কোড নেম প্রমিথিউস

স্যার নিজেকে দ্রুত সামলে নেন আমাদের বোকা বোকা মুখগুলো দেখে। তারপরই হেসে বলেন, “কোথায় ছিলাম যেন? ও হ্যাঁ, প্রমিথিউসের লেখাগুলো পড়ে আমাদের মাথা ঘুরে গিয়েছিল। আমি এখনও ভেবে পাই না, ওরা কিভাবে এন্ডোনিউক্লিয়েজ এনজাইম, বা ক্রিস্পার-ক্যাস৯ এর কথা ভেবেছিল? এগুলো তো এই যুগের আবিষ্কার। যখন আমরা ওগুলো পড়ছিলাম, আমাদের নিজেদের কাছে এগুলো দুর্বোধ্য ঠেকছিল, কিন্তু আজ ২০১৯ এ দাঁড়িয়ে আর এই শব্দগুলো অজানা লাগে না। তবে, যে সমস্ত প্রাণীদের নাম ব্যবহার করা হয়েছিল যাদের জিন ব্যবহার করে মানুষ আরও দীর্ঘায়ু হয়ে উঠতে পারে, বা আরও শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে, তাদেরকে সে কিভাবে চিনেছিল, সেটার রহস্য আজও আমি ভেদ করতে পারিনি। যেসব প্রাণীর নাম ব্যবহার করা হয়েছে, সব আমাদের যুগের প্রাণী। তার মধ্যে দুটো আমার এই ল্যাবেই রয়েছে, এবং তাদের ওপর বেস করেই আমার এই গবেষণা।“

এখানে বর্ণালী একটা প্রশ্ন করল। “আচ্ছা স্যার, সেই ট্যাবলেটটা কি এখনও আপনার কাছে আছে?”

“হ্যাঁ, এখনও আছে আমার কাছে। প্রিজার্ভ করে রেখে দিয়েছি। পরবর্তীকালে যদি কোনও বড় গবেষণায় লাগে, তার জন্য।”, স্যার ভ্রূ কুঁচকে বললেন।

আমি ল্যাবের চারদিক দেখছিলাম। বারবারই চোখদুটো চলে যাচ্ছিল, অ্যাকোরিয়ামে রাখা সাদা রঙের প্রাণী গুলোর দিকে। আমি স্যারকে জিজ্ঞেস করলাম, “আপনার ল্যাবেই আছে সেই দুটো প্রাণী? তারা কি সেই যুগের প্রাণী না এই যুগের?”

স্যার হেসে ফেললেন। তারপর ধীরে ধীরে বললেন আমার দিকে তাকিয়ে, “না অয়ন, এরা আমাদের যুগেরই প্রাণী। তবে স্পেশাল পারমিশন করে এদের আনতে হয়েছে। এদেরকে এই দেশে পাওয়া যায় না। চল, দেখাচ্ছি।“

আবার স্যারের ল্যাবে ঢুকলাম। সেই ঘর, সেই টেস্ট টিউব, পিপেটের সারি, আর স্পেসিমেনে ঘর ভর্তি।

আমার চোখ চলে গিয়েছিল সাদা রঙের প্রাণীগুলোর দিকে। স্যারও সেদিকে তাকালেন। আমার মনের অবাক ভাবটা তখনো কাটতে চাইছিল না। এগুলোই সেই প্রাণী?

স্যার তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “চৌধুরী, আশা করি চিনতে পার ওগুলো কি?”

“হ্যাঁ স্যার, এগুলো অ্যাক্সোলটল।“ আমি ধীরে ধীরে বললাম।

“আর এদের বিশেষত্বটা কি, মিস বর্ণালী?” স্যার যেন আগেকার মত পড়া ধরছেন, সেরকম ভাবে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিলেন ওর দিকে।

বর্ণালী খানিকক্ষণ ভাবল, তারপর কিন্তু কিন্তু করে বলল, “এরা নিজেদের যেকোনো অঙ্গ কাটা গেলে আবার তৈরি করে নিতে পারে?”

“ব্রেভো। হ্যাঁ। একদম তাই। আর এইজন্যই এরা রিজেনারেটিভ মেডিসিনের সবথেকে বড় সেনসেশন। হাত, পা, এমনকি এদের কর্নিয়া কেটে নিলেও এরা তৈরি করে নিতে পারে তিন-চার দিনের মধ্যে।“ স্যার থেমে থেমে বললেন। “সমুদ্র, বল তো, কিভাবে এটা সম্ভব?”

“সঠিকভাবে কোনও হাইপোথিসিস দেওয়া যায়নি। তবে, মনে করা হয়, ওরা কোনোভাবে ক্ষতস্থানের ম্যাক্রোফাজগুলোকে বেশি অ্যাক্টিভ করে তোলে ইন্টারলিউকিন ছেড়ে দিয়ে। ইন্টারলিউকিনও আসলে একপ্রকার সাইটোকাইন। আর তাই সেখানকার কোশগুলো রূপান্তরিত হয় প্লুরিপোটেণ্ট কোশে, যারা একইসাথে অনেকরকম কোশ তৈরি করতে পারে, যেটা আগেই বলেছি। তাই অত তাড়াতাড়ি রিজেনারেশন সম্ভব হয় ওদের শরীরে। এছাড়াও ওদের শরীরে প্লুরিপোটেণ্ট কোশের সংখ্যা স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি। তাই এই অসম্ভবটা ওরা সম্ভব করতে পারে।“ সমুদ্র আউড়ে যায় কথাগুলো।

“এক্সেলেন্ট।“ স্যার সমুদ্রর পিঠ চাপড়ে দেন।

আমি ভাবছিলাম অন্য কথা। প্রমিথিউস কি সত্যি বাস্তবে কেউ ছিল? হেসিয়ড লিখে গিয়েছিলেন, বলেই সেটাকে প্রমাণ হিসাবে ধরতে হবে, এমন কোনও মানে ছিল না। কারন আজ থেকে ২৭০০ বছর আগে কোনও কিছুর যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা দেওয়াটাই ছিল দুরূহ কাজ।

কিন্তু যদি সত্যি হয়? যদি প্রমিথিউস বেঁচে থাকে? এমনকি, যদি হেসিয়ডের কথা সত্যিই হয়, তাহলে কি আজও বেঁচে আছে গল্পকথার সেই শক্তিমান টাইটান?

সমুদ্র আমার মনের কথাটাই তুলে ধরল, “স্যার, একটা জিনিস বুঝতে পারছি, প্রমিথিউসের লিভার খুব তাড়াতাড়ি রিজেনারেট করত। কিন্তু…এমনটা কি হতে পারে, যে সে বেঁচে আছে?”

“হতে পারে, আবার নাও হতে পারে।“ স্যার খানিকটা আত্মমগ্ন হয়েই বললেন, “কারন এটা তো জানার উপায় নেই, যে তার প্রযুক্তি তাকে রিজেনারেশন ছাড়া ইমমর্টালিটি বা অমরত্বের ক্ষমতাও দিয়েছে কিনা। আপাতত আমাদের কাজটা নিয়েই কথা বলা যাক, কেমন?”

সমুদ্র সম্মতির সুরে বলল, “ঠিক আছে, স্যার। আপনি বলুন। আমরা শুনছি।“

স্যার বলা শুরু করলেন, “হ্যাঁ, যেটা বলছিলাম, হাইনরিখ ট্যাবলেটটা পড়ার পর থেকেই তার মাথায় ভূত চেপে বসে। তখন আমাদের বয়স কম, রক্ত ফুটছে। খানিকটা সঙ্গদোষেও আমিও কাজটার জন্য জান লড়িয়ে দিতে থাকি। আমরা ঠিক করি, যে করেই হোক, প্রমিথিউস যেরকম যেরকম ভাবে ট্যাবলেটে লিখে গেছে, কিভাবে জিন এডিটিং করতে হয়, কিভাবে রিজেনারেশন ক্যাপাবিলিটি মানুষের বাড়িয়ে দিতে হয়, সেরকমভাবেই মানুষের রিজেনারেশন ক্যাপাবিলিটি বাড়াবো। বলতে গেলে, সেদিন থেকেই আমাদের নতুন প্রোজেক্ট শুরু হল। নামও দিলাম একখানা ভাল। প্রোজেক্ট প্রমিথিউস।

তবে বলতে পার, শুরু থেকেই একটা অন্ধগলিতে ছুটছিলাম। ভরসা বলতে শুধু ঐ ট্যাবলেটটাই, যার সত্যি মিথ্যে যাচাই করার মত কেউ নেই তখন। ট্যাবলেটের ওপর লেখা প্রসেসটা তোমাদের সহজ করে বলি। ফাইনম্যান এর একটা কথা তো আছে, যে বিজ্ঞানকে সহজ করে বোঝাতে পারে না, সে বিজ্ঞান নিজেই বোঝে না।

যখন কোন একটা শরীরে ক্ষত চিহ্ন সৃষ্টি হয়, তখন দুভাবে সেটা ঠিক হতে পারে। হয় প্রাইমারি ইনটেনশন দিয়ে অথবা সেকেন্ডারি ইনটেনশন দিয়ে। দুটো ক্ষেত্রেই যে রক্তপাত হয় সেখানে ইনফ্লামেশন হয়, ইনফ্লামেশন এর জন্য কিছু সাইটোকাইন তৈরি হয়। সাইটোকাইন হল কিছু রাসায়নিক পদার্থ, যারা এক কোশ থেকে অন্য কোশে গিয়ে সিগন্যালিং করে। তারপর, ম্যাক্রোফাজ এসে কাটা জায়গাটার জঞ্জাল সাফ করে, রক্তপাত বন্ধ হয়, আর ফাইব্রিন প্লাগ জায়গাটাকে বিষিয়ে যাওয়া থেকে বাঁচায়।

আর বলা বাহুল্য, ম্যাক্রোফাজগুলো ঐ জঞ্জাল খেয়ে আরও সাইটোকাইন ছাড়ে, যেগুলো ওখানকার স্থানীয় ইউনিপোটেন্ট কোশগুলোকে জাগায়, বিভাজিত হবার জন্য। রিজেনারেশন তখন শুরু হয়। আর যখন রিজেনারেশন করেও কাটা জায়গার কোশের ঘাটতি পূর্ণ হয় না, তখন ফাইব্রোব্লাস্টগুলো কোলাজেন ফাইবার তৈরি করতে থাকে জায়গা ভরানোর জন্য।“

স্যার এবার বর্ণালীর দিকে তাকিয়ে বললেন, “এবার ভেবে বল তো, কেন তোমার আমার শরীরে কোনও কাটা ছেঁড়া হলে, সেই জায়গাটা কখনই তার পুরো কার্যক্ষমতা ফিরে পায় না?”

বর্ণালী বিজ্ঞের মত বলতে থাকল, “স্যার যতদূর জানি, আমাদের শরীরের রিজেনারেশন খুব বেশি ভালো হয় না তা কারণ আছে আমাদের শরীরের মধ্যে থাকা প্লুরিপোটেন্ট কোষের সংখ্যা অত্যন্ত কম। তাই আমাদের রিজেনারেশন ফাইব্রোসিসেই সীমাবদ্ধ। সেই জন্য রিজেনারেশন রেটটা অত্যন্ত কম। রিসেন্ট গবেষণা বলছে যে স্টিমুলাস এর মাধ্যমে নরমাল কোষকে প্লুরিপোটেন্ট বানানো যায়।“

স্যার ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালেন, ” ঠিক। এটাও সেদিন ঐ পাথরের গায়ে লেখা ছিল। বুঝতে পারছ, কি বলতে চাইছি? প্রমিথিউস জানত, আর কোনোভাবে এই এক প্রযুক্তিই সে ব্যবহার করেছিল নিজের ওপর, যার জন্য তার লিভার রাতারাতি ঠিক হয়ে যেত।“

আমরা স্তম্ভিত তখন। সব গুলিয়ে যাচ্ছে। গ্রিক পুরাণ, জিন, কিডন্যাপিং, বুড়ো জিপসির কথাগুলো, রিজেনারেশন সব গুলিয়ে যাচ্ছে। যা ঘটছে, সবই কি বাস্তব তাহলে?

কিন্তু তাহলে আধুনিক বিজ্ঞানের জায়গাটা কোথায় হবে? সবই তো শেষে পুরাণে, বা জাদুবিদ্যায় গিয়ে শেষ হবে। তাহলে যেখানে বিজ্ঞানের শেষ, সেখান থেকেই কল্পনার শুরু হয়? যাকে বিজ্ঞানসম্মতভাবে আমরা ব্যাখা করতে পারি না, তাকেই আমরা কল্পনা, অবাস্তব, পুরাণ বলেই চালিয়ে দিই?

 

~ কোড নেম: প্রমিথিউস (পর্ব ১১) ~

Print Friendly, PDF & Email
Previous articleকোড নেম: প্রমিথিউস (পর্ব ১০)
Next articleডায়রির পাতা
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments