কোড নেম প্রমিথিউস

রাস্তায় ফেরার সময় টাকা লাগতে পারে, এই ভেবে দুই তিনজনের পকেট হাতসাফাই করে নিয়েছিলাম। তাই যথেষ্ট টাকা ছিল। একটা ট্যাক্সি ডেকে তাই তোমাদের পিছু নিলাম। কিন্তু তোমরা জেলে পাড়ার দিকে যাচ্ছ দেখে বুঝে গেলাম, হয় কোনও দ্বীপে যাবে, নয়ত পাথরটা তোমরা ওখানেই এক্সচেঞ্জ করবে। প্রথমটা যখন সত্যি হল, তখন বুঝলাম, আমার সঙ্গে যাওয়া ছাড়া গতি নেই। কারন ওরা সশস্ত্র, তুলনায় তোমাদের হাতে কিছুই নেই বলতে গেলে। তাই তোমরা যখন কথা বলছিলে, আমি গিয়ে লাইফলাইনের খোলের মধ্যে রাখা অত জিনিসপত্রের পেছনে গিয়ে লুকোলাম।

তারপর নৌকা থামতে, সেটা থেকে নেমে তোমাদের ফলো করে করে আসছিলাম। মাঝখানে অয়ন আমার পায়ের শব্দ শুনতে পেয়ে টর্চের আলো ফেলেছিল, বাধ্য হয়ে তখন লোকাতে হয়। নয়ত আরও ঝুঁকি বাড়ত। ওদের বুঝতে দেওয়া চলত না, যে আমিও এসেছি তোমাদের সাথে। তারপর যখন দেখলাম, ও তোমাকে শুট করতে চলেছে, তখন বাধ্য হলাম নিজের ক্ষমতা ব্যবহার করতে। নয়ত তোমাদের বাঁচানো যেত না।“

বর্ণালী আন্তরিকভাবেই বলল, “সত্যিই তাই। নয়ত, আমাদের আজকে বাঁচার আশা সত্যিই ছিল না।“

ঝিনুক হাসতে হাসতে বলল, “আরে না, এসব কিছুই না।“ তারপর আমার দিকে ঘুরে বলল, “সালফিউরিক অ্যাসিডের প্ল্যানটা কি তোমার ছিল? ইট ওয়াজ আ বিউটিফুল প্ল্যান। আর যাই হোক, প্রমিথিউসের নির্দেশগুলো ওর হাতে পড়ার থেকে নষ্ট হয়ে যাওয়াই ভালো।”

আমি বললাম, “হ্যাঁ।“

ঝিনুক মুখে একটা দুষ্টু হাসি হেসে বলল, “মানে সত্যি, মাথা থেকে প্ল্যান বেরোয়ও বটে তোমাদের।“

কেন জানি না, হঠাৎ করেই কানটা লাল হয়ে উঠল এই প্রশস্তি শুনে। কিন্তু একইসাথে একটা কথা মনে পড়ে গেল। আরে তাই তো। হাইনরিখ গেল কোথায়?

এতক্ষণ আমরা কথা বলছিলাম বলে হাইনরিখের খোঁজ করা হয়নি। চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম। কোথাও হাইনরিখের চিহ্ন নেই। লোকটা কি হাওয়ায় উবে গেল নাকি?

হঠাৎ করেই সমুদ্র আর্তনাদ করে উঠল একটা দিকে তাকিয়ে। আমরা সেদিকে তাকালাম। আর তাকিয়েই বিদ্যুতের শক খেলাম মনে হল।

হাইনরিখ এসে দাঁড়িয়েছে। হাতগুলোতে বিশাল বড় বড় ফোস্কা পড়েছে অ্যাসিডের জন্য, তবু সে তার মধ্যেই বাম হাতে একটা গ্লক পিস্তল ধরে রয়েছে। গ্লকটা পয়েন্ট করা স্যারের দিকে।

কেটে কেটে সে বলল, “যখন আমার আর কিছুই পাওয়া হল না, তখন সেন, কেন আবার একা যাব যমের কাছে? চল, তোমাকে নিয়েই যাওয়া যাক।“

বলেই দুম দুম করে পর পর দুবার ফায়ার করল সে।

পুরো ব্যাপারটাই যেন ঘটছিল স্লো মোশনে। আমি আর ঝিনুক স্যারের কাছে ছিলাম সবথেকে। আমি স্যারকে ধাক্কা দিয়ে সরাতে গেলাম। ঝিনুক এসে দাঁড়াল স্যারের ঠিক সামনে। আর তাই পরপর দুটো গুলি আমাদের দুজনকেই খুঁজে নিল টার্গেট হিসেবে।

আমার বাঁহাতে একটা ভয়ঙ্কর তীব্র জ্বালা করে উঠল। চিৎকারটা নিজেও ধরে রাখতে পারলাম না। মনে হল, যেন লালরঙা লোহা কেউ চেপে ধরেছে আমার বাম হাতের ওপর। এক মুহূর্তের জন্য দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে গেল। অসহ্য যন্ত্রণায় হাতটা খসে পড়তে চাইল যেন। এক অমানুষিক মনের জোরে, দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম। মনে হচ্ছিল চারিদিকে সব কিছু ঘুরছে, তার মধ্যেও দেখতে পেলাম, হাত বেয়ে লাল রক্তের স্রোত নেমে আসছে।  সমুদ্র, ক্রিস আর বর্ণালী চিৎকার দিয়ে আমাদের কাছে এগিয়ে আসছে। আমি ততক্ষণে বসে পড়েছি মাটিতে। অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে বাম হাতে। যেন হাতটা কেউ কেটে নিয়েছে।

আর তারপরেই আমি জীবনের সবথেকে বড় ধাক্কাটা খেলাম। ঐ দৃশ্যটা জীবনের শেষদিন অবধি মনে থাকবে আমার।

ঝিনুক ঘুরে দাঁড়িয়েছে হাইনরিখের দিকে। কিন্তু হাইনরিখ আর তার সেই পৈশাচিক হাসিটা হাসছে না। বরং তার মুখে, ঐ হাসির জায়গায় জমা হয়েছে আতঙ্ক। আর তার যথেষ্ট কারন ছিল।

ঝিনুকের ডান হাতের আঙুলগুলোয় এক নীলাভ আভা দেখা দিচ্ছিল। আঙুলগুলোর মধ্যে সাদা সাদা শিখা নেচে বেড়াচ্ছিল। কয়েক মুহূর্ত তাকিয়েই বুঝলাম, ওগুলো বিদ্যুতের শিখা। যেটা দেখে সবথেকে বেশি ভয় লাগছিল, সেটা হল, ঝিনুকের চোখের মণিগুলো আর সেই কালো রঙের নেই, সেগুলো উজ্জ্বল নীলাভ হয়ে গিয়েছে। হাতের আঙুলগুলোর চামড়াটা ধীরে ধীরে পুড়ে যাচ্ছে বিদ্যুতের তাপে। আস্তে আস্তে বিদ্যুতশিখার গতি আর তীব্রতা দুইই বাড়তে শুরু করল। একটা সময় আমরা সবাই দেখতে পেলাম, আক্ষরিক অর্থেই ঝিনুকের ডান হাতে বিদ্যুৎ নাচছে।

“ঝিনুক।” বলে বর্ণালী চিৎকার করে উঠল। কিন্তু ঝিনুকের কোনও তাতে ভ্রূক্ষেপ নেই। যেন আমাদের কথা সে শুনতেই পাচ্ছে না। প্রতিশোধস্পৃহা যেন তাকে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এই নাটকের শেষ পরিণতির দিকে।

আস্তে আস্তে ঝিনুক শুধু ডানহাতের তর্জনীটা ফেরাল হাইনরিখের দিকে। আর তারপরেই মুহূর্তের মধ্যে ব্যাপারটা ঘটে গেল। পরপর অনেকগুলো নীলচে বিদ্যুৎশিখা বিদ্যুতের গতিতেই সোজা আঘাত করল হাইনরিখের বুকে, মাথায়, তার চারপাশের জমিতে, গাছে।

হাইনরিখ একটা আর্তনাদ করারও সুযোগ পেল না। প্রবল আক্ষেপে তার দেহটা কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল। মাংস পোড়ার তীব্র কটু গন্ধে জায়গাটা বিষিয়ে উঠল। আর তারপরেই, তার আধপোড়া শরীরটা ছিটকে পড়ে গেল সেই খাড়াই ঢাল বেয়ে, ইজিয়ান সাগরের বুকে।

আমি যন্ত্রণা সহ্য করে কোনমতে হেঁটে হেঁটে এগিয়ে গেলাম সেই ঢালের দিকে। উঁকি মেরে দেখলাম,  কোথাও কোন দেহের চিহ্ন নেই। সমুদ্র পরম মমতায় যেন ঢেকে নিয়েছে সেই আধপোড়া দেহটাকে।

সমুদ্র, বর্ণালী আর ক্রিস তখনও হাঁ হয়ে তাকিয়ে আছে ঝিনুকের দিকে। তারা এখনও বুঝে উঠতে পারেনি, কোথা থেকে কি হয়ে গেল তাদের সামনে।

ঝিনুক দাঁড়িয়ে আছে, আর শ্বাস নিচ্ছে হাপরের মত।

আর স্যার তাকিয়ে আছেন আমার মতই খাড়া ঢালের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সিডার গাছটার দিকে, যে গাছটায় ঝিনুকের হাতের একটা বিদ্যুৎশিখা গিয়ে লেগেছিল।

গাছটা আগুনে জ্বলছে। দাউদাউ করে জ্বলছে সেই লাল রঙের আগুন, ঝোড়ো হাওয়া আরও বেশি করে রসদ যোগাচ্ছে তাকে। কাঠের পোড়া গন্ধে আর আগুনের হলকায় জায়গাটায় দাঁড়ানো যাচ্ছে না।

আমি এগিয়ে গিয়ে ঝিনুকের হাতটা ধরলাম। রক্তে লাল হয়ে গিয়েছে তার টপ। গুলি খুব সম্ভবত লেগেছিল তার ডানদিকে কলারবোনের নিচে, আর এপার–ওপার হয়ে গিয়েছে, কারন পিঠেও রক্তে ভেসে গিয়েছে। আশার কথা, রক্তপড়ার গতি কমে এসেছে এর মধ্যেই। এখন শুধু জায়গাটা সেরে যাওয়ার অপেক্ষা।

ঝিনুক আমার দিকে ঘুরে তাকাল। এখনও তার হাতের তালুতে দু-তিনটে ছোটখাটো বিদ্যুৎশিখা খেলা করছে, কিন্তু তার চোখে আর সেই উজ্জ্বল নীল আভা নেই। সেগুলো শান্ত, ঘন কালো হয়ে এসেছে।

সে আর বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। সে এলিয়ে পড়ল আমার ওপর। আমি তার এলিয়ে পড়া শরীরটাকে ডানদিকে নিয়ে, বসে পড়লাম মাটির ওপর। যাক, নিঃশ্বাস পড়ছে তার, শুধু অজ্ঞান হয়ে গেছে সে।

অস্ফুটে শুধু মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল, “তাহলে পৃথিবীতে এভাবেই আগুন এনেছিলে তুমি, তাই তো প্রমিথিউস?“

দুরের কালো আকাশ চিরে সাদা বিদ্যুৎশিখা নেমে এল সমুদ্রের বুকে। বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে মুষলধারে।

আট

চার দিন পরের ঘটনা। আথেন্সের সবথেকে বড় সরকারি হাসপাতালে সেরে ওঠার চেষ্টা করছি। গুলিটা ভাগ্যিস হাত ফুঁড়ে এপার-ওপার বেরিয়ে গিয়েছিল, নয়ত আরও অনেকদিন হাসপাতালে থাকতে হত। ঝিনুকের অবশ্য একদিনই লেগেছিল সেরে উঠতে। ক্ষতস্থান মেলাতে মোটে দশ মিনিট লাগলেও যে বিদ্যুৎ শিখা সে তৈরি করেছিল, তার জন্য তার প্রচণ্ড ধকল গিয়েছিল। তার শ্যাক্স সেলগুলো রিচার্জ হবার জন্য তাকে একটা গোটা দিন বিছানায় কাটাতে হয়েছিল।

 

~ কোড নেম: প্রমিথিউস (পর্ব ১৯) ~

Print Friendly, PDF & Email
Previous articleকোড নেম: প্রমিথিউস (পর্ব ১৮)
Next articleকোড নেম: প্রমিথিউস (পর্ব ২০)
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments