রাত তখন প্রায় পৌনে দশটা, সিঙ্গুরের মেয়ে তনয়া তখনো কাজ করে যাচ্ছে। পুরো অফিস ফাকা, তনয়া ছাড়া আর কেউ নেই তখন। তনয়ার ও থাকতে ভালো লাগছে না কিন্তু কাজ বড় বালাই তাই থাকতেই হবে। তনয়া কাজ করে একটা KPO তে। তার কাজ হচ্ছে বিদেশে থেকে যারা পড়াশোনা করে তাদের জন্য research paper তৈরী করে দেওয়া। এই কাজে পয়সা ভালই আসে। তবে মাঝে মাঝে ছাত্র-ছাত্রীরা বড় জ্বালায়, তাদের বা বলা ভালো তাদের শিক্ষকদের কখনও এই সব ভারতীয়দের লিখে দেওয়া পেপার পছন্দ হয় না। অবশ্য তারা জানে যে এই সব পেপার ভারতীয় ছেলে-মেয়েরা লিখেছে। তারা জানে যে তাদের সুবোধ ছাত্র-ছাত্রীরা কষ্ট করে এই সব পেপার লিখেছে। যাই হোক এখন এই সব ভাবার সময় নেই, তাড়াতাড়ি আর ও হাজার শব্দ লিখে reference দিয়ে, formatting করে তারপর ছুটি।

খটা-খট, খটা-খট, খট-খটা, শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ শোনা যায় না। মনে হচ্ছে যেন একটা মানুষের হাড়ের সঙ্গে আর একটা হাড়ের ঠোকাঠুকি লাগছে। অদ্ভূত এক পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে অফিসটাতে। কিন্তু হঠাৎ যেন একটা খেদ পড়ল। এই শব্দের বাইরেও আর ও একটা শব্দ শোনা গেল। তনয়া কান খাড়া করল। হ্য, ঠিক, আরও একটা কিসের যেন শব্দ শোনা যাচ্ছে। তনয়া ভাল করে শোনার চেষ্টা করল। কোথাও যেন সেতার বাজছে। অল্পক্ষনের জন্য হলেও তনয়া খুব ভয় পেল। তারপর আস্তে আস্তে শব্দটা থেমে গেল। তনয়া ভাবল, “ধুর সব আমার মনের ভুল। তাড়াতাড়ি বেরোতে হবে। না হলে আরো বেশি এই সব আওয়াজ শুনব”। এই ভেবে সে আবার লেখা শুরু করল। কিন্তু কিছু ক্ষন পর আবার সেতার বাজতে শুরু করল। এইবার তনয়া একটু ভয় পেল। তার মনে পড়ল একটা কথা।

যেই অফিসটাতে বসে সে কাজ করছে সেটা ছিল এক জনের বাড়ী। বাব-মেয়ে থাকত সেই বাড়ীতে। একে-ওপড়কে ঘিড়ে ছিল দুজনের পৃথিবী। সেই পৃথিবী ভাঙল যখন বাবার মৃত্যু হল। মেয়ে সহ্য করতে পাড়ল না সেই শোক। এক রাতে নিজেকে শেষ করে পাড়ী দিল বাবার জগতে। সেই মেয়ে নাকি খুব ভাল সেতার বাজত। AC ঘরে তনয়া ঘামতে লাগল। তার এখনো পাঁচশো শব্দ লেখা বাকি, কিন্তু তার হাত চলছে না। কোন অজানা নিশি ডাকে সে এগিয়ে চলল শব্দটার দিকে। কিছুক্ষন বাজার পর থামল শব্দটা। তনয়া দাঁড়িয়ে পড়ল।

কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থাকার পর সে ভাবল ফিরে যাবে নিজের ডেস্কে, আবার বাজতে লাগল সেতার। এইবার সে এগোতে লাগল আওয়াজটার দিকে। আওয়াজটার মধ্যে কেমন যেন একটা ব্যপার আছে, অনেকটা নিশির ডাকের মতো। তনয়া যত এগোতে লাগল আওয়াজটা বেশী করে তীব্র হতে লাগল।তনয়া এসে দাড়াল একটা দরজার সামনে। এটা Finance team এর রুম। তনয়ারা অনেক বিষয় নিয়ে কাজ করে এবং বিষয় অনুযায়ী টিম ভাগ করা। তনয়া কাজ করে management –এর টিমে। যদিও সে নিজে sociology-র ছাত্রী।

যাক গে সে সব কথা। তনয়ার এখন প্রচন্ড ভয় করছে কিন্তু সে কিছুতেই পেছোতে পারছে না। এ যেন এক অদ্ভূত টান, সে অনুভব করছে। সব শক্তি সঞ্চয় করে তনয়া দরজায় একটা ঠেলা দিল সঙ্গে সঙ্গে তার পিঠে পড়ল একটে হাত। ভয়ে তনয়া চেচিয়ে উঠল।

“এই চুপ, চুপ, ষাঁড়ের মত চিৎকার করছিস কেন?” কার গলা? তনয়া আস্তে আস্তে চোখ খুলল, ওর সামনের ঘরে আলো জ্বলে গেছে। না, ভুত নয় এবং মেয়ে ভুত তো নয়ই বরং তার সামনে যে দাঁড়িয়ে আছে তাকে আস্ত একটা বাদঁর বলা যেতে পারে। আজ সকালেও বলেছে। সম্বিত, হল এই বাদঁরটারর নাম। কিন্তু তনয়া এইটা বুঝতে পারছে না যে ও এইখানে কি করছে। “তুই এইখানে কি করছিস?” সম্বিত, একটু কিন্তু কিন্তু করে বলে উঠল, “ইয়ে, মানে, মোবাইলটা ফেলে গিয়েছিলাম-,” কথার মাঝে ছেদ পড়ল। আবার সেতার বাজতে লাগল, কিন্তু এইবার তনয়া লক্ষ্য করল, যে সেতার বাজার সঙ্গে সঙ্গে সম্বিতের ফোন থেকে একটা আলো ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। সম্বিত ফোনটা ধরে বলল, “হ্যা, হ্যা, পেয়েছি, পেয়েছি,- আচ্ছা রাখছি এখন”। তনয়া এইবার ব্যপারটা বুঝল। বাবু আতঁলামি করে সেতারের শব্দ রিংটোন করেছে…আর সে কিনা…উফফফফফ!!!

রাগে তার গা রি রি করতে লাগল, “গাড়ল একটা। ফোন ফেলে গিয়েছিস কেন?” সম্বিত ভ্যাবাচাকা খেয়ে বলল, “অ্যা?” তারপর একটু সামলে বলল, “আরে আমার একটা দোষ হচ্ছিল বেরোনর আগেই মা কে বলে দি যে বেরিয়ে গিয়েছি, ফলে মা আর সারা রাস্তা ফোন করে না। আজ কেন জানিনা মেহুলের আমাকে খুব দরকার ছিল। ও আমাকে দুবার ফোন করে না পেয়ে বাড়ীতে ফোন করেছিল। বাড়ী ঢুকতেই মা সে কথা বলতেই পকেট হাতড়াতে গিয়ে বুঝলাম-” সম্বিত তার কথা শেষ করতে পাড়ল না, তনয়া বলে উঠল, “যে আপনি ফোন অফিসে ফেলে রাখার মত মহান কাজটি করেছেন। কিন্তু একটা খটকা তো রয়ে গেল বস্‌”।

 

সম্বিত একটা চেয়ারে আয়েস করে বসে জিঞ্জেস করল, “বলে ফেলুন ম্যাডাম”, তনয়া বলল, “তুই বেরলি সাড়ে ন’টায়, তোর বাড়ী তো কাছেই বাড়ী নিশ্চয় পৌছেছিস পৌনে দশটা নাগাদ। তার মানে তোর মেহুল এই মাঝের সময়টা ফোন করেছিল, তখন, as far as I know, পায়েল আর রাহুলদা ছিল,ওরা শুনতে পেল না?” সম্বিত বলল, “পায়েলের কথা বলিস না তো, কানে earphone এমন ভাবে গুজেছে, যে পাশে বসা লোক কি বলছে তাই শুনতে পাবে। যাওয়ার আগে bye বললাম উত্তর দিল না”, তনয়া বলল, “দেবে কেন? তোর তো মেহুল আছে। যাক গে রাহুলদাও কি পায়েলকে কপি করকছিল নাকি?”, সম্বিত বলল, “না রে না। রাহুলদা যখন কাজ করে তখন যদি তুই ওর পাশে বোমও ফাটাস না, ও শুনতে পাবে না। আর তা ছাড়া ও তো বেশীক্ষন অফিসে ছিল ও না”।

তনয়া বলল, “আচ্ছা তুই জানলি কি করে অফিস খোলা আছে?” “নিচে security কে ফোন করে জানলাম যে তুই আছিস”। সম্বিত হেসে বলল, “জানিস অফিসের নীচ থেকে ফোন বাজাতে শুরু করেছিলাম-” তনয়া এইবার রেগে গিয়ে বলল, “কেন রে তুই কি বাদুর? যে supersonic sound শুনতে পাবি?আমি আবার ভাবছিলাম-” তনয়া কথাটা শেষ করল না। ইস্‌! কি সব ভাবছিল সে, এখন নিজেকে খুব ক্যাবলা মনে হচ্ছে। সম্বিত বলল, “কি রে কি ভাবছিলিস?” তনয়া রেগে বলল, “কিছু না, তোর জন্য কতটা দেরী হয়ে গেল জানিস”, সম্বিত হঠাৎ বলল, “তো আর কত বাকি?”

তনয়া বলল, “কেন তুই জেনে কি করবি?” “বলই না”, সম্বিত বলল। তনয়া নিজের রুমে ফিরে যেতে বলল, “আরো পাচঁশ সঙ্গে reference”। সম্বিত, তনয়ার চেয়ারের পাশে এসে দাড়িয়েছে, সে বলল, “ঠিক আছে তুই টপিকটা বল, আমি reference বার করে দিচ্ছি”। তনয়া দেখল সম্বিত already laptop খুলতে শুরু করছে। সে বলল, “সত্যি সত্যি করবি নাকি?” সম্বিত বলল, “হ্যা রে বাবা”। তনয়া একটু হাসল, যাক বাবা আর ভুতের সঙ্গে তাকে কাজ করতে হবে না। এখন অন্তত ঘরে একটা মানুষ আছে।

 

~ সেতার ~

Print Friendly, PDF & Email
Previous articleশেষ দৃশ্য
Next articleমিডনাইট মিশন
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments