আমার মনে পরে একদিন আমি আমার বায়োলজি টিচার এর কাছ থেকে একটা দোলনচাপা গাছ এনেছিলাম .বাড়ির পিছনে লাগিয়ে ছিলাম গাছ টা এটা ভেবে যে “ফুল ফুটুক বা নাই বা ফুটুক” তাতে কি এসে যায়.তারপর এক বছর কেটে গেছে কোনো ফুল ই ফুটল না.তখন বৈশাখ আসন্ন.চারপাশ কৃষ্ণ চূড়া আর পলাশ এর আগুনে পুরো লাল.দিন টা ছিল বুধবার আমার ক্লাস 9 এর ফাইনাল পরীক্ষার result বেরোবে ..সকালে উঠেই বুক টা ধর ফর করতে লাগলো but অদ্ভুত একটা মৃদু মিষ্টি গন্ধ পেলাম..মনে হল বাড়ির পিছন থেকে গন্ধ টা যেন আসছে.পিছনে গিয়ে অবাক ..
সেই দোলনচাপা গাছ টা , যাকে প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম সেখানে দুটো সুন্দর সাদা ফুল ফুটেছে আর তার ই এমন মন মাতোআরা গন্ধে আজ এই গরমের সকাল টাকে অদ্ভুত সুন্দর লাগছে… পিসির সাথে স্কুল এ যেতাম .. পিসি ছিল আমার বডি গার্ড এমনি ই বলত বন্ধুরা ..স্কুল এ আমাদের একটা কৃষ্ণ চূড়া গাছ ছিল ..যার চার পাস টা বাধানো ছিল.. সেখানে বসে সবাই অপেক্ষা করত..আজ কৃষ্ণ চূড়া গাছ টাকে অদ্ভুত সুন্দর লাগছে .. আমরা আবার কৃষ্ণ চূড়ার ফুল থেকে হাতে নখ বানাতাম..খুব মজা লাগত…
যাইহোক result তো বেরোলো ..বায়োলজি আর অঙ্ক টা ভালই হয়েছে..কিন্তু হিস্ট্রি তে এত কম..উফ I hate this সাবজেক্ট.. যাইহোক এ সেকশন রোল নম্বর 4 হল … আর কিছু দিনের মধ্যেই গরমের ছুটি পরে যাবে..উফ বাচবো তখন ..গরমের ছুটি তে চরক মেলা হত..বাবার সাথে যেতাম … সেই মেলায় একটা মাটির ঘার ঘোরানো নিল-লাল দাদু পাওয়া যেত..প্রতি বার ই কিনতাম ওটা, but বাড়ি ফিরতে ফিরতে সেই দাদুর ঘার বেঁকে যেত… চড়ক মেলায় গরম গরম জিলেপি খেতে দারুন লাগত..তার পরের দিন ই হত পইলা বৈশাখ ..
এই দিন টা সকাল এ উঠেই ঘরে সুধু বেল ফুলের গন্ধ আসতো..কারণ বাবা সকালে উঠেই চলে যেত বাজারে ফুলের মালা কিনতে ..পইলা বৈশাখ এ ঠাকুর কে দেবে বলে ..আর আমার তো তখন গরমের ছুটি..কে আর ওঠে এত সকালে … but যখন ঘুম ভাঙত বেল ফুলের গন্ধে তখন বুঝতেই পারতাম না আমি এই বেলা অবধি লোড শেডিং এ ঘামে ভিজে নেয়ে সুয়ে আছি.. ভগবান কে বলতাম কি বাজে গরম আমাকে কেন যে ঠান্ডার দেশে জন্ম দিলে না কে জানে .. আজ ঠিক ঘর থেকে ৯,০০০ মাইল দুরে বসে যখন দেখি মার্চ এ বরফ পরছে তখন বুঝতে পারি কেন জন্ম দেইনি.. ভেবে খুব খুশি হয়ে যাই আর দুখী ও ..কোনো দিন ভাবিনি Life Without Summer কেমন ই বা হতে পারে..
আজ বুঝতে পারি..গরম কাল আসার আগেই সবাই বলত উফ আবার পচা গরম আসছে…তাই গরম কে চিরকাল ই পচাই লাগত.. সুধু ভালো ছিল গরম এর ছুটি টা… যাইহোক আবার পইলা বৈশাখ ই যাওয়া যাক .. পইলা বৈশাখ এ আমরা সবাই মিলে বিকেল বেলা বেলুর মঠ এ যেতাম.. সেখানে গঙ্গা র ধারে বসে বাদাম ভাজা খেতাম.. বেলুর মঠ এ অনেক আম গাছ ছিল..এই সময় তাতে হাজার হাজার আম ঝুলে থাকত গাছ থেকে … আর রং বাহারি সব ফুল ফুটে থাকত..বেলুর মঠ এ সন্ধে ৬ টাই প্রেয়ার শুরু হত … বেশ ভালো লাগতো বিশাল একটা হল ঘরে গম গম করত গান .. প্রেয়ার শেসে বেরিয়ে বাইরে orange আর mango ice cream খেতাম সবাই মিলে..
তারপর সেই গরম এ ভিড় বাস …আর Howrah তে ভিড় ট্রেন .. সেই ভিড় ট্রেন এ ঘটি গরম … উফ দারুন লাগত খেতে.. জানলার ধারে সিট পেতাম ঠিক আমাদের স্টেশন আসার দুটো স্টেশন আগে .. মুখে যখন হাওয়া টা লাগত মনে হত প্রাণ ফিরে পেলাম.. জানলা দিয়ে ঘেটু ফুলের গন্ধ আসতো মৃদু মৃদু .. জানলা দিয়ে হাওয়া খাওয়ার মজা টা এখন বুজতে পারি যখন আমেরিকা তে গাড়ির জানলা খুলতে পারি না কখনো ঠান্ডার জন্য বা কখন ও গাড়ি খুব স্পিড এ চলার জন্য…
সত্যি গরম কাল কে আজ কাল বড্ড মিস করি.. গরম কালে সেই কাল বৈশাখী ঝর এ ছাদে দাড়িয়ে থাকা.আর চোখে ধুলো ঢুকে গেলেও দাড়িয়ে থাকতে হেভি মজা লাগত.. ঝর ওঠার ১০মিন এর মধ্যেই লোড শেডিং ..আর সেই ঝড়ের রাত্রে মায়ের হাতের গরম খিচুরী আর ডিম ভাজা উফ কি যে ভালো লাগত .. খেয়ে নিয়ে লাইব্রেরি থেকে নিয়ে আসা হানা বাড়ি রহস্য প্রেমেন্দ্র মিত্র অথবা টিনটিন এর কান ভাঙ্গা মূর্তি .. জমিয়ে দিত একদম.. সব চেয়ে মজা লাগত দাসেদের আম গাছ থেকে মাঝে মাঝে আম পরত ঝরে.. একবার তো tuition পড়তে গিয়ে আমার মাথায় একটা পাকা আম পরেছিল…নিয়ে এসেছিলাম ঘরে.. গরম কালের আরেক টা মজা ছিল মামার বাড়ি যাওয়া.
বাবা আমাকে আর মাকে পৌছে দিয়ে আস্ত. মামার বাড়ি Rourkela ..আমরা রাত্রের ট্রেন এ যেতাম সম্বলেস্বরী এক্সপ্রেস ..ট্রেন এ জানলা নিয়ে বরই মাথা বেথা থাকত আমার… আর জানি না কেন সবসময় হাওয়া র উল্টো দিকে সিট টা পরত আমার.. কিন্তু টাটা চলে আসার পর মাঝে মাঝে ভালো সিট টা পেতাম.. রাতের অন্ধকারে কিছু দেখা যেত না ভালো করে… মাঝে মাঝে ট্রেন টা হঠাট করে একটা অজানা স্টেশন হীন জায়গায় দাড়িয়ে যেত.. তখন অনেক বার বাইরে দেখতাম ঘন কাল জঙ্গল আর হাজার জোনাকির দল উড়ে বেরাছে.. একদম নিশ্চুপ একটা অদ্ভুত বন্য ফুলের গন্ধ পেতাম ..জোনাকির ঝিক মিক আর বাবার কিনে দেওয়া নতুন Walkman এ ৯০’ এর হিন্দি গান..
এইভাবেই আসতে আসতে দেখতাম স্টেশন এ বাংলা এনাউন্সমেন্ট তা হঠাট করে উড়িয়া তে বলছে.. তখন বুঝতাম Orrisa ঢুকে গেছে ..ট্রেন টা থেমে গেলে খুব গরম লাগত.. তবে সকালে মনোহর পুরের “খারাপ সে খারাপ চা” খেয়ে মনটা ভরে যেত..মে মাসে Rourkela তে প্রচন্ড গরম.. তখন আবার AC ছিল না ঘরে .. তবে কুলার খুব ভালো ঠান্ডা করতে পারত… দিদা র গাছ লাগানোর খুব সখ ছিল..আর আমার মামার বাড়ির ছাদে উঠলেই সামনেই দেখা যেত ছোট পাহাড় টাকে , আর দিদার লাগানো বেল আর জুই ফুলের গাছ .. গরম মানেই লোড শেডিং সে নিজের ঘরে এ হোক বা মামার বাড়ি তে..লোড শেডিং হলেই ছাদে সবাই মিলে মাদুর পেতে বসে গল্প করতাম.. মাঝে মাঝে ঘুমিয়ে ও যেতাম.. ঘরের ছাদে দোলনচাপার গন্ধ আর মামার বাড়ির ছাদে জুই ফুলের গন্ধ.. কিন্তু খুব বিরক্ত লাগত এই গরমে আর লোড শেডিং এ ..but এখন ভাবি সেই সব দিন কত ভালো ছিল..
তারপর এই গরমের দেশেই দিন কাটতে লাগলো ..আসতে আসতে কলেজ এ গেলাম পড়তে.. উফ কোলাঘাট এর গরম সবাই বলেছিল ”মেদনিপুরের গরম ..মরেই যাবি ”.. সত্যি ই তাই ..বাপ রে বাপ কি গরম… তার মধ্যে হোস্টেল এর রুম এ দুপুর বেলায় মনে হত যেন পুরে যাচ্ছি..ক্লাস বাংক করেও কোনো লাভ নাই.. তবে কলেজ ক্যাম্পাস এ সেই হলুদ ফুলের গাছ তা খুব সুন্দর ছিল..ঠিক যেন মনে হত সোনার মতো ঝরে পরছে… তারপর রাত্রে বন্ধুদের সাথে ভুতের গল্প… বিকেলে ঘুরে বেড়ানো.. গরম ভালো না লাগলেও এইসব করেই কেটে যেত.. পরা শোনা কিছুই করতাম না…
শনি বারে বাড়ি ফিরতাম ..প্রথমে ট্রেকার তার পর ট্রেন..দুপুরে ফিরলে মনে হত মাথা ঘুরে যাবে গরমে ..তার পর ট্রেন এ সেই প্যাকেট এ অরেঞ্জ সাদা ঠান্ডা কোল্ড ড্রিংক.. নুন মাখানো শসা বেস ভালো লাগত খেতে.. ট্রেন থেকে Santragachi স্টেশন এ নেমেই সেই চরম লু বইত..মাথায় ছাতা আর কাঁধে ভারী ব্যাগ নিয়ে মনে হত আর বুঝি বাড়ি অবধি পৌছাব না.তারপর কোনো রকমে বাড়ি গিয়ে ধুম পটাস.. তখন গরম কে একদম ভালো লাগত না. আর আজ সারাদিন স্নো পড়লে মনে হয় সেটাই বুঝি ভালো ছিল.. সব কিছু মিস করছি আজ. সেই গড়িয়াহাট এ গরম এ চরম ঝাল ফুচকা খাওয়া ..অথবা ঠান্ডা কুলফি ..সব কিছু যেন হারিয়ে গেছে কোথায় .. সেই গরমের ছুটিতে পিসির মেয়েদের সাথে লোড শেডিং এ চোর পুলিশ ডাকাত খেলা.
যদিও সব সময় চোর ই পরতো আমার ভাগ্গে আর আমাকে সবাই ধরে ফেলত , তাও যেন সেই গরম কাল তাকে ফিরে পেতে চাই.. রানিং ট্রেন এর দরজায় দাড়িয়ে হাওয়া মুখে লাগাতে চাই.. কোকিলের ডাকে, দোলনচাপা র গন্ধে ঘুম থেকে উঠতে চাই.. মা বাবা এর সাথে মামার বাড়ি গিয়ে সেই পাহাড়ে উঠতে চাই ছাতা মাথায় দিয়ে.. চৈত্র সেলে সারি কিনতে চাই..চরক মেলায় গিয়ে গরম জিলিপি খেতে চাই. আবার গরমে ছাদে বসে আকাশের তারা গুনতে চাই.. ঘেটু ফুলের গন্ধে পা পুরে যাওয়া রাস্তা দিয়ে হাটতে চাই.. কৃষ্ণ চূড়া গাছের নিচে বসে থাকতে চাই.. পলাস ফুল কুড়াতে চাই.. আরো কত কি করতে চাই যে আমি আজ ৯০০০ মাইল দুরে বসে থেকে কে জানে .
২৫সে বৈশাখে চুলে বেল ফুলের মালা লাগিয়ে সাজতে চাই .আবার বাচতে চাই সেই গরম কাল টাকে যেটা কোনো দিন আমার প্রিয় ছিল না.একবার ক্লাস 4 এ গরম কাল রচনা এসেছিল বলে বরই দুঃখ পেয়েছিলাম এটা ভেবে গরম কাল নিয়ে কি আর লিখব..আজ যদি রচনা লিখতে দেয় অনেক কিছুই লিখতে পারব বোধয় …আজ মার্চ ২০ ..গুগল ডট কম এ দেখাছে এটা নাকি 1st day of Spring আমেরিকা তে –কোনো দিন ভাবিনি 1st day of Spring এ সারাদিন শুধু বরফ পরবে…আর গরম কাল তা আমার এত প্রিয় হয়ে যাবে একদিন …..
আজ শুধু মন কাঁদে আর যেতে চায় সেই দেশে :
“দূরে কোথায় দূরে দূরে
আমার মন বেড়ায় গো ঘুরে ঘুরে।
যে বাঁশিতে বাতাস কাঁদে সেই বাঁশিটির সুরে সুরে ॥
যে পথ সকল দেশ পারায়ে উদাস হয়ে যায় হারায়ে
সে পথ বেয়ে কাঙাল পরান যেতে চায় কোন্ অচিনপুরে ॥”…..