ইস্কুল বন্ধ অনেকদিন। বিক্রিবাট্টা একেবারে তলানিতে ঠেকেছে। এ পাড়া ও পাড়ায় আলু কাবলি-চুড়মুড় নিয়ে দাঁড়িয়ে কত আর আয় হয়। শুধু বিকেলবেলাটা। আর সারাদিন ত হাঁ করে থাকা।

ইস্কুল খোলা থাকলে গেটের সামনে দাঁড়ালে টিফিন আর ছুটির সময়টা ভালোই বিক্রি হয়। বাকি সময়টা এদিক ওদিক ফেরি করে চলে যায়। এভাবে চলে কোনোমতে।  কিন্তু এখন একেবারে বাজে অবস্থা।

ছেলেকে জোর করে লেখাপড়াটা শিখিয়ে নিয়েছিল দীনেশ। ইস্কুলের গেটে রোজ রোজ গিয়ে টিফিন বিক্রি করে ও এটা বুঝেছিল যে লেখাপড়া শিখলে বাবু হওয়া যায়। বাবুদের ছেলেরা গাড়ি করে আসে ইস্কুলে- ওদের বাবারা ঠাকুর্দারা ভালো করে লেখাপড়াটা করে নিয়েছিল। লেখাপড়াটা বংশে ঢুকে যায়।

ছেলেকে ভর্তি করেছিল ফ্রি ইস্কুলে। কিছুতেই প্রথমদিকে যেতে চাইত না। অনেক মেরে ধরে দীনেশ ছেলেকে ইস্কুলে পাঠাত। পরের দিকে প্রায়ই শরীর খারাপের অজুহাত দিয়ে কামাই করত। জানতে পেরে তিনদিন খেতে দেয়নি ছেলেকে দীনেশ। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি, মা লুকিয়ে খাইয়ে দিয়েছিল ছেলেকে। যদিও সেটা টের পেয়েছিল দীনেশ, কিছু বলে নি।

নতুন একটা মাস্টার এসেছিল তারপর ইস্কুলে। কি যাদু করে দিল- ছেলের মন এসে গেল লেখাপড়ায়। আর একবারই ইস্কুল পালিয়েছিল তারপর। ঐ মাস্টার কয়েক বছর পরই অন্য ইস্কুলে চলে গেল। ততদিনে ছেলে একটা পাশ করে পরেরটা পড়ছে।

দু বছর পর আরেকটা পাশ দিতে গিয়ে পারল না। ঘা খেয়েছিল খুব, পরের বার উতরে গেল। খুব খুশী হয়েছিল দীনেশ। ওর ততদিনে বয়স হয়েছ- মনে মনে ভেবেছিল এরপর ছেলে ভাল কিছু কাজ করে অবস্থা ফেরাবে বাপের।

টিউশনি করে এখন দীনেশের ছেলে। দুখানা। ঠিক সময়ে মাইনেও পায় না। যাই হোক, আস্তে আস্তে এগোবে। বংশে লেখাপড়া ঢুকেছে, দীনেশ মনে মনে হাসে।

এই করোনা র বাজারে টিউশনির মাইনে মোটে হচ্ছে না। অটোওলা দোকানদারদের ছেলেমেয়েদের পড়ায়। ওদের রোজগার বন্ধ আর টিউশনি মাস্টারকে বেতন দেবে কিভাবে?

হাতে ধরা বিড়িটার দিকে তাকাল দীনেশ। বিড়িটা জ্বলে জ্বলে ফুরিয়ে যাচ্ছে। ঠিক ওর পয়সার মত। ছেলের জমানো টাকা ফুরিয়ে আসছে ঠিক ওভাবে। আজ আর বিকেলে ফেরি করতে বেরোয় নি দীনেশ। বিরক্তি ধরে গেছে- খামোখা ঘুরঘর- কোনো লাভ হয় না।

সন্ধ্যা নামার পর ছেলে এল কোত্থেকে যেন। বাড়ির সামনে বাবাকে দেখে তাকাল। বলল ‘আজ থেকে আর একটা টিউশনি ধরলাম, একদম চিন্তা ছাড় বাবা।’ ‘টাকাকড়ি দিবে ত রে?’ ঠাট্টার সুরে জিজ্ঞাসা করল দীনেশ ছেলেকে। -‘হাঁ দিবে ত, এরা ফেলাটে থাকে, গাড়ি আছে।’ দীনেশের মুখে হাসি দেখা দিল। একটা গর্ব বোধ করল ছেলের জন্য, ছেলেটা বড় হচ্ছে।

পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢুকল ছেলে। ওর বাবা জানে না- ও কোনো নতুন ছেলে পড়াতে সুযোগ পায় নি, ওর টিউশনি দুটোও গেছে গত সপ্তাহে।  পুকুরের ওধারে যে ভাটিখানা, যেখানে চোলাই মদ তৈরি হয় দরমার দেয়ালের আড়ালে, বলে কয়ে ওখানেই একটা কাজ জুটিয়েছে ও। চোলাই ভেজানো, বোতলে ভরা, মাতালদের খাওয়ানো এইসব কাজ। মাইনেটা ভালোই দেবে, টিকে গেলে বেড়েও যাবে।

Print Friendly, PDF & Email
Previous articleঅশনি সংকেত
Next articleআমি আছি থাকবো
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments