কোড নেম প্রমিথিউস

কিন্তু না, এখানে তো অ্যাডভান্সড জেনেটিক্স নিয়ে কথা হচ্ছে, বিশেষ করে যেখানে মানুষের প্রজাতিই সম্পূর্ণ পাল্টে যেতে পারে। কিন্তু এর সাথে ঝিনুকের কিডন্যাপিং এর সম্পর্ক কি?

খানিকটা খেই হারিয়ে ফেলেছিলাম, তাই আমি হাত তুললাম। স্যার বললেন, “বল?”

আমি বললাম, “স্যার, নো ডাউট যে প্রযুক্তির কথা উঠছে এখানে, তা বাস্তব জীবনে ব্যবহার হলে, মানুষের লাইফ এক্সপেক্টেনসি তো বাড়বেই, তার সাথে ভার্চুয়ালি তার কোন অঙ্গই বিকল হবে না। কারন সে অঙ্গটার কোশগুলো নষ্ট হচ্ছে, সেগুলোকে সে নিজে নিজেই ঠিক করে নিতে পারবে।“

স্যার সম্মতিসূচক মাথা নাড়লেন। “বলে যাও।“

“কিন্তু, আপনি যে প্রযুক্তির কথা বলছেন, সেটা জেনেটিক লেভেলে। জাইগোটের জিনে যদি বদল আনেন, সবকটা কোশেই তার প্রভাব পড়বে। তাহলে, না চাইতেও তার সমস্ত কোশই রিজেনারেট করতে শুরু করবে। তাহলে ব্যাপারটা শিপ অফ থেসাসের মত হয়ে গেল না? কোনওদিনই সে মরবে না, অথচ তার আগের শরীরটা আগের মত থাকবে না, কারন কোশগুলো সমানে পাল্টে যাচ্ছে। এমনকি তার কোনোদিনই মেমরি স্টোরেজ হবে না, কারন তার নিউরনগুলোও রিজেনারেট করছে।“ আমি প্রশ্ন করলাম।

স্যার তখন থামলেন। তারপর মৃদু হেসে বললেন, “খুব ভাইটাল প্রশ্ন। সমুদ্র, বর্ণালী তোমরা এতক্ষণ এই প্রশ্নটা কেন করনি, আমি ভাবছিলাম। খুব ভাল প্রশ্ন, চৌধুরী। কিন্তু এই প্রশ্নের উত্তর নেই আমার কাছে। আমার ব্যক্তিগত মত, খুব সম্ভবত পাল্টায় না। কারন স্মৃতি আর.এন.এ. হিসাবে স্টোর হয়, কোশ হিসাবে নয়। তবে আমি ভুলও হতে পারি।“

স্যার আবার বলা শুরু করলেন। এতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পায়ে টান লাগছিল, বসলাম একটা চেয়ারের ওপর। দেখি, আমার দেখাদেখি ওরাও চেয়ারে বসল। স্যার কিন্তু দাঁড়িয়েই বলতে থাকলেন। আসলে এটা স্যারের অভ্যাস, যখন বলা শুরু করেন, তখন বসে থাকতে পারেন না।

“আমরা গবেষণা শুরু করেছিলাম দুটো প্রাণীকে নিয়ে। একটা হল প্ল্যানেরিয়া কৃমি, অন্যটা তো দেখতেই পাচ্ছ, এই অ্যাক্সোলটলগুলো। দীর্ঘ দু’বছর গবেষণার পর আমরা চিহ্নিত করতে পেরেছিলাম দুটো জিনকে যে দুটো জিনের ওপরেই দাঁড়িয়ে আছে, কি করে অ্যাক্সোলটল নিজের কাটা হাত-পা অতো তাড়াতাড়ি তৈরি করতে পারে। ঐ জিন বিভিন্ন পোকামাকড়, ছোট লতা এদের জিনে ঢুকিয়ে দেখলাম। রাতারাতি ফল পেলাম। ওদেরও রিজেনারেশন রেট স্বাভাবিকের থেকে বহুগুণে বেড়ে গেল। কিন্তু, প্রাণীদের ওপর কাজটা করতে গিয়েই জোর ধাক্কা খেলাম।

আমরা গরম রক্তের প্রাণী। অ্যাক্সোলটল উভচর, তাই ঠাণ্ডা রক্তের প্রাণী। কোনো উষ্ণ রক্তের প্রাণীর মধ্যে কোনও ঠাণ্ডা রক্তের প্রাণীর এনজাইম আর হরমোন ঢোকালে অত বেশি টেম্পারেচারে নাও কাজ করতে পারে। কিন্তু, ট্রায়াল আর এরর মেথডে দেখলাম, হাই ইলেকট্রিক ডিপোলারাইজেশন করলে এই এনজাইমগুলো কাজ করে যাচ্ছে উষ্ণ রক্তের প্রাণীদের মধ্যেও। তো সেই কারণে দুটো রাস্তা ভাবতে হল। কোন একটা অন্য স্পিসিসের প্রাণীর জিন দিয়ে এই ক্ষত নিরাময় করার প্রচেষ্টাকে আরো দ্রুত থেকে দ্রুততর করা যায় কিনা অথবা এমন কোনও প্রজাতির প্রাণী খোঁজা, যার শরীরে হাই ইলেকট্রিক ডিপোলারাইজেশন হয় প্রতিনিয়ত।

আলটিমেটলি একটা ব্রিলিয়্যান্ট প্ল্যান হাইনরিখই দিল। প্রতিরক্ষাতন্ত্রের মধ্যে হিলিং আর রিজেনারেশনের জন্য আমাদের দেহে মুখ্য ভূমিকা নেয় ম্যাক্রোফাজ। তো ম্যাক্রোফেজগুলোকে যদি কোনভাবে খুব বেশি উত্তেজিত করে ফেলা যায়, তাহলে অতিরিক্ত সাইটোকাইন তৈরি হবে যেগুলো হিলিং প্রসেসকে ফাস্ট ফরোয়ার্ড করতে পারে।

হঠাৎ মাথায় আইডিয়াটা চলে এল। হাতের কাছে এত ভাল একটা প্রজাতি থাকতে কেন যে অন্যত্র হাতড়ে মরছিলাম, কে জানে। বৈদ্যুতিক ইল মাছ, যাদের শরীরে কয়েক হাজার শ্যাক্স অরগ্যান থাকে, যেগুলো খুব দ্রুত পোলারিটি পাল্টে বিশাল পরিমাণে জৈববিদ্যুতের জন্ম দেয়। আলাদা করে সেই মাছের জেনেটিক প্রোফাইল করে খুঁজে বার করলাম, কোন জিনগুলো এই বিদ্যুতের ব্যাটারি কোশগুলো তৈরি করে। তারপর একটা ছোট ইঁদুরের ভ্রূণের মধ্যে সেই জিনগুলো ঢুকিয়ে রিকমবাইন করে একটা মেয়ে সারোগেট ইঁদুরের গর্ভে প্রতিস্থাপন করলাম।

প্রথম কয়েকবার ব্যর্থতাই দেখতে হল। হয় গর্ভপাত হয়ে গেল, নয় কম্প্যাটিবল হল না। কিন্তু আট নম্বর বার সফল হল আমাদের পরিশ্রম। যে ইঁদুর জন্মাল, তার হাই রেজোলিউশন সিটিস্ক্যান করে দেখলাম, ব্যাটারি কোশগুলো মেরুদণ্ডের ঠিক পাশাপাশি দুসারি তৈরি হয়েছে। পরে ডিসেকশন করে দেখলাম, যে ব্যাটারি কোশগুলো তৈরি হয়েছে, তার সাথে ইল মাছের ব্যাটারি কোশগুলোর খুব অমিল নেই। আর তার আগে, ইঁদুরটার লেজ কাটার ঠিক এক মিনিটের মধ্যেই লেজটা গজাতে শুরু করল। এবং পাঁচ মিনিটের মধ্যেই পুরো লেজ গজিয়ে গেল।

কিভাবে এই রিজেনারেশনটা বেড়ে গেল এত দ্রুত, একটাই তত্ত্ব আছে আমার কাছে। যদিও, আমি আমার যুগের প্রযুক্তির জন্য খুব নিশ্চিতভাবে কিছু বলতে পারছি না, বলতে পারো, একটা হাইপোথিসিস দাঁড় করাতে পেরেছি, যাতে বলা সম্ভব কিভাবে এই রিজেনারেশন হচ্ছে।

অ্যাক্সোলটল আর মানুষের সাধারন পূর্বপুরুষ ৩৬ কোটি বছর আগেই আলাদা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু, তাহলেও ওদের আর আমাদের রিজেনারেশনের মধ্যে খুব বেশি তফাত নেই। যে জায়গাটায় তফাত, সেটা হল যে আমাদের আর ওদের ম্যাক্রোফাজের ভূমিকায়। আমাদের ম্যাক্রোফাজ বেশি করে কোলাজেন ফাইবার তৈরি করতে জোর দেয়, তাই আমাদের স্কার টিস্যু বেশি তৈরি হয়ে যায়, যার জন্য আর আমাদের কাটা হাত পা গজায় না। অন্যদিকে, ওদের ক্ষেত্রে ম্যাক্রোফাজগুলো স্কার টিস্যু তৈরি হতে দেয় না, কারন অ্যাক্সোলটলের ক্ষেত্রে কিছু জিন সুইচড অন, যেগুলো আমাদের ক্ষেত্রে অফ।  আর তাছাড়া আমাদের ক্ষেত্রে কোশকলার গঠন অনেক বেশি কমপ্লেক্স। তবু, তবু আমাদের শরীরের পুনর্গঠন সম্ভব যদি কোশগুলোকে বোঝানো যায়, যে তারা কে কোথায় আছে, এবং তাদের কি কি তৈরি করা উচিৎ কতটা পরিমাণে, যাতে একটা কাটা অঙ্গ আবার ঠিকভাবে তৈরি হয়ে যায়।

অ্যাক্সোলটলের ক্ষেত্রে কাটা জায়গায় ব্লাষ্টেমা বলে একটা জিনিস তৈরি হয়, যেটা প্রথমে ওর কাটা অঙ্গ থেকে একটা অপরিণত অঙ্গ তৈরি করে, আর তারপর সেটা পরিণত হয়, প্রচুর পরিমাণে পরিণত কোশ তৈরি হবার জন্য। কিন্তু যেকোনো স্তন্যপায়ীর ক্ষেত্রে ব্লাষ্টেমা তৈরি করতে গেলে প্রচুর ম্যাক্রোফাজ দরকার। কিন্তু অ্যাক্সোলটলের অনুপাতে আমাদের শরীরে ম্যাক্রোফাজের সংখ্যা অনেক অনেক কম। তাহলে কিভাবে ইঁদুরটার দেহে ওদের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে ম্যাক্রোফাজের ক্ষেত্রে?

আচমকাই মনে হল, শ্যাক্স সেল দিয়ে সমানে যে জৈববিদ্যুৎ তৈরি হচ্ছে, ওগুলো যদি ডিপোলারাইজ করে ম্যাক্রোফাজগুলোকে, তার জন্যই কি এরকম হচ্ছে? ওরা উত্তেজিত হলেই তো সাইটোকাইন ছাড়বে, তার পরের বিক্রিয়াগুলো পুরো চেন রিঅ্যাকশনে ঘটবে।“

স্যার একটু থেমে গেলেন। আমরা অধীর আগ্রহে শুনছিলাম। স্যার থামতেই বলে উঠলাম, “তারপর স্যার?”

স্যার একটা রহস্যময় হাসি হেসে বলতে শুরু করলেন, “যা ভেবেছিলাম, ঠিক তাই। জৈববিদ্যুতের জন্যই ম্যাক্রোফাজগুলো এতটাই অ্যাক্টিভ হয়ে গিয়েছিল, যে যখনই লেজটা কাটলাম, ইলেকট্রিক্যাল পোলারিটি চেঞ্জের জন্য লেজের ওখানেই প্রচুর প্রচুর ব্লাষ্টেমা তৈরি হতে শুরু করল। তাই এত তাড়াতাড়ি লেজটা তৈরি হয়ে গিয়েছিল।“

“এতদূর অবধি সব ঠিকই ছিল। আমাদের সাফল্য দেখে আমরা নিজেরাই চমকে উঠেছিলাম। যথারীতি আমি ঠিক করলাম, এই গবেষণার কথা সবাইকে জানাব। সমস্ত পৃথিবী জানুক, যে আমরা শেষ পর্যন্ত টাইটানদের সমগোত্রীয় হতে চলেছি। কিন্তু, তখনও কিছু বাকি ছিল।”

 

~ কোড নেম: প্রমিথিউস (পর্ব ১২) ~

Print Friendly, PDF & Email
Previous articleঅমর স্মৃতি
Next articleকোড নেম: প্রমিথিউস (পর্ব ১৩)
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments