মিসেস সেন দরজায় ধাক্কা মারতে মারতে বললেন- “মাম্পি,-অ্যাই মাম্পি – দরজা খোল, খেতে আয়। বাবা কতক্ষণ অপেক্ষা করবে তোর জন্য?”
আরও কয়েকবার দুমদুম করে দরজায় আওয়াজ করলেন মিসেস সেন। ভিতর থেকে বিদিশা মানে মাম্পির গলা পাওয়া গেল। সে গান গাইছে –“ও মেরে সোনারে সোনারে সোনা, দে দুঙ্গি জান জুদা মৎ হো নারে”
মিসেস সেন বিরক্ত হয়ে বলতে থাকলেন –“এই গান-পাগল মেয়েকে নিয়ে আমি আর পারছি না। গান শুনলে যে ও কোন ভাব জগতে চলে যায় কে জানে। আগে তাও টেপ রেকর্ডারে গান শুনত, ডাকলে সাড়া দিত। এখন হয়েছে আইপড, সারাদিন কানে গুঁজে গান শুনছে। আজ আবার দরজাও ভিতর থেকে বন্ধ করে রেখেছে। কখন হুশ হবে কে জানে।“
সোফায় বসে থাকা মিস্টার সেনের উদ্দেশ্যে বললেন – “তুমি আর কতক্ষণ অপেক্ষা করবে? খেয়ে নাও।“
মিঃ সেন–“আরে ঠিক আছে। অত রাতও তো হয় নি। ও কিছুক্ষণের মধ্যে নিশ্চয়ই বেরিয়ে আসবে। আরেকটু অপেক্ষা করে দেখি না।“
মিসেস সেন–“তোমার আদিখ্যেতা দেখে পারি না। মেয়ে না এলে খাবে না। তোমাদের আর কী, খাবে দাবে শুয়ে পড়বে। খাবার পরে গোছানো, টেবিল মোছার কাজগুলো তো আর করতে হবে না।“
মিঃ সেন-“আচ্ছা, ও না এলে তুমিও তো খাবে না। তাহলে আমাকে দোষারোপ করছ কেন?”
মিসেস সেন-“মা হবার তো এই জ্বালা। সবার ফাইফরমাশ খাটতে হয়। তবে তোমার আশকারাতেই ও এই রকম হয়েছে। গানের কটা প্রোগ্রাম করে টাকা রোজকার করছে বলে তুমি ওকে মাথায় তুলে রেখেছ। সারাদিন গান নিয়ে পড়ে আছে। পড়াশুনার যে কী হবে কে জানে? বলি B.A. টা তো পাশ করতে হবে নাকি?”
মিঃ সেন-“তুমি এত হাইপার হচ্ছ কেন? ওর গুরুজীতো বলেছেন ও ভীষণ ট্যালেন্টেড। গানের সাধনায় লেগে থাকলে বড় সিঙ্গার হতে পারবে। ওর গানের প্রতিভা তো অস্বীকার করতে পার না।“
মিসেস সেন-“দেখ বাপু, গান আমিও ভালবাসি। গানে অবসেসড অনেক মানুষ আমি দেখেছি। কিন্তু এটা ওর অবসেসান নয়, পাগলামি। এর জন্য ওর কোন বিপদও তো হতে পারে।“
দরজা খোলার শব্দ ওদের কথোপকথন বন্ধ করল। বিদিশা বেরিয়ে আসতেই মিসেস সেন বললেন-“আসুন মহারাণী। যাক, আপনার এখন সময় হল। একটু অপেক্ষা করুন, খাবারগুলো ঠাণ্ডা হয়ে গেছে, গরম করে আনি।“
বিদিশা-“ওমা, তুমি ডেকেছিলে? কই একবারও শুনতে পাই নি তো।“
মিসেস সেন রেগে চীৎকার করে বললেন-“সারাদিন কানে গুঁজে গান শুনলে ডাক শুনতে পাবে কী করে? দরজা বন্ধ করে ছিলি কেন?”
বিদিশা-“আরে জামাকাপড় চেঞ্জ করার জন্য বন্ধ করেছিলাম। পরে গান শুনতে গিয়ে খুলতে ভুলে গেছি। ই-স-স সরি মা। এই দেখ কান ধরছি।“
বিদিশা দুহাতে কান ধরে মিসেস সেনের কাছে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরল। তারপর বলল-“আচ্ছা, আর কোনদিন এই রকম হবে না, প্রমিস।“
মিসেস সেন একটু ঠাণ্ডা হয়ে বললেন-“টেবিলে গিয়ে বস, খাবার দিচ্ছি।“
বিদিশা খাবার টেবিলে বসতেই মিঃ সেন বললেন-“মাম্পি, এটা কিন্তু একদম ঠিক নয়। তোর মা পনেরো মিনিট ধরে তোকে ডাকছে। তোর কোন হুঁশ নেই! আর এত জোরে গান শোনাও তো কানের পক্ষে ভাল নয়।“
বিদিশা-“বাবা, প্লীজ, তুমি আবার শুরু করো না। সরি বললাম তো।“
মিঃ সেন-“সরি বললেই তো সমস্যার সমাধান হয়ে যায় না। আমরা তো কেউ তোর গান শোনা নিয়ে আপত্তি করছি না। কিন্তু গান শুনতে গিয়ে বাকী সবকিছু ভুলে যাবি সেটাও তো ঠিক নয়।“
বিদিশা-“কী করব বল। গান আমার অবসেসান। গান শুনলেই মনের ভিতর কী রকম একটা হয়। সত্যিই যেন কোথাও হারিয়ে যাই।“
মিঃ সেন-“অবসেসান থাকা ভাল। কিন্তু অতিরিক্ত কোন কিছুই ভাল নয়। একটা সংস্কৃত শ্লোক আছে- সর্বমত্যন্তম গর্হিতম। গান শুনতে গিয়ে দিগ্বিদিক শূন্যতা তোকে সমস্যায় ফেলতে পারে। যেমন ধর-তুই বাসে করে কোথাও যাচ্ছিস। গান শুনতে গিয়ে ঠিক স্টপে নামতে ভুলে গেলি। বা রাতে গান শুনতে শুনতে ফিরছিস, কয়েকজন খারাপ লোক তোর পিছু নিল। তুই তো বুঝতেই পারবি না। অবসেসড হলেও তো সজাগ থাকা দরকার।
বিদিশা-“বাবা, তুমি উল্টোপাল্টা কথা বোলো না তো। এই রকম কোনদিনও কিছু হয়েছে? এখন খেতে দাও। জ্ঞান শুনতে ভাল লাগছে না। ফ্রাইডে নাইটের মুডটা খারাপ করে দিও না।“
পরবর্তী দুদিন বেশ নির্বিঘ্নে কাটল। প্রতিবারের মতো সোমবার ঘুম থেকে উঠতে দেরী হয়ে গেল বিদিশার। তাড়াহুড়ো করে জলখাবার খেয়ে স্নান করে কলেজের উদ্দেশ্যে রওনা দিল সে। বাড়ী থেকে কলেজ প্রায় পনের মিনিট হাঁটা পথ। এই পথটা যেতে যেতে সে মোবাইলের এফএমে কটা গান শুনে নেয়। হেড ফোনটা কানে গুঁজে তার পছন্দসই এফএম চ্যানেলটা দিল। আজ আরডি বর্মণ স্পেশাল গান দিচ্ছে। কার্ত্তিক নগরের আন্ডার পাশের উপর রেল ব্রিজটা ধরতেই গান শুরু হল “পিয়া তু অব তো আজা …” বিদিশার সবচেয়ে পছন্দের গানগুলির মধ্যে একটি। রেল লাইনটা তার কাছে ডান্স ফ্লোর মনে হল। গানের তালের সাথে শরীর দুলিয়ে গলা ছেড়ে গানটা ধরল সে- “শোলা সা তন মন আ কে বুঝাযা …”। পিছন থেকে হটাত এক প্রকাণ্ড ধাক্কা তার গান বন্ধ করে দিল। মোবাইলটা হেড ফোন সমেত ছিটকে পড়ে গেল রেললাইনের ধারে। তাতে গান বেজে চলল –“ও মনিকা – ও মাই ডার্লিং”।
পরদিন খবরের কাগজের পাতায় বেরোল- “গতকাল সকালে কার্ত্তিক নগরের রেল ব্রিজে একজন যুবতী ট্রেনে কাটা পড়ে মারা গেছেন। মৃতার নাম বিদিশা সেন। কিছু প্রত্যক্ষদর্শী ও ট্রেন চালকের বক্তব্য অনুসারে বিদিশা মোবাইল ফোনে গান শুনছিলেন। বহুবার হর্ন দেওয়া সত্ত্বেও উনি লাইন থেকে সরে যান নি। গতিবেগ বেশি থাকার জন্য ট্রেন দাঁড় করানো সম্ভব হয় নি।“