“আপনিও পদ্মার অশরীরিক আত্মার দেখা পেয়েছেন? নাকি শুনে বিশ্বাস করছেন?”মলয়দা কালুকে মজা করে জিজ্ঞেস করেন।
কালু বলে, সে আর এক গপ্পো, আমার এক কাকা, তাকে আমরা লালকাকা বলতাম কারণ তার নাম লালু। ছোটবেলায় শুনেছিলাম সে নিরুদ্দেশ, বড় হয়ে বাবার কাছে শুনেছি তার অসৎ সঙ্গত আর বদ নেশার জন্য তাকে দাদু বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলো। দাদু তো কবে গত হয়েছেন বাবাও সর্গ্গে গেছেন। কিছু বছর আগেকার কথা, হঠাৎ এক শীতের দুপুরে কোথা থেকে হাজির হলেন লালকাকা । পরনে ছাই রঙের স্যুট, চোখে কালো চশমা, ফ্রেঞ্চ কাট দাড়ি মাথায় টুপী, হাতে এটাচী। সতেরো বছর পরে তাকে তো কেউ চিনতেই পারে না। মা অনেক কষ্টে তাকে চিনলেন যত্ন করে খাওয়ালেন, জিজ্ঞেস করলেন, ঠাকুরপো এতদিন কোথায় ছিলে তোমার একটা খবরও পাই নি?
উত্তরে লালকাকা বলেন, খবর পাবে কি করে আমিতো এদেশেই ছিলাম না। বাবা শুধু বাড়ি নয় এক্কেবারে গ্রাম ছাড়া করে দিলেন। গ্রাম ছাড়ার পরে এক বন্ধুর সাথে মুম্বাই চলে যাই, ওখানে সে একটা গুজরাটির বাড়িতে কাজে করতে। মালিককে বলে আমাকেও কাজে লাগিয়ে দিল। সত্যি বলছি বাবা তাড়াবার পরে অনেক দরজা বন্ধ পেয়ে ঠিক করেছিলাম নিজেকে পাল্টাতেই হবে। খুব মন দিয়ে কাজ করতাম। আমার কাজে খুশি হয়ে মালিক একদিন জিজ্ঞেস করেন তাদের ফ্যাক্টরিতে কাজ করতে আফ্রিকায় যাবো নাকি? বেশি মাইনে সঙ্গে থাকা খাওয়া ফ্রি। আমি এক কথায় রাজি হয়ে গেলাম। কেনিয়াতে বেশ ছিলাম, কবছরের মধ্যেই ওখানকার স্বহিলি ভাষা শিখে স্থানীয়দের সাথে স্বচ্ছন্দে কথাও বলতে পারতাম। এরমধ্যে মিষ্টি স্বভাবের মৌরিনের সাথে আলাপ হল, যত দিন যাচ্ছিলো ততই আমরা একে ওপরের কাছে আসতে লাগলাম। একদিন ওর বাড়িতে নিয়ে গেল, বুড়ো বাবা আর ও থাকতো। ওর বাবা কঙ্গোতে হীরের খনিতে নাকি কাজ করত। গৃহযুদ্ধর সময় ওদের পরিবারে সকলে মারা যায়, বাবার সাথে মৌরিন কোনোরকমে কেনিয়ায় পালিয়ে এসে প্রাণ বাঁচায়। মাঝেমধ্যেই ওদের বাড়িতে যেতাম, একটা ব্যাপার লক্ষ্য করতাম মৌরিনের বাবা একদম বাড়ির বাইরে বের হত না। বাড়ির মধ্যেই একরকম লুকিয়েই থাকত। অচেনা কাউকে বাড়ির বাইরে দেখলেই ভয়ে সিঁটিয়ে যেত। ভাবতাম নিজ দেশে গৃহযুদ্ধর ভয়াবহতার থেকে মানুষিক আঘাত পেয়েই এমনটা হয়েছে।
মৌরিনকে জিজ্ঞেস করতে সে বলে, সেদিন বাবার সঙ্গে ও গেছিল এক আন্তীয়র বাড়ি। রাত হয়ে যাওয়াতে ওই আন্তীয়র অনুরোধে ওদের বাড়িতেই থেকে যায়। পরদিন বিকেলে বাড়ি ফিরে দেখে সারা বাড়ি লন্ড ভন্ড। চাপ চাপ কালচে জমাট রক্ত চারিদিকে তারই মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে মা, ভাই, বোন, ঠাম্মার মৃতদেহ। এ দৃশ্য দেখার পরে বাবা আর একবিন্দু অপেক্ষা করে নি। তাকের থেকে শুধু মোটা বাইবেলটা নিয়ে আমার হাত ধরে নিরুদ্দেশের পথ ধরলেন। অনেক কষ্টে এখানে এসে পৌঁছলাম। আগে মাঝে মধ্যে বাবা কোথায় যেন যেত দুদিন পরে ফিরত অনেক টাকা নিয়ে। শেষবার, বাড়ি ফিরেই জানলা দরজা সব বন্ধ করে দিলো, এখন তো বাড়ি থেকে বেরোতেই ভয় পায়, জানলেও খোলার জো নেই।
একদিন ওর বাবা আমাকে বলল, লালু চলো আমরা এখন থেকে অনেক দূরে কোথাও চলে যাই, তোমাদের দেশে, ওখানে মাউরিনকে বিয়ে করে থাকতে পারবে না? বললাম হ্যাঁ কিন্তু এখানকার ভালো চাকরি ছেড়ে দেশে গিয়ে খাবো কি? বুড়ো বললো যীশুর দয়ায় কোনো অসুবিধে হবে না।
মাউরিনকে এ কথা বলতে ও কিছুক্ষন চুপ করে বললো তুমি যেখানে আমাকে নিয়ে যাবে আমি যেতে রাজি তবে বাবাকে ফেলে কোথাও যাবো না।
একদিন বুড়ো আমায় একা পেয়ে বলল, কি ঠিক করলে? হাতে বেশি সময় নেই তাড়াতাড়ি কর। আমার যদি কিছু হয়ে যায় তৎক্ষনাৎ তোমরা এখন থেকে পালিয়ে যেয়ো আর হ্যাঁ ওই বাইবেলটা সঙ্গে নিতে ভুল না, ওটা পড়লে সর্বশক্তিমান যীশুই তোমাদের পথ দেখিয়ে দেবে।
মৌরিনকে একথা বলতে সে জানায় বাবা তাকেও এই কথা অনেকবার বলেছে, অথচ ওই বাইবেলে হাত দেওয়া এক্কেবারে নিষিদ্ধ।
সব শুনে খুবই অবাক লাগলো।
চলবে …….