Inventer ও F- Visiva

১৭-০৫-১৯৮৫

সচরাচর আমার এমন অনুভূতি কখন হয়নি। এখন আমি প্রতিদিনের মত আমার দৈনিক কার্যকলাপ লিখতে বসেছি। এই কিছুক্ষণ আগে আমার পোষা বিড়াল মিনিস্টোন আমারই চোখের সামনে ছট-ফট করতে করতে মারা গেলো আমারই ল্যাবোরেটরিতে। আজ সকাল থেকেই আমার সাথে যে সমস্ত ঘটনা গুলি ঘটছে তার বেশির ভাগটাই প্রায় আমার জানা। এই যেমন মিনিস্টোনের মৃত্যু আর আমার ডান হাতের কনুইতে সদ্য রসায়নের ছিটা লেগে পুরে যাওয়া খত ও আমার আমেরিকান বৈজ্ঞানিক বন্ধু স্যার রবার্ট জোন এর ল্যাবোরেটরি থেকে Cabhrach এর নতুন উন্নত মস্তিস্ক নিয়ে পালিয়ে যাওয়া। আজ থেকে ৫ বছর আগে আমারই এক রিসার্চের দ্বারা আবিষ্কৃত এক মেশিন যা আজ পর্যন্ত আমি বৈজ্ঞানিক মহলে পেশ করিনি, বা বলা চলে বিজ্ঞান এখন এই আবিষ্কারের সম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞাত। আমার এই যান্ত্রিক কার্যকলাপের দরুন আমি এ সকল ঘটনার পূর্ব আভাষ পেয়ে ছিলাম আজ থেকে ৫ বছর আগে। আমার আবিষ্কৃত সেই মেশিনটার নাম F- Visiva…

সেদিনও আমি আমার দৈনিক কার্যকলাপ লিখেছিলাম, কিন্তু সেদিনের তুলনায় আজকের ভাবনা সম্পূর্ণ ভিন্ন ও আলাদা। সেবার আমি এই যন্ত্রের সম্পর্কে বিশেষ কিছু লিখতে পারিনি, কারন আই এই যন্ত্রের ক্ষমতা ও গুনের ব্যাপারে একেবারেই অজ্ঞাত ছিলাম, কিন্তু আজ যখন এই যন্ত্রের ক্ষমতা ও গুনের ব্যাপারে জানতে পারলাম তখন এই ব্যাপারে আমাকে লিখতেই হল। আজ আমার আনন্দের দিন যে আমি এক বিস্ময় যন্ত্রের সৃষ্টি কর্তা যা ভবিষ্যত জানাতে সক্ষম। এবার আজ থেকে ৫ বছর আগের সেই ঘটনার কথা বলি…

 

১৬-০৫-১৯৮০

সকাল থেকে বেশ গরম পরেছে, বাইরে সূর্যের তেজ চোখে তাক লাগানোর মতো। আমার বারিতে ইলেক্ট্রিক-এর একটু সমস্যা রয়েছে তাই আমার আবিষ্কার করা Brilla brillante,   এটা এক ঘণ্টা সূর্যের আলো খাওয়ালেই টানা ২ দিন উজ্জ্বলতা দিতে সক্ষম। কাল রাত থেকে ইলেক্ট্রিক কানেকশান নেই, এখনও পর্যন্ত তা আসেনি, এদিকে আমি একটা নতুন আবিষ্কারের পেছনে পরে রয়েছি আজ টানা ছয় মাস। আমি একটা এমন যন্ত্র বানাতে চলেছি যা সময়কে কিছু ক্ষণের জন্য স্থির রাখে। বেশ কিছু গাণিতিক নিয়মের দ্বারা তা কিছুটা সমতায় আনতে পারলেও বিশেষ একটা জায়গায় এসে তা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বারবার। আমার বারিতে কনও পরিচারক নেই, আমি নিজেই আমার সব কাজ করি। তবে আমার সঙ্গি বলতে আমার বানানো রোবট Cabhrach সে আমার কিছু কিছু কাজে সাহায্য করতে পারে। কিন্তু আমি তাকে আরও উন্নত করতে চাইছি, যাতে সে নিজেই নিজের সিধান্ত নিতে পারে, যার প্রায় কিছুটা সাফল্য আমি আজ ৫ বছর পর পেয়েছি। এখন Cabhrach নিজে আমার প্রয়োজন মতো কোন রসায়ন কখন দিতে হবে সে আগে থেকেই এনে আমার সামনে দিয়ে দেয়, তবে সেই সমস্ত রসায়ন ও আরও কিছু বিশেষ তথ্য তার মগজাকৃতির মতো এক যন্ত্রে ইন্টল করতে হয়েছে।

আমি নিজের ডেস্কের উপর খাতা কলম নিয়ে গাণিতিক নিয়ম দেখছি এমন সময় আমার মাথায় একটা কথা চমক খেয়ে গেলো। আমি তারা তারি আমার ল্যাবোরেটরিতে এসে সেই সাময়িক যন্ত্রের সামনে বসলাম। অনেকক্ষণ ধরে এই যন্ত্রের পেছনে পরে রইলাম, কিন্তু একটু আগে আমার মনে পড়া সেই ভাবনার সাথে কিছুতেই মিল করাতে পারছিলাম না এই যন্ত্রের আন্ত্রিক ক্ষেত্রকে। আমি আবার বেড়িয়ে এলাম ডেস্কের কাছে, দেখলাম Cabhrach আমার টেবিলের উপর বসে কলমটা বেকায়দায় ধরে কাগজের উপর ঘোষছে। আমি একটু মুচকি হেঁসে ওর দিকে এগিয়ে এলাম, ভেবেও হাঁসি লাগলো যে একটা যান্ত্রিক রোবট নিজে থেকেই টেবিলে বলে লিখছে, কিন্তু যখন কাগজের উপর চোখ গেলো তখন সত্যিই আমাকে অবাক হতে হয়েছিল। Cabhrach তার যান্ত্রিক হাতে আঁকা প্রথম ছবি এঁকেছে একটা আশ্চর্য ধরনের এক জিনিসের। আমি প্রথমটা সেটা আসলে কি বুঝতে না পারলেও মনে হচ্ছিল যে এই জিনিস টাকে কোথাও একটা দেখেছি।

এমি কাগজটা পাশে সরিয়ে দিয়ে Cabhrach-কে Deactivate করে আমার রাসায়নিক গণিত কষতে লাগলাম। অবশেষে একটা রসায়নের সন্ধান পেলাম। গাণিতিক ফল অনুযায়ী তিনটে রসায়নের একত্রিত সংমিশ্রণের বাষ্প থেকে নিঃসৃত তরলকে যদি ওই যন্ত্রের মধ্যে দেওয়া যায় তাহলে কার্য সিদ্ধ হতে পারে। আমি সেই তিনটে রসায়নে তিনটে জারে নিয়ে এক প্রকার বিশেষ আকৃতির টিউবের দ্বারা সেটাকে রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় ফোটাতে দিলাম আমার ল্যাবে। প্রায় ৯০০ মিলি. থেকে ১.৫ লিটার বাষ্পায়িত তরল প্রয়োজন এই যন্ত্রের জন্য। অতিরিক্ত গারহ ও বেশি হওয়ায় অনেকটা সময়ের প্রয়োজন ছিল, তাই সেটাকে ওই অবস্থায় রেখে দিয়েই আমি সেদিনের মতো ল্যাবোরেটরি-র দরজা বন্ধ করলাম। ঘড়িরই দিকে তাকিয়ে দেখালাম বিকাল সাড়ে চারটা বাজে, সেদিন আর রান্না করতে পারিনি তাই গতকালের জল দিয়ে রাখা ভাতটাই খেয়ে নিলাম।

সন্ধ্যা ৬ বাজে, দেখলাম Cabhrach মুখ থেকে কিছু একটা শব্দ বের করছে, আমি এর আগেও ওর মুখ থেকে শব্দ শুনেছি কিন্তু আজকের শব্দটা ভিন্ন ও অন্য সুরের। আমি সেই শব্দকে কর্ণ পাত না করে ওর পেছনে রাখা deactivate switch টা চেপে বন্ধ করতে যাবো দেখলাম ওর হাতে সেই ওর আঁকা ছবিটা। আমি এবার ছবিটার অর্থ বুঝতে পারলাম, ওটা একটা হাতল প্রকৃতির জিনিস ও এর আকার সাধারণের থেকে আলাদা। প্রথম যখন ছবিটা দেখি তখন বুঝতে না পারলেও এখন মনে পড়লো ঠিক এরকম-ই একটা জিনিস আমি বানিয়ে ছিলাম স্টেনোসিয়া নামক এক কঠিন পদার্থ দিয়ে, যা অতিরঞ্জিত আলো ও এস্থরেন রসায়নের স্পর্শে এলে এর থেকে বেড়িয়ে আসা আলোক রশ্মি পার্শ্ববর্তী এলাকায় থেকে সমস্ত পদার্থকে ১ ঘণ্টার জন্য অকেজো করে দেয়। কিন্তু Cabhrach কেন যে এই ছবি এখন আমাকে দেখাচ্ছে আমি কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম না। তাই সময় নষ্ট না করে আবার Cabhrach-কে deactivate করে আমি আমার কাজ করতে লাগলাম, তার পর ঠিক রাত ১১ টার সময় বিছানায় ঘুমোতে গেলাম।

১৭-০৫-১৯৮০

ঘুম থেকে উঠে Cabhrach-কে সেই একই রকম ভাবে পরে থাকতে দেখলাম যেমন টা গতকাল রাতে তাকে deactivate অবস্থায় রেখে ছিলাম। যখন ল্যাবোরেটরিতে প্রবেশ করি তখন ল্যাবোরেটরির ঘড়িতে সময় সকাল ১০ টা। প্রবেশ করার পর লক্ষ করলাম সেই বাষ্পিয় তরল তখনও ভরছে। আমি তার কাছে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে দেখি তরলের রং কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। এবার আমি মেশিনটার দিকে এগিয়ে যাই, একটা সাদা কাপড় দিয়ে ঢেকে রেখে ছিলাম মেশিনটাকে। দুটো মানুষ খুব ভালো ভাবেই বসতে পারে সেটাতে, আসলে সময় যে থেমে যাবে সেটা সবচেয়ে বেশি অনুভূতি হবে মেশিনটাতে বসলে তাই এই ব্যবস্থা করা। আমি মেশিনটার ভিতর ঢুকে একটা সিটে বসি। সামনে অনেক সুইচ-এর ব্যবস্থা রয়েছে, যার দ্বারা মেশিনটাকে সমতায় রাখা সম্ভব। একটা যান্ত্রিক ডিসপ্লে রাখা হয়েছে যেখানে দেখে যায় কতটা সময় অতিক্রম হল, কতটা সময় স্তব্দ থাকছে ও আরও অন্যান্য কার্যকলাপ দেখা যাবে। সুইচ গুলো সঠিক ভাবে কাজ করছে কিনা দেখার জন্য নম্বর লেখা সুইচ-গুলো চেপে চেপে পরীক্ষা করলাম, বুঝলাম যে হ্যাঁ ঠিকঠাক কাজ করছে। তার পর সামনের দিকে তাকাতেই হঠাৎ মনে হল আরে কিছু একটা যেন নেই, কিন্তু কি নেই বুঝে উঠতে পারছিলাম না কিছুতেই।

চোখ বন্ধ করে কল্পনা করতে চেষ্টা করলাম, হঠাৎ মাথায় চমক দিয়ে গেলো একটা চিত্র। Cabhrach-এর আঁকা ওই ছবির কথা মাথায় এলো, সাথে সাথে খুঁজতে লাগলাম ছবিটা কিন্তু পেলাম না। প্রায় ৩০ মিনিট ধরে চরম মাত্রায় খোঁজার পরেও যখন পেলাম না তখন ক্লান্ত হয়ে বসে পড়লাম মেশিনটার পাশে থাকা একটা চেয়ারে। চেয়ারে বসে আছি, সেখান থেকে দরজার সামনে লাগানো আমার তৈরি আয়না যার দ্বারা আমি Cabhrach কে দেখতে পেলাম। এই আয়নার দ্বারা সমস্ত কঠিন পদার্থ ভেদ করে অপর প্রান্তের বস্তু দেখা যায়। আমি তাড়াতাড়ি গিয়ে Cabhrach-কে Activate করে ওর সামনে ছবিটা ধরতেই ও ২ মিনিটের মধ্যে সেটা খুঁজে এনে দিলো। এক বিশেষ ধরনের কাঁচের তৈরি ফ্লাস্কে ও বাষ্পিয় তরলকে ঢাললাম ও সেটাকে মেশিনের একটা অংশের সাথে সংযুক্ত করতেই পুরো মেশিনটার রং সেই তরলের রঙের মতো হয়ে গেলো।

প্রথমটা ঘাবড়ে যাই, কিন্তু পরে সামলে নিয়ে মেশিনের ভেতরে ঢুকে বসি। হাতলতা যেখানে লাগবে সেই জায়গাটা খুঁজতে লাগলাম, দেখলাম Cabhrach হাত দিয়ে ইঙ্গিত করছে সেই জায়গাটা। Cabhrach তৈরি বেশ কিছু উন্নত মানের ধাতু ও স্টিল দ্বারা মিশ্রিত পদার্থ দিয়ে যা উচ্ছো মাত্রা সম্পন্ন তড়িৎ বা বিদ্যুতের সংস্পর্শে এলে অকেজো বা খারাপ হয়ে যেতে পারে, তাই আমি মেশিন থেকে বাইরে বেড়িয়ে Cabhrach কে deactivate করে আবার মেশিনের ভিতর ঢুকে বসি। হাতলটা যেখানে লাগানো হবে বলে ঠিক করলাম সেই জায়গাটা একটু কালচে কিন্তু চকচক মনে হতে লাগলো, আমি হাতলটা সেই জায়গাটার সংস্পর্শে আনতেই চুম্বকের মতো হাতল টাকে মেশিনটা উপযুক্ত জায়গায় টেনে নিলো। আমি হত স্তম্ভের মতো তাকিয়ে দেখতে থাকলাম, এমন সময় দেখলাম মেশিনটার পুরো অবস্থান জুড়ে সেই অজানা এক বিশাল আলোক রশ্মির চলাফেরা হতে লাগলো। আমি ঘাবড়ে গেলাম, মেশিনের সব কটা সুইচ পাগলের মতো করে চেপে মেশিনটাকে বন্ধ করার ব্যর্থ চেষ্টা করতে থাকলাম, কিন্তু পারলাম না। আমি বুঝতে পারছিলাম না যে কি করবো, এদিকে মেশিন প্রায় চালু হয়ে গিয়েছিল, আমার কিছু করের ছিল না, এর পর যে সব ঘটনা ঘটল তা এক প্রকার অবিশ্বাস্য।

তীক্ষ্ণ, সরু ও single line ধরে একটা কান ফাটানো শব্দ, আমি সেই শব্দ সহ্য করতে পারছিলাম না, আমি দুটো কানে দুটো আঙুল গুঁজে শব্দ টাকে বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করতে লাগলাম। এমন সময় মেশিনের বাইরেটা দেখলাম ধীরে ধীরে সাদা আলোয় ভরে চলেছে। মনে হল মেশিনটা যেন দ্রুত গতিতে চলছে। মেশিনের ভেতরে বসে আমি একেবারে বোকা মেরে যেতে লাগলাম এই ভেবে যে আমি জানি যে আমি মেশিনের ভেতরে রয়েছি তবে কেন মনে হচ্ছে মেশিনটা চলছে ও আমাকে কোথাও একটা নিয়ে চলেছে। আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই এবার আরও জোরালো ও তীবর মাত্রায় বাজতে লাগলো সেই single sine  শব্দ, এর পর সব সাদা। কতক্ষণ এভাবে ওই মেশিনটার মধ্যে ছিলাম জানি না, যখন আলোয় ফিরলাম তখনও দেখলাম সেই মেশিনটার মধ্যেই বসে রয়েছি। আমি তাড়াতাড়ি করে মেশিন থেকে বেড়িয়ে এলাম।

জল তৃষ্ণা পেয়ে ছিল খুব তাই Cabhrach কে জল আনতে পাঠানোর জন্য ওকে activate করবার জন্য খুঁজতে লাগলাম। প্রায় ১০ মিনি খোঁজার পরও Cabhrach কে খুঁজে পেলাম না, ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি ১২ টা বাজে। আয়নার কথা মনে পরতেই একবার ওই আয়না টার দিকে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম, কিন্তু কি ব্যাপার আয়না থেকে বাইরের কিছু দেখা কান যাচ্ছে না কেন? আমি কিছু বুঝতে পারলাম না, মেশিনটার পাশে থাকা কাঠের চেয়ারটাতে ক্লান্ত হয়ে বসে পড়লাম। মেশিনটা থেকে কেমন একটা বৈদ্যুতিক শব্দ আসতে লাগলো, হঠাৎ সেই শব্দটা একবার জোরে হয়ে উঠলো সাথে একটা বৈদ্যুতিক ঝলকানি। ঝলকানি থামার সাথে সাথেই দেওয়ালে ঝুলতে থাকা Old Grand Father Clock-টা বেজে জানান দিলো ১ টা বাজে। আমি অবাক হবে ঘড়িটার দিকে দেখতে থাকলাম, এ কি করে সম্ভব, এই তো কিছুক্ষণ আগে দেখলাম ১২ টা বাজে এরই মধ্যে ১ ঘণ্টা হয় কি করে।

অবাক আরও বেশি হই যখন ঘড়ির পাশে থাকা ক্যালেণ্ডার-টার দিকে চোখ যায়। আজ ১৭-০৫-১৯৮০, কিন্তু আমার ল্যাবোরেটরির ক্যালেন্ডারের দেখতে পাচ্ছি আজকের তারিখ নয়, সেখানে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে আজ থেকে ৫ বছর পরের তারিখ, ১৭.০৫.১৯৮৫। আমি কিছু বুঝতে পারছিলাম না কি হচ্ছে, এই মেশিনটা কি তাহলে সঠিক ভাবে কাজ করছেনা, না কি এটা? তা কি ভাবে সম্ভব, ভবিষ্যতে যাওয়া কি সম্ভব, সম্ভব হলেও আজকের বিজ্ঞানের কাছে সেখানে যাওয়ার রাস্তা জানা নেই। তবে নিশ্চয়ই কিছু যান্ত্রিক গোলযোগ দেখা দিচ্ছে মেশিনটায়। আচমকাই আবার একই রকম শব্দ আর বৈদ্যুতিক ঝলকানি, আমি এবার সাথে সাথে ঘড়ির দিকে তাকাতেই আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো, ঘড়িতে তখন ১৩৫ মিনিট; চমকে দরজার দিকে তাকালাম মিনিস্টোনের ডাকার শব্দ শুনে। দরজার অপার থেকে ডাকছে মিনিস্টোন, কিন্তু কিছু দেখা যাচ্ছে না কেন? দরজা তো খোলাই আছে, দরজার অপার থেকে শুধু মিনিস্টোনের ডাকার শব্দই পাওয়া যাচ্ছে, টাকে দেখা যাচ্ছে না। দরজার ওপারের অংশ সম্পূর্ণ ঝাপসা ও ঘোলাটে।

আমি ধীরে ধীরে দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম, একটু এগিয়ে যেতেই দরজা ও বাইরের মাঝামাঝি অংশে একই রকম উজ্জ্বল রঙিন আলোর ঝলকানি যেমনটা মেশিনটার থেকে বের হচ্ছে ক্রমাগত, এর পর দেখলাম ওর ভেতরে থেকে বেড়িয়ে এলো মিনিস্টোন, কিন্তু একই মিনিস্টোন এতো মোটা হয়ে গেলো কি ভাবে, তার গায়ের চামড়া একটু বেশি যেন ঝোলা ঝোলা মনে হচ্ছিল। তার ডাকার গতিও সেন আগের তুলনায় অনেক কম। আবার একটা শব্দ ও ঝলকানি, আমার কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখলাম আমার সামনেই মিনিস্টোন ছটফট করতে করতে মারা যাচ্ছে, কেন আর কি ভাবে জানি না টেবিলের উপরে থাকা আমার তৈরি অতি শক্তিশালী অ্যাসিড সালফিউরিক ল্যাসাফিউরিন পড়েছে মিনিস্টোনের গায়ে, আমার হাতে হঠাৎ জালা করতে লাগলো, হাতটাকে চোখের সামনে এনে দেখি যে আমার হাতেও ছিটা লাগার দরুন কয়েক যায় গায় ফোস্কা পড়তে শুরু করেছে। আবার সে শব্দ হতে শুরু হল, আমার এবার মেশিনটার উপর বিরক্তি অনুভূতি হতে লাগলো, ইচ্ছা হচ্ছিল সেটা এক্ষুনি নষ্ট করে দিই।

এবার আবার সেই বৈদ্যুতিক ঝলকানি, আমর বুক ধুকধুক করতে শুরু করলো, আবার কি হয়। ল্যাবোরেটরি সংলগ্ন বাথরুম থেকে হঠাৎ একটা অজানা লোক বেড়িয়ে এলো, আমি টাকে কখনো দেখিও নি আগে সে আমার বাথরুম এ কি ভাবে এলো আমি বুঝতে পারলাম না। হঠাৎ লোকটা কোমর থেকে একটা পিস্তল বের করে ইংরেজি ও পোর্তুগিজ মিশ্রিত ভাষায় বলল, “বল রায় কোথায় সেটা? বল এক্ষুনি নাহলে বন্দুকের এক ট্রিগারেই তোমার জীবন এখানেই থামিয়ে দেবো, বল কোথায় সেটা”। আমি বুঝতে পারছিলাম না যে লোকটা কিসের কথা বলছে, আমি তো তাকে চিনিই না, আমি আতঙ্কিত গলায় বললাম, “কে আপনি, কিসের কথা জানতে চাইছেন আপনি? আমি জানি না আপনি কি বলছেন জানি না আমি”। লোকটা এবার যেন আরও বেশি রেগে গেলো সে পোর্তুগিজ ভাষায় একটা বিশ্রী নিচু ভাষার প্রয়োগ করলো, এর পর আমার দিকে বন্দুক দাগিয়ে বলল- “স্কাউন্ড্রেল, জানো না না? দারাও” এই বলে সে তার পকেট থেকে একটা কুণ্ডলী পাকান কাগজের গোছাকে বের করে আমার সামনে ধরল, আমি বুঝতে পারলাম না জিনিসটা আসলে কি, তবে লোকটাকে দেখে এটা অনুমান করতে পারলাম যে লোকটা পেশায় ও হয়তো নেশায় বৈজ্ঞানিক।

সে বলতে লাগলো- “কি এবার বুঝতে পাড়ছ আমি কিসের কথা বলছি, ভালো ভালোয় বের করে দাও নাহলে”  আমি আবার কম্পিত গলায় বললাম, “দেখুন আমি জানি না আপনি কে আর কিসের কথা বলছেন, কি চান আপনি একটু পরিস্কার করে বলবেন আর আপনি আমার ঘরে এলেন ই বা কেমন করে” লোকটা এবার মুখে কিছু না বলে তার হাতের কাছে থাকা একটা মোটা গোছের বই আমার দিকে ছুঁড়ে মারল, বইটা এসে লাগলো আমার মাথায়, আমার চোখ থেকে চশমাটা মাটিতে পরে গেলো। আমি নিচু হয়ে চশমাটা তুলে নিলাম ও চোখে পড়লাম, দেখলাম লোকটা আমার আবিষ্কার করা জিনিশ গুলোকে এক একটা করে দেখছে আর টান মেরে যেখানে সেখানে ফেলছে। আমি ভীষণ রেগে আপত্তি জানাতেই সে আমার দিকে আবার বন্দুক দাগিয়ে তুলল। আমি নির্বাক দর্শকের মতো শুধু তাকিয়ে দেখতে থাকলাম।

একটা বিশ্রী হাসির শব্দে আমি লোকটার দিকে তাকালাম, দেখলাম লোকটা তার হাতে একটা একটা কাঁচের বাক্সে থাকা উজ্জ্বল নীলচে কি একটা জিনিসকে আমায় দেখাচ্ছে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “ওটা, কি কেন নিচ্ছেন ওটা” এই বলে ওর দিকে এগিয়ে যেতেই ও বন্দুকের ট্রিগার চেপে দিলো, সাথে সাথে একটা গুলি ছিটকে এলো আমার দিকে কিন্তু সেটা আমার গায়ে লাগলো না আমার শরীর থেকে বেশ খানিকটা দূর থেকে বেড়িয়ে গেলো মেশিনটার দিকে আর তার গায়ে লাগলো। মেশিনে গুলি লাগতেই তার বিকৃতি ঘটতে শুরু করলো, লোকটা কি বুঝল জানি না সেই কাঁচের বাক্সটাকে নিজের পকেটে রেখে বেড়িয়ে যেতে লাগলো দরজা দিয়ে। এমন সময় একটা বিশাল কান ফাটানো শব্দ আর সাদা আলোর চোখ ধাঁধান ঝলক খলে গেলো। এমন জোরালো আলোর ঝলকানি যে ঘড়ের কোন অংশই আর দেখা গেলনা। ক্ষণিকের মধ্যের আবার সব ঠিক হয়ে গেলো।

মেশিনটা এখন বন্ধ হয়েছে। সেই লোকটা কোথায় গেলো দেখার জন্য দরজার দিকে তাকাতেই দেখলাম এতক্ষণ যে ঝাপসা ভাব টা ছিল টা এখন দরজা থেকে সরে গেছে। আমি বাইরে গিয়ে লোকটাকে দেখার চেষ্টা করলাম কিন্তু কাউকে দেখতে পেলাম না। কিন্তু যখন চোখ গেলো বারান্দায় থাকা Writing Table টার উপর আমার চোখ কোপালে উঠলো। মিনিস্টোন টেবিলের উপর বসে দিব্যি আলিস্যি ভাঙ্গছে ও টেবিলে পড়া নিজের ছায়ার সাথে খেলছে। তাহলে একটু আগেই যে দেখলাম মিনিস্টোন অ্যাসিডে আক্রান্ত হয়ে মরে পরে রয়েছে ল্যাবোরেটরির মেঝেতে, তাড়াতাড়ি ল্যাবোরেটরিতে এসে মেঝের উপর তাকিয়ে দেখি, সেখানে আর পরে নেই মিনিস্টোনের ঝলসে যাওয়া সেই মৃত দেহ। আমি আমার হাতের দিকে তাকিয়ে দেখি আমার হাতে একটাও ফোস্কার ছিটা নেই, এমন হাত তেমন ই রয়েছে। আমার অবাক হওয়ার আরও বাকি ছিল যখন কানে এলো Grand Father Clock এর ১১ টা বাজার শব্দ, আর ফির ফিরে হাওয়ায় উরতে থাকা ক্যালেণ্ডার যাতে পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে আজকের তারিখ ১৭-০৫-১৯৮০।

১৭-০৫-১৯৮৫

এতো গেলো আজ থেকে ৫ বছর আগের কথা, এখন আসি আজ সকালের কথায়, সকালে আমার বন্ধু স্যার রবার্ট জোন কে আমন্ত্রণ জানাই। তাকে আমি বেশ কয়েকটা বৈজ্ঞানিক কাজে সাহায্য করেছি, বা বলা চলে আমারা এক সাথে কাজ করেছি। Cabhrach-কে তৈরি করা থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত ওকে অনেক পরিবর্তন করেছি ও ওকে অনেক বিকশিত ও উন্নত করেছি। এখন প্রায় অনেক গবেষণা করার পর গত পরশু Cabhrach-এর একটা নতুন মস্তিস্ক বানিয়েছি, যার দ্বারা সে নিজে থেকে সকল প্রশ্ন ও উত্তরের জন্য প্রস্তুত হতে পারবে ও নিজেই নিজের সংরক্ষণ করতে সক্ষম হবে। এ বারে আমি রবার্ট কে জানাই ও সে আমার কাছে এসে তা নিজের চোখে দেখবে বলে জানায়।

রবার্ট Cabhrach-কে আগে দেখেছে ও মুগ্ধ হয়েছে। ঠিক বেলা সাড়ে বারোটা নাগাদ ও আমার কাছে আসে, আমি ওকে নিয়ে আমার ল্যাবরেটরিতে যাই, সেখানে আমারা Cabhrach এর মস্তিস্ক নিয়ে কথা বলতে থাকি। মাঝে মাঝে আমি মাথায় হাত দিয়ে ভাবতে থাকি কিছু কথা। এমন যেন মনে হতে লাগলো আমার। ল্যাবোরেটরির ভেতরটা যেন প্রতিদিনের তুলনায় আরও বেশি করে চেনা মনে হতে লাগলো। ঘড়িতে বাজল ১ টার ঘণ্টা, রবার্ট টার নিজের আবিষ্কারের কথা বলতে বলতে উঠে দরজার পাশে থাকা টেবিলটার কাছে দাঁড়াল, টার পর আমার তৈরি অতি শক্তিশালী অ্যাসিড সালফিউরিক ল্যাসাফিউরিন-এর পাত্র তাকে হাতে নিয়ে বলল- এটা সেই অ্যাসিড না, যেটা তুমি ব্রাজিলে স্তেনিস্কের উপর প্রয়োগ করেছিলে?”

আমি ঘার নেড়ে হ্যাঁ জানালাম। রবার্ট আমার বাথরুম কথায় জিজ্ঞাসা করতে আমি আমার ল্যাবোরেটরি সংলগ্ন বাথরুমে যেতে বলি। এমন সময় আমার পোষা বেড়াল মিনিস্টোন ডেকে উঠলো আর সাথে সাথে আমার মাথা ঘুরে গেলো, আমি যেন এসব ঘটনার কথা আগে থেকেই জানি, কিন্তু কথায় কি ভাবে ঘটেছে সেসব কিছু মনে করতে পারছিলাম না। মিনিস্টোনের এখন ওজন ও বয়স দুই বেড়েছে ফলে ও তেমন আগের মতো চলাফেরা করতে পারেনা। মিনিস্টোন ভেতরে প্রবেশ করার পর টেবিলে হালকা ধাক্কা দিয়ে ঢোকে ফলে টেবিলের উপর উন্মুক্ত হয়ে থাকা অ্যাসিডের জারটা কাট হয়ে পড়লো মিনিস্টোনের গায়ে। বীভৎস আর্তনাদ করে চেঁচিয়ে উঠলো মিনিস্টোন, ওর কাছে দাঁড়িয়ে থাকার কারণে আমার হাতে কয়েক ফোঁটা ছিটা পরে অ্যাসিডের আর সাথে সাথে ফোস্কা পরে যায় হাতে।

এই অ্যাসিড থেকে বাচার একটা বিকল্প রসায়ন আছে আমার কাছে, সেটা লাগালে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে আবার নিরাময় পাওয়া যায়। আমি তাড়াতাড়ি সেটা কথায় আছে খুঁজতে লাগলাম। এমন সময় রবার্ট বাথরুম থেকে বেড়িয়ে এলো, আমার দিকে বন্দুক দাগিয়ে Cabhrach-র মস্তিস্ক কথায় আছে জানতে চাইল। আমি বলতে ও দিতে অস্বীকার করতে ও আমার দিকে একটা মোটা বই ছুঁড়ে মেরে নিজে থেকেই খুঁজতে লাগলো Cabhrach-র মস্তিক। সব আবিষ্কৃত জিনিশ একটা একটা করে ছুঁড়ে ফেলতে লাগলো। এর পর যখন সেটা পেলো নিজের পকেটে ভরে বাইরে বেড়িয়ে যেতে লাগলো। আমি বাঁধা দেওয়াতে আমার দিকে আচমকাই একটা গুলি ছুঁড়ে দিলো, গুলিটা আমার লাগলো না ঠিকই কিন্তু রবার্ট Cabhrach-এর মস্তিস্ক নিয়ে বাইরে বেড়িয়ে গেলো। যতক্ষণ আমি বাইরে এলাম ততক্ষণে রবার্ট গাড়ি নিয়ে চলে গেছে।  আমি ল্যাবরেটরিতে ফিরে দেখি অ্যাসিডের বিষাক্ত ধোঁয়া ল্যাবরেটরিকে গ্রাস করেছে, আমি সেখানেই বোধয় জ্ঞান হারাই।

…..এখন জ্ঞান ফেরার পর ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে যখন ৫ বছর আগের সেই ঘটনার সাথে আজকের এই ঘটনার হুবহু মিল পাই, তখনই এই মেশিন F-Visiva-র গুরুত্ব পায়। নিজের অজান্তেই যে আমি একটা বিস্ময়কর জিনিস আবিষ্কার করেছি এতে কোন সন্দেহ নেই, এবার এটাকে সঠিক ভাবে কাজে লাগাতে হবে। আজ থেকে ৫ বছর আগে জানতে পেরেছিলাম যে রবার্ট কিছু একটা চুরি করবে, কিন্তু সেটা কি জানতে বা বুঝতে পারিনি। আজ মিনিস্টোন মারা যাবে জেনেও তাকে বাচাতে পারিনি। কিন্তু এবার আর নয়, Cabhrach-এর মস্তিস্ক কিছুতেই আমি অন্যের হাতে যেতে দিতে পারিনা। রবার্টের কাছ থেকে ওটা আমাকে নিতেই হবে, প্রয়োজনে আরও এক বার ওই মেশিনে আমি বসবো, ও ভবিষ্যতে যাবো।

১৮-০৫-১৯৮৫

আজ সারাদিন যা যা ঘটল তা উল্লেখ করতে গেলে F-Visiva-র কথা একটু বলা দরকার। কাল রাতে আমি F-Visiva-র কিছু মেরামত করি ও সেটাকে আবার চালানোর মতো অবস্থায় ফিরিয়ে আনি। F-Visiva-য় করে আমি ভবিষ্যতে যেতে তো পারবো, কিন্তু ফেরার পথ আমার জানা ছিলনা। কিন্তু তবুও ঝুঁকি নিয়ে আজ সকালে মেশিনটাতে আমার সমস্ত প্রয়োজনীয় সামগ্রী নিয়ে ভবিষ্যতে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হই। F-Visiva-র সামনে থাকা Control Panel-র উপর থাকা সংখ্যা গুলিকে ব্যবহার করে ভবিষ্যতে যাওয়ার সময় নির্ধারণ করলাম ১৯-০৫-১৯৮৫; দুপুর ২ টা। এর পর F-Visiva-র হাতলের সাহায্যে মেশিনটাকে অন করে দিলাম। আমর চোখের সামনে ঘটতে লাগলো ৫ বছর আগের সেই পুনরাবৃত্তি। সেই জোরালো Single line শব্দ, বৈদ্যুতিক আলোর চমক আর তারপর সম্পূর্ণ সাদা আলোর জগৎ । যখন মেশিনটা থামল তখন ল্যাবোরেটরির ঘড়িতে সময় পুরো কাঁটায় কাঁটায় ১২ টা। ল্যাবোরেটরির দরজা থেকে বাইরের দিকে মুখ বারিয়ে দেখি আমারই মতো আরও একটা প্রোফেসর সদাশিভ রায় টেবিলে বসে ডাইরি লিখছে। আমি ল্যাবোরেটরি সংলগ্ন একটা গুপ্ত রাস্তা ধরে বাইরে বেড়িয়ে যাবো বলে ঘুরতে যাবো এমন সময় দেখি, আমার প্রতিবেশী প্রভাকর বাবু, এসে হাজির।

প্রভাকর বাবু সোজাসুজি টেবিলে বসে থাকা আগামীকালের রায়-কে বলল,- “কি ব্যাপার, প্রোফেসর রায়, শুনলাম আপনার কি একটা বিশেষ জিনিশ খোয়া গেছে, কিন্তু কি ভাবে টা হল। শুনে খুব খারাপ লাগলো, তা পুলিশে খবর দিয়েছেন? দেখলাম বেশ কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে থাকার পর আগামী কালের আমি মাথা তুলে প্রভাকর বাবুর দিকে বিষন্ন চোখে তাকিয়ে চেয়ারে বসার ইঙ্গিত করলেন। তারপর ম্লান গলায় ঘার নেরে উত্তর দিলো- “না, কিভাবে জানাবো, আমার এই আবিষ্কারের ব্যাপারে এখনো তেমন কাউকে জানাই নি। কাকেই বা জানাবো, দেখলেন তো একজন কে জানানোর ফল” এর পর প্রভাকর বাবু বললেন, আপনি সেবার Cabhrachকে দেখিয়ে যখন ওর মস্তিস্কের বিষয়ে কথা বলছিলেন তখন মনের মধ্যে খুব ইচ্ছা জাগছিল, তাই কাল আসবো ঠিক করে ছিলাম, কিন্তু কাল আপনার সাথে অমন একটা ঘটনা ঘটায় কাল না এসে আজ এলাম। আপনি নিশ্চই কিছু একটা ব্যবস্থা নিন ওঁর বিপক্ষে, না হলে…..

আমি আর বেশিক্ষণ সেখানে দাঁড়ালাম না, তাড়াতাড়ি বেড়িয়ে পড়লাম রবার্টের আস্তানার দিকে। আগে বহু বার, বিগত দুই বছর ধরে প্রায় সময় বিভিন্ন কাজের উদ্দেশে তাকে ভারতে আসতে হয়েছে, ফলে তার এখানে নিজস্ব একটা বারিও রয়েছে। আমার বিষাস সে এতো তারা তারি দেশ ছেরে যাবে না, সে নিশ্চই রয়েছে তার নিজস্ব গুপ্ত ডেরায়। আমার ধারনা অনুযায়ী রবার্ট এখন তার বাড়ির নিজে একটা গোপন সিঁড়ির পথ ধরে মিলিয়ে যাওয়া মাটির নীচে রয়েছে একটা গোপন ও সুরক্ষিত আস্তানায়। আমাকে একবার নিয়ে এসেছিল রবার্ট, কিন্তু সেই গোপন দরজা খোলার যে বিশেষ কায়দা আছে সেটা সে আমায় জানায় নি। যদিও তাতে বড় একটা সমস্যা হবে না, কারণ আমি নিজের সাথে এনেছি Transpa Stick, এর সাহায্যে যে কোন যায়গায়, যে কোন অবস্থায় আমি প্রবেশ করতে পারবো ও বেরিয়েও আসতে পারবো।

আমি আমার বারি ধানপুর থেকে একটা গাড়ি ধরে ১৫০ কি.মি দূরে আরসাদ পুর এলাম রবার্টের বারি। দুবার মনে হল হুঙ্কার দিয়ে রবার্টের নাম ধরে ডাকি, কিন্তু তা করলাম না। উত্তেজনা সামলে রবার্টের ঘরে ঢুকলাম, দরজাটা খোলা কেন ছিল তা বুঝতে পারলাম না, ওঁর সিঁড়ির নিচের রাস্তা ধরে নীচে নামতে শুরু করলাম। একটু হাঁটার পর আলো ধীরে ধীরে কমে জেত্র লাগলো, এরপর আলো পুরো নিভে গেলো। কিন্তু আমি হাঁটা বন্ধ করলাম না, এক সময় একটা নীলচে আলো আর সামনে থাকা দেওয়ালের উপর একটা হালকা সবুজ আলোয় আঁকা একটা সাঙ্কেতিক কঙ্কালের মুণ্ডু। তার দুটো চোখের গর্তের মধ্যে একটাতে বেশ কিছু সংখ্যা আর একটাতে কিছু ইংরেজি অগোছালো এলোমেলো বর্ণ।

আমি এই সাঙ্কেতিক অর্থ না খুঁজে Transpa Stick ব্যাবহার করাই সঠিক বলে মনে করলাম, কারণ এই সাঙ্কেতিক অর্থ যখন মিলে যায় তখন এক ভয়ানক জোরে শব্দ করে গোপন রাস্তা খোলে তাই এই ক্ষেত্রে আমার Transpa Stick বেশি কাজের ও সুরক্ষিত। Transpa Stick-এর সাহায্যে একটা বৃত্য আকৃতির ঘড় এঁকে এর ভিতর থেকে প্রবেশ করলাম। প্রবেশ করার পর যা দেখালাম তাতে আমার চোখ চড়ক গাছ হয়ে গেলো, উপরের ছাদ থেকে নিচের দিকে ঝুলছে মোটা স্টিলের ধারালো মাঝারি গোছের মোটা লম্বা পাত। পাত গুলো পাশাপাশি ভাবে এপার থেকে ওপার আর ওপার থেকে এপার হচ্ছে, আর এমন ভাবে ১ ফুট পর পর একটা করে ধারালো পাত। পাশে পরে থাকা একটা কাঠের টুকরো ধারালো পাত গুলোর দিকে ছুরতেই নিমিষে সেটা দু-টুকরো হয়ে গেলো।

আমি ব্যাগ থেকে Astro Pauser বেরকরে এক ঝাঁক আলোক রশ্মি এই ধারালো পাত গুলোর উপর পরতেই এগুলি স্থির হয়ে গেলো। আমি অতি সাবধানে আসতে আসতে সেগুলিকে স্পর্শ না করে চলে গেলাম রবার্টের প্রধান গোপন গবেষণা গারে। একটা বন্ধ কাঁচের ঘরে রবার্ট আর আরও দুজন একটা গোল টেবিলের অপর ঝুঁকে পরে কি যেন বেশ একটা করছে। ওই অপর দুজনের মধ্যে এক জনকে আমি খুব ভালো ভাবেই চিনি, ও হল হেলিয়াস, রাশিয়ান পদার্থ বৈজ্ঞানিক। গত বছর রাশিয়ায় বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে ওঁর সাথে আমার চরম অশান্তি বাঁধে, কিন্তু ও যে ওখানেই থেমে থাকে নি আর রবার্টের সাথে ষড়যন্ত্র করে এখানে পর্যন্ত আসবে সেটা আমি কল্পনা করতে পারিনি। কাঁচের ঘরটার পাশে আরও একটা লম্বা কাঁচের টেবিল, পাশে রবার্টের বৈজ্ঞানিক সরঞ্জাম আর টেবিলে শোয়ান রয়েছে Cabhrach-র মতো একই রকম একটা যান্ত্রিক রোবট।

আমি ওদেরকে আর বেশিক্ষণ অভাবে দেখতে পাচ্ছিলাম না, আমি চিৎকার করে ডাকলাম,-

– রবার্ট, ছিঃ তুমি এরকম জঘন্য কাজ করবে আমি ভাবতে পারিনি। লজ্জা করেনা তোমার, এভাবে অন্য কারও আবিষ্কার চুরি করে নিজের নামে চালিয়ে দিতে।

–  লজ্জা, how funny, এতে আবার লজ্জা পাওয়ার কি আছে। আমার দরকার টাকা, তোমার এই Cabhrach -ই আমার মনে দাগ কেটে ছিল, তারপর তোমার আবার এই মস্তিস্কের আবিষ্কার, ছাড়া যায় বল। আর কি বলছিলে ‘লজ্জা’ না, এ সব লজ্জা-টজ্জা আমি খুব একটা পাই না, লজ্জা তো তোমার করার কথা, অনুমতি না নিয়ে কারো ঘরে এবাবে প্রবেশ করার জন্য, you bloody brilliant” আমায় দেখে রাগে গদ গদ করেতে করতে বলল রবার্ট।

–  আমি সোজাসুজি বললাম,  ওটা আমাকে ফেরত দাও রবার্ট, না হলে কিন্তু এর ফল মারাত্মক হবে।

–  তুমি কি পাগল হয়ে গেলে ‘রয়’, তুমি ভাবলে কেমন করে যে এটা তুমি আবার ফেরত পাবে, এর দাম ইতি মধ্যেই আকাশ ছুঁয়েছে রাশিয়ায়। ভালোয় ভালোয় ফিরে যাও না হলে এই আবিষ্কারই তোমার শেষ আবিষ্কার হবে।

–  আমি শেষ বারের মতো বলছি রবার্ট, দেবে কি না? আমার সারা শরীর রাগে জ্বলছিল, কিন্তু রবার্ট-ও যেন আরও বেশি জ্বলছিল আমার থেকে আমার থেকে সে বন্দুক নিজের কম থেকে বের করলো তার পর সেটাকে আবার আমার দিকে দাগিয়ে বলল

–  বেশি কথা বলে ফেলছ না প্রোফেসর রয়, আর একটা বাজে কথা বললে এখানের তোমার লাশ ফেলে দেবো and no one ever find you, you know. Now you just escape from here না হলে… মুখে পৈশাচিক হাঁসি এনে বন্দুকের ট্রিগারে আঙুল রেখে বলল রবার

–  এ ভয় আমাকে দেখিয়ে কোন লাভ হবে না রবার্ট। আমি কথা বলতে বলতে ওঁর দিকে এগিয়ে যেতে থাকলাম, তার পর ওঁর কাছে পৌঁছাতেই আচমকা আমার পেছন থেকে দাপছে ধরল হেলিয়াস আর আরও একজন। আমি আর নড়তে-চড়তে পারলাম না, রবার্ট উচ্চ স্বরে হাঁসতে লাগলো।

–  এখন তোমাকে তোমার ই আবিষ্কার করা এই মস্তিস্কের ক্ষমতা ও গুন একটু দেখাই, তার পর তোমার আবিষ্কারের হারেই তোমার মৃত্যু লিখে দেবো, কেমন?

আমাকে দাপচে ধরা পেছনের দুজন ও রবার্ট তিন জনেই হাঁসতে লাগলো। রবার্ট টেবিল থেকে কাঁচের বাক্স টা হাতে তুলে নিলো, এর পর তার ঢাকনাটা খুলে ভিতর থেকে বের করলো নীল উজ্জ্বল মস্তিস্ক চিপ The Cerebrum.  আমি নির্বাক ডানা কাটা পাখীর মতো ছটফট করছিলাম, ইচ্ছা করছিল টান মেরে ছিনিয়ে নিই ওটা রবার্টের কাছ থেকে কিন্তু আমি নিরুপায় ছিলাম। রবার্ট চিপটাকে বের করে নিজের হাতে ধরল এর পর এগিয়ে  গেলো টেবিলে শোয়ান রোবট টার দিকে। আমি এবার অধৈর্য হয়ে উঠলাম, আমি ছটফট করতে লাগলাম। আমাকে ধরে থাকা ওরা দুজন ও বিরক্ত হয়ে গেল আমার জন্য, কিন্তু এসব না দেখে নেশায় মগ্ন রবার্ট এগিয়ে চলল টেবিলের দিকে।

আমি লক্ষ করলাম আমার পায়ের কাছে একটা স্টিলের বল জাতিয় কিছু পরে রয়েছে, সেটাতে একটা লাথি মারলাম রবার্ট কে লক্ষ করে। বলটা দিয়ে লাগলো সোজা ওঁর হাতের, সাথে সাথে ওঁর হাত থেকে পরে গেলো চিপটা। রবার্ট রক্ত লাল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে এগিয়ে এলো, কোন কথা না বলে আমার গালে একটা সজোরে চড় বসিয়ে দিলো, তারপর আমার পেটে একটা ঘুষি মেরে চিপটাকে খুঁজতে লাগলো। আমি অসহ্য যন্ত্রণায় পেটে হাত দিয়ে বসে পরলাম। যারা আমাকে ধরে ছিল তারা এখন আমাকে আর ধরে নেই, আমি এই সুযোগে ব্যাগ থেকে Astro Pauser বের করে ওদের দুজনের দিকে আলোক রশ্মি প্রয়োগ করতেই সাথে সাথে ওরা দুজন নিঃশব্দে স্থির হয়ে গেলো।

এরই মধ্যে রবার্ট চিপটাকে খুঁজে নিয়েছে ও সেটাকে নিয়ে রোবট-র মাথার পেছনের অংশে দেওয়ার জন্য রোবট-টাকে টেবিলে তুলে বসিয়েছে। আমি নিরুপায় হয়ে হাতে ভয়ানক অ্যাসিড সালফিউরিক ল্যাসাফিউরিন এর জারটা নিয়ে রবার্টের উদ্দেশে বললাম,- “রবার্ট, আমি শেষ বারের মতো তোমায় সাবধান করে দিচ্ছি, আমায় বাধ্য করো না, রবার্ট!”  কিন্তু নেশায় আক্রান্ত বৈজ্ঞানিক আমার কথাকে কর্ণ পাত না করে চিপটা রোবট-র মাথার কাছে নিয়ে গেলো,  চিপটা মাথায় দিতে যাবে এমন সময় আমি জারের ঢাকনা খুলে বেশ কিছুটা অনুতাপ বোধ করে কিন্তু নিরুপায় হয়ে ছুঁড়ে দিলাম সালফিউরিক ল্যাসাফিউরিন-এর মতো মারণ অ্যাসিড রবার্টের ওপর।

অ্যাসিড রবার্টের মুখে পরতেই চিৎকার করতে লাগলো ও ছটফট করতে লাগলো যেমন করছিল আমার পোষা বিড়াল মিনিস্টোন। এমন ভাবেই ছটফট করতে দেখেছিলাম তাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই রবার্টের মুখের হার বেড়িয়ে এলো অ্যাসিড প্রয়োগের ফলে, মাটিতে পরে মারা গেলো রবার্ট। বাকি দুজন যারা স্থির হয়ে গিয়ে ছিলো তারা আরও কিছু ঘণ্টা পর সাধারণ অবস্থায় ফিরে আসবে ও ওর মধ্যের না খেতে পেয়ে মরবে কয়েক মাসের মধ্যে। কারণ ওই ঘর থেকে বেড়িয়ে আসার রাস্তা শুধু রবার্ট-ই জানত।

১৯-০৫-১৯৮৫

আজ সকালে আমার ল্যাবোরেটরিতে টেবিলের পাশে F-Visiva র পাশের কাঁচের বাক্সে রাখা নীলচে উজ্জ্বল মস্তিস্ক The Cerebrum-কে পরে থাকতে দেখি। সেটাকে একটা সুরক্ষিত যায়গায় তুলে রাখি। আজ প্রভাকর বাবু এসে ছিলেন, দুঃখ প্রকাশ করলেন আমার খোয়া যাওয়া জিনিশ টার জন্য কিন্তু যখন শুনলেন যে সেটা আমি আবার খুঁজে পেয়েছি তখন এক গাল হাঁসি নিয়ে Cabhrach-এর বানানো কফি খেয়ে বারি ফিরে গেলেন।

২০-০৫-১৯৮৫

আজ সকালে কাগজে রবার্টের মৃত্যুর কথা জানতে পারলাম। রবার্টের কোন এক বৈজ্ঞানিক বন্ধু নাকি জানতেন তার এই গোপন আস্তানার কথা। সেই নাকি প্রথমে তাকে বাড়িতে খুঁজে না পেয়ে সে গোপন আস্তানায় গিয়ে ওদের দেখা পায়। রবার্ট কে তারা সেই রকম ঝলসানো অবস্থায় পায়, আর বাকি দুজনকে তারা দেখতে পায় নি, কিন্তু আস্তানায় ঢোকার সময় যেই অংশে ধারালো পাতের আনাগোনা, তার দেওয়ালে ছোপ কাটে বেয়ে পড়া আধ শুকিয়ে যাওয়া লাল রক্তের দাগ। পরে পুলিশ টুকরো টুকরো হয়ে থাকা শরীর খুঁজে পেয়েছে নিচের কিছু পাতের নিচ থেকে। কিন্তু ওই টুকরো শরীর পাতের নীচে কেমন করে গেলো পুলিশ তার অনু সন্ধান চালাচ্ছে। রবার্টের মৃত্যুর জন্য তার কোন নতুন আবিষ্কারের কারণ হিসেবে দেখিয়েছে। লিখেছে, কোন এক নতুন experiment করতে গিয়ে অসাবধানতার কারণে অ্যাসিডের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে ইংরেজ বৈজ্ঞানিক রবার্ট জন-এর।

কিন্তু খুব খারাপ লাগছিল এই ভেবেই যে, গত দুই দিনে আমি তিন জন মানুষ কে খুন করেছি। কিন্তু আমার কাছে কিছু উপায় ছিলনা যে। ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি যেন ওদের আত্মা শান্তি পায়। আজ সন্ধ্যায় Cabhrach-এর মধ্যে নতুন মস্তিস্ক install করিয়েছি, এখনো তেমন কোন পরিবর্তন লক্ষ করিনি শুধু তার মুখে একটা নতুন শব্দ শুনতে পাচ্ছি। সে আজ প্রায় অনেক বার একটু স্পষ্ট ঘষা ঘষা Robotic ভাষায় বলছে ওদের আত্মা শান্তি পাক প্রোফেসর, ওদের আত্মা শান্তি পাক”।

 

~ প্রোফেসর রায়-এর F- Visiva ~

Print Friendly, PDF & Email
Previous articleগার্ডিয়ান এঞ্জেল
Next articleআশার আলো
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments