কুটীরের দ্বারদেশে দাঁড়ায়ে শুভ্রবেশে
বৃদ্ধা এক লাবণ্যময়ী,
ঐশ্বরিক অবয়বে সত্বগুণ বৈভবে
সহস্র আময় বুঝি জয়ী।
মহাকবি কালিদাস যাঁহার হৃদয়ে বাস
বিদ্যা তথা জ্ঞানরূপ মণি,
রাজপথে ভ্রমণান্তে উপাগত দ্বারপ্রান্তে,
অতীব তৃষ্ণার্ত কবি তিনি।
কহিলেন মহাকবি “অম্বরে প্রখর রবি
তীব্র করে বক্ষ মোর তপ্ত,
পিপাসায় ক্লান্ত অতি হে মাত পুণ্যসতী
চেতন যে প্রায় এবে লুপ্ত।”
“তৃষ্ণার্তে বারিদান সে মহা পুণ্যস্নান
সেই পুণ্যে হউন দেবী স্নাত,”
শুধান বৃদ্ধা নারী “মিত্র নাকি তুমি অরি !
নহ মোর পূর্বপরিচিত।”
“পরিচয় দাও মোরে নচেৎ কুটীর পরে
আপ্যায়ন করিতে আমি নারি,”
হাসিলেন কবি–রাজ “মোর ত’ পথিক সাজ
দয়া করে দিন মাতা বারি।”
“তুমি কি পথিক পুত্র ! পথিক দুজন মাত্র
আদিত্য তথা সুধাকর,
অনন্ত পথের যাত্রী দিবস কিংবা রাত্রি
তুমি কে বা দাও উত্তর।”
“তাহলে অতিথি আমি কহিলেন জ্ঞানস্বামী
বড়ই তৃষ্ণার্ত হায় এবে,
তপ্ত মোর সর্বগাত্র পূর্ণ অম্বু এক পাত্র
প্রাণ রক্ষা হইবে অবিলম্বে।”
“অতিথি কিমতে তুমি ! অতিথি অতীব দামী
সম্পদ তথা যৌবন,
তবে দুটি ক্ষণস্থায়ী সততই উদ্বায়ী
সত্য বল তুমি কোনজন !”
তর্কে বিজিত কবি স্থিতধীর জলছবি
কহিলেন-“আমি সহ্যশীল,
হায় এ কি তিতিক্ষা মাগি এবে প্রাণভিক্ষা
দিন দেবী নীর এক তিল।”
“হাসাইলে পুত্র বটে সহ্যশীল নহ মোটে
চিত্ত তব হেরি সংক্ষুব্ধ,
সহ্যশীলা বসুন্ধরা পাপপুণ্য যাঁহারে ঘেরা
সাথী বৃক্ষ সেবক নি:শব্দ।”
“কে তুমি বল সত্য” নারীর প্রশ্নে ত্যক্ত
কালিদাস কণ্ঠে ঊষ্মা,
“আমি এক হঠকারী অবিনীত ভাবধারী
কৃপা মাগি আপনার রমা।”
“বারবার মিথ্যাভাষে” কহিলেন কালিদাসে
বৃদ্ধা সেই শুভ্রকেশী নারী,
“কি হেতু লিপ্ত তুমি বুঝিতে পারিনা আমি
নহ তুমি কোন হঠকারী।”
“হঠকারী নখ ও চুল ধারণায় নাহি ভুল
যতবার তুমি কর ছেদ,
আসে তারা বারবারই তাহারাই হঠকারী
পুত্র তুমি মিথ্যা করো ভেদ।”
কবি–রাজ অসহায় হায় কি বিষম দায়
তৃষ্ণায় দীর্ণ বুঝি বক্ষ,
আঘাত করিয়া শিরে কহিলেন বৃদ্ধাটিরে
“আমি তবে কোন এক মুর্খ।”
“করুন আপনি দয়া হে দেবী সর্বজয়া
প্রাণরবি বুঝি অস্তগামী,”
জননীর অট্টহাসি “পুনরায় মিথ্যাভাষই,
তব প্রাণ বহুতর দামী।”
“তুমি কোন মূর্খ নহে মূর্খ রাজারে কহে
অযোগ্য যে শাসনকর্তা,
আর রাজ পণ্ডিত কর্ম সদা রাজহিত
সঙ্গীটি তাহার সমহর্তা।”
কালিদাস নির্বাক তৃষার দহনে খাক
তদ্যপি ক্ষমাপ্রার্থী,
সকল তর্ক অন্তে বৃদ্ধার পদপ্রান্তে
তাঁহার কি করুণ আর্তি !
“ওঠো বৎস,এইক্ষণে” ভিন্ন স্বর শ্রবণে
কালিদাস বুঝি শিহরিত,
হেরিলেন সমখে দ্যুতি নীহারিকা সরস্বতী
কবি–রাজ চিত্ত সঞ্জীবিত।
করজোড়ে মহাকবি কহিলেন – “বাগ্দেবী
ক্ষমা করো অধমেরে জননী,
ক্ষণিকের অহংবোধ কণ্ঠ করিল রোধ
অধিকার করিল বাকধ্বনি।”
কহিলেন প্রিয়ংবদা “ স্মরণে রাখিও সদা
জ্ঞান বিদ্যা বিনয়ের প্রতীক,
বিদ্যার ধ্বজাধারী যদি হয় অহংকারী
সেই জনে ধিক শতধিক।”
জ্ঞানচক্ষু উন্মীলন তৃষ্ণাও নিবারণ
কাদম্বরী দেবী অন্তর্ধান,
তাঁহার প্রসাদে কবি জ্ঞানের জগতে রবি
সততই অর্চিষ্মান।
চতুর্দিকে আজি হেরি আমিত্বের বাজে ভেরী
দম্ভ সাথে অসূয়ার সখ্য,
মোর নম্র আহ্বান দূর করো স্বাভিমান
বিনম্রতাই হউক এবে লক্ষ্য।