খোকা তখন সবেমাত্র চার কি পাঁচ মাসে,

কর্মসূত্রে খোকার বাবা গেলেন দূরদেশে।

খোকার মাকে বলে গেলেনফিরবো তাড়াতাড়ি,

বড় জোর দিন পনেরতার থেকে নয় দেরী।

গুণতে থাকেন মা দিনএক,দুই,তিন,চার,

পনের দিন কেটে গেলমাসটিও হায় পার।

তবু স্বামীর দেখাটি নাইউতলা জায়ার মন,

এমন সময় খবর এলঘুর্ণিঝড়ের মাতন।

দুর্ঘটনায় স্বামীর তাঁর ভবের লীলা সাংগ,

খোকা তখন কোলের শিশুমায়ের শুরু জঙ্গ।

স্বজন নেই দুকুলে কেউ,ছিল না কোনো পুঁজি,

নিরূপায় খোকার মাকে খুঁজতে হলো রুজি।

দিনের বেলা দু চার বাড়ীকাজ রান্না করা,

রাতের বেলা সেলাই ফোঁড়াইঘুম আসে না ত্বরা।

খোকাটির চিন্তা সদা দুখিনীর মন জুড়ে,

মানুষ তিনি সন্তানেরে করেন কেমন করে !

খোকার বাবার স্বপ্ন ছিল ছেলে আই এস

স্বপ্ন পূরণ করতে হবেই হোক না যতই ক্লেশ।

ধীরে ধীরে ছেলেটি তাঁর বড় আরও বড়,

লেখাপড়া খেলাধুলা সবে সমান দড়

প্রতি বছর প্রথম স্থানলাভ করে সে বৃত্তি,

মায়ের মুখ ঊজল করেনিত্য নতুন কীর্তি।

শিষ্ট খোকা মায়ের কথা করে না অমান্য,

মা ভাবেন এমন ছেলেসত্য তিনি ধন্য।

দিনরাত বিরামবিহীনঅসীম শ্রম তাঁর,

বাপের আদর,মায়ের শাসন সবই একাকার।

এগোয় ছেলে মায়ের চোখে উজল আলোর রেশ,

অবশেষে ছেলেটি তাঁর হল আইএএস।

স্বপ্ন পূরণ হল বাবার,মায়ের চোখে জল

এতদিনের যণ্ত্রণাআজকে তারই ফল।

অবশেষে সুখের দিনদুখের পরাজয়,

ধুমধাম করে ছেলের দিলেন পরিণয়।

একমাত্র কন্যাপিতা মস্ত শিল্পপতি,

সম্পর্ক গড়ে নি মোটেই রাতারাতি।

দুজনাই দুজনার মনটি ছিল জুড়ে,

চার হাতের মিলন এবার নহবতের সুরে।

নাতি হলোমায়ের তখন আনন্দ না ধরে,

তাঁর চেয়ে সুখী কে বা আজকে সংসারে

কিন্তু ললাটে যাঁর দুখের লিপি,তাঁর কি থাকে সুখ !

ধীরে ধীরে হারিয়ে গেল মায়ের হাসিমুখ।

আগে থেকেই মাঝে মাঝে ছিল মনের দ্বন্দ্ব,

দ্বন্দ্ব ক্রমবর্ধমানজীবন হারায় ছন্দ।

খোকাও যেন বদলে গেলো,কেমনতর রুক্ষ,

তার ব্যবহারমা ইদানিং পান বড়ই দু:

অবশেষে মায়ের ভাগ্যে চরম পরিণতি,

ঠিকানা তাঁর বৃদ্ধাশ্রমহায় কি দুর্গতি।

চোখের জলে বাণভাসিমা ভাবেন বসে,

এমনতরো শাস্তি তাঁর কি কপাল দোষে !

মানুষ করার জন্য যারে এত কৃচ্ছসাধন,

তার কাছেই পরিশেষে এহেন আচরণ!

মান হুঁশ হারিয়ে সে কি মানুষ সত্যকার!

নিজেকেই বলেন মা সব অপরাধ তাঁর।

হে ঈশ্বর দাও গো আমায় সর্বসহন শক্তি.

দাও হে শরণ তোমার চরণ চাই যে চিরমুক্তি।

অভাগিনীর করুণ আর্তি শোনেন দয়াময়,

চলে গেলেন দুখিনী মা চিরতরেই হায়।

খোকা তখন বিদেশেকাজের চাপ ভারী,

শেষকৃত্য মায়েরআসা সম্ভব নয় তারই।

যার জন্য করেছিলেন জীবন বলিদান,

তার কাছেই অভাগিনী পেলেন এহেন মান।

বৃদ্ধাশ্রমে এমন কত মায়ের দীর্ঘশ্বাস,

লিখতে গেলে সেসব কথা হবেই ইতিহাস।

তাঁদের মধ্যে একটি মায়ের কষ্ট দিলেম তুলে,

শেষ বিদায় জানাই তাঁরেপ্রণাম চোখের জলে।

Print Friendly, PDF & Email
Previous articleকলকাতা – ৩২ ; প্রেম, মনখারাপ, কিংবা পাগলামো
Next articleসহবাস
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments