হাত আমাদের শরীরের একটি অঙ্গ। ছোটবেলায় হাতের এই মানেটার সঙ্গে যখন পরিচয় হয়েছিল তখন জানতাম না যে হাত কথাটার মানে শুধু এতেই সীমাবদ্ধ নয়। এর আলাদা অনেক মানে আছে। আমরা যত বড় হই তত এই মানেগুলোর সঙ্গে আমাদের পরিচয় হতে থাকে। হাতের এই মানেটা জানার পর সবাইকে বলে বেড়াতাম যাতে সবাই বুঝতে পারে যে আমি হাতের মানে জানি। যেমন আমি হাত দিয়ে ভাত খাই। হাত দিয়ে ব্যাট ধরি এইসব আর কি। লোকে বেশ খুশি হত বিশেষ করে মা বাবা। এখন অবশ্য হাতের বদলে Hand এর মানে বাচ্চারা বেশি বোঝে। অনেক বাচ্চারা বেচারা হাত কে এখনও চিনে উঠতে পারে নি।
যাইহোক হাতের মানে প্রথম পালটে গেল যখন সাদা-কাল টিভি তে প্রথম ১৯৮৬র বিশ্বকাপ ফুটবল দেখলাম। মারাদোনার বিখ্যাত হাত দিয়ে গোল। ওটার নাম হয় গেল ভগবানের হাত। যদিও আমি নিজের চোখে দেখেছিলাম মারাদোনার হাত। নিন্দুকেরা বলতো চিটিংবাজের হাত আর ভক্তরা বলতো ভগবানের হাত। আমার সেই সাত বছর বয়সে প্রথম হাতের অন্য মানের সঙ্গে পরিচয় হোল। বুঝলাম যে মানে বইএর মানেতেই অনেক কিছুর মানে সীমাবদ্ধ নয়। ছোটবেলায় এই মানেটাও অনেকবার ব্যবহার করেছি। হাত দিয়ে গোল করে বলেছি ভগবানের হাত। যদিও তাতে লাভের বদলে লোকসানটাই বেশি হয়েছে। অনেকবার প্রায় মারামারি বাধার উপক্রম হয়েছে। হাতের অন্য মানের সঙ্গে পরিচয় হয় আরেকটু পরের দিকে। মুম্বাই বিস্ফোরণ। তখন অতো বুঝতাম না যে কে, কি, কেন। কিন্তু একটা জিনিস খবরের কাগজ পড়ে বুঝেছিলাম। হাতের একটি নতুন মানে। বিদেশি শক্তির হাত, প্রতিবেশি রাষ্ট্রের হাত। এই হাত আর আমার ছোটবেলায় বইয়ে পড়া হাত এক নয়। রাষ্ট্রের হাত কি করে হয়! রাষ্ট্র তো মানুষ নয়। বাবাকে জিজ্ঞেস করছিলাম এর মানে। বাবা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। বুঝেছিলাম হাত জিনিষটা যত সহজ ভেবেছিলাম তত সহজ নয়। এর মানেও তত সহজ নয়। এছাড়াও হিন্দি সিনেমায় ছোটবেলায় শোনা ডায়লগ “কানুনকে হাত লম্বে হতে হ্যাঁয়”, হাতের নতুন মানে শিখিয়ে ছিল।
এরপর এল কলেজ জীবন। হাতের আরও কিছু নতুন মানে যুক্ত হল। যেমন কলেজ মিছিলের স্লোগান, “সাম্রাজ্যবাদী শক্তির কালো হাত ভেঙ্গে দাও, গুঁড়িয়ে দাও”। এই হাতের মানে আলাদা। কিন্তু একটা ব্যপার বুঝতে একটু আসুবিধা হত। কালো হাত মানেই কি খারাপ? একজন কালো মানুষের হাত তো কালোই হয়। সেই হাত খারাপ হয় কি করে। আর যাদের কালো হাতের বিরুদ্ধে এই স্লোগান দেওয়া হতো তাদের বেশির ভাগের হাতই তো সাদা। তাই কালো হাতের মানেটা ঠিক মাথায় ঢুকত না। কারন “আমার কালো মেয়ের পায়ের তলায় দেখে যা আলোর নাচন” এই গানও কালীপূজায় পাড়ার পাণ্ডালে বাজত। তাই কালোটা খারাপ হোল কিসে তা বুঝতে আসুবিধা হত। আরেকটা মানে নতুন পেলাম যখন শুনলাম কোন কুখ্যাত মস্তানের মাথার উপর কোন রাজনৈতিক নেতার হাত। সেই হাতের জোরেই তার মস্তানির জোর। এই হাতের মানে আর সাধারন হাতের মানে এক নয়। এই হাত আনেকটা আশীর্বাদের হাত, অভয়ের হাত। এই হাতের জোর তার নিম্নস্থ মাথার থেকে অনেক বেশি।
এইসময়েই আরও একটি বিশেষ মানে বুঝলাম। ভালবাসার হাত। অবশ্য এই ভালবাসার হাতও ভিন্ন এবং তার মানেও ভিন্ন। বন্ধুর হাত আর প্রেমিকার হাত। দুটোর মানে প্রায় এক আবার এক নয়। সূক্ষ্ম অন্তর আছে। বন্ধুর হাত ভরসার হাত, বিপদের দিনে শক্ত করে ধরার হাত, প্রেমিকার হাত এই দুটো মানেই বোঝায় কিন্তু প্রেমিকার হাত মানে এক পুরুষ ও নারীর প্রেমের সম্পর্কের হাত। সেই হাতের সঙ্গে বন্ধুর হাতের মানে গুলিয়ে ফেললে হবে না। অবশ্য যাদের প্রেমিকার সঙ্গে বিচ্ছেদ হয় গিয়েও বন্ধুর সম্পর্ক বজায় আছে তারা এর পার্থক্যটা ভাল বুঝবেন। যাইহোক এইসমস্ত মানের সঙ্গেই যত বয়স বাড়ছে তত নতুন নতুন মানে খুঁজে পাচ্ছি, যেমন হাত কামড়ানো, মাথায় হাত ইত্যাদি। আরও অনেক মানে হয়ত ভবিষ্যতে যোগ হবে। তবে সবশেষে এটাই বুঝেছি যে আমাদের হাত যত সরল দেখতে তার মানে তত সরল নয়। আনেক্ষেত্রে ভীষণ জটিল।