সলমন বলে, আক্রোশে সারা শরীর জ্বলে গেলেও জানতাম আমি একা কিছুই করতে পারবো না। ইচ্ছে করছিলে সকলকে কেটে ফেলি কিন্তু মৌরিনকে তো বাঁচাতে হবে! সারা সন্ধ্যে ঘাপ্টি মেরে লুকিয়ে থেকে গভীর রাতে সর্দারের বাড়িতে গিয়ে দেখলাম সেখানেও স্মশানপুরী। সর্দারের কাছে জানার ছিল দলের বাকি দুজন কে? সন্দেহ হচ্ছিল দুজনের এক জন নিশ্চই গুপ্তচর? জানাবার লোকই জীবিত যখন নেই মৌরিনকে নিয়ে যত দূরে পারা পালতে পালতে আতি নদীর তীরে ছোট্ট কারখানা শহরে আস্তানা নিলাম । এতদূরে এলেও মনে স্বস্তি ছিল না। জানতাম কঙ্গোর আদিবাসী রক্ত ওদের শরীরে, শেষ বিন্দু রক্ত থাকা অবধি প্রতিহিংসা নিতে ছাড়বে না, সঙ্গে আছে হীরের লোভও, খুঁজে ঠিকই আমার দরজায় পৌঁছবে একদিন।

কেনিয়াতে পৌঁছে প্রথমে ভাবছিলাম বাইবেল কোথায় লুকোই। একদিন বাইবেল খুলে দেখলাম ছোট হীরে অনেক রয়েছে কিন্তু বড় গুলো উধাও, বুঝলাম সর্দার দামী হীরে গুলো অন্যত্র লুকিয়ে রেখেছে কোথায় তা আর কেউ জানতেই পারবে না। জর্জের  সঙ্গে আলাপ হতেই মাথায় অন্য বুদ্ধি খেলে গেল। বাতের ব্যাথায় ও নড়াচড়া বিশেষ করতে পারতো না বাড়িটাও লোকালয়ের  শেষ প্রান্তে একদম নিরিবিলিতে । বাগানে ওর আগাছা আবর্জনা ভর্তি।  যেচেই ওর সঙ্গে ভাব জমালাম। বাগান পরিষ্কারের নামে  একটা ঝোপের আড়ালে গর্ত খুঁড়ে বানালাম গোপন সিন্দুক। হীরেগুলো ওখানে লুকিয়ে মাটি চাপা দিয়ে কিছু ফুলের গাছ লাগিয়ে দিলাম, কারোর বোঝার সাধ্যি নেই মাটির তলায় কি আছে। এদিকে জর্জ খুব  খুশি, আমি  ওর বাড়ি-বাগান পরিষ্কার করে দি, মাঝে মাঝেই গিয়ে গল্পও  করি । যেতাম আসলে আমার ধন সুরক্ষিত আছে কিনা দেখতে। মৌরিন গুপ্তধনের কথা কিচ্ছু জানতো না।  ওকে লোক দেখানো কাজ করতে পাঠাতাম,  টাকার দরকার পড়লেই  মোম্বাসা, নাইরোবি, গারিসার মত বড় শহরে যেতাম হীরে বেচতে। যেহেতু কংগোতে বাইবেলের কথা জানাজানি হয়ে গেছিল সেটাকে জিইয়ে রাখতে আসল বাইবেল আতি নদীতে ভাসিয়ে ওরকমই আরেকটা বাইবেল কিনে জনসমুক্ষে রেখে দিলাম, বিভ্রান্ত করতে কাউকে ছুঁতেও দিতাম না। শুধু বাইবেলের শেষ পাতায়  জর্জের বাগানের নকশা এঁকে রাখলাম। আমার কিছু হলে যাতে মৌরিন পরে গুপ্তধন খুঁজে পায়।

চাঁদের রুপোলি আলোয় শুকনো তৃণভূমিকে মনে হচ্ছে বিশাল এক শ্বেতশুভ্র সমুদ্র। হঠাৎ নজরে পড়লো খানিক দূরে কি যেন কালো মতো নড়ে উঠলো। গন্ডার, মোষ নাকি সিংহ? সলমনের দৃষ্টি আকর্ষণই করতে যাচ্ছিলাম, সহসা পিছন থেকে বজ্রকঠিন কণ্ঠস্বর, একদম নড়বে না,পালাবার চেষ্টা করলেই মেরে ফেলব। এতোটা পথ হাঁটার পরে মনে একটাই স্বস্তি ছিল সলমনের লেঠেল শত্রূর থেকে অন্তত রেহাই পেয়েছি। কিন্তু আবার যে কোন বিপদ উদয় হল?  লেঠেল না ডাকাত? ভয়ে তো আমার ভিমরী খাবার জোগাড়, হাত পা কাঁপছে।

মাথার ওপর হাত তুলে সকলে উঠে দাঁড়াও, আবার সেই কঠিন গলা। পুতুলের মত আজ্ঞা পালন করলাম। আমাদের সামনে দুজন আর পেছনা তিনজন সশস্ত্র ব্যাক্তি আমাদের ঘিরে রয়েছে। খালি গা পরনে শুধু প্যান্ট, সকলের মুখ ঢাকা। ওদের হাতে তরোয়াল আর বন্দুক দেখে মনে  হচ্ছে না  আমাদের জঙ্গল যাত্রায় সাহায্য করতে ওরা এসেছে l বুক দুর দুর করছে এই বুঝি তরোয়ালের এক কোপে ভবলীলা সাঙ্গ হল। তরোয়ালের কোপ পড়লো না, কিন্তু আমাদের হাত আর চোখ বেঁধে ওদের সঙ্গে হাঁটিয়ে নিয়ে চললো। অন্ধের মত হোঁচট খেতে খেতে কোথায় চলেছি কিছুই জানি না।

