একটা শৃঙ্খলিত দুমদাম আওয়াজ। প্রচণ্ড শব্দে ড্রাম বাজছে। প্লাস্টিকের বোতল তুলতে কুড়াতে আসা অর্ধ উলঙ্গ ছেলেটা পিঠে নোংরা বস্তা নিয়ে হাঁ করে দাঁড়িয়েছিল।

ড্রাম বিট থামার সাথে সাথেই হারমনিয়ামের সুরে বেজে উঠলো ‘জন গণ মন…’

ছেলেটা শুনছে। এক দমকা হাওয়াতে খাঁচায় বদ্ধ পাখির মতো ঝটপট করে ওঠে ওই মিনারটার ওপরে তোলা তেরঙ্গা কাপড়টা। ছেলেটা দেখছে । কিছুক্ষণ আগে কয়েকজন ছেলের হাতে ঠিক ওইরকম তেরঙ্গা ব্যান্ড দেখেছিল। তাকে দেখে, “একেবারে অসভ্য, অশিক্ষিত” বলেছিল। আর বলেছিল, “আজ আমাদের স্বাধীনতা দিবস আর তুই টাকা চুরির ধান্দায় বেরিয়েছিস, যা ভাগ !” হতবাক ছেলেটা সেদিন জানলো আজ তাদের দেশের স্বাধীনতা দিবস আর ওই তেরঙ্গা কাপড়টা হল দেশের পতাকা।

স্বাধীনতার সত্তর বছর পূর্তিতে তাকে কয়েকজন ছেলে চোর অপবাদ দিল। আরও অনেক কিছু তারা বলেছিল কিন্তু সে সব কথা কানে তোলেনি। তবু চোখের পাতা ভারী হয়ে এলো। অশ্রু বাধা মানলো না। নাহ্ কাঁদলে চলবে না।

আজ স্বাধীনতা দিবস। কি করবে সে? বাবা নেই। মা অন্যের বাড়িতে কাজ করে, বাসন মাজে। শুধুমাত্র ওই টাকায় তাদের চলে না। তার আবার একটা ছোট্ট বোন আছে। সে কাজ না করলে তাদের চলবে কি করে? জন্মানোর পর থেকে সে শুধু অভাবই দেখেছে। আর দেখেছে – সমাজের দাঁড়িপাল্লাতে টাকার বিনিময়ে কিভাবে স্নেহ – ভালবাসার কেনা বেচা চলে। স্বাধীনতা দিবস, তেরঙ্গা পতাকা, মায়ের মুখ সব কিরকম মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। ওই যে পতাকাটা হওয়াতে কিরকম খাঁচায় বদ্ধ পাখির মতো ডানা ঝাপটাচ্ছে। ওই কি স্বাধীনতা? নীচে দাঁড়ানো লোকগুলো যেন ওই বন্দি পাখিটাকে বুলি শেখাচ্ছে। কিন্তু পতাকার আকুল আবেদন মুক্ত আকাশে স্বাধীনভাবে ওড়ার।

হাতের মুঠোটা নিজের অজান্তেই কিরকম শক্ত হয়ে আসে ছেলেটার। পতাকাটাকে খুব খুব ভালো লাগতে আরম্ভ করে। আকুল আর্তনাদে পতাকাটা যেন তাকে ডাকছে – “বাঁচাও, বন্ধু বাঁচাও। এরা আমায় খাঁচায় আটকে মেরে ফেলতে চাইছে।”

ছেলেটার চুল এলোমেলো। চোখ চকচক করছে। নতুন কি এক অজানা মুক্তির স্বপ্নে বিহ্বল হয়ে ওঠে। মুষ্ঠিবদ্ধ হাত হওয়ায় ছুঁড়ে আপনমনে বলে ওঠে – “পতাকা বন্ধু ! তুমি তো আর বন্দি নও। ওই খাঁচা থেকে তোমাকে মুক্ত করতে আমি এসে গেছি, বন্ধু। নীল আকাশের বুকে তোমাকে ওড়াবই আমি।”

সূর্যের আলোতে আরও একবার চকচক করে ওঠে ছেলেটার চোখ, স্বপ্নভরা বুক, সুকঠিন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ মুখ আর কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে ওঠে ছেলেটার মুষ্ঠিবদ্ধ হাত।

 

~ খুঁজে পাওয়া স্বাধীনতা ~

Print Friendly, PDF & Email
Previous articleপরিক্রমা
Next articleবন্ধু
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments