পূজনীয় মাষ্টারমশাই –

প্রনাম নেবেন।

আমায় আপনি চিনবেন না, চেনার কথাও নয়; কারন আপনার দৃষ্টি অতদুর কোনদিন পৌঁছায়নি।

কখনো ক্লাসে জুতো ঘসার শব্দ শুনেছেন, কখনো টেবিলে এসে পড়েছে কাগজের এরোপ্লেন, কখনো লজ্জায় অপমানে চেয়ারে ঘসা বিচুটির অত্যাচারে ক্লাস ছেড়েছেন, কখনো বা বোর্ডে আঁকা পশুপাখির পাশে আপনার নাম দেখেছেন; আর  এ সবের পরিনতি একটাই, লক্ষ্য আমি, কখনো বেত্‌ পড়েছে হাতে, কখনো পিঠে, কখনো ডাষ্টার ছুটে এসেছে আমার দিকে বিদ্যুত গতিতে, আর এসবই করেছেন চোখ বন্ধ করে, তাই আমাকে চিনতে পারবেন না-

আমি হলাম আপনার শেষের বেঞ্চের ছাত্রটি ।

মাষ্টারমশাই, ভূগোল আমি ভালবাসি।

মনে মনে আশা ছিল, গ্রীনিচ্‌ থেকে শুরু করে একদিন গ্রীনিচে গিয়েই থামবো|

কিন্তু ভূগোল ক্লাসের শুরুতেই আপনার রাঙা জবার মত চোখ আর অকারনে বিরক্তি ভরা মুখ, যাত্রা শুরুর সমস্ত উৎসাহ-ই শেষ করে দিল| তখন আমি শেষ বেঞ্চে বসে বসেই, সাহারা মরুভূমিকে রাজস্থানে নিয়ে গিয়ে স্থাপন করি, ঢাকাকে করে তুলি আমেরিকার নতুন রাজধানি, নাইল নদীর তীরে অপেক্ষায় থাকি তাজমহলের প্রতিফলনের, আর ইটালির পতাকায় সযত্নে বসিয়ে দিই চাঁদ তারাকে|

ব্যাস ! থেকে গেলাম শেষ বেঞ্চেই, আর এগোনো হোলোনা ।

মাষ্টারমশাই, ইতিহাস জানতে খুব ইচ্ছে হয়।

ইচ্ছে হয়, মহিঞ্জদারোর সেই মেষ শাবক্‌টিকে নিয়ে আ্যলেক্‌জান্ডারের ঘোড়ার পেছোনে চড়ে, হুমায়ুনের রাজ্য পেরিয়ে, লর্ড মাউন্টব্যটেনের দরবারে গিয়ে সেলাম ঠুঁকি। কিন্তু ক্লাসে আপনার এলোমেলো, প্রস্ততি ছাড়া, অবহেলার স্বরে পড়ানো আর গতানুগতিক প্রশ্ন পত্র থামিয়ে দিল ইচ্ছের ঘোড়াটাকে।

তইমুরলন নির্মিত আশোক চক্রের পাদদেশে বসেই শুনলাম পানিপাতের যূদ্ধে রাজা বল্লাল সেনের বিজয় রথের উল্লাস, সাক্ষী রইলাম আকবর ও দ্রৌপদীর প্রেম কাহিনীর, আর অবাক হলাম লর্ড করনাওয়ালিশের রাজগৃহে বাবর্চি তান্‌সেনের কর্ম নৈপুন্যতা দেখে।

আর অবাক হয়েই থেকে গেলাম, ক্লাসের শেষ বেঞ্চে, আর এগোনো হোলোনা।

মাষ্টারমশাই, একদম ছোটো বেলায় অঙ্কটা নাকি ভালো পারতাম।

তাই মনে মনে একটা সাহস ছিলো স্কুলে গিয়ে চোখের পলকে জটিল সমীকরনগুলোকে সমাধান করে ফেলবো, বীজ্‌গনীতের বেপোরয়া স্বভাবগুলোকে নিমেষে পোষ মানিয়ে নেবো,

কিন্তু মাষ্টারমশাই, কত ছোটো ছোটো যোগ ভাগকেও কত সহজে জটিল করে তুললেন, আর পড়িয়ে গেলেন নিজের জ্ঞানের দশতলায় দাঁড়িয়ে। একতলায় নেমে খোঁজও নিলেন না কখন আমি ডান দিকের বদলে দশমিকের বাঁদিকের শুন্যটা উড়িয়ে দিয়েছি ত্রিভূজের চারটি কোনকে জুড়ে তিনশো ষাট ডিগ্রী ঘুরিয়ে দিয়েছি আর বৃত্তের আটটি বাহুকে সাজিয়ে, সুন্দর একটা ঘুড়ি তৈরী করেছি –

ঘুড়ি উড়ল- কিন্তু আমি থেকে গেলাম একি জায়গায়, আর এগোনো হোলোনা।

মাষ্টারমশাই, বড়দের বলতে শুনেছি বিষয়ের সেরা ভৌতবিজ্ঞান।

তাই মন ছটপট করতো সেই আপেল গাছটাকে কাছ থেকে দেখার, একটা সাদামাটা আলোকে সাতটা রঙে মাতিয়ে তোলার ম্যাজিক শিখ্‌তে|

কিন্তু তার চেয়েও বড়ো মাজ্যিকের মত, আদি অনন্তকাল ধরে চলে আসা আপনার হলুদ চিরকুটটা এক ঝলকে সমস্ত গ্রাস করে ফেললো। গবেষনা চলে, আবিষ্কার হয়, বিজ্ঞান সামনে তাকায়, কিন্তু আপনার চিরকুট অটল, অবিচল।বিরক্তিতে, রাগে, চাঁদের মাধ্যাকর্ষনকে বাড়িয়ে করলাম পৃথিবীর ছ গুন, আলোকে বাধ্য করলাম বক্র পথ ধরতে, আর শব্দকে শূন্যের মধ্যে দ্রুতগামি করে তুল্‌লাম।

রাগের ফল ?

থেকে গেলাম নিজের জায়গায়, আর এগোনো হোলোনা।

মাষ্টারমশাই, সমস্ত রহস্যের সমাধান শুনেছি রসায়ণ দেয়।

অপেক্ষায় ছিলাম, কবে ইস্কুলে গিয়ে ওই অনু-পরমানু গুলোর সঙ্গে ভাব জমাবো, তারপর হাইড্রজেন বন্ডগুলোকে পকেটে করে বাড়িতে এনে ইচ্ছেমত কখন জল, কখন বাষ্প, কখন বরফ বানাব। শুধু প্রয়োজন মাষ্টারমশায়ের পরামর্শ আর অভিজ্ঞতা।

বেশ কয়েকবার ঘুরেছি মাষ্টারমশায়ের পেছন পেছন, কিন্তু সে ব্যস্ত মানুষ; চোখে, মুখে, ভাবে ভঙিতে, কারনে অকারনে ব্যস্ততা, কখন ক্রিকেটের ধারাবিবরনীতে, কখন ডি-এ মিটিং-এ, কখন বা আলু বিলের জল পাওয়াতে।

ক্লান্ত হয়ে শেষে নিজেই কার্বন-ডাইক্সাইডের হাইড্রোজেন পরমানুটিকে নিয়ে হাঁটা দিলাম।  বইতে না পেরে সোডিয়ামকে ছেড়ে দিলাম পর্যায় শ্রেনীর ঠিক আইয়োডিনের ওপরে।আর সেই ক্লান্তির জেরেই থেকে গেলাম শেষ বেঞ্চে, আর এগোনো হোলোনা।

মাষ্টারমশাই, অস্বীকার করবো না, একটু ভয় পেতাম ইংরেজীকে।

কিন্তু সাহেবদের ভাষা, শিখতেই হবে, দৃঢতা ছিলো মনে।

ভেবে রেখেছিলাম মিলিয়ে দেখবো আমাদের বসন্তের কোকিলের সঙ্গে  Wordsworth-এর নাই্ট্যাঙ্গেলের কোনো মিল আছে কিনা। খুঁজে দেখবো Byron-এর সেই সূন্দরী আসলে কে;  সত্যি কি সেক্সপিয়ারের সাইলক্‌ ছিলো নৃশংস ?– এসবের উত্তরের জন্য ইস্কুলি ভরসা!

মাষ্টারমশাই, আপনার অহংকারি উঁচু নাক, আর ক্লাসের ভালো ছেলেদের নিয়ে আদিখ্যেতা, আর বার বার “ইংরেজী তোদের  জন্য নয়” এই তিনে মিলে বাড়িয়ে তুলল আতঙ্ক।

আর আট্‌কে রইলাম সেই GO –গো তে আর TO-টো তেই, আজো পারলাম না নটা vowel  মুখস্থ করতে,

আর আমার “sun climbs above the east”  শুনে নাকি সাহেবদের দেশে সূর্য ওঠাই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল বেশ কিছু দিন,

শাস্তি স্বরুপ-

পড়ে রইলাম শেষ বেঞ্চেই, আর এগোনো হোলোনা।

মাষ্টারমশাই, মাতৃভাষায় জানি মাতৃদূগ্ধ।

বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে দখল আনতে গেলে তো আর যাকে তাকে দিয়ে হয়না, মাষ্টারমশাই-র বড্ড প্রয়োজন।

স্বপ্ন ছিলো আমিও একদিন লিখবো, গদ্যে আগুন ঝরাবো, পদ্যে কফি হাউস মাতাবো।

কিন্তু আমাদের পনেরো পাতা হাতের লেখা করতে দিয়ে টেবিলে মাথা রেখে যখন আপনি ভাবতে শুরু করলেন, দূর থেকে আপনাকে দেখে চোখ বন্ধ করে আমিও ভাবতে শুরু করলাম।

একটু পরেই দেখি আমাদের মাইকেল আফ্রিকায় বসে শেষের কবিতা লিখতে ব্যস্ত, আর পাশে বিভূতিভূষনের মহেশ আপন মনে ঘাঁস খেয়ে চলেছে আর তাই দেখে বঙ্কিমবাবুর ছোট্ট মিনির সে কি আনন্দ।

তার পর ঘুমটা ভাঙতেই দেখি ক্লাসে কেউ নেই, সবাই চলে গেছে, আমি বসে শেষ বেঞ্চে, আর এগোনো হোলোনা।

মাষ্টারমশাই জানেন, আমার দৃঢ় বিশ্বাস আমি একদিন পড়াশুনায় আবার আনন্দ পাব, আবার ফিরে পাবো আগ্রহ, আর ঠিক এগিয়ে যাব প্রথম বেঞ্চে, শুধু আপনার হৃদয়টা নিয়ে একটু যদি এগিয়ে আসেন। এ আমার অভিযোগ নয়, অনুরোধ মাত্র।

ইতি-

শেষের বেঞ্চের ছাত্রটি।।

 

~ মাষ্টারমশাই-কে খোলা চিঠি ~

 

Print Friendly, PDF & Email
Previous articleবসন্তের অন্ধকার
Next articleল্যাম্পপোস্টের নীচে
Pijush Ghosh
I am an Associate Professor in the Department of Applied Mechanics, IIT Madras. I love writing things related to school students.
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments