকে নিষেধ করা হয়েছিল রান্না পাঠাতে । চারুলতার আগমন বার্তা দিবাকর তার বৌঠানকে যথা সময়ে দিয়ে এসেছিল । বাসনের পাহাড় দেখেই পাঁচুর মা র সন্দেহ হয়েছিল । এতদিন  হাঁড়ি ,  কড়াই  এঁটো বাসনের সাথে থাকতো না । এখন দুবেলা তাদের দেখা মিলছে । একদিন সাহস করে বলেই বসলো ,গিন্নি মা , আমি জানি তুমি এসেছ । তুমি কেমন আছ ? ভালো আছ তো ? আমার প্রণাম নিও । এর পরে আর নিজেকে লুকিয়ে রাখার আবশ্যক বোধ করলো না   চারুলতা । ঝড়ের গতিতে দরজা খুলে বাইরে এসে মুখ ঝামটা দিয়ে বলল , কৃতার্থ করেছ আমাকে । এখন যাও , মাইক নিয়ে বেরিয়ে পড় । বাড়ি বাড়ি গিয়ে জানিয়ে এস যে গিন্নি মা এসেছে । তা না হলে তো তোমার আবার পেটের ভাত হজম হবে না ।

এ কি  কতা  , মা জননী  ? আমি পাড়ার নোক কে বলতে যাবো কেন ? আর ,এটা  কী  একটা বলার মত খপর ? তুমি এসেছ তাই বললাম । যাই মা আবার ওবেলায় আসবো ।

অনামিকা একদিন এল । অনেক করে বোঝালো চারুলতাকে । যা হবার হয়ে গেছে । এখন সব মেনে না নেওয়া ছাড়া উপায় কি ? তার ওপর নাতি হয়েছে । শুনলাম ওরা  সব কলকাতায় আসছে ।

তাতে আমার কী  ? আমার কাছে তো আসছে না । আসছে নিজের অসুস্থ বাবাকে দেখতে । ওদের সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই ।

এ কথা বললে কী  আর চলে ?  দিনক্ষণ পাল্টেছে । মেয়ে মানুষের এত জেদ কী  গো ? এই তো সেদিন গোঁসাই বাড়ির বড় ছেলে বিয়ে করে ঘরে তুললো বাগদি বাড়ির মেয়েকে । মেয়েটা আবার স্কুলে পড়ায় । বাড়ির সবাই মেনে   নিয়েছে । গোঁসাই গিন্নির সাথে সেদিন রাস্তায় দেখা । দেখি , নতুন বৌয়ের সাথে বেরিয়েছে কেনাকাটা করতে ।

ফস করে জ্বলে উঠলো চারুলতা । বলল, মানে , কী  বলতে চাও তুমি । একটা কায়স্থর ঘরের ছেলেকে আমি ঘরে তুলবো?  সে যে পারে পারুক , আমি পারবো না ।

সে না হয় না পারবি , তাই বলে নাতিটার মুখ দেখবি না ? দেখতে দেখতে পাঁচ বছর বয়স হয়ে গেল নাতির ।

কে নাতি ? কার নাতি ? ও আমার কেউ না । ওকে আমি নাতি বলে স্বীকার করি না । আমি কী  বুঝি না কিছু যে এটা  ওদের একটা চাল । নাতি কে আমার কাছে ঠেলে দিয়ে ভেবেছে আমি ওদের মাফ করে দেব । না , তা কখনই হবে না । এটা  ভেবে থাকলে ওরা  ভুল ভেবেছে । খাঁটি ব্রাহ্মণ পন্ডিতের মেয়ে আমি । আমার বাবা ছিলেন পুরোহিত । কায়স্থের বাড়ি পুজো করলে , বাড়ি ফিরে আগে গঙ্গা জল গায়ে মাথায় ছিটিয়ে , ধুতি পাল্টিয়ে তবে ঘরে প্রবেশ করতেন । কোনো অবস্থাতেই ওই কায়স্থ ঘরের ছেলে আমার বাড়ির চৌ কাঠ ডিঙাতে পারবে না । এই আজ আমি তোমাকে বলে দিলাম ।

রাজীবের বাবা মারাই  গেলেন । শ্রাদ্ধ সংক্রান্তি মিটে গেলে রাজীবের মা রাজীবকে ডেকে বললেন , বাবা রাজীব , আমার মনে হয় তোমার একবার ওই বাড়িতে যাওয়া উচিত । বৌমার মা র কাছে একবার ক্ষমা চেয়ে নাও ।

সে তা আমি পারি মা । কিন্তু উনি তো আমাকে উনার বাড়িতে পদার্পন  করেত নিষেধ করেছেন ।

রাগের মাথায় মানুষ কত কথাই না বলে । তোমার বাবা কম বলেছে । আমি চুপ করে শুনে গেছি । দুজনে একসাথে কথা বললে ঝগড়া হয় ।

কিন্তু মা , উনি আমার জাত তুলে অপমান করেছেন । বলেছেন , আমরা ছোট জাত  । আচ্ছা  , এই সমস্ত কথার কোনো মানে আছে ? মানুষ মানুষকে ভালোবাসবে  কি জাতের  ভিত্তিতে ? এই সব কথা ভাবাও তো অন্যায় ।  উনি তোমাদেরও অপমান করেছেন ।

কোনো অপমান করেন  নি বাবা । ব্রাহ্মণ বংশের মেয়ে কায়স্থ বংশের ছেলেকে মেনে নিতে পারেন নি । কষ্ট পেয়েছেন । বংশের আভিজাত্য থেকে এটা  হয় । অতো  ধরতে নেই , বাবা । তাছাড়া ,রূপক তো  তারও  নাতি । নাতিকে দেখার সাধ তারও  তো হয় । বৌমা তার নিজের মেয়ে । কতদিন তিনি নিজের মেয়ে কে দেখেন নি । তার দুঃখটা বোঝো , বাবা । যাও । রাগ পুষে রাখতে নেই । ও তে কারোর মঙ্গল হয় না ।

ঠিক আছে মা , আমি যাবো ।

এতক্ষন একটা কথাও বলে নি মিতালি । এবার সে বলল , না মা , ও হবে না । আমার মা ওকে অপমান করেছে । কেন ও সেধে আবার অপমানিত হতে যাবে ?

বৌমা , মা বাবা সন্তান কে জন্ম দেওয়ার পর তাদের যেমন কিছু দায়িত্ব থাকে তেমন কিছু অধিকারও থাকে । সেই অধিকার থেকে যদি তারা ছেলে -মেয়েকে শাসন করে তাহলে সে টা  কী  অপরাধ ?

আমি মানছি আপনার কথা । কিন্তু আমার মা তো শাসন করেন নি । ওকে তাড়িয়ে দিয়েছেন । ওর অপরাধ কি না ও ব্রাহ্মণ বংশে  জন্ম গ্রহণ করে নি । ব্রাহ্মণ বংশে  জন্ম গ্রহণ না করলে সে মানুষ নয় ? এটা  মানতে পারছি না আমি । কোনো স্ত্রী তার স্বামীর অপমান সহ্য করবে না । আমি আপনাকে হাতজোড় করে অনুরোধ করছি ওকে আপনি আমার মায়ের কাছে আর পাঠাবেন না । আমাকে ক্ষমা করবেন ,মা ।

আমি যাবো । হঠাৎ কোথা থেকে রূপক এসে হাজির ।  বলে  , আমি যাবো । দেখবো দিদান আমাকে কী  ভাবে তাড়িয়ে দেয়? আমাকে একবার দিদানের কাছে নিয়ে চল  ।

রূপকের পীড়াপীড়িতে শেষ পর্যন্ত ঠিক হলো রোববার বিকেলে মিতালীর বাপের বাড়ি যাওয়া হবে । যাওয়া হল রূপকের দিদান বাড়ি । খবর  আগে থেকে দেওয়া হয়েছিল । বিয়ের পর এই প্রথম মেয়ে জামাই আর নাতি আসছে । দিবাকর বাবু যত  পেরেছেন কেনা কাটা করেছেন । খাবারের এলাহী ব্যবস্থা । জ্ঞানদাচরণ বাবু আর অনামিকাকে খবর দেওয়া হয়েছে । যথা সময়েই তারা এসে গেছে । বিকেল  চারটে । একটা উবার ক্যাব এসে থামলো বাড়ির সামনে । একে একে  তিনজনেই নেমে এল ।  তিনজনকেই ঘরে নিয়ে বসালেন দিবাকর বাবু । সবাই আছে নেই শুধু একজন । সে চারুলতা । নিজের ঘরের দরজা জানলা বন্ধ করে বসে থাকলেন । সবাই ডাকা ডাকি করতে লাগলো । কোনো জবাব নেই । সব চেয়ে বেশি ডাকলো রূপক ।

দিদান , আমি এসেছি । দরজা খুলে দেখ । তোমার নাতি রূপক ।

কোনো  সাড়াশব্দ নেই । দরজা খোলা তো দূরের  কথা । সবাই যখন নিশ্চিত হলো যে চারুলতা দরজা খুলবে না তখন  ফিরে যাওয়াই  সাব্যস্ত   হলো । কেউ কিছুই খেল না । কোনো উপহারই কেউ গ্রহণ করলো না । যেখানকার জিনিস সব সেখানেই পড়ে  থাকলো । গাড়ি বাইরে দাঁড়িয়েই ছিল । ফিরে  গেল তিন জনে ।

সবাই চলে গেলে চারুলতার বড় ছেলে দরজায় টকটক করে শব্দ করে বলল , মা , দিদিরা চলে গেছে । এবারে দরজা খোলো ।

দরজা খুললো না । কোনো সাড়াও দিল না ।

অনামিকা ডাকলো , চারু , দরজা খোল । আমরা তোর জন্য বসে আছি ।

কোনো সাড়াশব্দ নেই চারুলতার । অনামিকার মনে কু  গাইলো ।  বড়ছেলেটাকে বলল , পেছনে গিয়ে দেখতো কোনো জানলা খোলা আছে কি না ? মনে হয় ঘুমিয়ে পড়েছে । পেছন দিকের একটা জানলার ছিটকিনি খারাপ । বড়ছেলে জানতো সে টা  । সেদিন বৃষ্টির সময় জানলা বন্ধ করতে গিয়ে দেখে জানলার ছিটকিনি টা  খারাপ । বন্ধ হয় না । আজকে গিয়ে একটু ঠেলে দিতেই পাল্লা টা  খুলে গেল । ভেতরে উঁকি দিয়েই চিৎকার করে উঠলো সে । দৌড়ে এল বাড়ির সবাই । সিলিং ফ্যানের সাথে কাপড় জড়িয়ে ঝুলছে চারুলতা । খবর দেওয়া হল পুলিশে । খবর রটে  গেল পাড়াময় । দেখতে দেখতে জমে উঠলো ভিড় । দরজা ভেঙে নামানো হলো চারুলতার নিথর দেহটা । বংশ মর্যাদা রক্ষা করতে নিজের  প্রাণ দিয়ে দিল চারুলতা ।

Print Friendly, PDF & Email
Previous articleছুটি (৩য় পর্ব)
Next articleকাজীর বেণু
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments