তখন থানেশ্বররাজ প্রভাকরবর্ধনের মৃত্যু হয়েছে। তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র রাজ্যবর্ধন সবেমাত্র সিংহাসনে আরোহণ করেছেন। ভগিনীপতিগ্রহবর্মার নিধন তথা ভগিনী রাজ্যশ্রীর কারারুদ্ধের সংবাদে তিনি আর স্থির থাকতে পারলেন না।বয়োকনিষ্ঠ হর্ষবর্ধনের হাতেরাজ্যের ভার সঁপে দিয়ে তিনি দেবগুপ্তকে শাস্তি দেবার উদ্দেশ্যে কনৌজ অভিমুখে যুদ্ধযাত্রা করলেন। কিন্তু সে খবর পাওয়া মাত্রইদেবগুপ্ত মাঝপথে তাঁর পথ অবরোধ করলেন। তবে এবার দেবগুপ্তের ভাগ্য সহায় ছিল না। রাজ্যবর্ধনের বিশাল সৈন্যবাহিনীরপরাক্রমে দেবগুপ্ত পরাজিত নিহত হলেন।দেবগুপ্ত তাঁর কৃত অন্যায়ের শাস্তি হাতে হাতেই লাভ করলেন।

ইতিমধ্যে শশাংক কনৌজের প্রায় নিকটেই এসে গিয়েছিলেন।মৌখরীরাজ গ্রহবর্মা এবং মিত্র মালব্যরাজ

দেবগুপ্তের মৃত্যুসংবাদ তাঁর কানে এসে পৌঁছল। তিনি তড়িৎ গতিতে অগ্রসর হয়ে কনৌজের প্রবেশদ্বারে রাজ্যবর্ধনের পথঅবরোধ করলেন। দুদিন ব্যাপী মহা সংঘর্ষের পর রাজ্যবর্ধন উপলব্ধি করলেন যে তাঁর পরাজয় অবশ্যম্ভাবী। তখন তিনি এককূটনীতির চাল চাললেন।তিনি শশাংকের নিকট একটি সন্ধি প্রস্তাব পাঠালেন। শর্ত ছিল একটিইতাঁর ভগিনী রাজ্যশ্রীকেকারামুক্ত করতে হবে। পরিবর্তে কনৌজের অধিকারী হবেন মহারাজ শশাংক।এমনকি থানেশ্বরের সাথে গৌড়ের চির শত্রুতারঅবসানেরও ঈঙ্গিত ছিল তাঁর সেই সন্ধি প্রস্তাবে। রাজ্যবর্ধন তাঁর শিবিরে শশাঙ্ককে আমন্ত্রণ জানালেন।

যদিও শশাংক কনৌজের অধীশ্বর হওয়ার জন্য মোটেই আগ্রহী ছিলেন না, কারণ সূদুর বঙ্গভূমি থেকে কনৌজ শাসন করারীতিমত দুরূহ ছিল, তাহলেও তিনি রাজ্যবর্ধনের প্রস্তাবে রীতিমত খুশী হলেন। কারণ এই অহেতুক রক্তক্ষয় তাঁর মনকে যথেষ্টপীড়া দিচ্ছিল। তবে তিনি রাজ্যবর্ধনের যুদ্ধশিবিরে যেতে সম্মত হলেন না। তাই স্থির হল দুই যুযুধান পক্ষের সেনাছাউনিরমধ্যবর্তী কোন এক জনহীন প্রান্তরে সূর্যাস্তের অব্যবহিত পরেই দুই রাজন এক বিশেষ শিবিরে পরস্পরের সাথে মিলিত হয়েমিত্রতার চুক্তিতে সিলমোহর দেবেন।তবে এই শিবিরটি মহারাজ রাজ্যবর্ধনেরই এক্তিয়ারভুক্ত হবে।শিবিরের বাইরে কেবল দুইসম্রাটের দুজন করেই দেহরক্ষী থাকবেন। কারণ যেখানে বন্ধুত্বই মূল লক্ষ্য, সেখানে অধিক সৈন্যের সমাহার মানেই অবিশ্বাসীমনোভাবকে প্রশ্রয় দেওয়া।যদিও শশাঙ্ক রাজ্যবর্ধনের অভিপ্রায় সম্বন্ধে সম্পূর্ণ সন্দেহমুক্ত ছিলেন না, কিন্তু বৌদ্ধধর্মাবলম্বীরাজ্যবর্ধনকে তিনি একেবারে অবিশ্বাসও করতে পারেননি।সময়টি নির্বাচিত হয়েছিল সুর্যাস্তের পর। যদিও রাজ্যবর্ধনের ইচ্ছা ছিলআলোচনাটি দিনের বেলায় হোক, কিন্তু শশাঙ্ক তাঁর ইষ্টদেবতা মহাদেবের

সন্ধ্যারতি সমাপন না করে, তাঁর আশীর্বাদ না নিয়ে এই সন্ধি আলোচনায় যোগ দিতে সম্মত ছিলেন না। আর আগের রাত্রিইছিল মহাশিবরাত্রি। রাত্রীর চার প্রহর ব্যাপি পূজার্চনার শেষে মহারাজ শশাঙ্ক স্বাভাবিক ভাবেই পরদিন ক্লান্ত ছিলেন. তাই শেষঅবধি আলোচনাটি সন্ধ্যার পরে হবে বলেই স্থির হয়েছিল।

নির্দিষ্ট দিন সন্ধ্যার কিছুক্ষণ পরে মহাকালের আর্তি সমাপনে মহারাজ শশাঙ্ক তাঁর দুজন দেহরক্ষী নিয়ে রাজ্যবর্ধনের শিবিরেরউদ্দেশে রওয়ানা দিলেন। শিবিরের কিছু দূরে অশ্বপৃষ্ঠ থেকে অবতরণ করে তিনি তাঁর দুই দেহরক্ষীকে সেখানেই শিবিরের দিকেতীক্ষ্ণ দৃষ্টিপূর্বক অপেক্ষার নির্দেশ দিলেন। আর বললেন যদিহর হর মহাদেবএই মন্ত্রটি শিবির বাবংবার উচ্চারিত হয়, তাহলে তারা যেন বোঝে যে তাঁর কোন বিপদ হয়েছে এবং সাথেসাথেই তারা যেন যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করে। বিষয়ে তিনিতাঁর শিবিরের সৈন্যদেরও সতর্ক করে রেখেছিলেন।

মহারাজ শশাঙ্ক সন্ধানীদৃষ্টিতে চতুর্দিক নিরীক্ষণ পূর্বক যখন সম্পূর্ণ নিশ্চিত হলেন যে আশেপাশে মহারাজ রাজ্যবর্ধনের কেবলদুজন দেহরক্ষী ব্যতীত আর কেহই নাই , আর তারাও শিবিরের সন্নিকটে প্রহরারত নয়, তখন তিনি কিছুটা নি:শঙ্ক চিত্তেরাজ্যবর্ধনের শিবিরে প্রবেশ করলেন।

সুস্বাগতম, সুস্বাগতম , গৌড়বঙ্গের সার্বভৌম সম্রাট মহা প্রতাপাণ্বিত মহারাজ শশাঙ্ককে থানেশ্বররাজ রাজ্যবর্ধনের পরমঅভিনন্দন। ভগবন তথাগত আপনার মঙ্গল করুন।

রাজ্যবর্ধনের এহেন সম্ভাষণে শশাঙ্ক যারপরনাই আপ্লুত হলেন। তিনিও যথোচিত সম্ভাষণে থানেশ্বররাজকে সম্মান প্রদর্শনকরলেন। এরপর পরস্পরের মধ্যে কুশল তথা উপহার বিনিময়ের পরে মহারাজ রাজ্যবর্ধন সম্রাট শশাঙ্ককে পানভোজনেআপ্যায়িত করার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন।কিছু সুস্বাদু খাদ্যসম্ভার পানীয়ের ব্যবস্থা তিনি আগেই করে রেখেছিলেন। কিন্তু শশাঙ্কেরইতস্তত: মনোভাব দেখে রাজ্যবর্ধন হেসে ফেললেন।

মহারাজ, বুঝতে পারছি আপনি আমাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছেন না। তাই এই খাদ্যদ্রব্য গ্রহণে আপনার অনীহা।  ঠিকআছে, প্রথমে আমিই না হয় এই খাদ্য এবং পানীয়ের আস্বাদ গ্রহণ করি। তারপর না হয় আপনি আহার করবেন। মহারাজ, আমাকে অবিশ্বাস করবেন না, আমি ভগবন তথাগতের সেবকএই বলে রাজ্যবর্ধন শশাঙ্কের নিষেধ না মেনে আহারে প্রবৃত্তহলেন। এরপর মহারাজ শশাঙ্কের আর কিই বা করার থাকতে পারে। অতএব তিনিও আহারে প্রবৃত্ত হলেন। মনে মনে শশাঙ্ক কিন্তুতাঁর আচরণে বেশ লজ্জিত বোধ করলেন এবং সেই কারণে মহারাজ রাজ্যবর্ধনের নিকট ক্ষমা প্রার্থনাও করলেন।

অবশেষে তাঁরা সন্ধিপ্রস্তাব নিয়ে আলোচনা শুরু করলেন। অনেকক্ষন দুজনের মধ্যে আলোচনার পরে মালব রাজ্য দেবগুপ্তেরউত্তরাধিকারীর হস্তেই সমর্পণ করতে হবে এই অঙ্গীকারে দুজনেই সহমতে এসে পৌঁছলেন। শশাঙ্ক রাজ্যবর্ধনকে কথা দিলেন যেতাঁর প্রথম কাজই হল ভগিনী রাজ্যশ্রীকে কারামুক্ত করা আর তারপর কনৌজের দায়িত্ব থানেশ্বরের হাতে অর্পণ করা, কারণআগেই বলেছি যে তিনি কোনমতেই কনৌজের অধিকার নিজের হাতে রাখতে ইচ্ছুক ছিলেন না। দুজনেরই হৃদয় যেন খুশীতেউচ্ছল।রাজ্যবর্ধন শশাঙ্কের কাছে তাঁর অন্তরের কৃতজ্ঞতা জানাতে দ্বিধা করলেন না।

অভিবাদন গ্রহণ করুন, মহারাজ শশাঙ্ক আমার সন্ধিপ্রস্তাবে সম্মত হবার জন্য আপনাকে আমার অসীম কৃতজ্ঞতা জানাইএবং সেইসাথে অনেক অনেক অভিনন্দন। আজ থেকে আমাদের মধ্যে শত্রুতার চির অবসান ঘটল। আমরা এখন পরস্পরেরমিত্র। ভগবন তথাগতের পরম আশীর্বাদে আপনার জীবন হোক আনন্দময়।

শশাঙ্কমহারাজ রাজ্যবর্ধন, এই রক্তক্ষয় আর আমাকে শান্তি দেয় না। তাই আমিও এর অবসান চাই আমার মিত্র দেবগুপ্তএবং আপনার ভগিনীপতি গ্রহবর্মার আত্মার প্রশান্তি কামনা করে আসুন এখন থেকে আমরা শান্তির বারি সিন্চন করি।

রাজ্যবর্ধন – “নি:সন্দেহে মহারাজ, আপনার উপর আমার সম্পূর্ণ আস্থা আছে

শশাংক – “মহারাজ রাজ্যবর্ধন, আপনি যা বলতে চাইছেন তা আমার বুঝতে অসুবিধা হয় নি কিন্তু মহারাজ, আপনাকে স্মরণকরিয়ে দেই যে আমি দেবাদিদেব মহাদেবের উপাসক। আমি কখনোই কোনরূপ হীন কার্যে লিপ্ত হইনি বা লিপ্ত হইনা।এমনকিআমার পরম মিত্র সদ্য প্রয়াত দেবগুপ্তের কোন দুষ্কর্মেই আমার কখনো সায় ছিল না, একথা আমি দেবাদিদেবের নামে শপথ নিয়েবলছি।

অবশেষে দুই নৃপতির সম্মতিতে সেই সন্ধি তথা মিত্রচুক্তি সম্পাদিত হল। দুই প্রতাপশালী নৃপতির অভিজ্ঞান মুদ্রা চুক্তির উপরঅঙ্কিত হল।

এইবার রাজ্যবর্ধন বললেন-“মহারাজ শশাঙ্ক, ভগবন তথাগতের আশীর্বাদে আজ এই শুভক্ষণে যখন আমরা পরস্পরের মিত্রহলাম, তখন এই পরম মুহূর্তকে স্মরণীয় করার উদ্দেশ্যে আমরা পরস্পরের আলিঙ্গনে আবদ্ধ হই।

শশাঙ্ক যেন আবারও একটু কুণ্ঠা বোধ করছিলেন। তবে রাজ্যবর্ধনের মিত্রতাসুলভ আচরণ, তাঁর সৌহার্দ্যপূর্ণ ব্যবহার এবংসর্বোপরি তাঁর কথায় কথায় ভগবান তথাগতের নামোচ্চারণ শশাঙ্কের মনের সমস্ত কালিমাকে এক নিমেষেই দূর করে দিল।

কিন্তু রাজ্যবর্ধন শশাঙ্কের মনের দোলাচল অবস্থাটি বুঝি অনুমান করতে পারলেন। তিনি শশাঙ্ককে বললেনভগবন তথাগতেরদীন সেবক হিসাবে আমি আপনাকে আবারও বলছি মহারাজ, আমার মনে কোন বদ অভিসন্ধি নেই। দয়া করে আপনি আমাকেভুল বুঝবেন না।

অতএব শশাঙ্ক অশঙ্ক হৃদয়ে মহারাজ রাজ্যবর্ধনের আলিঙ্গনের প্রস্তাবে সাড়া দিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত রাজ্যবর্ধনের উদ্দেশ্যএবার বোধ করি মহৎ ছিল না কিংবা হয়ত সেই মুহূর্তে রাজ্যবর্ধনের মনে কোনো বদ অভিসন্ধি স্থান করে নিয়েছিল। আরএখানেই আমাদের কাহিনীর নাটকীয় পট পরিবর্তনের শুরু।

Print Friendly, PDF & Email
Previous articleমহালয়ার অনন্য অনুভূতি
Next articleমিথিলা বিজয়।
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments