অনেকদিন হল রিয়ার পেটে ভালো খাবার জুটেনি৷ আজ প্রায় ২-৩ বছর হয়েছে , এক পথ দুর্ঘটনায় সে তার মা-বাবা সহ নিজের একটি পা হারিয়ে ফেলে৷ সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান৷ তবে মা বাবা মরা নিঃসহায় মেয়েকে পরিবারের জেঠা-কাকারা সম্পত্তির লোভে আর বাড়িতে ঢুকতে দেয়নি৷ সেই থেকে পথে-ঘাটে ভিক্ষা করে কোনরকমভাবে দিন কাটাচ্ছে৷ করবেও বা কী! বয়স সবেমাত্র ১০ হল৷ দেখতে ভারী সুন্দর৷ শরীরের রং ফর্সা ৷ চুল কোমর ছুঁয়েছে প্রায়৷ তবে পরিচর্যার অভাবে আর সেই মাধুর্য নেই৷ রুক্ষ চুলে উকুন ধরেছে৷ তবুওতো রূপ ঢলে পড়েনি৷ রাস্তায় যখন বের হয় ভিক্ষা দেওয়ার বাহানায় কত মানুষ অন্তরঙ্গ স্পর্শ করে যায় ৷ ললুপতার বাজে ইঙ্গিত রিয়াকে কোন কোন সময় কাঁদিয়ে ফেলে৷ কিন্তু কী করবে!অসহায় ভাগ্যের অবলা নারী সে৷
রিয়া আজ ভিক্ষা করতে করতে নিজের বাড়ির রাস্তার মোড়ে গিয়ে পৌঁছায় ৷ মনে হচ্ছে বাড়িতে কোন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে৷ খোড়াতে খোড়াতে সে গলির ভিতর ঢুকলে , চেনা লোকেরা দেখে কেউ হেসে বলল —এল রে আমাদের ভিখারি মেয়ে৷ বরণডালাটা নিয়ে আয়৷ কেউ চুপিচুপি হাসল৷ কেউ আবার ভগবানের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল—এমন ভাগ্য যাতে কারো না হয়৷
রিয়া ততক্ষনে সবকিছু উপেক্ষা করে বাড়ির গেটের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় ৷ খুব সুন্দর আয়োজন৷ ইয়া বড় পেণ্ডেল৷ মাছ-মাংস আরও কতধরণের ব্যঞ্জনে মিশ্রিত রান্নার সুগন্ধ৷ পেটে বড় জ্বালা করছে রিয়ার৷ ভাবতে ভাবতেই টিটন কাকু কার খোঁজে যেন বাইরে বেরিয়ে এল৷ রিয়াকে দেখেই হতভম্ব ৷ রিয়া কিন্তু টিটন ছোট্টুকে ভুলেনি৷ কত ভালোবাসতো রিয়াকে সে! রোজ বিকেলে চানাচুর কখনো চপ খাওয়ানোর উদ্দেশ্যে বাইরে বেড়াতে নিয়ে যেত৷ তাকে দেখে রিয়া ছোট একটি হাসি দিল৷ টিটন দৌড়ে বাড়ির ভিতর ঢুকে পড়ল৷
নেমন্তন্ন বাড়িতে প্রচুর লোকের সমাগম,আদর আপ্যায়ন চলছে৷ বেশ সরগরম মহল ৷ বিকেল প্রায় ৫টায় সবকিছু শেষ হওয়ার পর বড় জেঠিমা সহ টিটন কাকু বেরিয়ে এল৷ এসেই রিয়ার দিকে তাকিয়ে জেঠিমায়ের প্রশ্ন— অলুক্ষণে মেয়ে কী চাই তোর? বাপ-মা খেয়ে এখন কী আমাদেরও খেতে এসেছিস?
রিয়া মুখ নামিয়ে, পা কাটা জংঘায় হাত রেখে বলল— জেঠি খুব খিদা পেয়েছে৷ অল্প ভাত দিবে?
—ওম্ , ন্যাকা , ভাত খাবে! তা যা না ভিক্ষা কর৷ এখানে এসে মরতে পারলি? একেবারে আদরে নাদুস নুদুস!
হ্যাঁ , একসময় রিয়া ওদের খুব আদরের ছিল৷ আগে রিয়া খাবে তারপর ওরা খাবে ৷ এইছিল তাদের ভাব ৷
সে যাই হোক৷ জেঠিমা টিটন ছোট্টু সহ কিছু কটুক্তি করার পর একটি কাগজের থালে অল্প ভাত,ডাল ও একটা বেগুন ভাজা এনে দিয়ে বলল—এই নে, খেয়ে যা এখান থেকে তাড়াতাড়ি৷ আর যেন কোনদিন এখানে না দেখি৷ বলেই বাড়ির ভিতর ঢুকে পড়ল৷
টিটন ছোট্টু তখন নিজের মেয়ে সঙ্গে নিয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে৷ রিয়া ছোট বোনকে দেখে একটা হাসি দিল,তখনি মিনু ভয়ে দৌড়ে গিয়ে বলল— ও মা পাগলি দেখে হাসে যে!
মেঘ করেছিল আকাশে আজ হঠাৎ করেই৷ ভাতের দুই গোরাস মুখে দিতেই ঝুমঝুম করে নামল বৃষ্টি৷ রিয়া ভাত সহ থালাটাকে বাঁচানোর জন্য যেই না বাড়ির গেটের ভিতর হাত বাড়াল, অমনি টিটন ছোট্টু গেটে তালা দিয়ে বাড়ির ভিতর ঢুকে পড়ল৷ নিমিষেই কাগজের থালা সহ সমস্ত খাবার বৃষ্টির জলে ধুঁয়ে নিয়ে যায়৷
রিয়ার চোখ থেকে সেদিন জল বেরিয়েছিল নাকি বৃষ্টির জলই চোখের জলে পরিণত হয়৷ এইটি অদৃষ্ট ছাড়া আর কারোরই সেদিন বুঝবার ক্ষমতা ছিল না ৷