অনেকক্ষন অজানা উদ্দেশে হাঁটার পর আমাদের চোখের পট্টি খুলে, একরকম ঠেলে এক অন্ধকার ঘরে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দেওয়া হল। এতক্ষন চুপ করে ছিলাম আশপাশে কেউ নেই, ফিসফিস করে সলমনকে জিজ্ঞেস করলাম, এরা কারা? আমাদের কি মেরে ফেলবে? চাপা স্বরে উত্তর পেলাম, জানি না।

ক্লান্ত অবসন্ন শরীর, হাত বাঁধা অবস্থাতেই কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না, পরদিন দরজা খোলার আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল। আমাদের বাইরে একটা মাঠে দাঁড় করানো হল, চিরিদিকে ঘন জঙ্গলে ঢাকা।  রাতে আমাদের রাখা হয়েছিল পুরোনো একটা শস্যাগার, ভেঙে পড়ছে প্রায়। পাশে একটা একতলা পোড়ো  বাড়ি। একটা গাছের গুঁড়ির ওপরে একজন বসা বাকি আরো জানা দশেক ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে, সকলের হাতে অস্ত্র।

এতরাতে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে কোথায় যাওয়া হচ্ছিল? দলের সর্দার, জিজ্ঞেস করলো । সলমন সব ঘটনা বললো শুধু লক্ষ্য করলাম হীরের কোনো উল্লেখ করলো না। আমাদের লোটা-কম্বলও ওরা নিশ্চয়ই খুঁজে দেখেছে, সেখানেও হীরের কোনো সন্ধান পায় নি । সলমন কি তাহলে আমাকে হীরের লোভ দেখিয়ে বোকা বানাল? সলমনের গল্প শুনতে শুনতে বসা লোকটা সলমনের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে হাতে ওর চকচক করছে তরোয়াল। আমার বুক ধুকপুক করছে এই বুঝি চোখের সামনে সলমনের শিরোচ্ছেদ দেখব। ভয়ার্ত সলমনও।

তরোয়ালের ডগা সলমনের গলায় রেখে সে বলল, এই উল্কিটা আমার বাবার গলাতেও দেখেছি, এটার অর্থ কি? আপনি কে?

সলোমন বলে এই গাইতির উল্কি আমি আর খনি সর্দার একসঙ্গে করি আমাদের বন্ধুত্বের চিহ্ন হিসেবে।

তারপরে যা হলো আশ্চর্য হবার মত। পরিচয় বিনিময়ের পর জানা গেল ডাকাতদের সর্দার আসলে সলমনের খনি সর্দারের ছেলে নাম মোসে । আমরা হলাম বাঁধন মুক্ত, পেলাম খাবার।

মোসে বলে, বাবা-মায়ের কোনো খবর নেই, ওদিকে কঙ্গোতে আত্মীয়ের বাড়িতে অসহ্য নির্যাতন, একদিন লাঞ্ছিত ১৭ বছরের মোসে আত্মীয়কেই প্রহার করে পালিয়ে যায় বাবা-মায়ের খোঁজে। নিজেদের গ্রামে পৌঁছে দেখে অনেক বদলে গেছে। কোথায় তাদের বাড়ি? খুঁজেই পায়না। সর্দারের নাম করলেই কেউ কোন কথাই বলতে চাই না। অনেক কষ্টে এক প্রতিবেশীর কাছে জানতে পারে পরিবারের দুঃখজনক ঘটনা।  সে  আবার মোসের পরিচয় পেয়ে ভীতসন্ত্রস্থ, বলে, সর্দারের ছেলেকে কোনো রকম সাহায্য করেছে জানাজানি হলে তার পরিবারের ঘোর  বিপদ, তাড়াতাড়ি চলে যাও  এখন থেকে ।

ওখান থেকে পালিয়ে মোসে ভবঘুরে ভিকিরির মত যখন এখান সেখান ঘুরছে সেসময় পরিচয় হয় এক কামারের সঙ্গে। কামারের ছেলে পুলে নেই, অসহায় মোশেকে নিয়ে যায় নিজের বাড়িতে, দেয় পুত্রের মর্যাদা। দিনে কামার রাতে তিনি দস্যু সর্দার। ধীরে ধীরে দুবিদ্যাতেই হয় মোসের অভিষেক, কামারের মৃত্যুর পরে সে হয় দলের সর্দার। ডাকাতি শুধু ধনীদের ওপর, সেই  অর্থ দিয়ে হয় গ্রামের অত্যন্ত গরিব ও বুড়োদের সাহায্য।

মোসের অনুরোধে ওদের গ্রামে গেলাম। পথে সলমন আমাদের দুজনকে সাবধান করে দিলো হীরে নিয়ে যেন এক্কেবারে মুখ না খুলি। কদিন মোসের গ্রামের আতিথেয়তার পর সেই আমাদের ভৈ স্টেশনে পর্যন্ত পৌঁছে দিল যেখান থেকে আমরা ট্রেন ধরলাম মোম্বাসার। উদ্দেশ্য ওখান থেকে জাহাজে ভারত পৌঁছনো।

মোম্বাসার বন্দর ঘুরে জানলাম বোম্বে যাবার জাহাজ সবে কদিন আগেই রওনা হয়েছে। আমাদের মাসদেড়েক অপেক্ষা করতে হবে পরবর্তী জাহাজের জন্য।

চলবে……..

Print Friendly, PDF & Email
Previous articleছুটি (পর্ব ৬)
Next articleমন্দ মেয়ে
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments