(১)

দিঘীটার নাম জলেশ্বরী। কোনকালে কে এটা খুঁড়েছে, তা নিয়ে  কোন নির্দিষ্ট ইতহাস পাওয়া যায়না। যদিও মুখে মুখে লোককথা চালু আছে অনেক। এলাকার বুড়োদের জিজ্ঞাসা করলে অন্তত তিন চার রকমের কাহিনী শোনা যায়। কেউ বলে প্রাচীন কোন বণিকের আদরের এক মেয়ে ছিল এই নামে। দুরারোগ্য অসুখে পড়লে তাকে বাঁচানোর জন্য স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে বানিয়েছিলেন এই মন্দির আর তৎসংলগ্ন দিঘী। আবার কেউ বলে জলেশ্বরী নামের কোন জাগ্রত দেবীর পীঠস্থান ছিলো এটা। তাকে নিয়েও ভয় জাগানিয়া বহু গল্প এ গ্রামের প্রত্যেক ঘরের বুড়ো বুড়ীদের মুখে মুখে শোনা যায়। প্রতিবছর নাকি পুকুরটা ভরা শ্রাবণে অন্তত একজন মানুষকে ডুবিয়ে মারে। কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যা তা অবশ্য যাচাই করার উপায় নেই। তবে পুকুর পাড়ের মাটিতে ইতস্তত ছড়ানো পুরোনো ভাঙ্গা ইট আর পূর্ব পাড়ে কালের ধাক্কা কাটিয়ে কোনমতে দাঁড়িয়ে থাকা টেরাকোটা ইটের একটা দেয়াল সাক্ষ্য দেয় পুকুরটা অনেক বেশি পুরাতন কালের। সম্ভবত গোপালপুর গ্রামের বাসিন্দাদের পূর্বপুরুষরা এই এলাকায় বসত স্থাপনেরও আগের নিদর্শন। এখন এই এলাকার অধিকাংশ মানুষই মুসলিম। যে দুই চার ঘর হিন্দু বাড়ী আছে তারাও এ নিয়ে বিশেষ কিছু জানেনা। মাঝেমধ্যে আচার অনুষ্ঠানে অবশ্য পুকুরটাতে তাদেরকে আসতে হয়! তবে এর বেশি কোন মাহাত্ম্য তাদের কাছে এর নেই।

পুকুরটার বাম পাড় ঘেঁষে তিন রুমের দেয়াল ঘেড়া সরকারী কোয়ার্টার। সম্ভবত প্রাণিসম্পদ গবেষণা জাতীয় কোন একটা সরকারী কাজের জন্য বানানো হয়েছিলো আশির দশকে। উপমহাদেশের চিরাচরিত সরকারী প্রথায় তা আর বাস্তবায়ন হয় নাই, কোন গবেষণা কাজের উদ্যোগও কারো নজরে পড়ে নাই! কোয়ার্টারটা এখনো নিঃসঙ্গ বৃদ্ধের মতো চলটা উঠা দেয়াল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে পুকুরটার পাশে। কখনো সখনো মনে হয় আনমনে বোধ হয় পুকুরের জলে তার জরার ছায়া দেখেছে। ভরা শ্রাবণে চাঁদের আলোয় যখন খুব রহস্যময় হয়ে যায় জায়গাটা, এলাকার মানুষের একা হাঁটতে গাঁ ছমছম করে।

(২)

পারতপক্ষে এদিকটায় আগে মানুষের আসা যাওয়া খুব বেশি ছিলোনা। হয়তো ভর দুপুরে মাঠের কাজে পরিশ্রান্ত হয়ে কিছু মানুষ এদিকটায় আসতো; আড্ডা জমাতো। সন্ধ্যা পার হলে এদিকে আসা যাওয়া একেবারেই হতোনা বলা চলে! তবে এখনকার কথা অবশ্যই আলাদা।

ছিয়াশির বড়বন্যা যমুনা পাড়ের বহু মানুষকে নিঃস্ব করে ছেড়েছিলো। ছয়মাস আগেও যাদের সব ছিলো, তারা হঠাত সব হারিয়ে খড়কুটোর মতো দেশের নানান প্রান্তে ভেসে গিয়েছিলো। সবচেয়ে দুর্ভাগা ছিল ভবানীমোহনের মতো মানুষ, যাদের মাথা গোঁজার শেষ ঠাই, বসত ভিটাও নদীর রাক্ষুসে গর্ভে হারিয়ে গিয়েছিলো চিরদিনের মতো।

জীবন নাকি বহতা নদীর মতো। তার বয়ে যাওয়া বন্ধ থাকে না কখনোই! ভবানীমোহন এর জীবনও থেমে থাকে নাই। স্ত্রী আর বিবাহিত তিন পুত্র ও তাদের পরিবার সহ বহু ঘুরে হাজির হয়েছিলো এই এলাকায়। একথা বলা যাবে না যে এলাকার মানুষ তাদের প্রথম দর্শনেই স্বাগত জানিয়েছিল! বরং তাদের এলাকা ছাড়া করার চেষ্টার কোন ত্রুটি হয় নাই প্রথম দিকে। ভবানীমোহনের জন্য একরকম সৌভাগ্যই বলতে হবে; জলেশ্বরীর এদিকটায় তখন অপরাধের মাত্রা ছাড়িয়েছিল। কয়েকদিনের মধ্যেই এক জোড়া খুন এলাকার মাতব্বরদের ঘুম হারাম করা অবস্থা! রাত জেগে পাহারার কথা ভাবছিলো কেউ কেউ।

এরইমধ্যে নাটকীয় ব্যাপারই বলতে হবে; এমাজ মাতব্বরকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল ভবানী। শেষ সন্ধ্যায় বাজার করে বাড়ি ফিরছিল এমাজ মাতব্বর। বলা নেই কওয়া নেই, জলেশ্বরীর পাশের মাঠ থেকে এক লোক বের হয়ে লাঠি নিয়ে তাড়া দিয়েছিলো তাকে। জলেশ্বরীর মাঠে তাবু টাঙ্গানো ভবানী দেখে ফেলেছিলো সব। চর ভাঙ্গনের মানুষ সে! লাঠীওয়ালা মানুষ দেখে ভয় পাবার লোক নয়! হাতের কাছে থাকা একটা শক্ত চেলা কাঠ নিয়ে ওদিকটায় রে রে বলে লাগিয়েছিল দৌড়। মাতব্বরকে আক্রমণকারীর কাছে সম্ভবত সম্পূর্ন অপ্রত্যাশিত ছিলো এই উল্টোদিক থেকে আসা প্রত্যাঘাত! হতভম্ভ হয়ে লাঠি ফেলে সন্ধ্যার আধো অন্ধকারে পালিয়েছিলো সে!

পরদিন সকালে সারা এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছিল ভবানীর বীরত্ব গাঁথা। এলাকার মাতব্বরদের এ বিষয়ে আর সন্দেহ ছিলো না যে, জলেশ্বরী আর গোপাল্পুর পাহাড়া দেয়ার একমাত্র যোগ্য মানুষ ভবানী। আরেকটা বিষয় হচ্ছে যে, অন্য কাউকে একাজে রাজী করানোও যাচ্ছিলোনা! আর ভবানীর সংসার বহরে আর যাই হোক লোকবলের অভাব ছিলোনা একদমই! ভবানী আর তার সন্তানরা পোড়ো কোয়ার্টারে আশ্রয় পেয়েছিল; তিন রুমের ভাঙ্গা বাড়ীটাতে আশ্রয় পেয়েছিলো প্রায় জনা পনের মানুষ! তখন থেকেই ভবানী জলেশ্বরীর পাহারাদার!

(৩)

ভবানীর বয়স পঞ্চাশের উপর; আসল বয়স অবশ্য সে নিজেও জানেনা! শুধু জানে মুক্তিরা যখন যুদ্ধ করছিল মিলিটারির সাথে তখন সে কিশোর কালে। তার তিন ছেলে- নীলমাধব, সুদীপ, প্রদীপ। তাঁরা সবাই বিবাহিত, সন্তানের জনক। এদের মধ্যে নীলমাধবেরই ছয় সন্তান!

ভবানীর পত্নী সুরবালা। বছর চল্লিশের বলিষ্ঠ চেহারার মহিলা। শক্ত হাতে সংসারের রশিটা এখনো ধরে রেখেছেন তিনিই। দুর্যোগের ডামাডোলের সময়টা পার করেও যে এতবড় পরিবারের বহরকে তিনি ধরে রেখেছেন একসাথে তা কিন্তু অবশ্যই কৃতিত্বের দাবী রাখে। যদিও একান্নবর্তী এ পরিবারে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ প্রাতাহিক রূটিনের মতো। অনেক সময় রাস্তা দিয়ে পার হওয়ার সময়ও পথচারীর কানে হাত দিয়ে রাখতে হয়, এমন অবস্থা! কেউ কেউ আবার মজা দ্যাখতে পুকুর পারে দাঁড়িয়ে থাকে! ভাইয়ে-ভাইয়ে, চাচা-ভাতিজায় হাতাহাতি হয় প্রায়ই! তবু দিনের শেষে কোনভাবে মিল হয়ে যায়। হয়তো তাদের আর কোথাও যাবার নেই এজন্য অথবা সুরবালার দূতিয়ালির জন্য! সুরবালা অবশ্য ঝগড়া বাজানো আর বন্ধ করা দুই কাজেই সিদ্ধহস্ত! ভবানি এসব ব্যাপারে মাথা ঘামায় না। দূরে পুকুরের পাড়ে কলা গাছের ছায়ায় বসে থাকে। এসবে তার অভ্যাস হয়ে গ্যাছে। সুরবালাকে দেখে তার অবশ্য মাঝে মাঝে সাপুড়িয়া দের কথা মনে হয়। কেমন কৌশলের সাথে ঝগড়া মারামারি সূচনা করে আবার শেষে তার লাগাম টানতে পারেন সুরবালা!

(৪)

সকাল থেকেই ভাদ্র মাসের চাপা গরম। এইসময় সবথেকে বড় সমস্যা হলো গাঁয়ের ঘাম শুকায় না। বেশিক্ষণ হাঁটতে গেলে খুব হাঁসফাঁস লাগে। কিন্তু এতে সুরবালার দমে যাওয়ার ফুসরত নেই। এই সময়েই বাদাম বিক্রি হয় সবচাইতে বেশি। গ্রামের বউ-ঝিরা আড্ডায় বসে আম জামের বাগানের ছায়ায়, ছেলে বুড়োরা ছায়াওয়ালা দালানের ছায়ায় বসে তাস পিটায়। ওদের মনোযোগ কাড়তে পারলে বেচাকেনা মন্দ হয়না; তাই গরমে সুরবালার বিশ্রামের সুযোগ তেমন মেলেনা কখনোই। দীর্ঘ শরীরের গড়ন, গাড় মিশমিশে কালো রঙ তার চামড়ার। অনেকটা পাথর কুঁদে বানানো মূর্তির মতো দেখাত তাকে। আশেপাশের লোকজন যে বাঁকা চোখে তাকায়না তা নয়। এদেশে সোজা দৃষ্টিতে মেয়েদের দিকে তাকানোর রেওয়াজটার খুব বেশি চল নাই, তারপরও কেঊ সামনাসামনি তাকে কিছু বলার সাহস করেনা। সম্ভবত সবাই তাকে ভয় পায়, তার পেশিবহুল হাত, আর সাধারণ পুরুষের সমান উচ্চতা অন্যদের চোখে ভয় জাগায়। সুরবালাও জীবনের অভিজ্ঞতায় পুরুষদের এই ভয়ের জায়গার খোঁজ জেনে গিয়েছে। তাই সে ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছে সাহসী। এখন সে একাই আশেপাশের দুই-দশ মাইলের সব গ্রামে বাদাম ফেড়ি করে বেড়ায়।

আজ বিকালে যখন বাসায় ফিরছিল হঠাত রাস্তায় তারা ছোটবোন ফুলবালার সাক্ষাৎ পেলো সে। ফুলবালা সুরবালার বাসার দিকেই যাচ্ছিল। অকস্মাৎ এই সাক্ষাৎএ সুরবালা আনন্দে বিহ্বল হয়ে জড়িয়ে ধরলো তার বোনকে! এরকম সময়ে আসলেই তার আসার কথা না। যমুনা পার হয়ে প্রায় মাইল বিশেক দূরে ফুলবালার বাড়ি; যেনতেন দূরত্ব নয়। তার উপর সে একা এসেছে। মেয়েদের চোখ সম্ভবত অস্বাভাবিক কিছু আগে ভাগেই টের পায়; বিশেষ করে সাংসারিক অসামঞ্জস্য তো অবশ্যই টের পায়। তাই সুরবালা প্রথমেই জানতে চাইলো- “হ্যাঁ রে তোর বর কই?”

-আছে বাড়ীতে।

-আসে নাই যে। সুস্থ আছে তো? কতোদিন দেখিনা নৃপেনকে!

ফুলবালা মুখ শক্ত করে বললো-

“ওরে আমিই আর দেখতে চাইনা। তোমার দেখে কাজ নাই। আর শোন! সরকারী বাসায় তো ভালোই আছ; আমারো থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। আমি একফাকে মাথা গুঁজতে পারলেই হলো। আর খরচ নিয়ে চিন্তা করোনা, আমারটা আমি যোগাড় করে নিবো।“

বোনকে দেখে সুরবালার মনে যে আমোদ এসেছিলো, তা রাস্তা ফুরানোর আগেই ফুরিয়ে গেলো। ওখানে মানুষ কেন, একটি পাখি থাকার জায়গাও আর অবশিষ্ট নেই; একথা বলতে গিয়েও নিজেকে থামালো সে কোনমতে। আপদকে পড়ে বুদ্ধি করে বিদায় করাই বুদ্ধিমানের কাজ মনে হলো তার। তাই আপাতত বেশি কথা না বলে দুজনেই জোর হাঁটা দিলো জলেশ্বরীর দিকে।

আসলে ফুলবালার এখানে আসার কারণটা ঠিক কাওকে বলার মতো নয়। কাউকেই বলা যাবেনা। তার স্বামী নৃপেণের সাথে বাজে রকম ঝামেলা বাঁধিয়ে ফেলেছে সে। নৃপেণের সাথে তার বয়সের পার্থক্য বছর বিশেক; নৃপেণের এখন পঞ্চাশ পার। গত অনেক বছর যাবত তাদের ভিতর কোন রকম শারীরিক সম্পর্ক ছিলোনা। বয়সের ভারে নানান অসুস্ততায় জর্জরিত নৃপেণ; এসব ভাববার মতো অবকাশ তার আর নাই। ফুলবালা চঞ্চলা মেয়ে। গল্প করতে ভালোবাসে; লোকে বলে বাচাল।  সম্পর্ক হয়েছিলো নৃপেণের এক দূর সম্পর্কের ভাইপোর সাথে। ফুলবালার ইচ্ছা ছিলোনা। কিন্তু কিভাবে যে কি হয়ে গেলো তা আর এখন মাথায় আসেনা তার। একদিন নৃপেণের চোখে ধরা পড়ে গেলো সে! না, নৃপেণ কোথাও অভিযোগ করে নাই, কোন শালিস বসায় নাই। কিন্তু কারণে অকারণে মাত্রা ছাড়া কান্নাকাটি শুরু করেছিলো। আর তাকে হাতজোড় করে অনুরোধ করতো। ফুলবালা এরপর আর কখনো এরকম করে নাই, কিন্তু নৃপেণের কান্না থামে নাই। সম্ভবত নিজের অক্ষমতা এখন তাকে লোকলজ্জার ভয়ে ভীত করে রাখে সবসময়! গ্রামে কানকথা বাতাসের মতো উড়ে। নৃপেণ না বললেও কানাঘুষা শুরূ হতে সময় লাগেনি তেমন। সবাই নৃপেণকে বলতো-“কিরে বুড়া বউ নাকি সামলাইতে পারোনা!”এসব আর সহ্য হচ্ছিলোনা ফুলবালার। নিজে বাঁচতে আর নৃপেণকে একেবারে রেহাই দিতে, সবাইকে না জানিয়ে একমাত্র   বড়বোনের বাসা জলেশ্বরীর দিকে তার আসা।

(৫)

ভবানীর বাড়ির এক অদ্ভুত রীতি হলো অতিথি আসলে ছেলে বুড়ো বাচ্চা কাচ্চা মিলে আনন্দে হাউমাউ করে চিৎকার করা। প্রথম প্রথম আশেপাশের মানুষ ভাবতো নিশ্চয়ই কোন অঘটন ঘটেছে; তবে এখন আর কেউ মাথা ঘামায়না তাদের এসব নিয়ে। আজো তাই হলো। প্রথমেই ফুলবালাকে দেখে নীলমাধবের বউ লতা রাণি একটা গগনবিদারী চিক্কুর দিলো, তার উপর ভবানীর বাড়ির সব বয়সী ছেলে মেয়ে ভেড়ার পালের মতো বের হয়ে এসে তাকে ঘিরে হইচই শুরু করে দিলো যথারীতি। প্রদীপের দুই ছেলে, যাদের বয়স গায়ে গায়ে লাগানো, তারা ফুলবালাকে না চিনলেও সেখানে এসে চেঁচামেচি জুড়ে দিলো। সুদীপের বউ দিপালী আরো এককদম বেশি অদ্ভুত মানুষ। আনন্দে কিংবা কষ্টে গান জুড়ে দেয়। অবশ্য সুখ আর দুঃখের গানের সুর আলাদা। একটু ভালো করে খেয়াল করলেই তা বোঝা যায় বেশ। আজ সে গাইলো- “আইলো কুটুম বসাও ঘরেতে, যতন করিয়া বসাও আসনে, আইলো কুটুম ফুলবালারে…”

এসব যখন চলছিলো, সুরবালা নিঃশব্দে জলেশ্বরীর পুকুরটার দিকে এগিয়ে গেলেন। ঝোপঝাড় আর কলাগাছের ভিড়ে জায়গাটাকে বন মনে হয়। সন্ধ্যারাতে একা আসলে গাঁ ছমছম করে। এখানেই ছিপ হাতে দিনের বেশিরভাগ সময় কাটায় ভবানী। মাছ ধরা নেশা? নাকি সংসার থেকে দূরে বসে থাকার ভান? তা  অবশ্য সুরবালা এখনো ঠাহর করতে পারেনা। লোকটা অদ্ভুত! ধীরপায়ে অইদিকেই এগিয়ে যায় সে। একটা ভাঙ্গা ইটের উপর বসে আছে ভবানীমোহন দাস। দূর থেকে দেখে তার বয়স বোঝা মুশকিল। শক্ত পেটা শরীরে তাকে পুকুর পাড়ে স্থির ভাস্কর্যের মতো লাগে অনেক সময়। এইসময়ে সুরবালাকে দেখে খানকিটা অবাকই হয় সে! সুরবালা সব কথা জানায় তাকে; ফুলবালার আসার কথা, আর না ফিরে যাবার ব্যাপার, এইসব! ভবানীর তেমন ভাবান্তর হয়না। শুধু পানির দিকে তাকিয়ে ছিপ নাড়াতে নাড়াতে বলে-“মেয়ে মানুষের মন! এক সপ্তাহ পর দেখবা একাই চলে গিয়েছে।“

সুরবালার কেন যেন তা বিশ্বাস করতে মন চায়না। তবু আর কথা বাড়ায় না সে। ফিরে যেতে যেতে বলে-“সবাই বলে পুকুর পাড়টা খারাপ! কোন না কোন দেবীর বিগ্রহ! এইখানে দিনরাত বসে থাকার মানে কি বাপু!”

আসলেই মানে বোঝা দায়। একেক জীবনের ভাষা একেক রকম। কেঊ কারো ভাষা কখনোই পুরো পড়তে পারেনা। যেমন এখন এখানে কেউ পড়তে পারেনা ফুলবালাকে! সুরবালা পারেনা পড়তে ভবানীর মনকে।

(৬)

এক সপ্তাহ, দুই সপ্তাহ করে বেশ কয়েক সপ্তাহ পার হয়ে যায়। ফুলবালা আর বাড়ী ফিরে যায়না। অবশ্য ইতোমধ্যে তার একপাল ভক্ত সমর্থক জুটে গিয়েছে; অধিকাংশই বাড়ির বাচ্চাকাচ্চা, অল্প বয়সী ছেলে মেয়েরা। একটানা গল্প বলতে পারে সে। নিজের বাড়ী থাকতে পাশের মজুমদার বাড়ি গিয়ে নিয়মিত সিনেমা দেখতো। সেসব কাহিনী সে যখন রঙ লাগিয়ে বলতো এদের তখন বাড়ির বউরা এমনকি সুরবালাও কান খাড়া করে শুনতো। সিনেমার গানগুলোও তার বেশ মুখস্থ ছিলো। গল্পের মধ্যে মধ্যে সুর করে সেসব গাইতো। তার কাছে শুনে জলেশ্বরী পাড়ের আধাফোটা বোলওয়ালা বাচ্চারাও গাইতে শিখেছ-“আদ পাশা খেব্বো লে সাম!” যখন ভর পূর্ণিমায় চাঁদ উঠে আকাশ আলো করে, ফুলবালা  তার পঙ্গপাল নিয়ে বসে ঘাসের উপর। শুরু হয় তার গল্প; সিনেমা দিয়ে শুরু করে ভূত-প্রেত দিয়ে শেষ করে সে।

তার মানে এই নয় যে সে খুব ভালো আছে। প্রায়ই কোন না কোন বউ এর সাথে তার ঝগড়া বাজে। মজার বিষয় হচ্ছে তখন অন্য আরেক বউ এসে ফুলবালাকে জোর করে তার ঘরে নিয়ে রাখে। আবার সেখানেও কয়েকদিন পর ঝামেলা হয় তখন আরেক জন। এভাবেই পার হয় ফুলবালার জীবন। ঝামেলার মূল বিষয়টা বৈষয়িক। এদের নিজেদেরই খাবার জোটেনা ভালো মতো। সেখানে আরেকটা মুখকে টানা খাওয়ানো সুরবালার কোন ছেলের পক্ষেই সম্ভব না। তবুও তারা চেষ্টা করে। ফুলবালার কিছু একটা দরকার। কিন্তু এই আকালের দেশে যেখানে জোয়ান ছেলেরাই কাজ পাচ্ছেনা, তাকে কে দেবে কাজ! তারপরও সে ভর সকালে বের হয় কাজের খোঁজে। মাঝে মাঝে ক্ষেত খামারে কাজ জোটে, মাঝে মাঝে জোটেনা। তারপরও সে এখানেই পড়ে থাকে।

পাল পাড়ার সুশীল পাল আজ এসেছে ভবানীর বাড়ীতে। এই এলাকায় যে কয়েক ঘর পাল এখনো আছে সে তাদের একজন। বছর পয়ত্রিশের লোকাটার মাথা ভর্তি ঝাঁকড়া বাবড়ি চুল। স্ত্রী তার মারা গেছে বছর খানেক আগে। বাসায় শুধু দুই ছেলে মেয়ে আর মা। স্ত্রী মারা যাওয়ার পর জ্ঞাতিগোষ্ঠী জোরাজুরি করেছিলো খুব আবার বিয়ের জন্য। কিন্তু সুশীল রাজী হয় নাই। তার মতে বুদ্ধিমান পুরুষ জীবনে একবারের বেশি এরকম ঝামেলা ঘাড়ে তোলেনা! এখন সে ইচ্ছামতো ঘোরে আর ব্যবসা করে; ব্যবসার ঠিক নাই, যখন যেটা সুবিধা। এইতো গত বছর বাঁশের ঝুড়ি বানানোর ব্যবসা করেছিলো সে। খুব বেশি লাভ হয় নাই যদিও। কিন্তু এবার গঞ্জের বাতাসে সে আন্দাজ করে নিয়েছে মাছের ব্যবসাটাই জমবে। তাই আজ ভবানীর কাছে আসা। নদী পাড়ের জাত জেলেদের বংশধর ভবানী। তাকে সাথে নিয়ে ব্যবসা করলে লাভটা বেশি হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। যদিও সন্ধ্যার পর কেঊ জলেশ্বরীর পথে আসেনা, তবুও সে এসেছে। তার আবার ভয় ডর কম।

পুকুরের একধারে আলোচনায় বসেছে সুশীল আর ভবানী। খানিক দূরে বসেছে ফুলবালার গল্পের আসর। কিন্তু আজ তার বেশি ভালো লাগছে না গল্প বলতে! সব মনোযোগ পুকুর পাড়ের দুজন মানুষের দিকে। একটুপর গল্পের আসর অসমাপ্ত রেখেই সেদিকে রওনা হয় সে।

(৭)

অনাকাঙ্ক্ষিত আগন্তুকের আগমনে দুজনেই খানিকটা অপ্রস্তুত হয়। ভবানী বলে-“কিরে ফুলো! কিছু বলবি?”

-“না গো। তোমাদের গল্প শুনতে আসলাম। গল্প শুনাইতে শুনাইতে বিরক্ত হয়ে আছি। এখন একটু কারো গল্প শুনতে মন চায়।“

-“আমরা তো ব্যবসার আলাপ করছি। তুই কি আর বুঝবি!”

ফুলবালা সামান্য হেসে সুশীলের দিকে তাকিয়ে বলে-

-“অনেক সময় গল্প করা মানুষের দিকে তাকায় থাকতেও ভালো লাগে যে। আচ্ছা সুশীলদা! আপনার চুল গুলো কোন নায়কের মতোন সাইজ করছেন?”

বলে কোন উত্তরের অপেক্ষা না করেই বাসার ভিতরে চলে যায় ফুলবালা। তাদের ব্যবসার আলাপের তাল সেদিনের মতো কেটে যায়। নায়ক! নায়ক! এই কথাটা কেন বলল ফুলবালা? প্রশ্নটা অসুস্থ চিন্তার মতো সারাক্ষণ মাথায় আসতে থাকে সুশীলের। আচ্ছা বলতেই পারে! কতো মানুষই তো মজা করে কতো কথা বলে! কিন্তু তার এরকম লাগছে কেন আজ? তবে কি বহুদিনের নারী সঙ্গের অনভ্যস্ততা তাকে দুর্বল করে ফেলেছে! মনের এ কি আজব খেলা! এমনতো নয় ফুলবালা আহামরি সুন্দরি কেউ! তারপরও কেন এরকম হচ্ছে!

আসলেই মনের জাল বোঝা মুশকিল। কোথায় পাতা থাকে আর কখন আটকে যায়, কেউ আগে থেকে বলতে পারেনা। গভীর রাত পর্যন্ত ভাবনার সাথে যুদ্ধ করে শেষে হার মানে সুশীল। ভাবে, আচ্ছা বেশ! সেও একা, আমিও একা, কাছাকাছি যেতে পারলে দুজনেরই খানিকটা উপকার হয়! তাতে দোষের কিছু নাই। সারাজীবন এরকম বিসর্জন কার ভালো লাগে!আর এভাবে নিজেকে বঞ্চিত করেই বা কি লাভ! সুশীলের পুরুষালি মন তার সাথে ঘোর তর্ক জুড়ে দেয়। পৃথিবীর অধিকাংশ পুরুষের মতো সেও এই তর্কযুদ্ধে নিদারুণ ভাবে হার স্বীকার করে নিতে বাধ্য হয়। আসলে মনের আদিম প্রবৃত্তির সাথে জেতা এক দুরূহতম কাজ!

পরেরদিন দুপুরে যখন ভবানীর বাড়ির অধিকাংশ পুরুষ লোক বাইরে যাবে তখন ফুলবালার খোঁজে যাওয়ার পরিকল্পনা করে ঘুমানোর চেষ্টা করে সে। কিন্তু আজ কিছুতেই তার ঘুম আসেনা! বাইরে বলা নেই, কওয়া নেই শুরু হয়েছে ঝুম বৃষ্টি আর তার ঘরের টিনের বেড়ার ফাঁক দিয়ে ভেসে আসছে উত্তরের বাতাস। ঘুমানোর উত্তম পরিবেশ থাকা সত্ত্বেও অনেক রাত পর্যন্ত জেগে ভোরে ঘুম আসে তার!

(৮)

“ফুটিছে কদম ফুল রাত্রি দুপুর”

“সখী তোর লাগি বাজাই বাঁশির সুর”

“কদম্ব তলে…”

সকাল হতেই ঘন কালো মেঘ কাটছে না। কালো পর্দার মতো মেঘের ছায়ায় ঢেকে আছে ধান ক্ষেত, মাঠের বটগাছ, জলেশ্বরীর ঝোপঝাড়। মাঝেমাঝেই দমকে দমকে বৃষ্টি হচ্ছে। সুশীলের উঠতে উঠতে নয়টা বেজেছে; এতো দেরী তার সাধারণত হয়না। কাল রাতের চিন্তার রেশ এখনো কাটছে না তার। বিছানায় কিছুক্ষণ ঝিম মেরে বসে থাকলো সে। অনেক ভাবনা আসছে তার মনে অচিন মেঘেদের মতো; যাদের সে কখনো ভাবে নাই। মেঘ দেখে তার মনে হলো, অন্তরীক্ষের দেবতারা বোধ হয় চাচ্ছেন না যে সে ফুলবালার খোঁজে যাক! তাই সকাল থেকে আকাশের এই বৈরী দশা। কিন্তু খানিক ক্ষণের মধ্যেই দেবতাদের প্রতি তার অপরিসীম ক্ষোভ চলে আসলো। তারা যে এই অল্প বয়সে তাকে বিপত্নীক বানিয়ে রসিকতা করছেন, এটা ভাবতেই রাগে মাথা গুলিয়ে গেলো তার! রাগে, ক্ষোভে খানিকটা অপ্রকৃতস্থের মতো রওনা হলো জলেশ্বরীর দিকটায়। রাস্তার মাঝে আসা উড়াল বৃষ্টি তাকে বিচলিত করতে পারলোনা। গামছা দিয়ে মাথা ঢেকে ধানের জমির আল দিয়ে আগালো সে। কাঁদায় পা মাখামাখি হয়ে গেলো। জলেশ্বরীর পুকুরটা পানিতে ভরে ঊঠেছে। কালো পানি দেখেই বোঝা যায় সেটা ভালোই গভীর। পাশেই একটা কদমগাছ ঝাঁকরা চুলের মতো এক মাথা ফুল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পুরানো মন্দিরের দেয়ালের পাশে। ছেলে ছোকরারা মন্দিরের ভয়ে এদিকটায় আসেনা, তাই টিকে আছে কদমগুলো। সুশীল সেই গাছের ডাল থেকে কয়েকটা কদম টেনে ছিঁড়ে নিলো তার হাতে। জলেশ্বরীর পাড়ে এসে কলা গাছের ঝোপের আড়ালে দাড়ালো সে। অপেক্ষায় থাকলো ফুলবালা কখন বের হয়!

বৃষ্টির জন্যই হোক আর যে কারণেই হোক, ফুলবালার দেখা পাওয়া যাচ্ছিলো না। ঘন্টা খানিক অপেক্ষার পর অধৈর্য্য হয়ে সে কোয়ার্টার দিকে আগালো। দরজায় গিয়ে জোরে ভবানীকে ডাকলো। সে জানতো ভবানী নেই তারপরও ডাকল! সম্ভবত যে কারোরই আসার সম্ভাবনা ছিল অন্দর থেকে। কিন্তু এইবার দেবতারা সুশীলের সহায় ছিলেন। ফুলবালা বের হয়ে আসলো তার স্বভাবী ভঙ্গিতে। সুশীল খানিকটা অবাক হয়েই তাকালো। গতকাল অন্ধকারে তার চেহারা ভালো করে ঠাহর করতে পারে নাই। আজ দেখে কিছুক্ষণ চুপ করে লক্ষ্য করলো, মুখে বসন্তের দাগ বড় বেশি বেমানান! চুল গুলো একটু বেশী পাতলা, আর হাঁটার একটা অদ্ভুত হাস্যকর ভঙ্গী আছে ফুলবালার! তবে দেহের গড়নে একটা আকর্ষণ আছে! সুশীল খুব বেশি সন্তুষ্ট হতে পারলো না, আবার এখুনি চলে যাওয়ার চিন্তাও করতে পারলোনা। ফুলবালা তাকে দেখে একগাল হেসে বলল-

“জামাই বাবু তো বাড়ী নাই গো।”

“ওহ! আমিতো একটা জরুরি হিসাব করতে এসেছিলাম। এখন তাহলে আর কি করার।“

লোকে বলে মেয়েদের দুই চোখের বাইরেও একটা অদৃশ্য চোখ থাকে। বুদ্ধিমান লোকেরা বলে নারীকূল নাকি ত্রিনয়না! তারা পুরুষের চোখের কথা, দেহ ভঙ্গীতে লুকানো কথা প্রকাশের আগেই জেনে যায় মাঝে মাঝেই। ফুলবালা বলে-

“ কেন দাদা, খালি কাজের কথাই থাকে আপনার কাছে! আমার জন্য একটু গল্প জমায় আনলেও তো পারেন! কতোদিন গল্প করিনা কারো সাথে।“

সুশীল হেসে তার হাতের কদম ফুল ফুলবালার দিকে বাড়িয়ে বলে-

“ফুল গুলো জলেশ্বরীর ফুলেশ্বরীর জন্য এনেছি। নাও। আর এভাবে এতো পঙ্গপালের মধ্যে কি সব গল্প করা যায়? সময় থাকলে মন্দিরের দেয়ালের পাশের জায়গাটায় আসো। ওখানে কেউ যায়না। মন খুলে গল্প করবো দুজন।“

বহুদিন পর ফুলবালার মুখ রক্তিম লাল হয়। এমন করে কোন পুরুষ মানুষ তাকে আগে কখনো ডাকে নাই, ফুল দেয় নাই। এ এক অন্যরকম শিহরণ! শান্ত বালিকার মতো রাজি হয়ে, আশেপাশে চোখ বুলিয়ে সুশীলের পিছু নেয় সে। তারা অনেক গল্প করে। ফুলবালা তার জানা সব গল্প শুনিয়ে দেয়, সুশীল কখনো জানা গল্প বলে, কখনো বানিয়ে। সুশীল বলে-“ফুলবালা সাঁতার জানো?”

ফুলবালা মাথা নাড়ে। জানোনা? তাহলে ভুলেও এই পুকুরে নামবেনা! জলেশ্বরী দেবীর এই পুকুর। প্রতি বছর কেউ না কেউ ডুবে মরে, বলা ভালো দেবী টেনে নেয়! কখনো নামবে না। ফুলবালা ভয় পায়। কিন্তু মুখে হেসে বলে তাহলে তোমার কাছে থেকে শিখে নিব না হয়! সকাল পার হয়, বিকাল পার হয়! দিনের পর দিন পার হয়! তাদের সাক্ষাৎ ধীরে ধীরে গল্প করা থেকে  আরো গাঢ়তর হয়। এখন সময়ে অসময়ে তারা এদিকটায় আসে, মনের বিনিমিয় শরীরের সম্পর্কে পৌঁছায়। অপরিণামদর্শী কিশোর কিশোরী যুগলের মতোই তারা হাওয়ায় ভাসে।

আশেপাশের মানুষের মনে সন্দেহের ডানা উঁকি দেয়। ভবানী বুঝতে পারে সুশীলের আসার কারণ শুধু ব্যবসার কাজ নয়, অন্য কিছু! সে একদিন তাকে সাফসাফ জানিয়ে দেয়, এ ব্যবসায় সে থাকবেনা! কিন্তু হাতে নাতে প্রমাণ কেউ পায় না। এখন প্রতি সকালে ফুলবালা গঞ্জের রাস্তায় হাঁটা দেয়, কোথায় নাকি কাজ পেয়েছে! কেউ তাদের ধরতে পারেনা। শুধু আকাশে বাতাসে চাপা একটা অস্বস্তি কাজ করে তাদের দুজন কে একসাথে কোথাও দাঁড়িয়ে গল্প করতে দেখলে।  দিন পার হয়ে যায়। এবার বৃষ্টি খুব ভারী ছিল, বেড়ে যায় জলেশ্বরীর গভীরতা। মনে হয় কোন কালো দানবের চোখ মানুষকে গিলে খাওয়ার পাঁয়তারা করছে।

(৯)

সুরবালা ভয়ানক রেগে আছে। এমন রাগ তাকে কেউ কখনো করতে দেখে নাই! বড় ছেলে নীলমাধবের বউ যে কিনা একমাত্র শাশুড়ির সাথে মুখে টক্কর দিয়ে ঝগড়া করতে পারে, তাকেও গতকাল পিঠে কিল বসিয়ে দিয়ে এসেছেন। তার ভালো লাগছে না। তিনি কিছু দেখেন নাই, কানাকানি শুনেছেন, প্রমাণ পান নাই কোন। কিন্তু কদাচিৎ সুশীল আর ফুলবালাকে দেখলে কেন যেন তার মনে হয় এরা নিশ্চয় কিছু করছে। শেষকালে এদের বদনামের চোটে তার বাসাটা হাতছাড়া না হয়। সরকারের জায়গা আজ আছে কাল নেই। তাহলে এতোগুলো মানুষ কোথায় যাবে? এসব নিয়ে সকালে ফুলবালাকে একটু উপদেশ দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন আর কি। তাতে ফুলবালা ঝগড়া করে বাসা মাথায় তুলেছে। সুরবালার কতো বড় সাহস প্রমাণ ছাড়া বোনের চরিত্রে কালি লাগাতে চায়! এমন বোন যেন ইগজগতে কারো না থাকে। সুরবালা এতো বড় আস্পর্দ্ধা মানতেই পারছেন না। তাদের ঝগড়ার মাঝে মধ্যস্থতা করতে এসেছিলো তার স্বামী ভবানী। অলক্ষ্মী মেয়েটা তার বোন-জামাইকেও ধাক্কা মেরে দিলো!

আসলে ভবানী বিরক্ত হয়ে ফুলবালাকে বাড়ি ছাড়তে বলেছিল। তাতেই সে ভবানীকে সোজা জানিয়ে দিয়েছে বাড়ি ছাড়বে না! কারণ এটা সরকারী কোয়ার্টার। সরকারের জায়গা, ভবানীর না! তারা যে অধিকারে দখল দিয়ে আছে, সেও সেই অধিকারেই থাকবে। ভবানী সত্যিই খুব অবাক হয়েছিলো। কে শেখালো ফুলবালাকে এসব জটিল কথা! নিশ্চয়ই সুশীল! তাহলে ব্যাপারটা সত্যি? তার মাথা কাজ করছিলো না। রাগের মাথায় তাকে ধাক্কা দিয়ে বাসা থেকে বের করতে গিয়ে কাঁদায় পিছলা খেয়ে নিজেই পড়ে গিয়েছিলো ভবানী। এখানে কারোই কোন দোষ ছিলোনা। কিন্তু এত গুলো নাতি নাতিন, ছেলে-বউদের সামনে এমন বেইজ্জতি তার আগে কখনো হয়নি! এখনতো বাজারে গেলেও মানুষ বলবে সে শালীর হাতে মার খেয়েছে! পুকুর পাড়ে সারাদিন বসে এসবই ভাবছে ভবানী। সুরবালাও ঘটনার আকস্মিকতায় বাক্রুদ্ধ। অন্যকেউ হলে আগে পিঠে বসিয়ে দিতো কয়েকটা, কিন্তু এতো তাদের থাকার অধিকার নিয়ে টানাটানি করছে। এর সাথে ঝামেলা করলে যদি পানি আরো ঘোলা হয়, বাসাটা হাতছাড়া হয়! এতো কিছু ভেবে চুপ করে দাঁতে দাঁত চেপে আপাতত বসে আছেন তিনি।

ভবানীমোহন একা একা পুকুর পাড়ে বসে আছে। আজ ছিপে মাছ উঠছে না একটাও। এটাই মানুষের কপাল, যখন খারাপ হয়তো খারাপ হতেই থাকে! জলেশ্বরীর পানি পাড় পর্যন্ত উঠে এসেছে ঘন কালো পানি, আয়নার মতো! দূরে ভাঙ্গা মন্দিরটার দেয়ালের প্রতিচ্ছায়া ভাসছে পানিতে। আকাশের নীচে মন্দিরটা তার মনে তেমন ভয় ধরায় না। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে দেয়ালটা পানির গভীর থেকে উঠে এসেছে। কতো গভীর কেউ জানেনা! ভবানীর ভয় হয়, ভাবে উঠে পড়বে এখুনি। অইদিকে ছোট ছেলে প্রদীপের দুই ল্যাদা বাচ্চা গুটি গুটি পায়ে ভরদুপুরে মন্দিরের দিকে আগাচ্ছে। সম্ভবত কদম ফুলের লোভে। দেয়াল আর পুকুরের মাঝে সামান্য একচিলতে জায়গায় বিপদজনক ভাবে বেড়ে উঠেছে গাছটা। জলেশ্বরীর পাড়ের সবথেকে খারাপ জায়গা ওইটা। এইতো গত বছর একজন ওখান থেকেই ডুবে মরেছিলো! চিৎকার করে তাদের থামাতে গেলো ভবানী! কিন্তু বাচ্চা দুটো সেদিকে ভোঁ দৌড় শুরু করেছে! আচ্ছা মানুষের বাচ্চার বুদ্ধি শুদ্ধি এতো কম থাকে কেন! ওদেরকে থামাতে সেদিকেই দৌড় লাগালো ভবানীমোহন।

(১১)

“পানা ফুলে দুনিয়া হইয়াছে কানা”

“জলের আড়ালে সাপ তোলে নীল ফণা”

প্রদীপের দুই ছেলে হারূ আর গোপাল পিঠাপিঠি। একজনের পাঁচ বছর আরেকজনের সাড়ে তিন। তারা কয়েকদিন ধরেই বুদ্ধি আঁটছিল কদম আনতে যাবে। আর ওদিকটায় কচুরীপানার নীল সাদা ফুল ও আছে বেশ কিছু। কদমের গাছের তলায় যেতে পারলে কলমির ডাল দিয়ে টেনে কিছু কচুরীপানার ফুল ও জোগাড় হয়ে যাবে; একের ভিতরে দুই পাওয়ায় মতো ব্যাপার। জলেশ্বরী দেবী আর তার কীর্তি কলাপের জনশ্রুতি তাদেরও শোনা ছিলো। বোঝার মতো বুদ্ধি ছিলোনা যে তাও নয়। তাদের খেলার সামগ্রীর দরকার। খেলনা কিনে দেওয়া তাদের বাবা মার পক্ষে যে অসাধ্য তা তারা এতোদিনে বুঝে গিয়েছে। তা বলে তো আর খেলা বসে থাকতে পারেনা। তাই তারা প্রকৃতির কাছে থেকেই সব জোগাড় করে। কদমের ফুল দিয়ে যে টেনিস বলের কাজ চালানো যায়, তা এই বাচ্চারা বহু ছোটকালেই শিখেছে। আজ ভবানী দাদুকে দেখে কিছুটা সাহস নিয়ে তারা আগাচ্ছিলো পুকুরের পাড়ের মন্দিরের দিকে। কিন্তু ভবানী যে এমন তেড়ে আসবে তা ভাবে নাই, আসলে ভবানী এদের এড়িয়ে চলে যথাসম্ভব। তারা ভবানীকে আসতে দেখে এক দৌড়ে গিয়ে উঠলো মন্দিরের ভাংগা দরোজার মতো জায়গাটায়।

সুশীল বেশ কিছুদিন পর তাদের অভিসারের জায়গায় এসেছে আজ। মাঝে কয়েকদিন সে বাইরে ছিলো ব্যবসাটা গোছানোর কাজে। ভবানী সাহায্য না করলে নাই। সে নতুন লোক পেয়ে গিয়েছে। ব্যাবসাটা জমলে মাছের দোকানে কোন একটা কাজ দিয়ে দিবে ফুলবালাকে। যাকে সে এখন আদর করে ডাকে ফুলেশ্বরী। নাহ, এখন যে সে তাকে খুব পছন্দ করে তেমন নয়, কিন্তু চাহিদাটা মেটে। আসলে এমন বন্ধনহীন সম্পর্কের খোজই তার মন করতো এতোদিন। সামাজিক দায়িত্ব নেই, সারাদিন প্যানপ্যানানি শোনার জ্বালা নেই। শুধু আনন্দ আছে এখানে। সুশীল পরিণতি নিয়ে চিন্তিত নয়; ফুলবালাকে ভালোবাসে কিনা নিশ্চিত নয়; তবে তার অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। পুরুষের শরীরের অভ্যাস ভয়াবহ, তা কাটানোর চেষ্টা করেও সবসময় পারে না সে। বহুদিন অভিসার শেষে রাতে বাসায় ফিরে মনে হয়, আর নয়! এসব ঝামেলায় জড়াবে না; কিন্তু দুই চারদিন পর আবার জড়িয়ে যায়। তাদের অভিসারের জায়গাটাও আসলে সুশীলের আবিষ্কার। এই পোড়ো মন্দিরের দেয়ালের আড়ালে কলমি ফুল আর বন কচুর বিশাল ঝাড়। বলা চলে দুর্ভেদ্য দুর্গ, সেখানে ঝোপ পরিষ্কার করে সে কিছুটা বাঁধানো জায়গা আবিষ্কার করেছিলো। ফুলবালা রাজী হয়নি প্রথমে। নারীমনের আজন্ম সংস্কার আর ভয় তাকে রাজী হতে দেয় নাই শুরূর দিকে। তাছাড়া জায়গাটা নিয়েও তার মধ্যে   ভয় ছিলো; সেটাই স্বাভাবিক। কোন না কোন দেবীর মন্দির, সেখানে এসব অপবিত্র কাজ! শাপ দিবে, দেবী ভয়ংকর অভিশাপ দিবে। সুশীল মাধ্যমিক স্কুলে কয়েক ক্লাস পর্যন্ত পড়াশুনা করেছিলো, তার ইংরাজী অক্ষরগুলি চেনা ছিলো। একদিন দুপুরে সে হেসে ফুলবালাকে মন্দিরের কোণের একটা জায়গা দেখিয়ে বললো-“ফুলেশ্বরী দেখেছো কি লিখা? এখানে লিখা R O B E R T! মানে রবার্ট সাহেবের বানানো বাড়ি! ইটা মন্দির নয়রে পাগলী!”

-তবে সবাই যে বলে?

-তাতো মানুষ না জানলে কতো কিছুই বানায় বলে!

সুশীলের কথা কেন যেন অবিশ্বাস করতে পারেনা ফুলবালা। সম্ভবত তাজা মিথ্যা কথা বললেও সে অবিশ্বাস করতে পারবেনা। বাবড়ি চুলের এই লোকটাকে সে অবিশ্বাস করতে পারেনা। তাকে সে খুব বেশি ভালোবেসে ফেলেছে। সুশীলের কথায় একসময় সে হেলে পড়ে শারীরিক ভালোবাসায়। বর্ষার সময়, কাঠফাটা রোদের আড়ালে, ভরা পূর্ণিমায় তারা মিলিত হয় এখানেই। সবসময় ফুলবালার এসব ভালো লাগেনা; তাও সে আসে! সে কোন ভাবেই সুশীলকে হারাতে চায়না! সুশীল শহর থেকে আজ ফুলবালার জন্য একটা লাল ফুলের ছোপ দেয়া শাড়ি নিয়ে এসেছে। ফুলবালার প্রতি তার কিছুটা মায়া জন্মেছে। এটা প্রাকৃতিক নিয়মে; তবে তাকে কোনমতেই ভালোবাসা বলা যাবেনা। বড়জোর কৃতজ্ঞতা বলা যেতে পারে। ফুলবালা আজো গঞ্জে যাবার নাম করে মাঠের আড়াল দিয়ে ঢুকে পড়লো মন্দিরের ভিতর। ওই তো এসেছে তার বাবড়ি চুলের মনের মানুষ! কতোদিন পর! তৃষ্ণাটা বেড়ে গিয়েছে আজ তারো।

সুশীলের হাত থেকে শাড়িটা পেয়ে জীবনে প্রথম তার সংসার করার ইচ্ছা জাগলো আবার। এমন করে কেউতো তাকে ভালোবাসে নাই কখনো! তার খুব কান্না পেলো। কচুরীপানার ফুল গুলো ভাসছে জলেশ্বরীর জলে আর ফুলবালার চোখে একজীবনের সবটুকু জল নেমে আসতে চাইলো। সুশীল আবদার করলো এখানেই শাড়িটা পড়ে তাকে দেখাতে। ফুলবালা স্থান সময়ের হিসাব যেন ভুলে গিয়েছে! পরনের শাড়ি খুলে লাল শাড়িটা পড়তে লাগলো। কিন্তু সুশীলের কাছে শাড়ি অপেক্ষা শরীর বেশী আকাঙ্খিত এই মুহুর্তে! সে তীব্র আলিঙ্গনে ফুলবালাকে কাছে টেনে নিলো; লাল শাড়ি পড়া হলোনা!

আকাশে তখন সুর্য্য মেঘের সাথে খেলা করছে, জলেশ্বরীর পুকুরে দেবীর অর্ঘ্যের মতো ভাসছে কচুরী পানা, দুই একটা ঝরে পড়া কদম, ভিতরে তন্ময় সুশীল-ফুলবালা! এমন নাটকীয় মুহূর্তেই সেখানে মন্দিরের দরোজায় দৌড়ে হাজির হলো হারূ আর গোপাল! ভিতরে চাপা অন্ধকারে সবকিছু কেমন অস্পষ্ট ছায়ার মতো ভৌতিক। তার এক কোণায় মানুষের মতো দুইটা কালো ছায়া দেখে তাদের পরাণ উড়ে গেলো ভয়ে। জন্ম থেকে আজ পর্যন্ত যত শক্তি তাদের ছিলো তাই নিয়ে চিৎকার দিলো তারা। সারা গ্রাম জাগানো চিৎকার দিয়ে দিক বিদিক ভুলে ভবানীর দিকে দৌড়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরলো বাচ্চা দুটো। ভিতরে আড়ষ্ট হয়ে পাথর হয়ে গেলো ফুলবালা; সুশীল উঠার চেষ্টা করলো, কিন্তু পারলো না। পাথরের মতো আঁকড়ে ধরে আছে ফুলবালা।

ভবানীও ভয় পেয়ে গিয়েছে। কিন্ত নদী ভাঙ্গনের দেশের মানুষ, সাহস তার কম নাই। মন্দিরটা দেখে গাঁ ছমছম করে বটে, তাই বলে দিনে দুপুরে ভূত। এই ভরদুপুরে ভুত তো ভবানীর পরদাদার আমলেও বের হতোনা! শুকনো বাঁশের একটা টুকরো হাতে নিয়ে সেইদিকে আগালো সে। বাচ্চাদের চিৎকারে বাসা থেকে বের হয়েছে নীলমাধব আর তার বউ, সুরবালাও। ভুত আর যাই হোক এতো গুলো মানুষের মধ্যে তার ঘাড় মটকাতে আসবেনা। এক দৌড়ে মন্দিরের দরোজায় পৌছালো ভবানী! চোখ হা হয়ে গেলো তার দুজনকে দেখে। সুশীলের তীব্র খিপ্রতার সাথে ধাক্কা দিয়ে দেয়ালে ফেলে দিলো ফুলবালাকে। তারপর পিছনের ভাঙ্গা দেয়ালে দিলো লাফ! ভবানীও বর্শার মতো ছুড়ে দিলো বাঁশের টুকরাটা। সুশীলের পায়ে লাগল ঠাস করে। ব্যাথায় কাকিয়ে উঠে সামান্য কয়েক সেকেন্ডের জন্য দাঁড়ালো সে! তারপর দেয়ালের পিছনের ঝোপে লাফ দিয়ে হারিয়ে গেলো।

মেঝেতে আলুথালু হয়ে বসে আছে ফুলবালা। শাড়িটা কোনমতে ঠিক করছে। কিছুক্ষণ দুইজন দুই জনের দিকে তাকালো। ফুলবালার চোখে অসহায় মিনতি আর ভবানীর চোখে রাগ নাকি হিংসা বোঝা গেলোনা! হাতজোড় করে মাফ চাইলো ফুলবালা। মুখে আঙ্গুল দেখিয়ে অন্যদের না জানাতে মিনতি করলো সে। এরকম ভয়াবহ অপদস্থ হতে সে চায়না! তার দুই চোখে জল। দেবতারা ফুলবালার কান্না সহ্য করতে পারলেন না। তারা তাকে রক্ষা করতে চাইলেন। তাদের কেউ কেউ ভবানীর মনের গভীরে ঢুকে তার মতিগতি পালটিয়ে দিলেন। ভবানী চিৎকার করে সুরবালাকে জানান দিল-

“আরে দুইটা কুকুর ঢুকে ছিলো! তাই দেখে ছাওয়ালরা ভয় পেয়েছে! সকলকে বলো নিজের বাচ্চা গুলো দেখে রাখুক অন্তত! সব গুলো আকাইম্মা বউ।“

-“তুমি চলে আসো। অইখানে সাপ খোপ আছে!”

-“তোমরা যাও। আমি ঝোপঝাড় গুলো কেটে আসি। নাহলে অন্যরা ভয় পাবে আবার।“

সুরবালার কাছে যুক্তিটা গ্রহণযোগ্য মনে হলো। তাই করা উচিত, নাহলে আবার কে কখন ভয় পায়! সে বাসায় চলে গেলো; অন্যরাও চলে গেলো নিজেদের কাজে। ভবানী ভিতরে এসে কিছুক্ষ্ণ একনজরে তাকিয়ে দেখলো ফুলবালাকে। না এর আগে সে কখনো তাকে এভাবে দেখে নাই। আজ বহুদিন পর তার শরীর শিহরিত হচ্ছে। এমন সময় আর সুযোগ তো মানুষের জীবনে সব সময় আসেনা। আজ দেবতারা ফুলবালার কলংক বাঁচানোর অজুহাতে তাকে এই উপহার দিয়েছেন। ভবানী উপহার ফিরালো না। সন্তর্পণে মেঝেতে বসলো ফুলবালার পাশেই। এক ঝটকায় তাকে কাছে টেনে নিলো!

(১২)

মাস দেড়েক পার হয়েছে। সুশীল আর জলেশ্বরীর দিকে আসেনা। সুশীলের মোহ কেটে গিয়েছে। সেদিনের ঘটনার পর তার চেতনা ফিরেছে বলেই নিজের কাছে মনে হচ্ছে। অযথা ঝামেলায় জড়ানোর খায়েশ আর তার নেই। কপালে ছিল তাই ভালোই কাটালো এই কয়েকদিন। কিন্তু তাই বলে এর চেয়ে বেশি ঝুঁকি নেয়া যায়না কোনমতেই। মুক্ত জীবনে নতুন ঝামেলা আমদানি করার কোন রকম ইচ্ছা তার নেই। আর সত্যি বলতে ফুলবালার মতো এক মহিলার মধ্যে আসলেও তেমন কোন আকর্ষণ নেই। দুজনার প্রয়োজন ছিলো, তাই মিটিয়েছে। এখন অন্য কোথাও খুঁজুক না হলে বরের বাড়ী যাক। বরটাতো দিব্যি বেঁচে আছে। তাই সুশীল আর আসেনা এদিকে। জলেশ্বরীর মানুষগুলোর জীবন আগের মতোই চলছে। শরতের খোলা আকাশের মেঘ আগের মতোই ভাসছে। শুধু ফুলবালা পাল্টে গিয়েছে। কারো সাথে কথা বেশি বলেনা সে আর। মাঝেমাঝে ভাবে সুশীলের বাড়ির দিকে যাবে। কিন্তু তার মনে বাঁধে। কেন যাবে, কি বলবে! কিছুই বুঝে উঠতে পারেনা। আর তার ভয় করে, খুব ভয় করে! সে সুরবালার ঘরে আর ঘুমায়না। সন্ধ্যার অন্ধকার গাড় হয়ে আসলে তার বুক কাঁপে কারণ ছাড়াই! জলেশ্বরী দেবীর মন্দির হোক বা না হোক, তার অভিশাপ যে তাকে পেয়ে বসেছে, এরকমটাই মনে হয়। আর নিজের মধ্যে কিছুটা বদল টের পায় ভবানী। সে আগেও অন্যদের সাথে বেশি কথা বলতোনা, এখনো বলেনা। কিন্তু মনে কোন সোয়াস্তি পায় না। মনে হয় কি যেন তার চাই! সুরবালার সাথেও ছোটখাটো কারণে হাতাহাতি বাঁধে। রাতে বিরাতে হঠাত সেদিনের কথা মনে হলে তার ভিতর জাগে অদম্য বাসনা। কিন্তু ফুলবালাকে আর সে নাগালের মধ্যে পায়না। লক্ষ্য রাখে সবসময়। কিছুতেই কিছু হয়না। অস্থিরতায় হাঁসফাঁস করে। ওদিকে হারু আর গোপালের সেদিনের ভয় পাওয়ার গল্প ডালপালা মেলে মোটামুটি পুরো এলাকায় ছড়িয়েছে। সবাই এখন এদিকটাকে ভয় পায়। গল্পের পিঠে আর বানানো গল্প জুড়ে অদ্ভুত সব কাহিনী এখন ভাসে এলাকার বাতাসে। গতকাল ভোরে নাকি রসূল আলি রাস্তা পার হচ্ছিলো। তখন দেখেছে এক মহিলা লম্বা চুলে দাঁড়িয়ে পুকুরের পাড়ে। আরো কত কথা ছড়ায়, ছড়াবে। নীলমাধবের বড় ছেলে ইঁচড়েপাকা সজল নাকি স্বপ্ন দেখেছে- পুকুর থেকে উঠে আসছে এক দেবী মাথায় সিঁদুর। অবশ্য সজল একটা কথা চেপে গিয়েছে, আসলে দেবী নয়, একজন মেয়েকে সে গোসল করতে দেখেছে। কোন পুকুরে ঠিক নাই, যে কোন পুকুর হতে পাড়ে সেটা। আর মেয়েটার মুখও তার  সদ্য দেখা সিনেমার নায়িকার মতো! একটু বাড়িয়ে না বললে কি স্বপ্নের মাহাত্ম্য থাকে?? তাই সে বলেছে! আর তা ছড়িয়েছেও গঞ্জ পর্যন্ত। তাতে অবশ্য ভবানীর বাড়ির মানুষের সুবিধাও হয়েছে। কেউ আর এদিকে তাদের ঘাঁটাতে আসেনা।

ভবানী বসে ছিলো পুকুরের পাড়ে। পুকুরের মাছ গুলোর চেয়েও তার মন বেশি অস্থির! চোখে দার্শনিক সুলভ স্থিরতা আর নেই। বিকাল পড়ে এসেছে। এমন সময় সেখানে আসলো ফুলবালা। সেদিনের পর এই তার প্রথম সামনে এসে কথা বলা। ভবানী খানিকটা অবাক হয়ে তাকিয়ে চোখ ঘুড়ায় অন্যদিকে। ফুলবালা বলে,

-“জামাই বাবু শরীরটা খারাপ। একটু ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে?”

-“কি হয়েছে?”

-“মাসিকটা হচ্ছেনা কেন যেন! আগেও অনিয়মিত হতো, কিন্তু এতো দিন বন্ধ থাকেনি কখনো!”

মেয়েদের এই সমস্যার অসংখ্য কারণ চিকিৎসা শাস্ত্রে থাকতে পারে, তবে এদেশের পুরুষদের কাছে একটা কারণই জানা আছে। ভবানী বিবাহিত পুরুষ, অভিজ্ঞতা কম নয়। সব বুঝলো সে এক কথায়ই। হঠাত তার গাঁয়ে কাপুনি ধরলো আর শরতের বিকালেও ঘাম আসলো শরীরে। আত্মরক্ষা মানুষের জাত প্রবৃত্তি। এ অবস্তাতে কিছুক্ষণ চুপ থেকে সে হঠাত হুংকার দিলো

-“তা যাওনা সুশীলের কাছে! ওর সাথেই তো তোমার লটরপটর! অকে বলো তোমার ব্যবস্থা করতে।“

আসলে ফুলবালারও এটা নিয়ে ভয় ছিলো মনে সবসময়। পৃথিবীর সব মেয়েরই থাকে। কিন্তু প্রবৃত্তির চাওয়ার কাছে তার ভয় পাত্তা পায় নাই এতোদিন। আজ ভবানীর এই উত্তরে সে ভয় পেলোনা কেন জানি! পুরুষ কখন কি নিয়ে ভয় পায়, নারীরা বোধ হয় ভালোই টের পায়! সে মুখ শক্ত করে বলল- “হুম, তার হতে পারে আবার তোমারও হতে পারে। দুই জনেই তো ছিলা সেইদিন! আমি কিভাবে বলবো কার?”

ভবানীর ইচ্ছা হচ্ছিলো মেয়েটাকে এখুনি চুলের মুঠি ধরে কয়েকটা আছাড় দেয়। সে তার হাতকে থামালো। দাঁত খিঁচিয়ে বললো-“কি প্রমাণ তোর কাছে আছে?” ফুলবালা সজলের কাছে শহরের অনেক গল্প শুনে কিছু জ্ঞান অর্জন করেছিলো। এক রাতে সজল গল্প শোনাচ্ছিল সবাইকে, কোন বড়লোক নাকি সন্তানকে অস্বীকার করায়, আদালতে পরীক্ষা করে প্রমাণ হয়েছে। তার মনে ছিলো গল্পটা। সে বলল-“জামাইবু আজকাল আদালতে নাকি পরীক্ষা এসেছে, তা দিয়ে ওরা ধরে ফেলে বাচ্চার বাপ কে?”

ভবানীর জানা ছিলোনা। সে সত্যিই জানতোনা! এতো দূর এগিয়ে গিয়েছে দুনিয়া! তার মাথায়, শরীরে কে যেন আগুন লাগিয়ে দিলো অকস্মাৎ। সে ভয় পেয়েছে! পাওয়ারই কথা!

(১৩)

গত এক সপ্তাহ হলো জলেশ্বরী দিঘীর পাড়ে নানান উৎপাত দেখা দিয়েছে। আগে অন্য মানুষরা ভয় পেতো, এখন ভবানীর বাড়ির মানুষেরাও রেহাই পাচ্ছেনা। কয়েকদিন আগে একটু রাতে ভবানীর বড় ছেলের বঊ লতা রাণী রাতে কি এক কাজে দিঘীর পাড়ে গিয়েছিলো, কোথায় থেকে এক কালো দৈত্য নাকি তার দিকে তেড়ে এসেছিলো। চিৎকার দিয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলো সে। সজলটা রাত আটটার দিকে বিড়ি টানতে গিয়েছিল দিঘীর পাড়ের কলা গাছের ঝাড়ে। কোথায় থেকে এক কালো মুর্তি, মাথাটা তার বিশাল, আগুনের মতো চোখ, তাকে তাড়া করলো। দৌড়াতে গিয়ে বেচারার পা মচকেছে, এখন বাসায় ব্যাথায় কাতরাচ্ছে। একটা আতংক ছড়িয়ে আছে এখানের বাতাসে। পূর্ণিমার রাতেও মানুষ আর বাইরে বের হয়না। সুরবালা দূরের হিন্দু পাড়া থেকে শুনে এসেছে- এসব নাকি জলেশ্বরী দেবী জাগ্রত হওয়ার লক্ষণ। যখন দেবী জাগ্রত হয়, তখন তার রক্তপিপাসা জাগে; একসময় নিয়মিতই মানুষ খুন হতো এখানে। পাশের পাড়ার লোকেরা বলে সব দুষ্ট জ্বিনদের কাজ। যে যাই বিশ্বাস করুক সন্ধ্যার পর আর কেউ এদিকে আসেনা।

ফুলবালার আজকাল খুব ভয় হয়। আর কেউ না জানুক সেতো জানে, কি পাপ সে করে এসেছে ওই জায়গায়। এখন দেবীর অভিশাপ তাদের সবাইকে নির্বংশ না করে! আর ঋতুস্রাবটাও আটকে আছে এই সময়েই। কি সর্বনাশ হতে যাচ্ছে তার! সে আর এখানে থাকতে চায়না! আবার স্বামীর বাড়ীতে গিয়ে মুখ দেখাবে কি করে! যদি সত্যিই পেটে বাচ্চা চলে আসে! না আর দেরী করা উচিত নয়। সুশীলের বাড়ির দিকে রওনা হয় সে। সুশীল সব শোনে। কিছুই অস্বীকার করেনা, শুধু তার শিড়দাড়া বেয়ে শীতল স্রোত নেমে আসে। সামান্য কামনার এতো জটিলতা তার প্রত্যাশায় ছিলোনা। সে বলে-“শুনছি শহরের ডাক্তাররা এইসব নষ্ট করতে পারে। চলো একদিন শহরে যাই। ঠিক করে আনি।“

মানুষের মন বোঝা খুব কঠিন, বেশিই কঠিন। মনে হয় দেবতারা অন্তরীক্ষে থেকে মনের চিন্তাকে ঘুরিয়ে পালটিয়ে তামাশার খেলা খেলেন সবসময়। এখন ফুলবালার সব চিন্তা আরেক দিকে মোড় নেয়। সে সুশীলকে বলে-

“শহরে নাকি কোর্টে গিয়ে বিয়ে করা যায়! চলো বিয়ে করি দুজন। আমরা বাচ্চাটাকে বড় করবো, আর তোমার তো বউ নাই, তোমার বাচ্চাগুলোকেও আমিই বড় করবো।“

সুশীল এই প্রশ্নের জন্য তৈরী ছিলোনা আসলেই। মেয়েটার সাহস কতো! একটা থাকার জায়গা নাই পর্যন্ত, আর চাচ্ছে তাকে বিয়ে করতে। অন্যের বয়সী বউ ভাগিয়ে বিয়ে করার মতো অধঃপতন এখনো সুশীলের হয় নাই। সে শক্ত করে বলে-

“নাহ! আগে এই ঝামেলা নষ্ট করে আসি!”

নারী যদি জেদ করে কে তাকে টলায়! আর এতোদিন পর একটা শক্ত সম্ভাবনা তৈরী হয়েছে ফুলবালার সত্যিকারের সংসার করার। সে তা হারাতে চাইবে কেন! সবাই সব জানলে সে হয়তো চরিত্রহীনা বলে পরিচিত হবে, তবে সুশীলও ছাড় পাবেনা। এমন দূর্বলতম মুহূর্তে কোন মেয়েই ছাড় দেয়না। ফুলবালাও দিলোনা। সে বলল-

“আমাকে বিয়ে করতেই হবে। নাহলে কিন্তু বিচার চাবো। পুলিশের কাছে যাবো।“

নিজের এতোখানি করূণ অবস্থা সুশীল জন্মেও কল্পনা করে নাই। সে বুঝতে পারছে সে মহাবিপদে পড়তে যাচ্ছে। তার মনে হচ্ছে ছোট হতে হতে মাতৃগর্ভে লুকায়। সে দেবতাদের মনে মনে ডাকে, বলে এবারের মতো রেহাই দাও। আর এ জীবনে কামনা বাসনা রাখবনা। দেবতারা সমাধান দেন না, সামনে মুর্তির মতো বসে আছে ফুলবালা। যাকে সুশীল কয়দিন আগেও উম্নত্ত হয়ে আদর করতো, তাকে এখন মনে হচ্ছে মুখে বসন্তের দাগওয়ালা এক ডাইনী! দানব গর্ভে নিয়ে সুশীলকে বন্দী করতে এসেছে!

না সে জেলে যেতে রাজি। কিন্তু একে বিয়ে করতে রাজী হবেনা। পুরুষের মন বড়ই অস্থির। তারা যখন কোন মেয়েকে বলে ভালোবাসি, তখন দুইপ্রকারে বলে-কখনো সত্যি প্রেমে পড়ে আবার কখনো দেহজ কামনায় পড়ে। ফুলবালা সুশীলের করূণ দশা বুঝতে পেরে আরো চেপে ধরে-

“কি হলো? বলো কবে বিয়ে করতে যাচ্ছি!”

সুশীল বুঝতে পারে আর কোন রেহাই নেই। এখন রাজী না হলে এ পাড়া মাত করে লোক জড়ো করবে। সব সন্মান ভেসে যাবে। সে রাজী হয়! বলে-

“আজ রাতে বাড়ি থেকে বের হয়ে জলেশ্বরীর পুকুর পারে এসে দাঁড়ায় থাকবা। আজকে রাতে পালায় যাবো শহরে। সেখানে তোমাকে রাখবো। বিয়ে করবো।“

হঠাত অমূল্য কিছু পেয়ে গেলে মানুষ যেমন দিশেহারা হয়ে যায়, তেমন দিশেহারা হয় ফুলবালা। আনন্দে মাথা নেড়ে দশটার পর ঘর ছাড়ার চিন্তা মাথায় নিয়ে বের হয় সে। আজ তার অনেক কাজ। সুশীল স্থির পাথরের মতো স্তাণু হয়ে বসে থাকে পুরোটা বিকাল!

(১৪)

“চান্দের আলো সখী তোমার চাঁদর”

“চুপি চুপি আসিও না হইতে ভোর”

জলেশ্বরীর পাড়ের ভবানীমোহনের বাসার সবাই সন্ধ্যার মধ্যেই ঘুমাতে যায়। আর দেবী জাগ্রত হওয়ার পর তো কেউ ঘর থেকেই বের হয়না রাতে। আজ সবার আগে বাইরে বের হওয়ায় ভাঙ্গা কাঠের দরজার সামনে চট পেতে বিছানা পাতে ফুলবালা। এখান থেকেই বের হওয়ার সবচাইতে সুবিধা, ঘুমের ভান করে জায়গাটা দখল করে পড়ে থাকে সে। সবচাইতে সজাগ কান তার বোন সুরবালার। তাই তার থেকে দূরে এই জায়গাটাই খুব নিরাপদ। চাঁদ উঠে আকাশে। তার আলোয় জলেশ্বরীর জল চকচক করে। অদ্ভুত সাদা আলোর মাখমাখি এই চরাচরে আজ। ভবানীমোহনের বাড়ির সবাই ঘুমে অচেতন, একমাত্র ভবানীমোহন ছাড়া। ফুলবালা তার ঘুম কেড়ে নিয়েছে! সত্যি যদি ফুলবালার গর্ভে কিছু এসে যায়, আর সে ফেঁসে যায়! এই বয়সে আত্মীয় পরিজন হারাতে হও, কি হবে তখন! তার ঘুম আসেনা চোখে! দিনের চব্বিশ ঘন্টা সে চোখ রাখে ফুলবালার উপর। সে ভালো করে খেতেও পারেনা, কোথাও বসতে পারেনা। সে শুধু লক্ষ্য রাখে শেয়ালের মতো পিছন থেকে। অলক্ষীটা তার ঘুম, শান্তি সবই কেড়ে নিয়েছে। ভবানী শুনতে পায় ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দে দরোজাটা খুলে গেলো। পাশেই শুয়ে সুরবালা! তাকে আস্তে করে পাশ কাটিয়ে নীচে নেমে আসে সে। চৌকির নীচ থেকে চটের গাঁয়ে আলকাতরা লাগিয়ে বানানো আলখাল্লা আর মাটির হাড়িতে ফুটো করে বানানো মুখোশটা বের করে তাড়াতাড়ি পড়ে নেয়। দেবী জাগ্রত হয়েছে, তার জলে বিসর্জন দেয়ার আজ উৎকৃষ্ট সময়। শুধু ফুলবালার জন্যেই বহুকষ্টে সে বানিয়েছে এসব। সবার   চোখের আড়াল থেকে তাদের ভয় পাইয়ে এসেছে কয়েকদিন! আজ ব্যর্থ হলে চলবেনা। বুকে ফুঁ দিয়ে সাহস জোগাড় করে বের হয় সে ফুলবালার খোঁজে। ফুলবালা সাঁতার জানেনা! জলেশ্বরী ও অনেক গভীর। দেবী তো এমন বিসর্জনই চায়!

বাইরে চাঁদের আলো ঝরণা ঝরছে। ফুলবালা সন্তর্পণে হাঁটছে। তাকে দূর থেকে চাঁদের আলোয় কিশোরীর মতো দেখাচ্ছে। দূর পুকুরের ওই পাড়ে একটা আলো জ্বললো। এমনটাই অবশ্য বলেছিলো সুশীল, এর আগে মাঝে মাঝে রাতে আসলে সে এভাবেই ডাকতো। কিন্তু ওই পাড়ে হেঁটে যাওয়া খুব মুশকিল। দিঘীর পাড়টা ভাঙ্গা আর আরেক পাশেই দেবীর মন্দির। অতোদূরে কেন দাড়িয়েছে সুশীল! এই রাতে সবাই ঘুমে! কে তাকে দেখতো! আর দেখলেই কি! আজকের পর কে আর ভবানীমোহনের বাড়ির মানুষের পরোয়া করছে! সরু পাড়টার দিকে হাঁটা দেয় সে।

হঠাত পিছন থেকে হুড়মুড় শব্দে তার বুক কেঁপে উঠে! পিছনে একটা কালো শরীর আর সাদা দাঁত বের করা কংকালের মুখ তার দিকে দৌড়ে আসছে! হাতে দা-জাতীয় কিছু একটা! ফুলবালা তার স্বপ্নের এতো কাছাকাছি এসে মরতে চায়না আজ। সে পাগলের মতো সরু পাড়টা ধরে জীবন হাতে নিয়ে দৌড়ায়। সুশীল তার দিকে এগিয়ে আসছে! আর মাত্র কিছুটা দূর। তারপরই বাবড়ি চুলের সেই মানুষটা দাঁড়িয়ে আছে, তাকে বরণ করার জন্য। পিছনে যাই আসুক ফুলবালাকে পারতেই হবে! সে পারে! সে পৌছে যায় গভীর জলের পাশে তার দিকে এগিয়ে আসা সুশীলের প্রায় কাছাকাছিই।

সুশীলও জানে ফুলবালা সাঁতার জানেনা। সে অবশ্য তার পিছনে আসা কালো মূর্তি এখনো দেখেনি। টালমাটাল হয়ে ছুটে আসা ফুলবালা তার নাগালের মধ্যে আসতেই হাতে রাখা শক্ত বাঁশের টুকরো দিয়ে শরীরের সব শক্তি জোগাড় করে তার মাথা লক্ষ্য করে বাড়ি মারে! লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে আঘাতটা পিঠে লাগলেও, উদ্দেশ্য সাধন হয়। এক ঝটকায় তাল হারিয়ে গভীর জলে পড়ে যায় ফুলবালা! এরপর আর কিছু ভাবার সময় পায়না সুশীল। দেখে মন্দিরের পাড় ধরে দাঁড়িয়ে আছে কালো আলখাল্লা গাঁয়ে এক কঙ্কাল, হাতে দাঁ! চোখ বন্ধ করে দৌড় দেয় সে; কোনদিকে দৌড়াছে তার ঠিক থাকেনা! সে শুধু দৌড়ায়!

(১৫)

ফুলবালা মরে যাচ্ছে! তার নাকে মুখে ঢুকছে জল! আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ফুলবালার শেষ নিঃশ্বাস চলে আসবে! একজোড়া বালা পড়া শক্ত হাত সম্ভবত তাকে টেনে নিচ্ছে কোথাও। দেবী কি তাকে টেনে নিচ্ছে বুকে?

*****

নাহ দেবী নয়! সুরবালা তার বোনকে তুলে এনেছেন কোনমতে। বোনের বেখাপ্পা জায়গায় শোয়া দেখেই তার সন্দেহ হয়েছিলো। সেও জেগে ছিলো, কিন্তু কেউ বোঝেনি। ভোরের দিকে ফুলবালা একটু প্রকৃতস্থ হলে, তাকে টেনে তুললো সুরবালা। হাতে একটু শুকনা শাড়ি এনে দিয়ে বলল-“বোন! পুরূষ মানুষের দুনিয়া তো অনেক দেখলি! এখন বাড়ি যাবি চল। আমি দিয়ে আসব, শাড়ি পড়ে নে তাড়াতাড়ি!”

টলমল পায়ে কাপড় বদলাতে গিয়ে ফুলবালা বুঝতে পারলো তার দুঃশ্চিন্তার কারণ শেষ! সে ঋতুমতী হয়েছে অবশেষে।

সমাপ্ত

Print Friendly, PDF & Email
Previous articleজাগরণ
Next articleপুরাতন গ্রাম
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments