অবশেষে চাকরিটা পার্মানেন্ট হলো শুভেন্দুর । দেখতে দেখতে দশটা বছর হয়ে গেল । প্রথমে ঢুকেছিল ডেপুটেশন ভ্যাকেন্সিতে । তাও মাত্র চার মাসের জন্য । চার মাস পরেই আবার বেকার । তবে লাভ হয়েছিল একটা । ভালো পড়াবার দৌলতে কর্তৃপক্ষের নজরে এসেছিল শুভেন্দু । তাকে রেখে দেওয়া হয় একজন পার্টটাইমার হিসাবে । মাইনে অতি নগন্য । টিউশনি করার সুযোগটা থাকলো । এতদিন পরিচিতির অভাবে সে পথও বন্ধ ছিল । ঠাকুরের আশীর্বাদে ছাত্র ছাত্রীর সংখ্যা বাড়তে লাগলো হুহু করে । আর একটা জিনিস বাড়তে লাগলো একই সাথে । শুভেন্দুর বয়স । সরকারি পরীক্ষায় বসার বয়স পার হয়ে গেছে অনেকদিন আগেই । বেসরকারি কাজ পেতে পারে । পায় নি । বড্ড অলস প্রকৃতির ছেলে । একবার গেছিল বালিগঞ্জে এক লেডি এডভোকেটের কাছে । পলিটিক্যাল সায়েন্সের ছাত্র সে । আইনের ওপর ছিল আলাদা উৎসাহ । শুভেন্দুর বড়দাই ব্যবস্থা করেছিলেন । কিন্তু বিধি বাম । ভদ্রমহিলা তার ব্যক্তিগত অনেক কাজই তাকে দিয়ে করাত । নির্দিষ্ট সময়ের বাইরে তাকে করতে হত সেই সব কাজ । ভালো লাগে নি শুভেন্দুর । কয়েকমাস করেই ছেড়ে দিল । এর কয়েকমাস বাদেই ডেপুটেশন ভ্যাকেন্সিতে স্কুলে কাজটা পেয়েছিল । যখন দেখলো সরকারি চাকরির বয়স অতিক্রান্ত , হাল ছেড়ে দিল সে । একজনের সুপারিশে ধরলো এক রাজনৈতিক নেতাকে । যথেষ্ট প্রভাবশালী । তাদেরই পরামর্শে কেস ফাইল করলো স্কুলের নিয়ম নীতির বিরুদ্ধে । সবটাই সাজানো । উভয় পক্ষের সম্মতিতেই ইচ্ছাকৃত ভুল করলো স্কুল । কেস জিতলে শুভেন্দুকে দিতে হবে মোটা রকম টাকা । সাজানো কেস । জিততে সময় লাগলো না । চাকরিটা পেয়ে গেল শুভেন্দু । এসব আজ থেকে বহু বছর আগেকার কথা ।
শুভেন্দুর মার বয়স হয়েছে । দাদা বৌদি এবং তাদের একমাত্র মেয়ে সৌমিলি একই বাড়িতে থাকে । দাদা বৌদি দুজনেই কর্মরত । সৌমিলি পড়ে একটি নামি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে । বাড়িতে রান্নার লোক আছে । কিন্তু বৌদি নন্দিনীর সাথে শুভেন্দুর মায়ের সাপ নেউলের সম্পর্ক । কেউ কাউকে সহ্য করতে পারে না । প্রতিক্ষেত্রেই বৌদি দাদার সমর্থন পায় । তিরস্কার জোটে মায়ের কপালে । বহু সময় শুভেন্দু দেখেছে মা কিছু একটা বললেই বৌদি তেড়ে আসে । চিৎকার করে বাড়ি মাথায় করে । ছুটির দিনে ছাদে কাপড় মেলতে গিয়ে পাশের বাড়ির জেঠিমাকে উঁচুস্বরে শাশুড়ির নামে নিন্দা মন্দ করে । পাশের বাড়ির জেঠিমার আবার পাড়া বেড়াবার স্বভাব । সুতরাং শুভেন্দুদের বাড়ির কথা পাঁচ কান হতে সময় লাগে না । শুভেন্দুর হয়েছে মহাজ্বালা । না পারে কিছু বলতে না পারে সহ্য করতে । দাদাকে আলাদা করে বলতে গেছিল বৌদিকে বোঝাবার জন্য । তাতে হিতে বিপরীত । দাদা তাকে পরিষ্কার বলে দিল সাংসারিক ব্যাপারে মাথা না গলাতে । তারপর থেকে সে আর কোনো ব্যাপারে কোনো কথা বলে নি ।
সেদিন রাত্রে বৌদি তাকে ডেকে পাঠালো । কফি নিয়ে এসে বসলো টেবিলে । দাদা ল্যাপটপ নিয়ে অফিসের কাজ ব্যস্ত । বৌদি বলল , ঠাকুরপো , চাকরিতো পাকা হলো এবার তো বিয়ের কথা ভাবতে হয় । এরপর সব চুল উঠে গেলে টেকো বরের জন্য আর মেয়ে পাওয়া যাবে না । একটু লজ্বালজ্বা মুখ করে শুভেন্দু বলল , সে তোমরা যা ভালো বোঝো । তুমি আছ , দাদা আছে , মা আছে । আমি কী বলবো ?
তুমি তো আচ্ছা ছেলে । বিয়ে করবে তুমি আর মত দেবে পাড়া প্রতিবেশী । হ্যাঁ বা না কিছুতো একটা বলবে ?
খানিকটা মাথা চুলকে শুভেন্দু বলল , আমার কোনো আপত্তি নেই । এরপরে বিয়ে করলে বাচ্চা স্কুলে পড়তে পড়তেই রিটায়ার করে যাবো ।
শোনো আমি একটা মেয়ে দেখেছি । গ্রাজুয়েট । ফর্সা । দেখতে শুনতে ভালো । বয়সে তোমার চেয়ে অনেকটাই ছোট | স্কুল মাস্টারের সাথে মেয়ের বিয়ে দিতে বাড়ির লোকের কোনো আপত্তি নেই । তবে মেয়ের একটাই দোষ । একটু ঠোঁট কাটা ।
লাফিয়ে উঠলো শুভেন্দু । বলল , বৌদি , তুমি আমার জন্য একটা ঠোঁট কাটা মেয়ে দেখলে ?
হো হো করে হেসে উঠলো নন্দিনী । বলল , আরে বাবা , তা নয় । মেয়েটা স্পষ্ট কথা বলতে ভালোবাসে । আমার মত অত লাজুক নয় ।
অবাক হয় শুভেন্দু । বৌদি যদি লাজুক হয় তাহলে বোলবোলা কোন মেয়ে ?
তাহলে বলো , কবে মেয়ে দেখতে যাবে ?
বৌদি , তুমি তো জানো টিউশন নিয়ে আমি প্রচন্ড ব্যস্ত । সামনেই টেন আর টুয়েলভের টেস্ট । তুমি আর দাদা দেখলেই হবে । প্রয়োজনে মামাদের আর মাসিদের বলতে পার ।
মোটামুটি সব ঠিকঠাক হয়ে যাবার পর একটা শুভ দিন দেখে মেয়ের বাড়ির লোক ছেলেকে আশীর্বাদ করে গেল । শুভেন্দুর দাদা বৌদি আর আত্মীয়-স্বজন মিলে আশীর্বাদ করে এল মেয়েকে । সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় ছেলে এবং মেয়ে কেউ কাউকে দেখলো না । অগাধ আস্থা বাড়ির লোকেদের প্রতি ।
দেখতে দেখতে এসে গেল বিয়ের দিন । বাড়ি ভর্তি আত্মীয়-স্বজন , বন্ধু বান্ধব । বরের সাজে চলল শুভেন্দু বিয়ে করতে । পেছন পেছন বরযাত্রীর দল । মেয়ে সুপর্ণা সেজে গুঁজে বসে আছে বান্ধবীদের সাথে । চলছে চটুল মেয়েলি রসিকতা । এমন সময় আওয়াজ উঠলো বর এসেছে , বর এসেছে । হুলুস্থুলু পড়ে গেল বিয়ে বাড়িতে । সব ছাপিয়ে সানাইয়ের সুর । জামাইকে বরণ করে বসানো হলো ঘরে । বরযাত্রীদের জন্য টিফিন আর কফি । ব্যবস্থা একদম পাকা । লগ্ন দেখে ছেলেকে আনা হলো বিয়ের পিঁড়িতে । এরপর পিঁড়িতে চেপে পানপাতা দিয়ে মুখ ঢেকে বিয়ের মঞ্চে হাজির মেয়ে । উলুধ্বনি আর শাঁখের শব্দে মিশে গেল বিয়ের মন্ত্র । পানপাতা সরাতেই সুপর্ণা প্রথম দেখলো তার হবু বরকে । একি ! ছেলের গায়ের রঙ এত কালো । তাকে তো আগে কেউ এই কথা বলে নি । না ছেলের বাড়ির লোক , না তার নিজের বাড়ির লোক । এতো পুরোপুরি ধোঁকা দেওয়া । অসম্ভব ! এই কালো ছেলেকে সে কোনো মতেই বিয়ে করবে না । তারজন্য তাকে যদি সারা জীবন আইবুড়ো থাকতে হয় , তাতে ও সে রাজি । সে নিজে যথেষ্ট সুন্দরী এবং ফর্সা ।
চিৎকার করে উঠলো সুপর্ণা , আমি এই বিয়ে করবো না ।
বিয়ের আসরে বিনা মেঘে বজ্রপাত । নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না শুভেন্দু । ঠিক শুনেছে তো ?
মেয়ের বাবা মা ,আত্মীয়রা ছুটে এলেন । সবারই এক প্রশ্ন হঠাৎ কি হলো ?
কোনো রকম ভনিতা না করে সোজাসুজি সুপর্ণা বলল , আমাকে তোমরা ধোঁকা দিয়েছ । একবারও কেউ বলনি যে ছেলে কালো । আমি এরকম কালো ছেলেকে বিয়ে করতে পারবো না ।
সবাই উঠে পরে লাগলো মেয়েকে বোঝাতে । বিয়েতে বসে এই রকম সিন্ ক্রিয়েট করা শোভা পায় না ।
মেয়ের একটাই প্রশ্ন , আমার গায়ের রঙ এরকম কালো হলে কি এত নির্বিবাদে আমার বিয়েটা হত ? তোমরা পুরুষরা কি মনে কর , তোমাদের পছন্দ আছে আর আমাদের মেয়েদের কোনো পছন্দ নেই । যদি প্রেম করতাম তাহলে সেই ছেলের হাজারো খুঁত ধরতে । ধর্ম , জাত কোনো কিছুই বাদ দিতে না । তোমাদের ওপর ভরসা করেছি মানে যে কোনো একটা ছেলে হলেই হল ? আমাকে কেউ বলার প্রয়োজন মনে করলে না যে কালো ছেলেকে আমি বিয়ে করতে রাজি কিনা ? কেন সে কথা গোপন করলে ? ভাবলে হীরের আংটি আবার বাঁকা ! ছেলে কালো হতে পারে , বেঁটে হতে পারে , চুল বিহীন হতে পারে । এর কোনোটাই ছেলের ক্ষেত্রে দোষের নয় । যত দোষ মেয়েদের ক্ষেত্রে । মেয়েদের কাছে এসব লজ্বার । সারা জীবন আমাদের এই লজ্বা নিয়ে বাঁচতে হয় । কেউ পাশে থাকে না । না স্বামী , না বাবা মা । মেয়ে গলার কাঁটা । একটা বড় দায় । কোনোমতে সেই দায় ঝেড়ে ফেলতে পারলেই নিশ্চিন্ত । কানা , খোঁড়া যে কোনো ছেলে হলেই হলো । সরি , আমি তীব্রস্বরে প্রতিবাদ করছি । আমি মেয়ে বলে আমি গর্বিত । ফেলনা নই । যতদিন বাঁচবো আত্মমর্যাদা নিয়ে বাঁচবো । আমি কাউকে ছোট করছি না শুধু আমার মত আমি জানালাম । বিয়েটা করবো জীবনের জন্য । নিজের জন্য । তোমাদের খুশি করার জন্য নয় । আমি উঠলাম ।
কে একজন বলে উঠলো , তুই তো লগ্নভ্রষ্টা হবি । তোর তো আর কোনোদিন বিয়ে হবে না ।
সাপের মত ফোঁস করে উঠলো সুপর্ণা । তাতে তোমাদের অসুবিধে টা কী ? আমাকে নিয়ে তোমাদের আর ভাবার কোনো প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না । আর দাঁড়ালো না সুপর্ণা । সোজা চলে গেল নিজের ঘরে । বন্ধ করলো দরজা । সকলেই কিংকর্তব্য বিমূঢ় হয়ে বসে । এ ওর মুখ চাওয়া চাওয়ি করছে । শুভেন্দু বুঝতে পারছে না তার ঠিক কি করা উচিত । জীবনে প্রথম বিয়ে করতে এসে এত বড় ধাক্কা । চরম অপমান । শধুমাত্র রঙ কালো হওয়ার জন্য । কাঁদতে ইচ্ছে করছে তার । যন্ত্র চালিতের মত উঠে পড়লো পিঁড়ি থেকে । বেরিয়ে এল বিয়ে বাড়ির বাইরে । আস্তে আস্তে মিশে গেল রাতের গভীর অন্ধকারে ।