নিউটনের তৃতীয় সূত্র অনুযায়ী প্রতিটা বলের সমান এবং বিপরীত মুখী প্রতিক্রিয়া আছে। একই রকম ভাবে যদি প্রতিটা দানের অন্ততপক্ষে সমান প্রতিদান থাকত, তবে কেমন হত? নিউটনের সূত্রে ওই ‘বিপরীত মুখী’ শর্তটা একটু পরিবর্তন করা যাক। ধরা যাক যে দাতা প্রতিদান পাবেনই, তা সে গ্রহীতার কাছ থেকে হোক বা অন্য কোন তৃতীয় ব্যাক্তির কাছ থেকে হোক। তাহলে কিন্তু এই পৃথিবীতে একটা জিনিস থাকত না, তা হল দরিদ্রতা। কারণ সবাই তখন দান করতেন, প্রতিদানের আশায়। কিন্তু তা হয় না। তাই এখনও আমাদের স্বাধীন ভারতবর্ষের প্রতি পাঁচজনের মাঝে একজন, দরিদ্র সীমার নিচে বাঁচেন। কিন্তু মরুতেও খুঁড়লে কখনো কখনো যেমন জল পাওয়া যায়, তেমনই পৃথিবী নামক এই মরুভূমিতে কখনো কখনো দান এবং প্রতিদানের আদান-প্রদান হয়েই থাকে। আর এরকমই একটা দান-প্রতিদানের গল্প বলার জন্যেই আজ কলম ধরা।
মহাষ্টমীর সন্ধ্যে, তখন আট’টা বাজে। রাস্তায় রাস্তায় বিভিন্ন রকমের আলোক সজ্জা। মাইকের কানফাটা আওয়াজ। পুরো কলকাতা মেতে উঠেছে। রাস্তায় লম্বা ট্রাফিক জ্যাম। গাড়িগুলো দু’পা এগোয় আবার থেমে যায়। প্রাইভেট গাড়ি, বিশেষত মোটর বাইকের সংখ্যাটাই বেশী। তার মধ্যে অটো, ঠেলা-রিকশা এগুলো তো আছেই। গড়িয়া হাট ক্রসিং এ যে রাস্তাটা বালিগঞ্জ ষ্টেশনের দিকে গেছে, সেই রাস্তার একদিকে লম্বা ঠেলা রিকশার লাইন। যাদের গাড়ি লাইনের একটু পেছনে তাদের বেশির ভাগই গাড়ির উপরে বসে বসে ঝিমচ্ছে। গত রাতের বকেয়া ঘুমটা মিটিয়ে নেওয়ার চেষ্টা বোধহয়। আর যাদের গাড়ি লাইনের সামনে, তাদের কেউ কেউ গল্প করছে, কেউ আবার হাতে খইনি ডলতে ডলতে প্যাসেঞ্জারের অপেক্ষা করছে। এখন যিনি লাইনের এক্কেবারে সামনে, তাঁর বয়স অন্তত ষাটের বেশী হবে। গাড়ির উপর বসে তিনি তখন প্রচন্ড কাশি সামলিয়ে জোরে জোরে দম নিচ্ছিলেন। এমন সময়ে মধ্যবয়স্ক একজন ভদ্রলোক এসে জিজ্ঞাসা করলেন -ও কাকু, ষ্টেশনের দিকে যাবেন?
জি বাবু যাবে। -বলে ধীরে ধীরে গাড়ি থেকে নামলেন। দেখে বোঝা খুবই শক্ত যে ইনিই রিকশাটা এখন ঠেলে নিয়ে যাবেন। এক্কেবারে জীর্ণ শরীর। একটা ময়লা লুঙ্গি হাঁটু পর্যন্ত ঝুলছে। গায়ে একটা গেঞ্জি। গেঞ্জিটার উপর থেকেও বুকের হাড়গুলো গোনা যাবে। গেঞ্জিটার ঘাড়ের কাছে হাজার ছিদ্র। মনে হয় কোন পোকার দল কুড়ে কুড়ে খেয়েছে। মাথার চারদিকে একটা গামছা জড়ানো। তার উপরে রোদে পোড়া টাকটা উঁকি দিচ্ছে।
বুড়োর ঠেলা রিকশা তখন ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে। গাড়ির সিটে তখন সেই ভদ্রলোকটি বছর সাতেকের একটা ছেলেকে কোলে নিয়ে বসে আছেন। বাঁ দিকে তাঁর স্ত্রী কোলে আর একটা বাচ্চা নিয়ে বসে আছেন। বাচ্চাটা ঘুমাচ্ছে, বয়স ঠিক ক’ত বোঝা শক্ত, কারণ বাচ্চাটার মুখ বাদে পুরো শরীরটাই ঢাকা। বড় ছেলেটার হাতে একটা গ্যাস বেলুন। বেলুনের সুতোটা ডান হাতের মধ্যমাতে জড়ানো। বেলুনটাকে ঘুড়ির মত ওড়াচ্ছে সে। হঠাৎ চিল্লিয়ে উঠে সে বুড়োটাকে বলল -ও কাকু একটু জোরে চালাও না।
সঙ্গে সঙ্গে তার বাবা বললেন -কাকু না সোনা, আমার কাকু হন, তোমার দাদু হবেন, দাদু বলবে। দেখছ না সামনে ভিড়, জোরে চালাবেন কি করে! তুমি আমাকে ধরে চুপ করে বসে থাক। আমরা একটু পরেই নামব।
বাচ্চার কথা শুনে বুড়োটা তখন হাসতে গিয়ে কেশে অস্থির। কাশি থামিয়ে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন -তুমার নাম কী আছে বাবু?
নাম বল সোনা। তোমার নাম জিজ্ঞাসা করছেন দাদুটা। সে তখন বেলুনটাকে নিয়ে খেলা থামিয়ে বলল -আমার নাম রাহুল, রাহুল ভৌমিক। তোমার নাম কী?
হামার নাম? হামার নাম কাশীনাথ আছে বাবু।
ও-বুঝেছি, তুমি সবসময় কাশো বলে তোমার বাবা-মা কাশীনাথ নাম দিয়েছে বুঝি? -ঘাড় নাড়তে নাড়তে কথাটা বলল সে। যেন কোন গোপন রহস্য উদ্ধার করে ফেলেছে, এমন একটা ভাবভঙ্গী।
বুড়োটা এবারে হাসতে গিয়ে এত জোরে কাশতে শুরু করলেন যে গাড়িটা একবার বেশ কেঁপে উঠল। রাহুলের মা তখন ভয় পেয়ে গিয়ে ছেলেকে হালকা বকুনি দিয়ে বললেন -এই তুই পাকা পাকা কথা বন্ধ করবি!
রাহুল তখন আবার বেলুন ওড়াতে মন দিল। বুড়োটার কাশি তখন থেমেছে। তিনি আবার জিজ্ঞাসা করলেন -রাহুল বাবু, তুম আজ কিতনা ঠাকুর দেখা হ্যায়?
রাহুল বলল -একটাও না। তুমি ক’টা ঠাকুর দেখেছ?
হামিভি একটাও না।
তুমি যাবে আমাদের সাথে?
জরুর যাবে, জরুর যাবে বাবু।
বাবা ‘জরুর’ মানে কী গো?
‘জরুর’ মানে ‘নিশ্চই’। -মা ঠোঁটে আঙ্গুল দিয়ে ঈশারা করে আবার ছেলেকে চুপ করতে বললেন। তিনি চান না বুড়ো বেশী কথা বলুক। কারণ কথা বলতে গেলে প্রায়ই বুড়োর কাশি পেয়ে যাচ্ছে। কাশির চোটে গাড়িটা একবার কেঁপেও উঠেছিল। তাঁর কোলে একটা বাচ্চা আছে। তাই তাঁর ভয়। রাহুলের বাবা এতক্ষন চুপ করে বসে ছিলেন। তিনি বললেন -আপনার এত কাশি হচ্ছে, ডাক্তার দেখাচ্ছেন?
জি বাবু, নেহি। ও ঠিক হো জায়েগা আপনে আপ।
নিজের প্রত্যাশিত উওর পেয়ে আর কিছু না বলে, স্ত্রীর দিকে তাকালেন।
পূব আকাশে প্রায় অর্ধেক চাঁদটা তখন জ্বলজ্বল করছে। রাহুলের বাবা এক দৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছেন চাঁদটার দিকে। বুড়োর রুগ্ন শরীরের শেষ শক্তি দিয়ে ঠেলা রিকশাটা যখন এগিয়ে চলেছে পৃথিবীর বুকে সুড়সুড়ি দিতে দিতে, ঠিক তখনই, সেই পৃথিবীর বুকে এক দল মানুষ পুজোর আনন্দে মাতোয়ারা। পুজো-প্যান্ডেল, নাগড়দোলা, আইসক্রিম, ফুচকার দোকানগুলোয় মানুষের ঠাসা ভিড়। পুজোর স্বাদ নিতে ব্যস্ত সবাই। না। সবাই বললে ভুল হবে। ঠিক সবাই নয়। আকাশের চাঁদটার কিছু অংশ যেমন অন্ধকারে, ঠিক তেমনিই, এই সমাজের কিছু মানুষ আজও দরিদ্রতার অন্ধকারে ডুবে আছে। ঠিক এই বুড়োটার মত। পুজোর রঙ্গীন আলো তাদের জীবন আলোকিত করতে পারেনি। তাদের কাছে পুজোর এই পাঁচ’টা দিন আর বাকি দিনগুলোর মতই। এই বুড়োটা আজ থাকতেই পারতেন ঘরে। পারতেন আপনজন কে নিয়ে আজ দু’টো ঠাকুর দেখে আসতে। কিন্তু অভাব তাঁকে ছুটি দেয়নি, কবে দেবে তারও ঠিক নেই। চাঁদের যে অংশটা আজ অন্ধকারে আছে কাল সে আলোয় আসবে, দেবে স্নিগ্ধ জোৎস্না। তাকে নিয়ে আমাদের ভাবী কবিরা কবিতা লিখতে বসবেন। কিন্তু এদের জীবনে দরিদ্রতার অন্ধকার যেমন আজ আছে, কালও থাকবে। এদের কথা কোন পাতার বুকে কালির আঁচড় কাটবে না।
বুড়োর ঠেলা রিকশাটা তখন একটা বিরাট বড় পুজো প্যান্ডেলের সামনে দিয়ে যাচ্ছিল। এখান থেকে ষ্টেশন খুব কাছেই। রাহুলের মা তখন বললেন -আচ্ছা, আমরা তো এখানেই নেমে যেতে পারি, এই ঠাকুর টা নাকি খুব ভাল করেছে, শ্যামলীর মা বলছিল। রাহুলের বাবা তখনও চাঁদটার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। স্ত্রীর কথায় তাঁর যেন ধ্যান ভঙ্গ হল। ভাড়া মিটিয়ে চলে আসার সময় যখন রাহুল দেখল যে বুড়ো ওদের সাথে পুজো দেখতে যাবেন বলেও যাচ্ছেন না, তখন সে বাবা কে জিজ্ঞাসা করল -বাবা, দাদুটা আসবে না?
হ্যাঁ সোনা, আসবেন। উনি এখন ওঁনার গাড়ি রাখতে যাবেন। তারপরে আসবেন। চল আমরা ততক্ষন এই ঠাকুরটা দেখে আসি। -ছেলেকে ভোলানোর চেষ্টা করলেন।
বুড়ো তখন চলে যাচ্ছিলেন ষ্টেশনের দিকে। যত তাড়াতাড়ি যাবেন, তত আগে জায়গা পাবেন লাইনে। রাহুল তখন জিজ্ঞাসা করল -দাদু কোথায় গাড়ি রাখতে যাচ্ছে, বাবা?
রাহুলের বাবা তখন বুড়োটার দিকে নিস্পলকে তাকিয়ে ছিলেন। রাহুলের মা বললেন -কী হল, চল? দাঁড়িয়ে রইলে যে? ভদ্রলোক তখন রাহুল কে বললেন -সোনা, দাদুটাকে ডাক তো।
বুড়োটা কাছে এলে, ভদ্রলোক বললেন -কাকু, চালিয়ে হামারে সাথ। এক ঠাকুর দেখকে আইয়েগা। বাস এক।
বুড়ো তখন দাঁতহীন এক গাল হাসি হেসে, আর এক বুক কাশি গিলে বললেন -বাবু, আপলোগ যাইয়ে। অন্দর বহত ভিড় হোগা। দের হো জায়েগা মেরা। এ সব হাম লোগোঁ কে লিয়ে নেহি হে বাবু।
রাহুলের বাবার চোখ তখন বুড়োর পায়ের দিকে গেল। ডান হাঁটুর নিচে একটা ব্যান্ডেজ বাঁধা আছে। বাইরের হলুদ দাগটা দেখে বোঝা যায় যে ভিতরে একটা বড় ক্ষত। ‘এ সব হাম লোগোঁ কে লিয়ে নেহি হে বাবু’ -বুড়োর এই কথাটা সেরকমই একটা ক্ষতের সৃষ্টি করে চলেছে, তাঁর বুকের ভিতরে নীরবে। পকেট থেকে পার্সটা বের করলেন। পার্সে এক’শ টাকার তিনটে নোট। দুটো নোট বের করে দিলেন বুড়োটাকে। বুড়ো তখন অবাক হয়ে গিয়ে কী করবেন বুঝতে পারলেন না। বললেন -নেহি বাবু এ…
নেহি নেহি, এ আপকো লেনা পাঢ়েগা, মেরা লেড়কা দেরাহা হে, লিজিয়ে।
বাবার হাত ধরে রাহুল তখন ঘাড় উঁচু করে, গাল হাঁ করে ঠাকুর দেখছিল। তখন মায়ের পুজো চলছিল। রাহুল হঠাৎ বাবাকে জিজ্ঞাসা করল -বাবা তুমি ওই দাদুটাকে টাকা দিলে কেন?
রাহুলের বাবা তখন কী বলবেন বুঝতে পারলেন না। স্ত্রীর দিকে তাকালেন। রাহুলের মাও ছেলের প্রশ্ন শুনেছেন। তিনি রাহুলের মাথায় হাত বুলিয়ে স্নেহ করলেন। রাহুলের বাবা বললেন -ঠাকুর দেখতে এলে পুজো দিতে হয় সোনা, তাই পুজো দিলাম। রাহুল তখন অসুরের গলার সাপটার দিকে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে ছিল। বাবার কথায় মন দিল না।
রাত তখন দশটা হবে। লাইনে গাড়ি রেখে ট্রেন রাস্তার ধারে একটা চায়ের দোকানে দোকানে বসে চা খাচ্ছিলেন সেই বুড়োটা। কোমরের কাছে লুঙ্গির ভাঁজে নোট দুটো মোড়া ছিল। আরও একবার হাত বুলিয়ে নিলেন টাকাটার উপর। টাকাটা রাখার পর থেকে ঘনঘন হাত চলে যাচ্ছে সেই জায়গায়, টাকাটা আছে তো! টাকাটা পাওয়ার পর থেকে তিনি ভাবছিলেন যে কোথায় খরচা করবেন। আগে নেশা করতেন খুব। কিন্তু বড় মেয়ে আত্মহত্যার ধমকি দেওয়ার পর থেকে সে অভ্যেসটা গেছে। ছোট মেয়ের নূপুরের সখ ছিল খুব। এই ক’দিন হল তাকে একজোড়া নূপুর কিনে দিয়েছেন। এখনো সেই দোকানে পাঁচ’শ টাকা বাকি আছে। একবার ভাবলেন এই টাকা দিয়ে কিছুটা ঋন শোধ করবেন। তারপর ভাবলেন, বাইকের ধাক্কায় হাটুতে ঘায়ের জন্য ডাক্তার খানায় যে বাকিটা হয়েছে, সেটা মিটিয়ে দেবেন। তারপর হঠাৎ মনে পড়ল যে রাহুলের মা যখন আজকের গাড়ি থেকে নামতে যাচ্ছিলেন, তখন তার শাড়ি আটকে যাওয়ায় প্রায় পড়ে যাচ্ছিলেন। এতে তার শাড়িটা কিছুটা ছিঁড়েও গিয়েছিল। শাড়িটা তাঁতের ছিল। এই পুজোতে বউ বলেছিল সে একটা তাতের শাড়ি কিনবে। টাকাও জমেছিল কিছু। কিন্তু মেয়ের নূপুরের জন্য সে টাকার কিছুই অবশিষ্ট নেই। তাই ভাবলেন যে আজ বাড়ি যাওয়ার সময় একটা তাঁতের শাড়ি কিনে নিয়ে যাবেন। বউ খুব খুশি হবে। ভেবে বুড়ো আর একবার টাকার ভাঁজের উপর হাত বুলিয়ে নিলেন। আছে, টাকাটা আছে! কতদিন যে বউকে কিছু কিনে দেওয়া হয়নি! ভেবে বুড়োর ইচ্ছে হল, এখনি কিনে নিয়ে বাড়ি যাই। চায়ে শেষ চুমুক টা দিয়ে উঠে দাঁড়ানোর সময় তাঁর সহসা খেয়াল হল, দু’শো টাকায় একটা তাঁতের শাড়ি হবে তো? ঝটপট করে চায়ের দাম টা মিটিয়ে গুনতে বসলেন আজকের মোট রোজগার। গুনে হল মোট সাতানব্বই টাকা। ইস, যদি চা টা না খেতাম তাহলে পুরো একশ টাকা হয়ে যেত! বুড়ো আফশোশ করতে লাগলেন। যদি কম পড়ে তো পড়ুক গে, বাকি টাকা নাহয় আজ কাল খেটে মিটিয়ে দেওয়া যাবে। কাঁচা পয়সা রোজ কামাই, আমার আর অভাব কিসের! এখনও গতরটা তো আছে। এই সব ভাবতে ভাবতে নতুন উদ্যমে বুড়ো এগোচ্ছিলেন নিজের গাড়ির দিকে। এতক্ষন পায়ের ব্যাথার জন্য হালকা খোড়াচ্ছিলেন, এখন সেটা এক্কেবারেই নেই। তখনও রাস্তায় মানুষের ভিড় কমেনি। কমেনি ট্রাফিক জ্যামও। ঠাকুর দেখে কিছু দল যেমন বাড়ি ফিরছে, তেমন কিছু আসছেও। কলকাতায় রাত দশটা মানে কিছুই না। তারপর আবার পুজোর সময়। সেই ভিড়ের মধ্যে থেকে একটা বাচ্চা ছেলের কান্নার আওয়াজ কানে আসছে। বুড়ো যত এগোয়, আওয়াজটা তত জোর থেকে জোরালো হচ্ছে। রাস্তার পাশে প্রায় অন্ধকার একটা জায়গায় ছেলেটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদছিল। বুড়ো সেই অন্ধকারেও ছেলাটাকে চিনতে পারলেন। রাহুল! বুড়োকে দেখে রাহুল আরও জোরে কাঁদতে লাগল। কি জানি কেন। হাতের গ্যাস বেলুনটা তখন আর নেই। ফেটে গেছে হয়ত। কিন্তু আঙ্গুলে বেলুনের সুতোটা ঠিক তেমন ভাবেই জড়ানো আছে। বুড়ো অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন -আরে রাহুল বাবু! তুম রোতা কিঁউ? তুমার বাবা-মা কাঁহা আছে?
রাহুল কিচ্ছু না বলে আরও জোরে কাঁদতে লাগল। বুড়োর তখন একটুও বুঝতে অসুবিধে হল না যে সে হারিয়ে গেছে। বুড়ো বললেন -চালো, বাবু হামি তুমাকে বাবা-মায়ের পাশ নিয়ে যাবে, রোও মত বাবু। বুড়োর এই কথাগুলো যেন ম্যাজিকের মত কাজ করল। রাহুল থামল। বুড়ো সুযোগ পেয়ে জিজ্ঞেস করলেন -তুমার বাবা-মা কাঁহা আছে বাবু? রাহুল বলল -আমি একটা দোকানে এরোপ্লেন দেখছিলাম, তারপর ঘুরে দেখি বাবা-মা কেউ নেই। বলে আবার কাঁদতে লাগল। বুড়ো জিজ্ঞেস করলেন -কোন দুকানে তুম এরোপ্লেন দেখছিলে? হামাকে লেকে যেতে পারবে? রাহুল মাথা নেড়ে বলল -না।
রাহুলের সাথে আরও কথা বলে বুড়ো জানতে পারেন যে এখানে সে পিসির বাড়ি এসেছে, হাজরাতে। তার নিজের বাড়ি নামখানায়। কিন্তু পিসির বাড়ি চেনে না সে। আশেপাশে অনেকগুলো জায়গায় পুজো হচ্ছে। বুড়ো সবচেয়ে কাছের প্যান্ডেল খুঁজে দেখলেন প্রথমে। পাওয়া গেল না রাহুলের বাবা-মা কে। তারপর বুড়োর খেয়াল হল যে পুজোর সময় তিনি মাইকে অনেক নিখোঁজের ঘোষণা করতে শুনেছেন। তাই তিনি সেই প্যান্ডেলের মাইক সেন্টারে গিয়ে সব বললেন, তাঁরা ঘটনাটা ঘোষনাও করলেন অনেক বার। প্রায় আধ ঘণ্টা হয়ে গেল। কেউ এলেন না রাহুলের খোঁজে। তারপর সেখানকার একজন ভদ্রলোক বললেন বুড়োকে -আভি য়্যাহাঁ প্রোগ্রাম চালু হোগা, আব হামলোগ অ্যানাউন্স নেহি কার সাকেঙ্গে। আপ এক কাম কিজিয়ে, পুলিশ স্টেশন যাইয়ে, এক F.I.R. কারকে আইয়ে।
বুড়ো যখন রাহুল কে নিয়ে পুলিশ ষ্টেশনে পৌঁছান তখন রাত এগারোটা বাজে। গেটের কাছে একজন পুলিশ দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি কারণ জানার পর ঢুকতে দিলেন বুড়োকে। থানায় ঢুকেই সামনে একটা টেবিল। টেবিলের ওপারে চেয়ারে বসে একজন পুলিশ ঝিমোচ্ছেন। বুড়োর কাশির শব্দে তাঁর ঘুম ভাঙল। ঘরটার ডান দিকের দেওয়ালের কাছে একটা বেঞ্চে আরও একজন পুলিশ শুয়ে নাক ডাকছেন। বুড়োর কাশির শব্দ তার ঘুম ভাঙাতে পারেনি। সেই ঘরটাতে আর কেউ নেই। ভেতরে আরও পুলিশ থাকতে পারে। তবে তারাও বোধহয় নিদ্রা গেছেন। কারন কারও কোন সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। বুড়ো কাছে গেলে, একটা বড় হাই তুলে পুলিশটা জিজ্ঞেস করলেন -কী ব্যাপার?
হুজুর, এ লেড়কা খো গয়া হ্যায়।
বুড়োর সাথে দেখা হওয়ার পর থেকে রাহুল একবারও বুড়োর হাত ছাড়েনি। এখনো একই রকম ভাবে সে বুড়োটার হাত ধরে চুপচাপ বুড়ো আর পুলিশের কথোপকথন শুনছে। সমস্ত কথা শোনার পর পুলিশটা বললেন -ঠিক হ্যায়, আপ তিন’শ রুপিয়া দিজিয়ে। কাম হো জায়েগা।
বুড়ো বললেন -হুজুর, মেরে পাস প্যায়সা নেহি হ্যায়। আভি লিখ লিজিয়ে, ফির ইস্কে ঘরবালো সে লে লেনা।
পুলিশ ধমক দিয়ে বললেন -কিসসে প্যায়সা লেনা হে অওর কিসসে নেহি লেনা হ্যায় এ আপ হামে মাত বোলিয়ে। F.I.R. ফ্রী মে লিখ লুঁ ক্যয়া? ম্যায় শালা রাত মে বিবি বাচ্চো কো ছোড়কে ইধার আপকা F.I.R. লিখনেকে বাস্তে ব্যাইঠা হুঁ? এয়সা চলতা নেহি। মাল ছোড়িয়ে, নেহি তো এ মাল লে কে যাইয়ে। সিম্পল বাত হ্যায়।
পুলিশের মেজাজ দেখে রাহুল তখন ভয়ে থরথর করে কাঁপতে শুরু করে দিয়েছে। বুড়ো সেটা লক্ষ্য করলেন। অশিক্ষিত, সরল বুড়ো ভাবলেন, সত্যিই হয়ত F.I.R. করতে পয়সা লাগে। কিন্তু তিন’শ টাকা পাবেন কোথায়! সব মিলিয়ে মোটে দু’শ সাতানবই টাকা আছে কাছে। তিনি বললেন -হুজুর, উতনা তো নেহি হ্যায়, দো’শো সে কাম হোগা বাবু? পথের ভিখারিকে এক টাকা দিয়ে যদি পঞ্চাশ পয়সা তার থলি থেকে তুলে নেওয়া হয়, তবুও সে প্রাণ ভরে আশীর্বাদ করে দাতাকে। এরা যে সভ্য ‘ভিখারি’। এদের কাছে দরাদরি চলবে না। পুলিশটা এবার গেটের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশটাকে ডেকে বললেন -এই রামু, ইনকো বাহার নিকালো। বুড়ো তখন কাঁদুমাদু হয়ে কাছে থাকা সেই দু’শো টাকা আর নিজের উপার্জন ঢেলে দিলেন পুলিশের টেবিলে। পুলিশটা তখন রামুকে বাইরে যেতে বলে বুড়োকে বললেন -এ ক্যয় হ্যায়?
বুড়ো কাশতে কাশতে বললেন -হুজুর, এহি হে বাস অওর কুছ নেহি মেরে পাস, সাচ বোল রাহা হুঁ।
পুলিশের সম্মানে লেগেছে কিনা ঠিক ঠাওর করতে পারিনা, তিনি শুধু নোট গুলো বেছে নিয়ে বাকি খুচরো গুলো বুড়োকে দিয়ে বললেন -ঠিক হ্যায় হো যায়গা। আভি আপ যাইয়ে। তারপর রাহুলের দিকে ঘুরে জিজ্ঞাসা করলেন -তোমার নাম কী বাবু?
রাহুল তখন কাঁপা কাঁপা গলায় বলল -রাহুল ভৌমিক।
এসো তুমি এখানে বস। অওর আপ আভি যা সকতে হ্যায়। -বলে পুলিশ টা টেবিলের উপর পা তুললেন।
বুড়ো যখন থানা থেকে বেরিয়ে আসছেন তখন বেঞ্চে বসে রাহুল তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ থেকে নীরবে জল ঝরে যাচ্ছে। পুলিশের ভয়ে কান্না নীরব ছিল বোধহয়। বুড়ো ঘাড় ঘুরিয়ে আর একবার রাহুলের দিকে তাকালেন। রাহুল কাঁদছে দেখে বুড়ো আবার তার কাছে এসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন -চিন্তা না করো রাহুল বাবু, আভি তুমার বাবা-মা আ জায়েঙ্গে।
বুড়ো চলে যাওয়ার পর, পুলিশ টা একটা নাম্বারে ডায়াল করে বললেন -হ্যাঁ, রাহুলকে পাওয়া গেছে, নিয়ে যান।
রাহুলের বাবা-মা যখন থানায় ঢুকলেন, তখন রাত প্রায় বারোটা। রাহুলের বাবা পুলিশ কে বললেন -আপনাকে যে কী বলে ধন্যবাদ দেব, বুঝতে পারছিনা। পুলিশ এক গাল হাসি হেসে বললেন -আরে না না, ধন্যবাদ কেন দেবেন, এটা তো আমাদের কর্তব্য। ঠিক আছে আপনি এই টাকাটা রাখুন -বলে রাহুলের বাবা পুলিশ কে কিছু টাকা দিলেন। রাহুল সহসা বলে উঠল -বাবা এই পুলিশটা দাদুটার কাছ থেকেও টাকা নিয়েছে।
কোন দাদুটা সোনা?
ওই তো, যে দাদুটা আমাদের সাথে পুজো দেখবে বলে এল না।
রাহুলের বাবা তখন হতবাক। কিছুক্ষনের জন্য যেন সব ইন্দ্রিয় কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। চোখের সামনে শুধু সেই দুর্বল, জীর্ণ মানুষের শুকিয়ে যাওয়া মুখটা। কিছুক্ষন পরে যখন পুলিশ বললেন -আপনি চাইলে টাকাটা নিয়ে নিতে পারেন, তখন রাহুলের বাবা পুলিশের দিকে শুধু ঘুরে তাকালেন মাত্র। কিছু বলার তার আর এখন ভাষা নেই বোধহয়। কিংবা, ভাষা থাকলেও ইচ্ছে নেই হয়তো।
থানা থেকে হনহন করে বেরোনোর সময় রাহুলের বাবা রাহুলকে জিজ্ঞেস করলেন -পুলিশটা কত টাকা নিয়েছেন সোনা, দাদুটার কাছ থেকে?
দুদিকে দুটো হাত ছুড়ে দিয়ে রাহুল বলল -অনেক বাবা, অনেক!
রাহুলের মা বললেন -তোমার পুজোর প্রসাদ তুমি পেয়ে গেলে তা হলে, কি বল?
রাহুলের বাবা কিছু না বলে একটা ট্যাক্সি ডেকে বললেন -গড়িয়া হাট ক্রসিং।
ট্যাক্সিতে বসে রাহুলের মা জিজ্ঞেস করলেন -গড়িয়া হাট ক্রসিং কেন? রাহুলের বাবা ট্যাক্সির জানালার বাইরে তাকিয়ে ছিলেন। মুখ না ঘুরিয়েই বললেন -দেখি, আর একবার পূজো দেওয়ার সুযোগ হয় কিনা।
কেমন করে হবে সুযোগ! যখন ওরা ট্যাক্সি নিলেন, ‘ঈশ্বর’ তো তখন থানার সামনেই রাস্তার ওপারে দাঁড়িয়ে কাশি থামাতে ব্যস্ত ছিলেন। কেন দাঁড়িয়ে ছিলেন? পুলিশের উপর তাঁর ভরসা ছিল না? নাকি হারিয়ে যাওয়া সন্তান ফিরে পাওয়ার আনন্দ কেমন হয় দেখার জন্য? সঠিক জানা নেই। তবে এটুকু জানি যে মায়ের পুজোমন্ডপে তখন সন্ধি পুজোর মন্ত্র পাঠ চলছিল।