স্কূল ছুটি হওয়াার প্রায় একঘন্টা পর বাড়ি ফিরল আবির. বাড়িতে ঢোকার পর বাবার গুরু-গম্ভীর মুখের দিকে একটিবারও চাওয়াার সাহস হলো না আবিরের. জুতো খুলতে খুলতেই আবিরের কানে এসে পৌঁছল বাবার ভারী গলার প্রশ্ন, ” কোথায় ছিলি এতক্ষণ তুই ?”
…আবির চুপ, তার কেন জানি না এখন এক পা সরতেও প্রচণ্ড ভয় লাগছে. তবুও বুকে সাহস টেনে আবির চেষ্টা করল বাবাকে এড়িয়ে গিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে যাাওয়াার, কিন্তু আবিরের বাবা, বিনয় বাবুও বোধহয় প্রতিজ্ঞা করে রেখেছেন যে উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত তিনি ছেলেকে কিছুতেই ছাড়বেন না| তাই ধমক দিয়ে তিনি বললেন, ” কী হলো, কথা কানে যাচ্ছ না ? একটা প্রশ্ন করেছি তোকে আমি …..কী করছিলি প্রায় একঘণ্টা ধরে ?” আবির মাথা নীচু করে নীম্নোস্বরে বললো,”ব্রীজের ধারে দাঁড়িয়ে ট্রেন দেখছিলাম “| ছেলের কথা শুনে রাগে বিনয় বাবুর চক্ষু রক্তবর্ণ| নিজেকে সামলাতে না পেরে তিনি সজোরে আবিরের গালে বসালেন চড়। তারপর নিজ নামের বিরূপ আচরণ কে আশ্রয় করে বিনয় বাবু উচ্চৈস্বরে বলতে লাগলেন………”আজ নিয়ে এবছর পাঁচবার হল তোর স্কুলের হেডমাস্টার আমাকে ডেকেছেন, তোর পরীক্ষার খাতা দেখালেন আমাকে, যা নয় তাই কথা শোনালেন. আর কথা শোনাবেনই বা না কেন, আমিও তো দেখলাম নম্বরের কি ছিড়ি…কুড়িতে কোনটাতে শূন্য, কোনটাতে এক, বড়জোর হলে আড়াই….
হ্যারে তোর লজ্জা করে না তোর বন্ধুরা কত ভালো ভালো নম্বর পায় আর তুই… যদিও লজ্জা করবে কেন, তোর তো লজ্জা বলে জিনিসটাই নেই ” বলে বিনয় বাবু দাঁত মুখ খিঁচিয়ে আবিরের পিঠে দিলেন আরও দু’ঘা। আবির কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগল….”আজ যদি মা থাকত,আমি জানি মা কখনও এরকম করত না আমার সাথে। স্কুলের স্যারদের মত তুমিও বাজে, আমি চলে যাবো বাড়ি ছেড়ে …আর কখনও ফিরব না” বলে ছুটে নিজের ঘরে চলে গেল আবির। বিনয় বাবু হতবাক হয়ে কিছুক্ষণ ধরে ভাবতে লাগলেন, এ কী বলে গেল তাঁকে ছোট্ট আবির ? তিনি কী আবিরের প্রতি একটু বেশিই কঠোর ? কিন্তু তিনি যে শাসন করেন আবির কে, তা তো আবিরের মঙ্গলের কথা ভেবেই। সাথে তিনি এটাও স্পষ্টই বুঝতে পারছেন যে তাঁর এই ব্যবহার বিনয় বাবু আর তাঁর ছেলের মধ্যে ক্রমশ দূরত্ব বাড়িয়ে চলেছে। তা নাহলে আবিরের মুখ দিয়ে এই সত্যি কথাটা আজ এভাবে অভিযোগের সুরে বেড়াত না।
তিনি ভাবলেন, নাহ্, এভাবে মেরে ধরে জন্তু শাসন করার মত নয়, তিনি আবির কে বোঝাবেন….তিনি ভালবেসে বোঝালে আবির নিশ্চয় বুঝবে। এই মনস্থির করে তিনি আবিরের ঘরে গেলেন। ছেলের কাছে গিয়ে দেখলেন আবির জানলার কাছে দাঁড়িয়ে বাইরের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে, চোখ দিয়ে অনবরত জল গড়িয়ে পড়ছে। বিনয় বাবু ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলেন ” তোর পড়াশুনা করতে ভালো লাগে না ? ইচ্ছে করে না বড়ো হয়ে গাড়ি চড়তে, প্লেন চড়তে, বড়ো বাড়ি হবে তোর, সবাই তোকে কত সম্মান করবে…”, আবিরের মুখে কোন উত্তর নেই। বিনয় বাবু আবার বললেন, ” আচ্ছা, এই যে তোর হেড্স্যার আমাকে তোর বাজে রেজাল্টের জন্য যা নয় তাই বলে অপমান করেন, তোর খারাপ লাগে না ?
আমার খুব কষ্ট হয় বারবার এটা ভেবে যে আমি তোকে ঠিকমত মানুষ করতে পারিনি ….সত্যিই কী তাই আবির ? আমি জানি তোর মা কে তোর কাছে আমি জীবনেও ফিরিয়ে দিতে পারব না, তুই কী আমাকে তারই শাস্তি দিচ্ছিস ?”…কথা শেষ হতে না হতেই আবির বাবাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল আর ভাঙা গলায় বলতে লাগল,” আমি পড়াশুনা করব না বাবা, তুমি ওদের বলে দিও, আমি আর স্কুলে যাব না, ওরা খুব বাজে, রোজ বকে আমাকে, অঙ্ক ভুল হলেই মারে আমাকে, হাতেরলেখা খারাপ হলে খাতা ছুঁড়ে ফেলে দেয়,সবাই তখন হাসে….কেন করে সবাই এরকম বাবা ?” -” পড়াশুনা করবি না তো সারাজীবন করবি কী ? বেকার হয়ে বসে থাকবি ?” বিনয় বাবু ছেলের পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন।
আবির জানলার বাইরে দূরের ব্রিজটার দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলল, ” ওই ব্রীজের ধারে দাঁড়িয়ে নীচের ট্রেন গুলো কে দেখব, অনেক জোরে চলে ওগুলো, প্রায়ই কত নীচ দিয়ে প্লেন যায় মনেহয় একটু হাত বাড়লেই ওগুলোকে ছুঁয়ে ফেলতে পারব, আর মাঝে মাঝে কত হাওয়া দেয় ওখানে মনে হয় যেন দু’হাত মেলে গোটা ব্রীজটাতে ছুটে বেড়াই।” বিনয় বাবু খানিক্ষন চুপ করে ভাবলেন, এ তো ছোটবেলায় তাঁরও ইচ্ছে হত, এখনও তো,অফিস থেকে সাইকেল চালিয়ে ব্রীজের উপর দিয়ে বিকেলে ফেরার পথে যখন একটু জোড়ে হাওয়া দেয়, সাইকেলের স্পীড যেন নিজের অজান্তেই বেড়ে যায়, তখন সেই হাওয়ার স্পর্শ যেন বিনয় বাবুর সারাদিনের ক্লান্তি ঘুচিয়ে দেয়…সত্যিই অপূর্ব এ প্রকৃতি, কিন্তু এর এত সৌন্দর্য্য অনুভব করার মত সময় কোথায় বিনয় বাবুর এই ব্যস্ত জীবনে? দিনোত্তোর দিন বেড়ে যাওয়া কাজের চাপে কবে বিনয় বাবুর ছোট ছোট ইচ্ছেগুলো হারিয়ে গেছে তা তিনি টেরও পাননি। মাঝে মাঝে মনে হয় সমস্ত কাজ থেকে বিরতি নিয়ে দূরে কোথাও চলে যাবেন, কিন্তু তাঁর দায়িত্ববোধ তাঁকে বাস্তব জীবনে বারবার ফিরিয়ে আনে।
বিনয় বাবু এবার আবিরের দিকে তাকিয়ে ভাবেন তিনিই দৈন্যন্দিন কাজের আর দায়িত্বের চাপে হাঁপিয়ে উঠেছেন আর আবির তো দশ বছরের মাত্র। সেই তিন বছর বয়স থেকে আবিরের বইখাতার বোঝা নিয়ে স্কুলে যাওয়া, স্কুলে বকা খাওয়া, বাড়িতে বকা খাওয়া…..এসবের ভিড়ে যেন ওর প্রাণবন্ত শৈশব না হারিয়ে যায়… বিনয় বাবু ছেলেকে কাছে টেনে নিয়ে বললেন , ” বেশ রোজ তোকে স্কুল যেতে হবে না , তুই বাড়িতে পড়বি আমার কাছে, আমি নিজে ছুটি নিয়ে বাড়িতে তোকে পড়াব, বিকেল হলে ওরকম আরও ব্রীজ ঘুরে আসব আমরা। কিরে পড়বি তো আমার কাছে ? যে ট্রেন, প্লেনগুলো শুধু দেখছিস বড়ো হয়ে সেগুলো চড়তে হবে তো নাকি ? দেশে, দেশের বাইরে সুন্দর সুন্দর কত জয়াগা আছে , ঘুরবি না ?”
আবির অবাক, এ ও কোন বাবাকে দেখছে ? বিশ্বাস হচ্ছে না যে বাবা এই কথাগুলো বলছে. আবির চোখ মুছে বাবার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, ” সত্যি বলছ ?…” বিনয় বাবু আবিরকে কোলে নিয়ে বললেন “একদম সত্যি, আমি তোকে শুধু ভালো একজন মানুষ তৈরী করতে চাই যার জন্য আমার গর্ব হবে, বাকিটা তোর ইচ্ছে …” বলে বিনয় বাবু আবিরের কপালে স্নেহভরে চুম্বন করলেন।