ললিতাদিত্য মুক্তাপীড়,

যাঁর বিক্রমে কম্পমান ছিল সারা কাশ্মীর।

আজি হতে তের শতাব্দী আগেতাঁরে লয়ে মোর গাথা,

পাহাড়ের দেশ কাশ্মীর ছিল ফুলে ফলে রূপকথা।

সেই কাশ্মীরে ললিতাদিত্য রাজন তেজস্বান,

বিধর্মী সবে হানা দিততবে নিয়তই হতমান।

রাজবিক্রমে বারে বারে হত সমূলে সর্বনাশ,

মুক্তাপীড়ের সবল করেই পাহাড়ী দেশের রাশ।

আরবাধিপতি খলিফা হিশাম বুঝি ভয়ানক ক্ষুব্ধ,

কাশ্মীররাজ ললিতাদিত্যে কেমনে করেন জব্দ !

বারেবারে তিনি মুক্তাপীড়ের পরাক্রমের কাছে,

পরাজিত হায়এর থেকে আর লজ্জার কি বা আছে !

যে কোন মূল্যে মুক্তাপীড়ের মুণ্ডটি তিনি চান,

সিন্ধ শাসক জুনেইদ প্রতি জারী তাঁর ফরমান।

যেন তেন প্রকারণে কর কাশ্মীর রাজে দমন,

নয়ত তোমারই মুণ্ডচ্ছেদশিয়রে দাঁড়ায়ে শমন।

ললিতাদিত্য অদ্বিতীয় বুদ্ধি,বীরতা,বল

সমুখ সমরে হারানো কঠিনকর এবে কৌশল।

অন্য উপায় খুঁজে বার করবিশ্বাসঘাতী কোনো,

অর্থের বশে বশীভূত রে প্রহরার ত্রুটি জানো।

সামান্যতম ছিদ্র লভিলে সহসা আক্রমণে,

ছত্রভঙ্গ করো কাশ্মীর পশ্চাত হতে রণে।

যেমন চিন্তা কাজেও তেমনপৃথিবীর আদি থেকে,

ভাল মন্দের দ্বন্দ্বের কথা শোনা যায় দিকে দিকে।

কুটিল মানুষ বিশ্বাসঘাতী সংখ্যায় অগণন,

জুনেইদ খানও খুঁজে পেল হেন কাশ্মিরী একজন।

মুক্তাপীড়ের সৈনাধক্ষ্য কিন্তু ভীষণ লোভী,

অর্থের মোহে করে সে পাচার রাজপ্রহরার ছবি।

চারিদিক জুড়ে সারা কাশ্মীরে অতি সতর্ক প্রহরা,

শুধু পশ্চিমে এক গিরিকন্দর দুর্গম স্থান ছাড়া।

যার সমুখেই বহমান এক উথালপাথাল

নদী,

তবে আরবী সৈন্য গিরিকন্দরে কোনমতে আসে যদি,

দীর্ঘ পথের অন্তে মিলিবে শ্রীনগর রাজধানী,

অতর্কিতেই কাশ্মীর দেশে প্রলয়ের হাতছানি।

খলিফা হিসামজুনেইদ খান দুয়ের অট্টহাসি,

মুক্তাপীড়ের এইবারে হবে চরম সর্বনাশই।

সবার অলখে গিরিকন্দরে সিন্ধ আরবীয় সেনা,

দুর্গম পথ আঁধারের মাঝে যায় না কিছুই চেনা।

মশালের আলো তাও বুঝি নিভেকোথা হতে বহে ঝড় !

জানেনা কেহই কতদিনে তারা পৌঁছাবে শ্রীনগর !

জুনেইদ খানও চিন্তাক্লিষ্টতবে কি যাবে সে ফিরে !

কিন্তু পিছনে খলিফা হিসামশমন দাঁড়ায়ে শিয়রে।

ঊষার লগণললিতাদিত্য নিদ্রিত নিজ কক্ষে,

অদ্ভুত এক স্বপনে রাজার শিহরণ জাগে বক্ষে।

ইষ্টদেবতা দীপ্ত অর্ক কহেন মুক্তাপীড়ে,

বিধর্মী সেনা কত সহস্র ঝিলম নদীর তীরে।

প্রবেশ করেছে গিরিকন্দরেউদ্দেশ শ্রীনগর,

এখনো রাজন্তোমার দুচোখে হেরি যে ঘুমের ঘোর !

জাগো নরপতি, সময় অল্পবাজাও তুর্য্য ভেরী,

বিনাশ কর হে দুষ্টেরে আজিযারা কাশ্মীর অরি।

ঘুম ভেঙে যায় মুক্তাপীড়েরস্বপ্ন নাকি সত্যি,

ভোরের স্বপনকহে যে সকলে অবশ্য আছে ভিত্তি।

জরুরী সভায় অমাত্যগণে ব্যক্ত সকল কথা,

বিশ্বাসঘাতী সৈনাধ্যক্ষসে হাজির সেথা।

কহেমহারাজ,স্বপ্ন কি কভু বাস্তব হতে পারে !

শত্রুর দল কেমনে হাজির দুর্গম নদীতীরে !

গিরিকন্দরে প্রবেশ সেতঅনায়াস নয় মোটে,

স্বপ্নের পিছে ছোটার অর্থ নির্বুদ্ধিতা বটে।

রাজার সঙ্গে প্রধানামাত্যে রুদ্ধকক্ষে শলা,

সৈনাধক্ষ্যতার মনে কি চলছে অন্য খেলা !

পাঠালেন নৃপ সৈনাধ্যক্ষে দূর কলিঙ্গ দেশে,

চলেন নিজেই ঝিলমের তীরে এক ফকিরের বেশে।

দূর হতে হেরিচক্ষুস্থিরদ্রুত ফিরিরাজধানী,

গিরিকন্দর বহির্দুয়ারে স্থাপন করেন বাহিনী।

তীরের অগ্রে অগ্নিগোলক অন্দরে নিক্ষিপ্ত,

গিরিকন্দরে আরবীয় সেনাচিহ্ণও বুঝি লুপ্ত।

অন্যপ্রান্তে চেনাবের তীরে শত্রুসৈন্য শিবির,

অতর্কিতেই সেথা আগ্রাসী ললিত মুক্তাপীড়।

বিধ্বস্ত বিধর্মী সবেজুনেইদ খান হত,

বিশ্বাসঘাতী সৈনাধ্যক্ষ অনায়াসে হয় ধৃত।

খলিফা হিসাম কাশ্মীরপতিআশা যে অধুরা হায়,

স্বয়ং দেবতা যাঁর রক্ষায়তাঁর যে হবেই জয়

এহেন কত না ঘটনা জড়ায়ে ললিতাদিত্য সনে,

বাস্তব তথা কল্পনা যেথা মেশে ছন্দের টানে।

দিগ্বিজয়ী বীর সম্রাট ছিলেন মুক্তাপীড়,

তাঁর অধীনে ভারতবর্ষে অর্ধেকই কাশ্মীর।

উত্তর থেকে পশ্চিম হয়ে পূর্ব কি দক্ষিণ,

ভারতের বহু স্থানেই তাঁর পতাকাটি উড্ডীন।

বিদেশীশক্তি তুর্কী,আরব,উজবেক,আফগান,

মুক্তাপীড়ের পরাক্রমে বারে বারে সবে ম্লান।

এমন কি অতি শক্তিশালী তিব্বত অধিপতি,

ললিতাদিত্য সমখে তিনিও স্বীকার করেন নতি।

রণাঙ্গণেই যদিও সতত ব্যাস্ত মুক্তাপীড়

তথাপি ছিলেন প্রজাবৎসল,বুদ্ধিমান ধীর।

বন্যার রোধে তাঁর কৌশল হতবাক হয়ে হেরি,

কেমনে করেন বাঁধ নির্মাণ উত্তাল নদী ঘিরি

অনুর্বরকে উর্বর করিচাষের যোগ্য জমি,

কাশ্মীর তাঁর সুশাসনে ছিল সুজলা সুফলা ভূমি।

পঁচাশি সৌধে নির্মিত তাঁর সূর্যের মন্দির,

বিধর্মী সবে করেছে ধ্বংস,তবু উন্নত শির।

বিশালাকার সাম্রাজ্যে তিনি একক অধীশ্বর,

ইতিহাসে তাঁর নামটি আজিও স্বর্ণলিপনে ভাস্বর।

এহেন শূর পরাক্রমীর করুণ মৃত্যুকাহিনী,

অশ্রুধারায় ভাসায় কপোল অমল      স্রোতস্বিনী।

কাবুল ছাড়ায়ে আরও উত্তরে সমরাভিযানে তিনি,

সহসা প্রবল তুষার ঝটিকাবিপর্যস্ত বাহিনী।

পিছল পাহাড়ী পথে রাজনের অশ্বটি বুঝি ক্লিন্ন,

সৈন্যদলের সঙ্গে নৃপের যোগাযোগ হায় ছিন্ন।

আকাশের নীচে তামস নিশীথে ললিতাদিত্য একা,

হিমেল বাতাস,পাহাড়ী শ্বাপদকি আছে ভাগ্যে লেখা !

এমন সময় প্রকৃতির রোষ,ওফ্ কি ভয়াল ভীষণ,

মুষলধারায় তুষার বরষে,অশনি,প্রভন্জন।

প্রতাপান্বিত ললিতাদিত্য একাকী অসহায়,

বরফের মাঝে প্রোথিত দেহটি শমনের কব্জায়।

সহস্রাধিক কাশ্মিরী সেনাএকই ললাটঁভূষণ,

অবশেষে ইতি তিনযুগ ব্যাপী মুক্তাপীড়ের শাসন।

নেতৃবিহীন কাশ্মীরদেশে প্রবল মাৎসন্যায়,

বিশালাকার সাম্রাজ্যটি খণ্ড খণ্ড হায়।

ললিতাদিত্য মুক্তাপীড়ের কিংবদন্তীসম কাহিনী,

অজ্ঞাত মোরাকজনাই হায় তাঁহার নামটি জানি।

কাশ্মীরে ভূমে আজও খুঁজে পাবে নৃপের চরণ চিহ্ন,

এমন মানব আবির্ভাবেই যুগে যুগে দেশ ধন্য।

Print Friendly, PDF & Email
Previous articleবারাণসী বিজয়।
Next articleঅঙ্ক
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments