বৃষ্টির দিন বাইরে সকাল থেকেই বৃষ্টি হচ্ছে, অফিস যেতে পারিনি তাই ঘরে বসেই একটু বই পড়ছিলাম। রাতের রান্না সেরে ঘরে এসে বসেছি, সবে একটা সিগারেট ধরিয়েছি এমন সময় দরজায় টোকা পড়ল। সিগারেট টা মুখে নিয়েই দরজা খুললাম। দেখি সামনে দাঁড়িয়ে আছে সমু, আমার কলেজের বন্ধু।

আমি এখন কলকাতা থাকি আর ও থাকে মালদা ওর চাকরির জন্য। ওর বাড়ি যদিও মুর্শিদাবাদ। বেশ ছটফটে ছেলে কিন্তু আজ মুখ টা যেন ভয় আর ক্লান্তি তে বিষণ্ন। সমুর কেও নেই বছর তিনেক আগে বিয়ে করেছিল যদিও মাস ছয়েক হল ওর বউ নদীতে স্নান করতে গিয়ে জলে ডুবে মারা যায়। ছেলেটার কপাল খারাপ মা বাবা নেই বউ টাও মারা গেছে থাকার মধ্যে শুধু আমি। আজ ওকে দেখে খুব অবাক লাগল ওর চোখ দুটো লাল, শরীর টাও ভালো না অনেক রোগা হয়ে গেছে, বেশ বোঝা যাচ্ছে ঠিক করে খাওয়া দাওয়া করেনি।

দরজা খুলতেই ধড়ফড় করে ঘরে ঢুকে আসলো সমু। আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল ভাই বাঁচা আমাকে। আমি দরজা বন্ধ করে ওকে এক গ্লাস জল দিয়ে শান্ত করলাম।

ও জল খেয়ে বলা শুরু করল, “ভাই আমি আর থাকতে পারছি না আমি পাগল হয়ে যাবো তুই বাঁচা আমাকে।”

আমি বললাম শান্ত হয়ে বসে আমাকে সব খুলে বলে কি হইছে তোর।

ও কিছুক্ষন চুপ করে তারপর বলল, ” আমি স্নেহা কে খুব ভালোবাসতাম”  বলা হয়নি স্নেহা ওর বউএর নাম। আমি বললাম হ্যাঁ আমি জানি কি হইছে ঠিক করে বল।

তারপর সমু যা বললো শুনে আমি ভয়ে আঁতকে উঠেছিলাম। ও বললো স্নেহা নাকি ওর সাথেই আছে প্রতি রাত এ নাকি ওকে দেখা দেয় আর বলে, “আমি আমার ভালোবাসার মানুষকে চাই” তার পর একটা বিশ্রী হাসি মেশানো কান্না করে চুপ হয়ে হওয়ায় মিলিয়ে যায়। আর দিনের বেলা সমু ঘর থেকে বেরোলে নাকি কেও এসে ঘর পরিপাটি করে গুছিয়ে রাখে। শুনে প্রথমে ভয় হলেও পরে মনে হলো বউএর শোকে ছেলেটার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। সমু বার বার বলতে লাগল আমি আর মালদা ফিরে যাব না তুই আমাকে তোর কাছে থাকতে দে। আমি যদিও কোনো আপত্তি করলাম না কারণ আমি একাই থাকি।

রাতে একসাথে খেতে বসে ওকে বোঝালাম, “দেখ তুই আমার কাছে থাকবি তাতে কোনো সমস্যা নেই আমার, কিন্তু এভাবে কদিন পালিয়ে বেরোবি ? সমস্যার সমাধান তো করতে হবে।”

সমু একটু চুপ করে থেকে বলল, ” তুই একবার আমার বাড়ি যাবি? তারপর নাহয় বাড়ি টা বিক্রি করে দেব।”

আমি আর না করলাম না, বললাম, ” কালকেই যাবো চল।”

সমুও রাজি হয়ে গেল। খাওয়া শেষ করে একসাথে শুয়ে পড়লাম। শুয়ে শুয়ে কথা বলতে বলতে সমু বলল, “কাল তুই আমার সাথে গেলে আর কোনো চিন্তা নেই আমার।”

আমি বললাম চিন্তা করিস না ভাই আমি আছি তো।

সমু একটু ইয়ার্কি মেরে বলল, ” সেটাই তো সব থেকে বড় চিন্তা আমার।”

তারপর ঘুমিয়ে পড়লাম। পরদিন খুব সকালে উঠে ব্যাগ গুছিয়ে বেরিয়ে পড়লাম আমরা। মালদা সিটি এন্টারসিটি ট্রেন এ বিকালের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম আমরা। স্টেশন থেকে গাড়ি তে তিরিশ মিনিট এর মধ্যেই পৌঁছে গেলাম ওর বাড়ি। আজ প্রথম আসলাম ওর বাড়ি , সমু তালা খুলতে খুলতে বলল, “কি রে তোর ভয় লাগছে না তো ?”

আমি বললাম, ” ভয় কিসের আমরা দুজন আছি তো।”

ভেতরে গেলাম আমরা। বাড়ি টা খুব বেশি বড় না, দোতলা নিচে দুটো আর ওপরে একটা ঘর আর তার সাথে খানিকটা ছাদ। আমরা উপরের ঘরে গিয়ে বসলাম, সমু আসার সময় খাবার কিনে এনেছিল সেটাই দুজন খেয়ে একটু ঘুমিয়ে নিলাম। শরীরটা বেশ ক্লান্ত ছিল তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম ভাঙল সন্ধে সাত টার সময়। তারপর চোখে মুখে জল দিয়ে দুজন মিলে আড্ডা দিতে বসলাম। কথায় কথায় সমু বার বার বলতে লাগল, “তুই না থাকলে একা হয়ে যাব।” বেশ অনেক্ষন কথা হলো আমাদের প্রায় দশটা বেজে গেল। সমু নীচে গিয়ে খাবার গরম করে নিয়ে এলো। দুজন একসাথে খেতে বসলাম।

সমু এবার একটু কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল, “তুই ছাড়া এখন আমার আর কেও নেই।” আমি আর কিছু বললাম না শুধু মনে হল ছেলে টা সত্যি পাগল হয়ে গেছে। খাওয়া শেষ করে বিছানা তে উঠে বসলাম আমি। তবে কিছুক্ষন থেকে একটা জিনিস লক্ষ করছি, সমুর মুখে আর সেই ভয় এর ছাপ টা যেন কমে এসেছে। যায় হোক আমি আর অত কিছু নাভাবে শোয়ার ব্যাবস্থা করতে লাগলাম। তারপর সমু কে জল আনতে বললাম ও নীচে চলে গেল।

আমি ওর কালকের কথা গুলো ভাবছিলাম হটাৎ ও ঘরে এসে বলে উঠলো,” কি রে তোর ভয় করছে না তো?” আমি একটু চমকে উঠলাম প্রায় কখন যে ও ঘরে এসেছে সেটা খেয়াল করিনি। যায় হোক আমি জল খেয়ে একটা সিগারেট ধরাতে ধরাতে একটু ইয়ার্কি মরেই জিজ্ঞেস করলাম,” কি ভাই স্নেহা কখন আসবে?” সমু চুপ করে রইল। আমার একটু খারাপ লাগলো ভাবলাম কথাটা বলা হয়তো ঠিক হয়নি।

কিন্তু ঘরের নিস্তব্ধতা ভেদ করে সমু কেমন যেন বদলে গিয়ে বলে উঠলো,” স্নেহার জন্য খুব চিন্তা হচ্ছে নাকি? মরার পরেও ভুলতে পরিসনি ওকে ?” আমি চমকে উঠলাম সমুর মুখে আর ভয় নেই তার বদলে একটা বিশ্রী ষড়যন্ত্র মেশানো হাসি। আমি আর কথা বলতে পারলাম না।

সমু বলে চলল,” তুই আমার সব থেকে কাছের বন্ধু হয়ে আমার স্নেহার সাথেই সম্পর্ক করতে পারলি ? তোকে এত বিস্বাস করতাম আর তুই কি না ছি: !”  আমি ভয়ে ভয়ে বললাম ভাই ক্ষমা করে দে আমাকে আমার ভুল হয়ে গেছে, ক্ষমা করে দে।

সমু প্রায় চিৎকার করে বলে উঠল,” স্নেহার গলাটা যখন ধরে ওর মুখটা নদীর জলে চেপে ধরে ছিলাম তার আগে ও অনেক বার ক্ষমা চেয়েছিল জানিস তো ঠিক তোর মত করেই, কিন্তু বিস্বাস কর ক্ষমা করিনি। একটা বারের জন্যেও আমার হাত তা কাঁপেনি নিজের হাতেই ওকে জলে ডুবিয়া শেষ করেছি।”

আমি কি কি করব কি বলব কিছুই বুঝতে পারলাম না, দুজনেই চুপ করে থাকলাম। শুধু সমুর চোখ দুটো দেখলাম রক্তের মতো লাল আর মুকে একটা হিংস্র হাসি।

আমি ওকে সমু বলে ডাকে দিতেই ও ঘরের নিস্তব্দতার বুক চিঁড়ে চিৎকার করে বলে উঠলো,” ভালোবাসিস তো স্নেহার কে যা তুই ওর কাছেই যা।” কথা তা শেষ হওয়ার আগেই সমু পাশে টেবিল থেকে একটা চুরি নিয়ে আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো, আর আমার বাধা দেওয়ার আগেই সোজা আমার বুকে বিধিয়ে দিল।

তারপর সমু শান্ত গলায় একটা কথা বলল, “আমি আবার একা………!!!”

 

~ সম্পর্ক ~

Print Friendly, PDF & Email
Previous articleল্যাম্পপোস্টের নীচে
Next articleঅদৃষ্ট
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments