আজ আকাশের নক্ষত্রগুলো নেহাতই এলোমেলো ছিল বোধহয়, সকাল থেকেই দিনটা খারাপ৷ মিনতি কাজে আসেনি৷ অফিস বেরোবার আগে দুনিয়ার কাজ সামলে তানিয়ার মাথা খারাপ৷ বাজু স্কুলে বেরিয়ে গেছে সাড়ে সাতটায়৷ আজ ওর মিড্ টার্ম রেজাল্ট৷ তাই নিয়ে তানিয়া নিতান্তই দুশ্চিন্তায়৷ এগারো ক্লাসএ উঠে অবধি বাজুর পড়াশুনা যেন ক্রমশই ​নিম্নমুখী৷ কি হবে আজকের ফল কে জানে? এর মধ্যেই মাথাটা ধরা ধরা লাগছে৷ তাই অবশ্যম্ভাবী ভাবে বরের ওপর একরাশ বিরক্তি দানা বাঁধছে৷ প্রাতরাশের টেবিলে কথাটা পাড়লো সে৷

  • ‘কাল বাজুর ঘরে একটা সিগারেট পেয়েছি৷’

সন্দীপ কাগজ পড়ছিলো খেতে খেতে৷ কোনো জবাব দিলো না৷

তানিয়া আবারো বললো, ‘শুনলে কি বললাম? কাল বাজুর ঘরে একটা সিগারেট পেয়েছি৷’

মুখ না তুলেই এবার উত্তর দিলো ‘হুঁ৷’

  • ‘কি হুঁ?’

অতি কষ্টে নিজেকে কাগজ থেকে ছাড়িয়ে সন্দীপ মুখ তোলে, ভুরু সামান্য কোঁচকানো৷

  • ‘তো?’

তানিয়া যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারেনা৷ তাদের একমাত্র সন্তান, সদ্য সতেরো, তার ঘরে সিগারেট পাওয়া গেছে, এটার চেয়ে ভয়ঙ্কর কোনো খবর কাগজে কি করে থাকতে পারে?

  • ‘তো মানে?’
  • ‘আরে বড় হচ্ছে, তায় ছেলে, একটু আধটু এসব তো করবেই৷’
  • ‘করবেই মানে?’
  • ‘মানে একবার করেছে হয়তো৷’
  • ‘তুমি কি করে জানলে একবার করেছে? তোমায় বলে করেছে?’
  • ‘বোকা বোকা কথা বোলোনা৷ তুমিই বা কি করে জানলে একবার নয়?’

এর পর থেকেই দুজনের তর্কটা স্বামী-স্ত্রীর চিরাচরিত পথে এগোতে থাকলো – কাঁটাঝোপ আর খানাখন্দ ভরা চেনা পথে৷ সন্তান মানুষ করার দায় কার, কে সংসারকে কতটা সময় দেয় থেকে শুরু হয়ে শেষ হলো জীবনে কত বড় ভুল করেছে পরস্পরকে বিয়ে করে – বলিউডের সিনেমার থেকেও চেনা স্ক্রিপ্টে৷ যতক্ষনে অফিসে বেরোবার সময় এলো, সন্দীপ অন্তত তিনগুন বেশি শব্দ করে নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে দড়াম করে দরজা টেনে বেরিয়ে গেলো৷ তানিয়ার মাথা টিপটিপ করছে৷ ইচ্ছে করছে আজ অফিসটা ডুব দিতে৷ কিন্তু আজ জরুরি মিটিং আছে একটা, কাটানো যাবে না৷ অন্ধকার মন নিয়ে অফিসে রওনা দেয় সে৷

অফিসে এসেও কাজে মন বসছে না তানিয়ার৷ আজ মিটিঙে তার প্রেসেন্টেশন আছে৷ ভাগ্য ভালো এবারের প্রেসেন্টেশনের আগে দুদিন সময় পিয়েছিলো৷ তাই স্লাইড তার তৈরী৷ কিন্তু প্রেজেন্টার হিসেবে আজ তার অবস্থা তলানিতে৷ এগারোটা নাগাদ দুটো কফির পরেও তার মাথা ধরা উর্দ্ধমুখী, মনে হয় আজ কাঁদাবে৷ বারোটা নাগাদ শুরু হলো মিটিং৷ গুরুগম্ভীর মুখে ওর সহকর্মী (এবং প্রতিযোগী) রঞ্জন বেরা তার প্রেসেন্টেশন চালু করলো৷ তানিয়ার এই মুহূর্তে মনযোগ দিয়ে শোনা দরকার, যদি কিছু তার নিজের প্রেসেন্টেশনে যোগ বা বিয়োগ দিতে হয় শেষ মুহূর্তে৷ কিন্তু তার কানের মধ্যে শব্দগুলো ঢুকছে কেমনতারা হয়ে, মৌমাছির ভনভনের মতো৷ রগের ওপর কারা যেন তাল ঠুকছে৷

‘তাই আমার মনে হয় এই আই-ও-টি ব্যবসায় আমাদের অবশ্যই বিনিয়োগ করা উচিত৷’ কানের ভনভনানিটা থেমে যেতে হঠাৎ সচেতন হয়ে ওঠে তানিয়া৷ শিট্৷ রঞ্জনের বলা শেষ৷ কনফারেন্স রুমের বাকি চারজন তাকিয়ে আছে তার দিকে৷ তানিয়া কি বলবে ভেবে ওঠার আগেই তার বস মিঃ মিত্তাল ঈষৎ রুক্ষ ভাবেই বলে ওঠেন, ‘এবার তোমার পালা তানিয়া৷’ অপ্রস্তুতভাবে তানিয়া উঠে দাঁড়ায়, শুরু করে তার প্রেসেন্টেশন৷ তার স্লাইডগুলো ঝকঝকে, যুক্তি ধারালো৷ কিন্তু আজ সে বারবার হোঁচট খায় কথা বলতে, ভুলে যায় সঠিক জায়গায় জোর দিতে৷ মিনিট কুড়ি বাদে নিতান্ত সাধারণ আর নির্জীব ভাবে সে শেষ করে, স্লাইডের জোরালো বক্তব্যের সাথে তার অনিশ্চিত গলার কোন মিল নেই৷

মিঃ মিত্তাল সুপুরুষ৷ তাঁর ফর্সা মুখে লালের ছোঁয়া, ভুরুতে ভাঁজ৷ কিন্তু অত্যন্ত ভদ্রলোক বলে বাকিদের সামনে কিছু বলতে গিয়েও থেমে যান তিনি৷ আরো দুজন সহকর্মী, একজন ফিনান্স আর একজন সিস্টেমসের, এর পরে এক এক করে নিজেদের প্রেসেন্টেশন দেন, কিন্তু তার একটা শব্দও আজ তানিয়া হৃদয়ঙ্গম করতে পারেনা৷ মৌমাছির ভনভনানি এখন ভ্যাকুয়াম ক্লিনার এর মতো জোরালো হয়ে উঠেছে৷ সে মুখিয়ে আছে কখন শেষ হবে এই যন্ত্রনা৷ কিন্তু মিটিং শেষ হতেই মিঃ মিত্তাল তাকে ওনার ঘরে দেখা করতে বললেন৷

– ‘তানিয়া, কি হয়েছে তোমার আজ?’

তানিয়া আমতা আমতা করে বলে ‘না স্যার, মাথা ধরে গেছে. শরীর টা ঠিক..’

  • ‘তানিয়া, মাথা ধরেছে তো ওষুধ খাও৷ ডু সামথিং৷ তোমার সমস্যা আমি সুরাহা করতে পারবো না৷ এতো সিনিয়র লেভেলে, যেখানে কোম্পানির পরবর্তী দিশা ঠিক হচ্ছে, সেখানে তোমার আজকের প্রেসেন্টশন? তুমি তো ছিলেই না ওখানে৷ রোল কল করার জন্য এই সব মিটিং করা হয়না সেটা আমার চেয়ে তুমি ভালো জানো৷’

তানিয়া বুঝতে পারছে বস ঠিক বলছেন৷ তার ওপর শুধু দায়িত্বই দেননি মিঃ মিত্তাল, তার ওপর অনেক ভরসাও করেন৷ কিন্তু আজকে আর যেন কিছু নিতে পারছে না সে৷ একটা গরম অপমানবোধ তার গাল ঘাড় হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে সারা শরীরে৷ কিছু অস্পষ্ট ‘সরি, আর হবেনা’ গোছের শব্দ বলে কোনোমতে বেরিয়ে আসে সে৷ বাইরে ঠিক রঞ্জন দাঁড়িয়ে একটু দূরে৷ কাঁচের দরজার ওপার থেকে সে শুনতে পায়নি ঠিকই কিন্তু ভেতরে কি কথা হচ্ছিলো জানার জন্য জাদুকর হবার দরকার নেই৷ মুচকি হেসে রঞ্জন অন্য দিকে চলে যায়৷ সিটে ফেরে তানিয়া, বিধ্বস্ত, ক্লান্ত৷

নাহ, মিঃ মিত্তাল ঠিকই বলেছেন৷ অফিস বয় নারায়ণকে ডেকে এক পাতা ক্রোসিন আনতে পাঠিয়ে তানিয়া ভাবতে বসে এবার কি করবে৷ প্রায় দুটো বাজে৷ কিন্তু খাবার কথা ভাবলেই গা গুলিয়ে উঠলো৷ আর একটু বাদেই বাজু বাড়ি ফিরবে৷ নারায়ণ ফিরে আসতেই একসাথে দুটো ট্যাবলেট খেয়ে ফেলে সে৷ এই ওষুধ খাওয়া আর তার প্রভাব শুরু হওয়ার মাঝের সময়টা চরম বিরক্তিকর৷ তাই পঁয়তাল্লিশ মিনিট সে কাটিয়ে দেয় কাজের ভান করে৷ পৌনে তিনটে নাগাদ সারাদিনে তার প্রথম মনে হলো মাথা ধরাটা যেন আর বাড়ছে না৷ বা নামমাত্র কমেছে হয়তো৷ বাজু এতক্ষনে বাড়ি ঢুকে গেছে, তাকে ফোন লাগায় সে৷ সাতটা রিঙের পর ফোন তোলে বাজু৷

– ‘কি রে? রেজাল্ট কেমন হলো?’

চুপ, কোন কথা নেই৷

– ‘বাজু? কি হলো?’

শুকনো গলায় উত্তর আসে, ‘ভালো হয়নি৷’

– ‘মানে?’

– ‘একদমই ভালো হয়নি৷ বিশেষ করে কেমিস্ট্রি৷’

তানিয়ার আবার কানে ভণভনানি৷ ‘নীলাব্জ সেন, ধানাইপানাই না করে পরিষ্কার করে কথা বলো৷’

– ‘মা, কেমিস্ট্রিতে পাশ করতে পারিনি৷’

তানিয়ার মাথাটা ঘুরে ওঠে৷ সে আর সন্দীপ দুজনেই পড়াশুনায় ভালো ছিল৷ বাজুও ক্লাস টেন পাস করেছে ৯৬% পেয়ে৷ তাদের ফ্যামিলিতে কেউ ‘ফেল’ করেনা৷ সকালের একরাশ বিরক্তিটা ভেতরে ভেতরে জমা ছিলই, এতক্ষনে তা আগুন হয়ে ফেটে বেরোলো৷

-‘এটাতে আশ্চর্যের কি আছে? এটা তো হওয়ারই ছিল৷ যখনি জেনেছি তুমি (রেগে গেলে তুই বলা যায়না) সিগারেট খাওয়া ধরেছো, তখন থেকেই ভয় পাচ্ছিলাম এরকম একটা কিছু হবে৷’

আবার ক্ষণিক নিস্তব্ধতা অপর প্রান্তে  ‘মা, আমি সিগারেট খাইনা, একদিন খেয়েছি শুধু৷ আর খাবোনা৷’

সকালে সন্দীপের সাথে ঝগড়ার কথা মনে পড়ে গিয়ে আরো রাগ বেড়ে যায় তানিয়ার, ছেলে বাবার সুরেই কথা বলছে৷ ‘আবার মিথ্যে কথা? তোমার নম্বরই তো বলে দিচ্ছে তুমি মিথ্যে কথা বলছো৷’

– ‘না মা, সত্যি বলছি, আমার কেমিস্ট্রি বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে, তাই৷’

  • ‘এখন পরীক্ষার পর মনে হচ্ছে বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে? আগে বলতে পারোনি?’

আবার চুপ৷ একটু পরে উত্তর আসে, ‘কাকে বলবো? কখন বলবো? তুমি আর বাবা কেউই তো থাকোনা৷’ গলায় যেন কান্নার ছোঁয়া ছেলের৷ কিন্তু তানিয়ার মাথায় বাবা শব্দটা ঢোকেনা, যেন শুধু মায়ের অভাবটাই ছেলের অভিযোগ৷

তানিয়া বুঝতে পারছে ছেলের এসময় সহানুভূতি দরকার, দরকার একটু ভালোবাসার৷ কিন্তু সেই সকাল থেকে একনাগাড়ে ঘটে চলা খারাপের চাপে তার মুখ দিয়ে যে কথাগুলো বেরোয় তা তেতো, বিষাক্ত, উত্তপ্ত৷ শেষ বাক্যটা আটকাতে পারার আগেই ছিটকে বেরোয় মুখ থেকে – ‘এ রকম ছেলের থাকার চেয়ে না থাকা ভালো৷’ বলেই শিউরে ওঠে তানিয়া৷ কিন্তু আর কিছু বলার আগেই ওদিক থেকে ফোন কেটে দেবার আওয়াজ৷ পরের পনেরো মিনিট বারবার ফোন লাগায় সে, কিন্তু বাজুর ফোন বন্ধ৷ ভয়ে হাত পা ঠান্ডা লাগছে তানিয়ার, বাজু যদি কিছু উল্টোপাল্টা করে বসে? আরো পনেরো মিনিট বাদে আর পারেনা সে, ফোন করে সন্দীপকে৷ চারবার চেষ্টার পর ফোন ধরে সন্দীপ৷

  • ‘কি ব্যাপার? ব্যস্ত আছি, পরে কথা বলবো৷’
  • ‘প্লিজ৷’

সকালের তুমুল ঝগড়ার পরে বৌ প্লিজ বলছে এটা এতটাই অবিশ্বাস্য যে সন্দীপ থমকে যায়৷

– ‘কি হয়েছে?’

– ‘বাজু৷’

– ‘বাজু কি?’

– ‘আমি ওকে খুব বকেছি৷’

– ‘তো?’

উফফ, সন্দীপের এই তো টা তার ভেতর অবধি জ্বালিয়ে দেয়৷ তবু থেমে থেমে, ভাঙা গলায় তানিয়া বলে ঘটনাটা৷ সন্দীপ অবিশ্বাসী গলায় বলে, ‘তুমি তোমার একমাত্র ছেলেকে এই কথাটা বলতে পারলে?’

  • ‘প্লিজ, ও যদি কিছু করে বসে? ফোন বন্ধ৷ প্লিজ একবার যাবে বাড়ি?’

সন্দীপ চাপা ঠান্ডা সীসার মতো ভারী গলায় দাঁত চেপে বলে, ‘আমার লাইফটা তো শেষ করেছো, এখন ছেলেরটাও? আসলে কি জানো মিসেস তানিয়া সেন? গন্ডগোলটা আমার বা বাজুর মধ্যে নেই৷ তুমি হলে আসল প্রব্লেম৷ ফ্যামিলির চেয়ে তোমার কাছে তোমার কাজ আর ইগোই বড়৷’ ফোন রেখে দেয় সন্দীপ৷

অনেকক্ষন চুপচাপ বসে থাকে তানিয়া৷ মাথাতে হাতুড়ি পেটাটা বন্ধ হয়েছে, এখন শুধু ভারী, চাপ ধরে আছে৷ চারিদিকে নানান শব্দ, কিন্তু তানিয়া নিজের মনের কথা ছাড়া আর কিছু শুনতে পাচ্ছে না৷ চারিদিক থেকে যেন দেয়ালগুলো চেপে ধরছে ওকে৷ চোখ বুজলেই দেখতে পাচ্ছে বাজুকে চালিতে করে মাটিতে শোয়ানো, সন্দীপের শীতল কণ্ঠস্বর, রঞ্জনের ব্যাঁকা হাসি৷

আর সেই এলোমেলো নক্ষত্রের দিনে আচমকা তার মনে হয় সত্যি তো৷ এতো অর্থহীন জীবনে কি লাভ৷ ছিটকে ওঠে সে৷ গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে রাস্তায়৷ এলোমেলো গাড়ি চালাতে চালাতে আবার ফোন করে৷ বাজুর ফোন এখনো বন্ধ, সন্দীপ ফোন তুলছে না৷ হঠাৎ খেয়াল হতে দেখে সে দক্ষিণ বাইপাসের দিকে একটা অপেক্ষাকৃত নির্জন জায়গায় চলে এসেছে৷ শীতের সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে, তানিয়ার মাথায়ও অন্ধকারের আনাগোনা৷ একদিক দিয়ে ট্রেন লাইন, রাস্তা আর ট্রেন লাইনের মাঝে ঝোপঝাড় আর দু চারটা কলাগাছ৷ ফোন বন্ধ করে, গাড়ি থেকে নেমে আস্তে আস্তে হেঁটে যায় সে লাইনের দিকে৷ এখানে অন্ধকারটা গাঢ়, ল্যাম্পপোস্টের বাহানাটুকু নেই বলে৷ আস্তে আস্তে লাইনের ওপর গিয়ে দাঁড়ায় তানিয়া৷ তার ইন্দ্রিয়গুলো জড়, মস্তিষ্কে ভিমরুলের বাসা৷ দূর থেকে একটা আলো দেখা যাচ্ছে, মাটিতে কাঁপুনি৷ চোখ বন্ধ করে নেয় তানিয়া৷

***

গল্পটা এখানে শেষ হতে পারতো, কিন্তু নক্ষত্রদের ইচ্ছা অন্যরকম৷

আলোটা যখন পঞ্চাশ ফুট দূরে, তার রোশনাই আলোকিত করে তুলেছে সুবেশী উচ্চপদস্থ মধ্যবয়স্ক মহিলাকে, ড্রাইভার আতঙ্কে তার হর্ন বাজায়, একবার, দুবার, তিনবার৷ আর তার সঙ্গেই হুড়মুড় করে ফিরে আসে তানিয়ার সব অনুভূতিগুলো৷ নিজের অজ্ঞাতেই সে ছিটকে সরে যায় লাইনের পাশে৷ তার গা ঘেঁষা দূরত্ব দিয়ে মাটি কাঁপিয়ে বেরিয়ে যায় একচক্ষু লৌহদানব৷ চারিদিক আবার ঢেকে যায় অন্ধকারে, নৈঃশব্দে৷ তানিয়ার নাকে এবার গন্ধ আসে, বিষ্ঠার, বুনো ফুলের, আর তার ভয়ের৷ শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে আসা ঠান্ডা স্রোত৷ কতক্ষন সে দাঁড়িয়ে থাকে তা সে জানেনা৷ একটা ঠান্ডা হওয়ার দমকায় চটকা ভাঙে তার, পায়ে পায়ে ফিরে আসে তার গাড়ির কাছে৷ ভেতরে বসে স্টিয়ারিংএ হাত রাখে, হালকা কাঁপছে হাত৷ কিছুক্ষন চোখ বুজে বসে থাকে সে, অন্ধকার গাড়িতে৷ চাবি দিতেই ভেতরের হালকা নরম আলো জ্বলে ওঠে৷ পাশের সিটে তার ফোন, বন্ধ৷ একটু অনিশ্চিত ভাবেই হাত বাড়ায় ফোনের দিকে, অন করে৷ দামী রুপালি মায়াদর্পন তার মধুর রিনিরিনি নিয়ে জেগে ওঠে৷ ২৪টা মেসেজ, পনেরোটা মিসেড কল৷ ঘড়ি দেখে তানিয়া, পৌনে এগারোটা? কোথায় গেলো মাঝের এতগুলো ঘন্টা?

প্রথম মেসেজ সাড়ে পাঁচটায়, সন্দীপের৷ রুক্ষ, সংক্ষিপ্ত – বাজু ওকে৷

পাঁচটা পঁয়ত্রিশে বাজুর মিস্ড কল৷

তারপর নিয়মিত অন্তরে কল আর মেসেজ, তার সুর ধীরে ধীরে পাল্টে যায়৷

– এরকম অবস্থায় তোমার ফোন কি করে বন্ধ থাকে? ছেলের কথা ভেবেও তো খোঁজ নিতে পারো৷

– মা, সরি৷

– তোমায় অন্তত পাঁচবার ফোন করেছি৷ কোথায় তুমি? অফিসেও তো নেই৷

– মা তোমায় ফোনে পাচ্ছিনা, ফোন করো৷

– এবার কিন্তু বাড়াবাড়ি হচ্ছে৷

এরপরেই হোয়াটসাপে, তাদের তিন জনের গ্রুপ সেন-সেশন (Sen-session)৷

– মা, সরি বললাম তো, আর এমন করবো না৷ এবার মন দিয়ে পড়াশুনো করবো৷

– তানি, কোথায় তুমি?

– মা, প্লিজ প্লিজ প্লিজ প্লিজ প্লিজ৷

– তানি, আমরা কিন্তু এবার চিন্তা করছি৷

বাজুর থেকে শুধু ইমোজি ওলা পাঁচটা মেসেজ পরপর৷

  • তানি, তুমি ফোন না করলে আমরা এবার কিন্তু পুলিশে খবর দেব৷

আবার বাজুর ইমোজি মেসেজ, তাদের অর্ধেকের মানেই জানা নেই তানিয়ার৷ তবে যেটাতে দু চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে, সেটা চিনতে ভুল হয়না৷ তার দুচোখ দিয়েও ধারা৷

একবার সে ভাবে লিখবে, কোন অন্ধকার খাদের এক চুল দূর দিয়ে ঘুরে এসেছে সে, কোন ছায়াপথে হেঁটে এসেছে নিজেকে ক্ষতবিক্ষত করে৷ তারপর বাদ দেয়৷ ধরে ধরে লেখে

– আমি ঠিক আছি, আসছি৷ তোমরা খেয়ো না৷ সবাই এক সাথে খাবো৷

একটা হালকা হাসি ফুটে ওঠে তার ঠোঁটের কোনে৷

সেদিন নির্জন বাইপাস দিয়ে গাড়ি চালিয়ে ফিরতে ফিরতে তানিয়া জানল না, সে সেই ৯৬% এর সংখ্যাতত্ত্বে ঢুকে গেলো, যারা আত্মহত্যা করতে গিয়ে ‘ফেল’ করে৷

Print Friendly, PDF & Email
Previous articleচিলেকোঠা
Next articleকবিতার জন্ম
4 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments