অন্ধকারে গ্রাম বা শহরের পথে হাঁটা এক, আর অচেনা বন্ধুর পাহাড়ী চড়াই উৎরাই চাঁদের ভরসায় পিঠে বোঝা নিয়ে, তাও পথ হাতড়ে যে কেমন বিভীষিকাময় বোঝাতে পারবো না। একঘেঁয়ে হাওয়ায় পাতার খসখস আর ঝিঝির ডাক। প্রতি বাঁকে মনে হয় কোন অজানা বিপদ বুঝি ওৎ পেতে দাঁড়িয়ে। নিজের স্নায়ু আর অনুভূতি যে এত সতেজ আগে জানতামই  না।  ক্ষুদ্রতম আওয়াজ, অতি সামান্য গন্ধ, পাতার  নড়ন কিছুই ইন্দ্রিয়কে ফাঁকি দিতে পারে না। একেই গরম তার মধ্যে অনেক্ষন মুখ বুজে পাহাড়ি পথে হাঁটার পরিশ্রমে , জামা ঘামে ভিজে সপসপ।

সলমনকে বললাম, একটু জিরোতে দাও আর পা যে চলছে না। তোমার গল্পেও বললে না।

চাপা ধমকে সলমন বলে, সময় হলেই বলব, কথার আওয়াজ শুধু বন্য জন্তু নয়, আদিবাসী ডাকাতদেরও আকৃষ্ট করবে । এখানকার ডাকাতরা বন্য জন্তুর থেকেও হিংস্র। ইশারায় মৌরিনও  আমাকে মুখ বন্ধ রাখতে বলল।

আরো ঘন্টা খানেক হাঁটার পর পৌঁছলাম এক বিশাল তৃণভূমির সামনে। কোমড় সমান উঁচু ঘাস জলের অভাবে শুকিয়ে গেছে । সলমন অনেক্ষন এদিক ওদিক পর্যবেক্ষণ করার পরে বললো, দেখছিলাম মোষের পাল আছে কিনা, মোষ থাকলেই সিংহ শিকারের লোভে হাজির হতে পারে।

আমার পা চলছে না গলাও শুখিয়ে কাঠ, মনে হচ্ছে মাথা ঘুরে পড়েই যাব । পিঠের বোঝা নামিয়ে একটা গাছের তলায় বসে হাঁপাতে লাগলাম। মৌরিনকেও বসতে দেখে চিরিদিকে তাকিয়ে সলমনও বসে পড়ল l মৌরিন সঙ্গে আনা ভুট্টার আটায় তৈরী উগালি আর জল দিল।

সলমন বলে, লালু হীরের খনিতে কাজ করতাম, খনির মালিক ও তার চেলাদের রাতারাতি বড়োলোক হতে দেখলাম, কিন্তু আমাদের বেলায় হাড়ভাঙ্গা খাটুনির পরেও সেই নুন আনতে পান্তা ফুরতো । খনি শ্রমিকদের নিত্য নানারকম অসুখ লেগেই থাকত, বিশেষ করে ফুসফুসের ব্যারাম। তাছাড়া শরীর কমজোরি করার নেশার সামগ্রী খনি বস্তিগুলোর আনাচে কানাচে অতি সহজলভ্য।

অনেক শ্রমিক বন্ধুকে দেখেছি যক্ষায় আক্রান্ত হয়ে, অর্থাভাব আর  বিনা চিকিৎসায় মরতে, তাদের পরিবারের দুর্দশা বলে বোঝানো যাবে না। দুমুঠো অন্নের  জন্য দেহ ব্যবসায় পর্যন্ত নামতে দেখেছি তাদের  স্ত্রী, কন্যাদের। যতটুকু পারতাম সাহায্য করতাম কিন্তু তা অতি  সামান্য, নিজেরও  পরিবার আছে। সর্দারকে বললাম, ভাবছি অন্য কিছু করব, এত খেটেও না আছে স্বচ্ছলতা না ভবিষ্যত ।  আমি মরলে আমার পরিবারেরও অনাহারে মৃত্যু। শুনে সর্দার বললে যদি রাজি থাক একটা মতলব আছে, তবে হুঁশিয়ার মুখ খুললেই মৃত্যু। দুপয়সা রোজকার করে যদি গরিবমুক্ত হতে পারি অবশ্যই  রাজি। খনি থেকে বেরোবার সময় সকলকে অগ্রপশ্চাৎ চেকিং করে বেরোতে দিত কিন্তু  কলার সঙ্গে গিলে হিরে নিয়ে বাইরে নিয়ে এলে কারোর ধরার  ক্ষমতা নেই । দলে মোট আমরা ৫ জন ছিলাম সর্দার সমেত।

সাবধানতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ মালিক পক্ষের চর চিরিদিকে ছড়ানো জানতে পারলেই ধন ও প্রাণ দুই যাবে। সর্দার ছাড়া বাকি ৩ জন যে কে জানতাম না। একটা মোটা বাইবেলের সব পাতা চতুস্কোন আকারে কেটে ওটাকে একটা বাক্সের রূপ দেয়া হল। ঠিক হলো বাইবেল ভর্তি হলেই আমরা ভাগ বুঝে নিয়ে অনেক দূরে যে যার পথে চলে যাব।

প্রতি বংশে যেমন একটা কুলাঙ্গার জন্মায় তেমনই প্রতি দলেও একটা নির্বোধ থাকে। একদিন শেষ রাতে দরজায় করাঘাত, খুলে দেখি চাদরে মুড়ি দেওয়া ভীতসন্ত্রস্থ সর্দার সঙ্গে তার নিদ্রামগ্ন একমাত্র ১০ বছরের ছেলেটি। ব্যাপার কি? বললে ভীষণ বিপদ সব ফাঁস হয়ে গেছে, আমাদের একজন নেশার ঘোরে পানশালায় হীরে আর বাইবেল সম্পর্কে অজান্তে বলে ফেলেছে। গুপ্তচর সর্বত্র, আর যাবে কোথায়? তার বাড়িতে চড়াও হয়েছে লেঠেল বাহিনী। এটুকু জেনেই সর্দারের ধারণা, ওকে অত্যাচার করে নিশ্চই সর্দারের বাড়ি পৌঁছবে। বাইবেল এনেছে যাতে আমি সেটা কোথাও লুকিয়ে রাখি আর ওর ছেলেকে আপাততঃ দূরে ওর এক আন্তীয়র কাছে রেখে আসি । বললাম আপনি স্বপরিবারে পালালেন না কেন? সর্দারের বললে, আমি পালালে তোমরা ভাববে তোমাদের ঠকালাম, তাছাড়া দেরি হয়ে গেছে, পেছনে এতক্ষনে ফেউ লেগে গেছে, হয়তো বাস রাস্তায় অপেক্ষমান পালতে গেলেই সব যাবে তার থেকে ছেলে ও হীরে আপাততঃ বাঁচুক, প্রাণ থাকলে দেখা যাবে । বাইবেল আর ছেলেকে রেখে সর্দার অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। সামান্য তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়লাম মৌরিনকেও সঙ্গে নিলাম যাতে মনে হয় আমারা ব্যক্তিগত পারিবারিক কাজে যাচ্ছি। মা-স্ত্রীকে বলে গেলাম জরুরি দরকারে যেতে হচ্ছে ফিরে সব বলব।

সর্দারের ছেলেকে তার আত্মীয়ের বাড়িতে রাখলাম কিন্তু বাইবেল লুকোবার তেমন যুৎসই জায়গা না পেয়ে সঙ্গেই নিয়ে ফিরলাম। দুদিন পরে সন্ধেবেলায় বাড়ি ফিরে অবাক হলাম, দরজা খোলা বাড়ি অন্ধকার। আলো জ্বেলে বাইবেলটা যীশুর মূর্তির পাদদেশের  তাকে রাখলাম।  ভিতরে ঢুকে সেই নরকীয় দৃশ্য দেখে স্তব্ধ হয়ে গেলাম, সকলকে হত্যা করেছে, মৌরিন চিৎকার করে কেঁদে উঠল। মুহূর্তে বুজলাম সর্দারের দরজা হয়ে বিপদ আমার ঘরে ঢুকেছে। যে কোনো মুহূর্তে আবার আসতে পারে। মৌরিনের মুখ চেপে ধরলাম যাতে আওয়াজ না করে, বাইবেলটাকে  নিয়ে আলো নিভিয়ে বাইরের অন্ধকারে গা ঢাকা দিলাম। খানিকটা দূরে গেছি, আওয়াজ শুনে পিছনে ফিরে দেখি আমার খোঁজে বাড়ি ভাংচুর চলছে।

চলবে ……….

Print Friendly, PDF & Email
Previous articleপাঁচশো টাকা
Next articleছুটি (পর্ব ৭)
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments