এবছর দোলযাত্রার ছুটি টা কিভাবে কাজে লাগাবো ভাবতে ভাবতে গুজরাট ট্রিপ ফাইনাল করে নিলাম | কর্মসূত্রে পুনে তে থাকি | ২১ শে মার্চ বৃহস্পতিবার অফিস ছুটি | একদিন শুক্রবার ছুটি নিলেই লম্বা ভ্যাকেশন | সোমনাথ – দ্বারকা – পোরবন্দর – গির প্ল্যান পাক্কা করে নিলাম |
২০ শে মার্চ অফিস থেকে ফিরে রাত ৯ টার ফ্লাইট এ আহমেদাবাদ | সেদিন আহমেদাবাদে রাত্রি যাপন | আহমেদাবাদ এয়ারপোর্টের কাছেই একটি হোটেল বুক করা ছিলো | এখানে ১-৩ কিলোমিটারের মধ্যে প্রচুর হোটেল আছে | আমি ফ্যাভোটেল মাহের ইন বুক করেছিলাম | আহামরি কিছু না , এক রাত্তিরের জন্য যদিও বা চলনসই | এয়ারপোর্ট থেকে অটো তে হোটেল ১০০ টাকা ভাড়া | সেই অটো ভাইয়াকেই সকাল ৭ টাতে হোটেলে আস্তে বলে দিলাম | কারণ কাল সকাল ৮.২০ তে সোমনাথ এক্সপ্রেসের (জব্বলপুর – সোমনাথ ) টিকিট কাটা আছে |
পরদিন সকালবেলা যথা সময়ে সেই অটো ড্রাইভার এসে উপস্থিত | বলে রাখা ভালো, এই নিয়ে আমার দ্বিতীয়বার গুজরাট যাত্রা, আর দুবারই যে জিনিস টি লক্ষ করেছি তা হলো অটো- ক্যাবের ড্রাইভার দের ব্যবহার , তাদের সময়ানুবর্তিতা | পর্যটকরা যে তাদের অন্যতম পুঁজি তা তারা ভালো ভাবেই জানে, এবং সর্বদা তাদের খেয়াল রাখতে যেন বর্ধপরিকর | যাই হোক সকাল বেলা খালি রাস্তায় ১৫ মিনিটে স্টেশন পৌঁছে গেলাম | স্টেশনের কাছে অনেক রেস্তোরাঁ আছে যেখানে ব্রেকফাস্ট করে নিতে পারেন | আমরাও ওখানেই একটি হোটেল এ ব্রেকফাস্ট সেরে ট্রেনে চেপে বসলাম | আজকাল অনেক ট্রেনেই কিন্তু প্যান্ট্রি কার থাকছে না, এই ট্রেনেও ছিল না | যদিও বা যাবার পথে কোনো স্টেশন এ বা ট্রেনেও আপনি অন্য vendor দের খাবার অর্ডার দিতে পারেন, তবে পারলে খাবার carry করাই ভালো |
সন্ধ্যে ৬টা নাগাদ আমরা সোমনাথ স্টেশনে পৌঁছে গেলাম | স্টেশন টি ছোট কিন্তু পরিষ্কার পরিছন্ন | অনেকটা সেই দক্ষিণের কন্যাকুমারী স্টেশনের সাথে যেন মিল খুঁজে পেলাম | আমাদের সোমনাথ সাগর দর্শন গেস্ট হাউস বুক ছিল | এটি মন্দিরের ট্রাস্ট এর আন্ডারে, রিলায়েন্স কোম্পানি তৈরি করেছে আর তারাই দেখ ভাল করে | অসাধারণ এর অবস্থান | সোমনাথ মন্দির দর্শনের জন্য এর চেয়ে ভালো জায়গা মনে হয় আর নেই | সোমনাথ মন্দিরের ঠিক পাশেই এটি অবস্থিত | সামনে খোলা সমুদ্র | প্রকৃত অর্থেই সমুদ্র দর্শন | গেস্ট হাউসের প্রতিটি রুম থেকেই সমুদ্র দেখা যায় | সাথে ভেজ রেস্তোরাঁ যেখানে খাবার কোয়ালিটি সত্যিই ভালো | গুজরাট এ কিন্তু খাওয়া দাওয়া হোটেলএ একটু কস্টলি | দর্শনীয় স্থানগুলোতে তো বটেই |
গেস্ট হাউসে পৌঁছেই আর এক মুহুত সময় নষ্ট না করে সোজা মন্দিরের দিকে রওনা হলাম | কারণ সন্ধ্যে আরতি শুরু হয়ে গেলে আবার বন্ধ হয়ে যাবে প্রধান ফটক | আগে যা বলেছিলাম, মন্দির আর হোটেলের মাঝে শুধু একটি মাত্র কমন দেওয়াল | যেতে বেশিক্ষন সময় লাগলো না | মন্দির টি অসাধারণ কারুকাজে সমৃদ্ধ | এটি আসলে নতুন মন্দির, সমুদ্রতটে অবিস্থত | পুরানো মন্দিরটি এর অদূরেই দেখতে পাবেন | এখানে দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের প্রথমটি আছে | বেশ তাড়াতাড়িই দর্শন হয়ে গেলো | এবার পেয়েছে খিদে | হোটেল এ ফিরে এসে সোজা রেস্টুরেন্ট অভিমুখে চললাম | খেতে খেতেই সন্ধ্যে আরতির আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলাম | খাবার শেষ করে হোটেলের গার্ডেন এরিয়া তে আসতেই এক অভূতপুর্ব দৃশ্য দেখতে পেলাম | মন্দিরের দেওয়ালে লাইট এন্ড সাউন্ড শুরু হয়ে গেছে আর তা আমরা হোটেলের গার্ডেন এরিয়া থেকেই সরাসরি দেখতে পাচ্ছি | পুরো মজা নেবার পর এবার সন্ধ্যে বেলার সোমনাথ ঘোড়ার পালা | মন্দির আর মার্কেট চত্বরে এদিক ওদিক ঘুরে বেরালাম | সব শেষে ক্লান্ত পায়ে গেস্ট হাউসে ফিরে এসে আমি সোজা চেয়ারটি নিয়ে রুম এর ব্যালকনি তে | সামনে দিগন্ত বৃস্তিত সমুদ্র, পাশে অপূর্ব আলোকে আলোকিত মন্দির, সব মিলিয়ে সে এক অসাধারণ অনুভূতি যা বর্ণে প্রকাশ করা যাবেনা | সমুদ্রের হাওয়াতে বেশ ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছিলো, ঘড়িতে দেখলাম রাত বারোটা | আর দেরি করা যাবেনা, কাল সকালে গাড়ি আসবে দ্বারকা যাত্রার জন্য |
ভোরবেলা আবার যথা সময়ে গাড়ি এসে উপস্থিত | এই গাড়িটি আগামী দুদিনের জন্য আমাদের সঙ্গী | সোমনাথের বাকি সাইটসিইং কোরে, সোজা চলে আসলাম পোরবন্দর | সোমনাথেই আছে সেই জায়গাটি যেখানে শ্রীকৃষ্ণ ভগবানের দেহত্যাগ হয়েছিল ব্যাধের ছোড়া তিরে | সেই গাছটির এখনো ভগ্নাশেষ আছে , তাকে ঘিরেই মন্দির টি গড়ে উঠেছে | পোরবন্দরে কৃষ্ণবন্ধু সুধামার একটি মন্দির আছে | সেটি দেখে চলে আসলাম গান্ধীজির পৈতৃক ভিটেতে | কিছুক্ষন ফটো সেশন করে এগিয়ে চললাম দ্বারকার দিকে | বিকেল ৩ তে নাগাদ দ্বারকা পৌঁছে প্রথমে নাগেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গ আর রুক্মিণী মাতা মন্দির দেখে সোজা হোটেলে চেক ইন | আমি হোটেল নারায়ণ ইন বুক করেছিলাম |
মার্কেট এরিয়ার মধ্যে, মন্দির বেশি দূরে নয় | প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো, আমি সাধারণত priority অনুযায়ী হোটেল বুক করি | যেমন আমার যদি কোনো জায়গা দেখার হয় সেদিন বিকাল বা সন্ধেয়, তবে তার আসে পশে হোটেল খুঁজি, অথবা যদি ভোর বেলা ট্রেন বা ফ্লাইট ধরতে হয়, তবে স্টেশন বা এয়ারপোর্ট এর আশেপাশে | এতে অনেক ঝঞ্ঝাট এড়ানো যায়, সময় অনেক বাঁচে |
যাই হোক দুদিনে দুটি জ্যোতির্লিঙ্গ দর্শন হবার পর, হোটেলে কিছুক্ষন বিশ্রাম নিয়ে, ফের পরের দর্শনীয় স্থান দ্বারকা শ্রীকৃষ্ণ মন্দিরের দিকে হাঁটা লাগলাম | হোটেল থেকে কাছেই , পায়ে হাঁটা দূরত্বেই মন্দির | মার্কেট এরিয়ার মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম | সেদিন দোল যাত্রার পরের দিন , মন্দির চত্বরে তখনও আবির লেগে ছিল | সেই পুণ্যস্থান থেকে দর্শন সেরে বেরিয়ে সোজা আসলাম গোমতী নদীর পাড়ে | সেখানে সুন্দর একটি ঝুলন্ত ব্রিজ আছে সেটি ক্রস করে গোমতী তীরে কিছুক্ষন সময় কাটালাম | ফিরে আসার মুখে দেখলাম পিছনে দ্বারকা মন্দির কে ক্যানভাসে রেখে সূর্যিমামা সাগর সঙ্গমে অস্ত যাচ্ছে | আজকের মতো দ্বারকা ভ্রমণ সাঙ্গ কোরে হোটেলে ফিরে আসা হোলো |
আজ সকাল সকাল আবার বেরিয়ে পরা হলো | দ্বারকা ছাড়ার মুখেই পোহা মানে চিড়ার পোলাউ (মহারাষ্ট্র আর গুজরাটে খুব কমন খাবার ) দিয়ে ব্রেকফাস্ট করে , এক অসাধারন চা খেয়ে আবার গাড়িতে চেপে বসলাম | এবারের গন্তব্য সোজা গির | বুকের মধ্যে খুব উত্তেজনা আর ভিতর ভিতর ঠাকুর কে ডেকে চলেছি, যেন সিংহ দর্শন হয়ে যায় | ড্রাইভার এর মুখে এবং নানা অনলাইন রিভিউ পরে যা জেনেছি, সিংহ মামার দেখা পাওয়া নাকি ভাগ্যের ব্যাপার | প্রসঙ্গত বলে রাখি গির এর সিংহ দর্শন আপনারা দুভাবে করতে পারেন | একটি হচ্ছে দেবালয় সাফারি – এর জন্য কোনো অ্যাডভান্স বুকিং নেই, আপনি যখন তখন গিয়ে বুক করতে পারেন | সিংহ এখানে দেখতে পাবেনই, কারণ ইটা অনেকটা সেই খোলা চিড়িয়াখানার মতো, যেখানে একটি নির্দিষ্ট এরিয়ার মধ্যে জিপ সাফারি করানো হয় | অনেকটা সেই নন্দনকানন বা Chennai এর ভান্দালুর zoo এর মতো ব্যাপার | আর দ্বিতীয়টি হলো আসল জঙ্গল কোর এরিয়া সাফারি | এর জন্য প্রতিদিন জিপ সংখ্যা আর লোক সংখ্যা বাঁধাধরা | কোনো কারেন্ট বুকিং হয় না, প্রচুর ডিমান্ড এর , কমসে কম ২০-৩০ দিন আগে অনলাইন এ বুক করতে হয় | আমি গিয়ে অনেক লোককে বুকিং সেন্টার এ অনুরোধ করতে দেখেছি একটি টিকিট আর পারমিশন এর জন্য , কিন্তু কোনো লাভ নেই | এখানে সিংহ দেখা আপনার ভাগ্যের উপর,কিন্তু এটাই আসল জঙ্গল সাফারি , যেখানে আপনি সত্যিকারের জঙ্গল ভ্রমণের স্বাদ নিতে পারবেন | জীবজন্তুরা এখানে নিজের মর্জি অনুযায়ী চলে | একমাত্র এশিয়াটিক লায়নের জায়গা এটি | সিংহ ছাড়াও প্রচুর হরিণ , বাইসন , ইন্ডিয়ান সম্বর নানা রকমের জীবজন্তুর দেখা পাওয়া যায় | আমার স্লট দুপুর ৩-৬ টা বুক করা ছিল | গিরে আমরা প্রায় ১টা নাগাদ পৌঁছে গেলাম | খিদে পেয়েছিলো , ড্রাইভার গিরের সিংহদর্শন (এখানেই আপনাকে বুকিং এর কাগজ পত্র নিয়ে আসতে হয় ) মূল ফটকের প্রায় ৮-১০ কিলোমিটারের আগেই একটি ধাবায় গাড়ি দাঁড় করালো | এটিও জঙ্গল এরিয়ার মধ্যেই পরে | সেখানে গ্রামীণ পরিবেশে অসাধারণ ভেজ লাঞ্চ করা হলো | যখন খাওয়া দাওয়া ছেড়ে পিছন দিকে হাত ধুতে গেছি, দেখি দু-চারজন গ্রামীণমহিলা উত্তেজিত ভাষায় কি কথা বলছে | পরে জানতে পারলাম, তারা নাকি কাঠ কাটতে গিয়ে ২ টি সিংহ এবং তাদের শাবকদের দেখতে পেয়েছে | আমি আবার মনে মনে ভাবতে লাগলাম কি জানি বাবা আমার ভাগ্যে লেখা আছে নাকি কে জানে |
যথাসময়ে সিংসদন বুকিং কাউন্টারে এসে পৌছালাম | আপনাকে বুকিং স্লিপ (অনলাইন এ যেটা পেয়েছেন সেটার প্রিন্টআউট ) , পরিচয় পত্র – আধার / পার্সপোর্ট / ভোটার আইডি সবকিছু নিয়ে আসতে হবে | আপনি যে পরিচয়পত্র উল্লেখ করেছিলেন সেটিই নিয়ে আসতে হবে , আর দলের সব লোকের জন্যই এটি বার্ধতামুলুক, এমনকি বাচাদেরও | ইচ্ছুক পাঠকদের বলবো আপনারা https://girlion.gujarat.gov.in/ – এই পোর্টালে বুকিং সংক্রান্ত সমস্ত খবর পেয়ে যাবেন | যাই হোক , বুকিং স্লিপ আর পরিচয়পত্র দেখানোর সঙ্গে সঙ্গে , ফরেস্ট অফিসার আপনার জন্য জঙ্গল সাফারীর জন্য একজন গাইড , জীপ আর রুট ধার্য করবেন | আপনার জন্য যেকোনো রুট ধার্য হতে পারে, কিন্তু যে রুট লেখা থাকবে, গাড়ি শুধু সেখানেই যেতে পারবে | আমাদের জন্য রুট নম্বর ৬ ধার্য হলো | গাইড দেখলাম খুব উত্তেজিত, বললো ” স্যার, সকালবেলা ৬ নম্বরে দেখা গেছে, আপনার ভাগ্য ভালো ” | সব মিলিয়ে ৩ ঘন্টার জিপ সাফারি | চালু হতেই কিছু হরিণ দেখতে পারলাম | এছাড়া সম্বর , বাইসন আর অজস্র হনুমানের দেখা পেলাম | কিন্তু সিংহ মামার আর দেখা নেই | গাইড একজায়গায় গিয়ে জিপ দাঁড় করিয়ে দিলো | বললো, একটু অপেক্ষা করে তারপর যাবো, তাতে সময় হাতে থাকবে, বিকালের দিকে যদি জল খেতে তারা বেরোয় | একথা সেকথা বলতে বলতে গাইড আরো বললো , অমিতাভ বচ্চন নাকি ৩ বার সাফারি করার পর সিংহ দর্শন করতে পেরেছিলেন আর সচিন টেন্ডুলকার প্রথম বারেই | আচমকা উল্টো দিক দিয়ে দেখছি একটি জিপ গাড়ি আসছে, আর তারা খবর দিলো, ৫ নম্বরে এই মাত্র তারা দেখতে পেয়েছে | গাইড বললো এরা ঠিক ৫ নম্বর ক্রস করে ৬ই নম্বরে আসবে , কিছুক্ষন আর একটু অপেক্ষা করি | গাইড সিগন্যাল দেবার পর এবার জিপ ধীরে ধীরে এগুতে লাগলো | রাস্তার দুদিকে স্বতন্ত্র দৃষ্টিতে আমরা নজর রাখছি | এতিমর্ধে আধা ৬ নম্বর রুট শেষ হয়ে গেছে , এখনো তার দেখা নেই | হটাৎ করে দেখি সামনে কিছু জিপের জটলা | এগিয়ে যেতে দেখি আমার ভাগ্য এযাত্রায় খুব ভালো | সিংহ শাবক সহ দুটি বেশ বড়ো জাতের সিংহ আমাদের অনেক সময় ধরে ফটোসেশন দিয়ে এযাত্রায় আমার শিব দর্শন আর সিংহ দর্শন দুইই সফল করলো |