পরের দিন কাগজে তুলকালাম কান্ড, বড় খবর – মুভি স্টার দেবশঙ্কর গ্রেপ্তার, হাজতে রাত্রিবাস, স্ত্রী মৌমিতা হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে লড়ছে। দেবশঙ্কর সবই পড়লেন, তারপর কাগজটা সরিয়ে পাশে রেখে দিলেন। পাতার একদম তলার দিকে একটা ছোট্ট খবর দৃষ্টি এড়িয়ে গেল – উঠতি নায়িকা প্রিয়াঙ্কা গতকাল রাত থেকে নিরুদ্দেশ।
সুবলবাবু অফিসে এসে আবার মিটিঙে বসলেন, অফিসার অজিত দেবশঙ্করের কিছু প্রতিবেশীর সাথে কথা বলে ফিরে এসেছেন। দেবশঙ্করের অ্যাপার্টমেন্ট থেকে কালকেও নাকি নারি কন্ঠের চিৎকার শোনা গেছে। সব থেকে ইনটারেস্টিং হোল একজন বয়স্ক প্রতিবেশী বলেছেন যে গতকাল সন্ধ্যায় তিনি একজন অচেনা পুরুষ ও একজন মহিলাকে দেবশঙ্করের ফ্ল্যাটে ঢুকতে দেখেছেন। বাড়ীর সিকিউরিটি তমালবাবুকে আইডেন্টিফাই করেছে। হাসপাতালের খবর একই, মৌমিতা এখনও অজ্ঞান কিন্তু স্টেবল। যেটা অবাক হবার তা হোল দেবশঙ্করের ফ্ল্যাটের টেবিলে যে গ্লাসগুলো পাওয়া গিয়েছিল, তার একটার মধ্যে শ্যাম্পেনের সাথে মেশান ঘুমের ওষুধ পাওয়া গিয়েছে। পুলিশ চারটে গ্লাসকেই ফিঙ্গারপ্রিন্টিং-এর জন্য ল্যাবে পাঠিয়ে দিয়েছে।
পুলিশের এখন শুধু অপেক্ষা, সমস্ত ব্যাপার দেখে এবং প্রতিবেশীদের জবানবন্দি অনুসারে দেবশঙ্করের হাজতবাস আরো বারান হয়েছে, তমালবাবুকে কলকাতায় থাকার প্রতিশ্রুতি নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, আসলে তার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগই নেই।
দেবশঙ্কর পুলিশ হেফাজতে, পুলিশের অনুমতিতেই তিনি তাঁর পরের ছবির ডাইরেক্টার চিরদীপ আর নায়িকা প্রিয়াঙ্কাকে কয়েকটা এস.এম.এস. করেছেন, সারাদিনেও তার কোন উত্তর নেই। প্রিয়াঙ্কা সবে উঠছে, তারও উত্তর না পেয়ে দেবশঙ্কর বেশ বিস্মিত।
তৃতীয়দিন সন্ধ্যার সময় ভালো খবরটা এলো, মৌমিতার জ্ঞান ফিরেছে, এখনও বেশ দুর্বল কিন্তু দেবশঙ্করকে দেখতে চাইছে। সুবল, দেবশঙ্কর ও অন্যান্য অফিসাররা থানা থেকে রওনা দিলেন। নার্সিংহোমের সামনেও রিপোর্টার আর সাধারণ মানুষের বেশ ভিড়। গাড়ী থেকে নেমে পুলিশ এবং দেবশঙ্কর সোজা ভিতরে চলে গেলেন। মৌমিতার জ্ঞান ফিরেছে এবং মেমোরিও ফিরে এসেছে। দেবশঙ্কর কাছে আসতেই মৌমিতা তাকে আঁকরে ধরে কেঁদে ফেললো – “আমি তোমার কাছেই থাকতে চাই, তুমি আমায় ছেড়ে যেওনা”। দেবশঙ্কর হাতবাক, সুবলবাবুও বিস্মিত, মৌমিতার কাছ থেকে এরকম রিঅ্যাকশান তিনি আশা করেননি। কোথায় মৌমিতা রেগে আগুন হবে, দেবশঙ্করকে গালাগাল দেবে, তবেই তো ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সের কেসটা দাঁড়াবে, এতো দেখা যাচ্ছে ভালোবাসায় গদ গদ। ডাক্তার দত্ত মৌমিতাকে আরো তিনদিন নার্সিংহোমে রাখার কথা বললেন, ওরা সবাই বেরিয়ে এলো।
কি একটা মনে হোতে সুবলবাবু দেবশঙ্করকে নিয়ে আরো একবার সাউথ সিটি মলের ফ্ল্যাটের দিকে গাড়ী ঘোরালেন, আরো ভালোভাবে সার্চ করে যদি নতুন কিছু পাওয়া যায়। মৌমিতার মাথার আঘাতটা কি শুধুই পা পিছলে পরে যাওয়ার ফলেই হয়েছে? যদি কোন কারণে মৌমিতা এখন মিথ্যে কথা বলে? বড়লোক ফ্যামিলীতে তো এরকম কেস কতই হয়, তার ওপর দেবশঙ্কর সিনেমা জগতের একজন প্রতিষ্ঠিত স্টার, মোউমিতার লোভ তো থাকতেই পারে। এখানে তমালবাবুর ভূমিকা কি? তমালবাবুর স্টেটমেন্টের সাথে দেবশঙ্করের স্টেটমেন্ট মেলেনি, তমালবাবু পুরো দোষটাই দেবশঙ্করের ঘাড়ে দিয়েছে। দেবশঙ্করের প্রতিবেশীরাও দেবশঙ্করকে মাতাল, বদরাগী আখ্যা দিয়েছে, প্রায়ই তাকে মত্ত অবস্থায় বাড়ীতে ফিরতে দেখা যায়। স্বামী স্ত্রীর মধ্যে উন্মত্ত অবস্থায় বিবাদ প্রায়ই হয়, কাজেই ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স একটা স্ট্রং পসিবিলিটি।
বাড়ীর সামনে পুলিশের গাড়ী এসে থামলো, কয়েকজন গাড়ীতেই রইল, সুবল, দেবশঙ্কর, অজিত ও আরো দু একজন লিফটে করে উঠে দেবশঙ্করের ফ্ল্যাটের সামনে এসে দাঁড়াল। সুবল চাবি দিয়ে ফ্ল্যাটের দরজা খুললেন। এখন আর রুম ফ্রেসনারের গন্ধ কোথায়, বেশ বিচ্ছিরি একটা ভ্যাপসা গন্ধে নাকে হাত চাপা দিতে হয়। দেবশঙ্কর অভ্যস্ত হাতে একটা সুইচ টিপতেই লাউঞ্জ আর কিচেনের আলো জ্বলে উঠলো। ঘরটা ঠিক আগের মতোই সাজান, কিছু ওলট পালট নেই, সুবল এবং অজিত এদিক সেদিক ঘুরে দেখছিল কোন ইঁদুর বা ছুচো মরেছে কিনা, কিন্তু কিছুই নেই। অগত্যা বেডরুমের দিকেই যাওয়া। প্রথম বেডরুমে বিশেষ কিছু নেই, আগের মতোই পরিচ্ছন্ন। সুবলবাবু দ্বিতীয় বেডরুমের দরজা খুলতেই মুখ দিয়ে ওয়াক বেরিয়ে এলো, অসহ্য পচা গন্ধ। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার ঘর ঠিক আগের মতোই, বিছানায় টানটান চাদর, বালিশ, একটুও এদিক ওদিক নেই, ঠিক আগের দিনের মতো। সবাই ঘরের মধ্যে নাকে রুমাল চাপা দিয়ে বোকার মতো দাঁড়িয়ে।
দেবশঙ্কর এদিক ওদিক পিটপিট করে তাকাচ্ছিলেন, যেন নিজেকে নিজেই স্তোক দিচ্ছিলেন। তারপর তার চোয়াল একটু শক্ত হয়ে গেল, মাথাটা দুবার নেড়ে তিনি বুক শেলফের দিকে এগিয়ে গেলেন। দূর থেকে বোঝা না গেলেও বুক শেলফটা চাকার ওপর বসান, একটু জোর দিতেই আস্তে আস্তে একদিকে সরে গেল। পিছনে সুন্দর পালিশ করা দেওয়াল। কিন্তু এটাতেও মজা, দেবশঙ্কর ইলেকট্রিক সুইচ বক্সে একটা সুইচ টিপতেই সামান্য শব্দ করে দেওয়ালের একটা অংশ একটু ফাঁক হয়ে গেল, গল্পের মতো সত্যি সত্যিই একটা সিক্রেট ডোর …।
********
আবার সেই রিপোর্টারের ভিড়, ক্যামেরার ফ্ল্যাশ, চারিদিকে মোবাইল ডিস ওয়ালা ভ্যান আর হাতে মাইক্রোফোন ওয়ালা রিপোর্টার, সেই সাউথ সিটি মল। এবার আর আহত কেউ নয়, দেবশঙ্করের ফ্ল্যাট থেকে এবার সত্যিকারের লাশ বার হোল। বেশ কয়েকদিনের পুরনো, একেবারে পচে গেছে। লাশ সোজা ল্যাবরেটরিতে পোস্টমর্টেমের জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হোল। পরেরদিন আবার কাগজে হেডলাইন দেবশঙ্কর।
অবশ্য চব্বিশ ঘন্টার মধ্যেই ব্যাপারটা কেমন উলটো হয়ে গেল। পোস্টমর্টেমের রিপোর্ট এসে গেল, ফিঙ্গার প্রিন্টের রেসাল্ট রেডি … সুবল, অজিত আর অন্যান্য অফিসাররা ঘন্টা দেরেক বসেই ক্রাইম সিনটা ভিসুয়ালাইজ করে নিলেন। পরপর সব খাপেখাপ মিলে যাচ্ছে … বয়স্ক ভদ্রলোকের দেখা তমালবাবু এবং একজন অজানা মহিলার আগমন এবং তার সময়, প্রতিবেশীদের বলা নারি কন্ঠের আর্তনাদ এবং ঘটনার সময়, দেবশঙ্করের স্যুটিং শেষ হওয়া এবং তার নিজের বর্ননায় বাড়ীতে পৌছনোর সময়, ডাক্তারকে ফোন করা এবং অ্যাম্বুলেন্স ডাকার সময়। আরো মিলছে চারটে গ্লাসে চারজন মানুষের ফিঙ্গারপ্রিন্ট, যার একটা অবশ্যই প্রিয়াঙ্কার, ঠিক যে গ্লাসে ঘুমের ওষুধ পাওয়া গিয়েছে। তার মানে তমালবাবুর সাথে প্রিয়াঙ্কাই দেবশঙ্করের বাড়ীতে গিয়েছিল।
ব্যাপারটা এবার ভাবলে সহজই। মৌমিতার দেবশঙ্করের প্রতি অবশেসন, কাজেই দেবশঙ্কর যে নায়িকার সাথেই কাজ করুক … তাকে মৌমিতা তার ভালোবাসার প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবে। প্রিয়াঙ্কা নতুন উঠছে, বয়স কম এবং সুন্দরী, কাজেই দেবশঙ্করের সাথে তার কাজ করার অর্থই মৌমিতার মনে আগুন আর প্রতিহিংসা। ব্যাপারটা নিশ্চয়ই তমালের সাথে আগেই প্ল্যান করা ছিল, আর তমাল তো দেবশঙ্করের শত্রু। ঘুমের ওষুধ খাইয়ে প্রিয়াঙ্কাকে খানিকটা অবচেতন করে তার হাতের শিরা মৌমিতাই কেটে দেয়, আর তখনই প্রিয়াঙ্কা চিৎকার করে উঠেছিল কারণ তখনও তার চেতনা ছিল। এটা করতে গিয়েই মৌমিতার নিজের হাত কয়েক জায়গায় কেটে যায়, যার থেকে পরে রক্ত বেরিয়ে মেঝে আর টেবিল ক্লথের ওপর পরেছিল যা পুলিশ দেখতে পায়। মৌমিতা আর তমাল প্রিয়াঙ্কার বডিটা তুলে সিক্রেট চেম্বারে রেখে দেয়। রক্ত বা অন্য কিছুর গন্ধ যাতে না পাওয়া যায় তার জন্যই অত বেশি করে রুম ফ্রেসনার স্প্রে করা হয়েছিল। প্রিয়াঙ্কার হাতের শিরা কাটার পর নিশ্চয়ই বেশ ভালো রক্ত মেঝেতে পরেছিল, সেই জন্যই মেঝে বেশ ভালো করে জল দিয়ে ধুতে হয়েছিল, আর সেটাই প্রথমে দেবশঙ্কর এবং আরো পরে সুবল আর অন্যান্য অফিসাররা ফ্ল্যাটে গিয়ে দেখতে পায়।
মৌমিতা এমনিতেই মেন্টালি স্লাইটলি ডিসব্যালান্সড ছিল, তার ওপর এই প্রিয়াঙ্কার ব্যাপারটা হঠাৎ ঘটিয়ে ফেলায় সে মানসিকভাবে অস্থির ছিল এবং তমালের সাথে কয়েক পেগ ড্রিঙ্কও করেছিল। কাজেই দেবশঙ্করকে দেখে সে উত্তেজিত হয়ে দাঁড়িয়ে ওঠে এবং শ্বেতপাথরের পলিশড ভিজে ফ্লোরের ওপর দিয়ে হাঁটতে গিয়ে পরে যাওয়াও স্বাভাবিক, যা দেবশঙ্কর পুলিশকে বলেছিল।
সুবলবাবুর কেস উলটে গেল, আর ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স নয়, প্ল্যান্ড মার্ডার। তমাল আর মৌমিতার অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট বার করা অবশ্য তেমন ঝামেলার কিছু নয়, প্রমান তো চোখের সামনেই রয়েছে … সেই ছুরিটা, যা দিয়ে মৌমিতা প্রিয়াঙ্কার ডান হাতের শিরা কেটে দিয়েছিল … সেটাও আবার মৌমিতার নিজস্ব আলমারির একটা গয়নার বাক্সর মধ্যে পাওয়া গেছে। তাতে আবার তমাল আর মৌমিতার দুজনেরই হাতের ছাপ পাওয়া গেছে।
দেবশঙ্কর বেচারা একটু মুসরে পড়েছে, বৌটা নার্সিংহোম থেকে সোজা জেলে চলে গেল, আর তার পরের মুভিটাও আটকে গেল কারণ নায়িকাই তো খতম। তাও আবার মুভিতে নয়, বাস্তবিক জীবন থেকেই হাওয়া।
শেষ