মনামী এই পাড়ায় এসেছে মাস দুয়েক হলো। সবই প্রায় অজানা অচেনা। মোটামুটি কাছাকাছি দোকান পাট আর রোজকার যাতায়াতের রাস্তাঘাট টুকুই যা একটু জানাশোনার মধ্যে। তেমন ভাবে পাড়ায় কারুর সাথেই পরিচতি ঘটেনি। এই দুটো মাস যা ঝক্কি গেলো! শিফটিং করা খুব পরিশ্রমের ব্যাপার। এক জায়গা থেকে শিকড় তুলে অন্যত্র স্থাপন, তার সাথে নতুন পরিবেশ- নতুন মুখ.. নিজের রোজনামতা-কর্মজীবন সব মিলে মিশে একাকার। দম ফেলার ফুরসত টুকুও ছিলো না। তাও কলেজ থেকে বকেয়া কিছু ছুটি দরখাস্ত করে পাওয়া গেছিলো বলে কিছুটা সুবিধা হলো। তাও সে আর ক’দিন। হাতে গোনা মাত্র দিন কুড়ি। তার মধ্যে একা হাতে এত কিছু সামলে ওঠা পরিশ্রমসাধ্য যথেষ্ট। দুজনের সংসার, একমাত্র সন্তান উচ্চশিক্ষার জন্য ভিন রাজ্যে আপাতত। সংসার দুজনের হলে কি হবে, জিনিষ পত্রের কমতি নেই কিছু। পরিবেশ পরিস্থিতি সব কিছুই নতুন। মানিয়ে নিতে একটু বেশীই সময় লাগে মনামীর। ব্রত সদা ব্যাস্ত মানুষ। তাঁর এসব দিকে হুঁশ নেই। তিনি তাঁর কনসাল্টিং জগৎ নিয়েই বুঁদ হয়ে থাকেন। সংসারে তাঁর উপস্থিতি একপ্রকার ধর্ত্যব্যের মধ্যে আসে না। তাই বলে সংসার সম্পর্কে তিনি যে উদাসীন, তা পরম শত্রুও বলতে পারবে না। তবে কি! যেটুকু বলা হয়, তিনি সেটুকুই করে থাকেন তিনি। অতএব মনামীকেই সব দিক বিবেচনা করে চলতে হয়। এই ঝামেলা ঝঞ্ঝাটে নিজের উপর চাপ কমাতে তাই আপাতত নিজের কাছে মাকে এনে রেখেছেন। মায়েরও বয়স হয়েছে। সব দিক আগের মতো সামলে উঠতে পারেন না। তবুও এই বয়সে এখনো তিনি যতটুকু কর্মঠ, সেই বয়সে পৌঁছে মনামী যে কতটুকু করতে পারবে মাঝে মাঝে নিজেরই সন্দেহ হয়।
সারাদিন কলেজে ছাত্র-ছাত্রীদের উপর স্বর সাধনা করে হা-ক্লান্ত হয়ে যখন ঘরে ফেরে মনামী… মায়ের হাতের গরম গরম চা টুকু পেয়ে ভারী তৃপ্তি বোধ হয়। অন্য সময়ে এই তৃপ্তিটুকু পেতে নিজেকেই কিচেন ক্ষেত্রে অবতীর্ণ হতে হয়। গরম চায়ে আমেজের চুমুক দিতে দিতে এই টুকুই পরম পাওয়া মনে হয়।
………………………….
আজ কলেজ থেকে বেরোতে বেশ দেরি হয়ে গেলো। বেরোনোর মুখেই দ্বিতীয় বর্ষের কিছু ছাত্র-ছাত্রী ঘিরে ধরলো। পরীক্ষার বেশি বাকি নেই। জমে থাকা সমস্যার সমাধানের উদ্দেশ্যেই ভিড় জমেছে। কি আর করা! শিক্ষাদানে ব্রতী মনামী। এই সকল ক্ষেত্রে সময়সীমা তুচ্ছ হয়ে যায়। পরম যত্ন সহকারে এক এক করে সমস্যার সমাধান করতে করতে অনেকটাই সময় পার হয়ে গেলো আজ।
বাড়ি ফিরে আজকাল প্রায়শই ডাইনিং-এ এক দুজন মুখ চেনা অথচ অপরিচিত অথবা স্বল্প পরিচিত মানুষের সাথে দেখা হয়ে যায় | মা যে কি করে পারে সবার সাথে ভাব জমিয়ে নিতে ! এই অবাসনেরই বাসিন্দা সকলে | এই দুই মাসে মনামী না পারুক, মনামীর মা বেশ সখ্যতা জমিয়ে ফেলেছেন আশেপাশের মানুষদের সাথে | সান্ধ্য চায়ের আড্ডা বেশ ভালই হয় মাঝে মাঝে | আজও তার অন্যথা ঘটল না | বাড়ির চৌকাঠ পেরোতেই কানে এলো গরম গরম উত্তেজক আলোচনা | মনামী এই সব বিষয়ে খুব একটা কৌতুহল বোধ করেন না | তাই সৌজন্য মূলক হাসি এবং কিছু কুশল বাক্যালাপের পরে পাশ কাটিয়ে নিজের ঘরের দিয়ে এগিয়ে যায় | জানে, মা যত ব্যস্তই থাকুক না কেন, ঠিক চানাচুর সহযোগে মুড়ি মাখা আর গরম গরম আদা দেওয়া চা এসে যাবে মুখের সামনে | যে কটা দিন এমন আরাম জোটে , মন্দ কি !
-“মনা, আজ একবার হাত মুখ ধুয়ে বাইরে আয় রে |”
-“কেন মা? খুব মাথা ধরেছে |”
-“তবু আয় | চা মুড়ি খেয়ে একবার আয় | আমি তো চলেই যাব কদিন পরে | এনারা তোর পড়শি মানুষ | বিপদে আপদে এনাদেরই পাশে পাবি রে | আয়, ওনারা আলাপ করতে চান ভালো করে |”
-“নিশ্চয় তুমি আমার গুণ গেয়েছো !”
-“বাহ রে,মেয়ে আমার প্রফেসর বলে কথা ! বলবো না ?”
মায়ের মুখের উজ্জ্বল হাসিটুকু দেখতে বেশ লাগে মনামীর | মৃদু হেসে সায় দিলো | আসছে সে |
মনামীর নিজেকে একপ্রকার অসামাজিক মনে হয় | ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে সদা স্বচ্ছন্দ যে মানুষ, সেই আবার এই সকল আড্ডায় বড় বেমানান | কি বলবেন ভেবে পান না, অথবা সামনের ব্যক্তির কথায় কি ভাবে রিয়াক্ট করবেন সেটা বুঝে উঠতে আজও পেরে ওঠেন না | তার থেকে টুকটাক সাংসারিক কাজ সেরে মোটা মোটা বইয়ের আড়ালে তলিয়ে যেতেই অপার শান্তি অনুভব করেন |
ডাইনিং হলে সকলের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা এবং তাদের সন্তানদের পড়াশোনা ক্ষেত্রে এমন একজন প্রফেসর মানুষকে পাশে পাওয়ার তারা যে কি ভীষণ নিজেদের চিন্তামুক্ত মনে করছেন… এহেন স্তুতি এবং মনামীকে ঘিরে তাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার চাপে মনামী বেশ অস্বস্তি বোধ করতে শুরু করলেন | প্রফেসর মানেই সে যে ভগবান জাতীয় কিছু নন, সে কথা কে বোঝায় এনাদের ! দু চার কথার পরে মনামী স্থান ত্যাগ করতে উদ্যত হয় |
-“তোমার মত এমন শিক্ষিত মানুষ খুব দরকার ভাই আমাদের মতো এই ছা-পোষা পাড়াতে | পরিবেশ ভালো থাকে, আশেপাশে বাচ্চাগুলো কু-শিক্ষা পায় না |”
মনামী একটু অবাক হলো |
-“ আপনার কথা ঠিক বুঝতে পারলাম না | এই পাড়ার পরিবেশ তো বেশ ভালই | সবাই কত মিশুকে | আমি বরং তেমন মিশতে পারি না |”
-“না ভাই | শিক্ষার প্রভাব বলেও তো কিছু আছে | আসলে এখানে দরকারে আর কিছু কাজ জোটানোর তাগিদে যেটুকু পড়াশোনা দরকার, তাই করে সবাই | চর্চা বলে তো কিছু হয় না ! এই যেমন ভাই তুমি, সারাদিন পড়াশোনার মধ্যেই থাকো, মন্দ জিনিষ তোমার চোখেই পরে না | এই রকম কিছু মানুষ সাথে থাকলে বাচ্চা কাচ্ছারাও উৎসাহ পাবে | সামনে একজন আদর্শ পাবে | তাই না ?”
মৃদু হাসলেন মনামী | এখনো বুঝে উঠতে পারলেন না, এই সকল প্রসঙ্গের অবতারণা কিসের জন্য | এই অবস্থায় উঠে চলে আসাও বাজে দেখায় | অগত্যা…..
-“তুমি তো এখানে নতুন ভাই | হাল হকিকৎ তেমন জানো না | এই যে আবাসনের তিন নম্বর বাড়িতে তিন তলায় ঘোষালরা থাকে, তুমি তো চেন না | ঘোষালের মেয়ে কি কেলেঙ্কারিটাই না করলো | তুমি অবশ্য তখন আসনি এখানে | এই সব দেখে বাকিরা কি শিখবে বলো ? জানতে তো কারুর আর বাকি নেই !”
মনামী শ্রোতা | অপর একজন বলে উঠলেন…
-“যা বলেছ দিদি | এই মেয়েরই এখন দেখো ধুমধাম করে বিয়ের জোগাড় চলছে | ছেলে নাকি সোনার টুকরো | ঘোষাল গিন্নি তো তাই বললেন | গাড়ি বাড়ি পয়সার অভাব নেই | খুব বুক ঠুঁকে বলছিলেন…মেয়ে খুব সুখে থাকবে | কথা হচ্ছে কি , ছেলের বাড়ি যদি আগের কুকীর্তি গুলো জানতে পারে ?”
মনামীর অস্বস্তি বাড়ছে | মায়ের দিকে তাকালো সে , একমাত্র মা-ই পারেন এমতাবস্থা থেকে উদ্ধার করতে | মেয়ের দৃষ্টি চেনেন তিনি | যথারীতি মেয়েকে ঘরে পাঠিয়ে দিলেন দুই কথায় | সারা দিনের ক্লান্তি.. আহা একটু বিশ্রাম নিক ঘরে |
ঘরে এসে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিলেন মনামী | ঘটনার সারসত্ত্বা বোঝা হয়ে গেছে তার | ঘোষাল বাবু নামক জনৈক ব্যক্তির একটি মাত্র কন্যা কোনো এক সময়ে কারুর প্রেমে পরে গৃহত্যাগিনী হয়েছিলেন এবং মাস কয়েক ঘুরতে না ঘুরতেই যথাস্থানে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন | ফিরে আসার পরে প্রথম কয়েকদিন মাথায় সিঁদুর দেখা দিলেও পরে তার চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায়নি | সেই ঘটনার বছর ঘুরতে ঘুরতেই সম্বন্ধ করে পাত্রস্থ করতে চলেছেন মেয়েকে ঘোষাল বাবু | সেই নিয়েই জল্পনা কল্পনার মাত্রা পারদসীমা ছাড়িয়েছে |
মা এলেন খানিক পরে | মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ……..
-“ তুই বিরক্ত হলি মনা?”
-“নাহ, তবে এই সব আলোচনা বাড়িতে আর হতে দিও না মা | ক্রমে ক্রমে বাড়তে থাকবে | ব্রতর কানে গেলে ও বিষয়টা ভালো ভাবে নাও তো নিতে পারে |”
-“জানি রে | মাঝে মাঝে আসে ওই দু-তিনজন | বাজার দর, রান্না, রেসিপি এই নিয়েই কথা হয়, সময় ও কেটে যায় | আর আমি না থাকলে তো এনারা আসবেন না | তবে আজ যে এনারা এই বিষয় নিয়ে গল্প জুড়বেন বুঝিনি |”
-“যাক, বাদ দাও মা | তুমি ঘরের আলো টা একটু নিভিয়ে দেবে মা ? মাথাটা ধরেছে | একটু শুই | আজ খুব চাপ গেছে |”
-“হ্যাঁ একটু বিশ্রাম নে | আমি বরং তোকে আর এক কাপ কড়া করে চা করে দি |”
-“না মা, কড়া করে বরং কফি করো একটু | দুধ বেশি দিয়ে | তোমার হাতের ধোঁয়া ওঠা কফি মুখে লেগে থাকে |”
মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে ঘরের বাতি নিভিয়ে দিলেন মা |
এই একলা মূহুর্ত টুকুই চাইছিলেন মনামী | ঘোষালের মেয়েকে নিয়ে অনেক কথা, অনেক গল্পের অবতারণা হচ্ছে আজ, হয়ত কাল ও হবে, পরশুও হবে..তারপর থিতিয়ে পড়বে একদিন | মনামী জানে না, সকলের অসন্তোষের কারণ কি ! মেয়েটির স্বচ্ছল ঘরে বিয়ে হওয়া নাকি নিজের ভালোবাসাকে নস্যাৎ করে ফিরে আসা কোনটি ? জনৈকা বলছিলেন এমন কিছু একটা | ভালো ঘর, ভালো থাকা, অর্থ, বিলাসিতা এগুলোই নাকি আসল কারণ…তাই পূর্ব-প্রেম ছেড়ে আসতে মেয়েটির অসুবিধা হয়নি | মেয়েটি আসলে স্বার্থপর ইত্যাদি ইত্যাদি | সম্পূর্ণ অচেনা অজানা একটি মেয়েকে কিছু মতামতের ভিত্তিতে কাঠগড়ায় দাড় করাতে রুচিতে বাধলো মনামীর |
মন পিছিয়ে যায় কয়েক যুগ আগে |
…………………………………………………………………………………………
উচ্চমাধ্যমিক শেষ | প্রচুর সময় | কত আর গল্পের বই পড়ে আর বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে সময় কাটানো যায় | পরীক্ষার আগে মনে হতো, একবার পরীক্ষা হয়ে যাক শুধু..তারপর চুটিয়ে শুধুই মজা করে দিন কাটানো যাবে | দিন কয়েক যেতেই খুব বোর লাগতে শুরু করেছে | ধুস ! রেজাল্ট বেরোতে অনেক দেরী এখনো | পরে কি নিয়ে পড়বে, কিছু স্থির করেনি এখনো তেমন করে | সে সব পরে ভাবা যাবে, এখন এই বোরিং সময় কাটানোই সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে মনামীর কাছে | অনেক ভেবে বাবার কাছে প্রস্তাব রাখে, বাবার অফিসে যদি রোজ গিয়ে বাবাকে কাজে একটু হেল্প করতে পারে ! কাজও শেখা হবে আর সময়ও কাটবে | ভয় ছিল, বাবা রাজি হবেন কিনা ! সেই ভয়কে মিথ্যা করে দিয়ে বাবা সানন্দে রাজি হয়ে গেলেন | এরপর শুরু হলো নতুন পর্ব মনামীর |
মনামীর বাবার ছোট্ট অফসেট প্রেস | অফিসের কাজ দেখাশোনার জন্য জনা তিনেক মানুষ আছেন | বাকিরা প্রেসের কাজে থাকেন | সর্ব-সাকুল্যে জনা পনেরো মানুষ | বাবার অফিসে এবার জায়গা হলো মনামীর | শুরু শুরুতে সব কিছুই বড় অন্যরকম | শুধুই অবজার্ভ করা….. ঘুরে ঘুরে বিরাট ছাপা মেশিনটার কার্য-কলাপ দেখা… ফিরোজ কাকুর তত্বাবধানে ওই মেশিন থেকে রং-বেরঙের ছাপা কাগজ বেরোনোর পদ্ধতি… বৃদ্ধ সামন্তবাবুর নিপুন হাতে কাগজ কাটার মেশিনে তাড়া তাড়া কাগজ সঠিক মাপে কাটা | এত ধার ওই ব্লেডের… মানুষের গলাও উড়ে যেতে পারে বোধ করি ! খুব মন দিয়ে এই কাগজ কাটার মেশিন দেখতে থাকে মনামী | আর ওই ব্লেডটা | বাবার একবার ওই ব্লেডে হাত ফালা ফালা হয়ে গেছিলো.. সামন্ত বাবুর অনুপস্থিতিতে , নাকি অসাবধানতার জন্য জানা নেই মনামীর… বাবা নিজে হাতেই কিছু কাজ করতে গিয়ে এত বড় বিপত্তি ঘটিয়েছিলেন… এখনো মনে আছে মনামীর.. রক্তে ভেসে যাওয়া হাত… স্টিচ চলছে.. বাবার স্থির মুখ |
-“ দেখে নে মনা.. ব্যান্ডেজ কিন্তু তোকেই করতে হবে বাড়িতে | আমার ড্রেসিং-এর দায়িত্ব তোর | আমি আর কারুর কাছে যাবো না কিন্তু | তুই আমাকে ভালো করে দিস মা |”
ভয় পেয়েছিলো মনামী | বাবাকে সারিয়ে তোলার দায়িত্ব ওর | বড় কষ্ট পাচ্ছে বাবা … যদি ভুল কিছু হয়, তাহলে তো বাবা আরো কষ্ট পাবে | বাবা আশ্বস্ত করেছিলেন | ভরসা ছিল মনামীর উপরে | দুরুদুরু বুকে অপটু হাতে রোজ দুবেলা বাবার ড্রেসিং করে দিতো মনামী | ডাক্তারের ওষুধে আর মনামীর যত্নে বাবার হাত ধীরে ধীরে একদিন সেরে গেলো | কিন্তু ওই ব্লেডটা চিরকালের মতো শত্রু হয়ে গেলো মনামীর | প্রেসে এসে রোজ মন দিয়ে দেখতে থাকে ওই বিশাল চওড়া ব্লেডটা | ব্লেড টা যখন সারাদিনের কাজ সেরে বিশ্রাম নেয়… একবার খুব ইচ্ছা করে মনামীর ওই ব্লেডে হাত ছুঁইয়ে দেখতে… কত ধার ওর, কত তেজ ওর.. যে একজন মানুষকে এত কষ্ট দিতে পারে !!! সাহস পায় না.. বাবা দেখলে বকবে | মনে মনে রোজ বলে ওই ব্লেডটাকে মনামী… এত নিষ্ঠুর কেন তুমি !!!!
এরকমই একদিন……. মনামী মন দিয়ে ব্লেডের কাজ দেখছিলো…
-“তুমি সময় পেলেই এখানে এসে কি এত দেখো কাগজ কাটা ?”
চঞ্চলদা | বাবার এসিস্টেন্ট একাউন্টটেন্ট | হাসলো মনামী | উত্তর দিলো না | আবার মন দিলো ব্লেডের দিকে |
-“আমি রোজ দেখছি তুমি মন দিয়ে ব্লেড দেখো | শুরুতে ভাবতাম, নতুন জিনিষ দেখে কৌতুহল হয়েছে | কিন্তু এখন তো দেখি, তুমি মন দিয়ে দেখেই যাও | কি আছে বলো তো ওই ব্লেডে ?”
-“এমনি দেখি | বসো চঞ্চলদা | চা খাবে ?”
-“বলেছি শান্তিদিকে | আসছে এখুনি | খুব জানতে ইচ্ছা হচ্ছে, কি আছে ওই ব্লেডে ?”
মনামী একটু এড়িয়ে চলে চঞ্চলদাকে | মানুষটা ভালো | নিজের কাজে মগ্ন থাকে | কিন্তু মনামীর প্রতি একটু বেশি উৎসাহ দেখায় | মনামীর অস্বস্তি হয় বেশ | আর ও জানে, বাবা এসব পছন্দ করবেন না | মাঝ খান থেকে মনামীর এই বাবার সাথে রোজ আসা বন্ধ হয়ে যাবে |
শান্তিদি ট্রেতে করে চা নিয়ে এসে হাজির | সবাইকে চা দিয়ে নিজের কাপ হাতে মনামীর কাছে এসে বসলো |
-“আমি জানি, মনা কেন এই কাগজ কাটার মেশিনের কাছে বসে থাকে |”
-“তাই, জানো তুমি?” চঞ্চলদার প্রশ্ন |
মনামী চুপ করে থাকে | অনেক বাচ্চা বয়স থেকে ও শান্তিদিকে দেখছে | বস্তুত এই প্রেসে শান্তিদি আছেন বলেই মা আসতে দিয়েছে ওকে | নাহলে মনামীর বাবা কাজে কম্মে সারাদিন এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়ান, সবসময়ে প্রেসে থাকেন ও না | মা একলা এতজন স্বল্প চেনা-জানা মানুষদের সাথে মনামীর সারাদিন কাটানো পছন্দ করেন না | শান্তিদি হয়ত বুঝতে পারে, মনামীর মনে কি চলে ! মায়ের জাত তো !!
চায়ের কাপ শেষ হতে না হতেই বাবা চলে আসেন, ফলত এই প্রসঙ্গের অবতারণার এখানেই ইতি | বাবা আসতেই অফিসঘরে ডাক পরে মনামীর এবং চঞ্চলের একসাথে |
-“মনা, তোকে একটা বড় কাজ দেবো | পুরো দায়িত্ব তোর |”
-“কি কাজ বাবা?”
-“প্রুফ রিডিং | বিশাল বড় কিন্তু | ধৈর্য্য ধরে করতে হবে | ভুল চুক হলে মুশকিল হবে |”
মনামীর কোনো আপত্তি নেই প্রুফ রিডিং –এ | বরঞ্চ বেশ ভালই লাগে … এই ফাঁকে অনেক নতুন নতুন লেখা পড়া হয়ে যায় | যা পরে ছাপার অক্ষরে সবাই দেখবে, সেটি আগে পড়ে ফেলার আলাদাই থ্রিলিং |
-“কি বই বাবা ! কার লেখা ?”
উৎসাহ ঝরে পড়ে মনামীর কন্ঠস্বরে |
আড়চোখে মেয়েকে একবার জরিপ করে নেন মনামীর বাবা |
-“ব্যাঙ্কের একটা বই বেরোবে | অফিসার্স আর স্টাফ লিস্ট আর কিছু দরকারি জিনিষ | সেই বইয়ের প্রুফ |”
মুষড়ে পড়ে মনামী | হে ভগবান ! শেষে এত নিরস জিনিষ ? বাবার পরের কথা শুনে আরো নিরাশ হয়ে পরে মনামী |
-“ চঞ্চল তোকে হেল্প করবে | এত বড় কাজ একা সামলানো চাপ | তোরা দুজনে মিলে কাজটা শেষ করে ফেল | হাতে সময় অল্প |”
ভীষণ রাগ হচ্ছে মনামীর | একে তো নিরস একটা কাজ, তার উপর সাথে জুড়ে দিলো বাবা চঞ্চলদাকে | অসহ্য !!
কোণের দিকের একটা ছোট ঘরে আপাতত ঠাঁই হলো মনামী আর চঞ্চলের | এখানে মেশিনের আওয়াজ আসেনা … বাইরে থেকে কেউ এলে চট করে এই ঘরে ঢুকে বিরক্ত করতে পারবে না | শান্ত পরিবেশে নিশ্চিন্তে কাজ শেষ করার যাবতীয় ব্যবস্থা করে দিলেন বাবা | মনামী বলতেও পারছে না, এই কাজটা করবো না | বাবা যে ভাবে ওকে দায়িত্ব দিলেন…… এর পরে কি ভাবে না বলে সে !!
শুরু হলো কাজ… প্রুফ রিডিং | একঘেয়ে কাজ… মন শরীর দুইই মাঝে মাঝে রিলিফ খোঁজে | উপায়ন্তর নেই… অতএব, অল্প স্বল্প গল্প… দু চার কথা… বেশির ভাগ চঞ্চলই বলে চলে, মনামী শ্রোতা | মাঝে মধ্যে মনামীও বক্তার আসন নেয় | চলতে থাকে… এই ভাবে…… এই ভাবেই |
একদিন কালের নিয়মে, অথবা গতির নিয়মে শেষ হলো কাজ | প্রথমে যত বোরিং আর বিরক্তিকর কাজ মনে হয়েছিলো, শেষের দিকে আর মোটেও তেমন লাগেনি | চঞ্চলদাকে আস্তে আস্তে মনামীর ভালো লাগতে শুরু করেছিল | ছেলেটি স্ট্রাগল করছে | নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের বড় ছেলে | সংসারের দায় অনেক | একজন সাধারণ বি.কম ছেলের এই বাজারে চাকরি পাওয়া অত সহজ নয় | তাই ছোট-খাটো কনসার্ন গুলো আছে বলেই চঞ্চলদার মতো বেশ কিছু মানুষ বেঁচে আছে… এসব চঞ্চলদার মুখেই শোনা | মনামী কৌতুহলী হয়ে ওঠে | জানতে ইচ্ছা করে.. কত আলাদা ওদের জীবন ওর নিজের থেকে ? কি ভাবে শুরু হয় চঞ্চলদার দিন, কি ভাবেই বা শেষ হয় !!
বাকি তো কালের নিয়ম ! জানার চেষ্টা অথবা খোঁজার প্রয়াস.. দুই হৃদয়কে কোথাও এক সুতোয় বাঁধার চেষ্টা করে | মনামী বুঝতে পারে না, এ কিসের টান ! ভালবাসা কি এতই সহজ !! কিন্তু এই টান উপেক্ষা করার সাধ্য এবং সাধ কোনটাই তার নেই | তবুও ভয় আছে, বাবা জানলে হয়তো চঞ্চলদার চাকরি যাবে | অতএব, কাজের পরিসরের বাইরে কোথাও কোথাও দুজনের দেখা হওয়া, কিছুক্ষণ একান্তে সময় যাপন… কখনো কোনো মেট্রো চত্ত্বরে, কখনো গঙ্গার ঘাটে…. লোক সমাগমের মাঝেও একান্ত মূহুর্ত যে খুঁজে পাওয়া যায়, চঞ্চলদার কাছেই শিখেছে মনামী | আজকাল চঞ্চলদাকে ঘিরে ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখতে ভালই লাগে | শুধু এখনো জানা হয়ে উঠলো না চঞ্চলদার দিন-রাত্রি | কোথাও একটা মাপ-কাঠির সুক্ষ্ম রেখা টেনে চলে চঞ্চলদা | যেটা পেরোতে পারলেই হয়ত ওর জগতে ঢোকা যাবে | মাঝে মাঝেই চঞ্চলদা একটা কথা বলে… “তোমার বাবা দারুণ সুযোগ্য একজন মানুষের সাথে তোমার বিয়ে দেবেন | তোমার জীবন বদলে যাবে একেবারে |”
মনামী ব্যথিত হয় | কিন্তু বলে উঠতে পারে না, চঞ্চলদাকে নিয়েই সে একটু একটু করে স্বপ্নের জাল বুনতে শুরু করেছে | হয়তো চঞ্চলদাও স্বপ্ন দেখেন, কে জানে !!
তারপর একদিন…… সেই দিনটা মনে ভীষনভাবে উজ্জ্বল হয়ে আছে মনামীর | ঢাকুরিয়া লেকের কাছে একটি বড় গাছের বাঁধানো বেদিতে বসে কত কথাই না বলে চলেছে মনামী- চঞ্চল | আজ চঞ্চল প্রধান বক্তা…. মনামী শ্রোতা | আজ আর কোনো রেখাপাত নেই, চঞ্চল খুলে দিয়েছে তার মনের আগল | অনর্গল বলে চলেছে তার ছোটবেলার গল্প, স্কুল, বাবা, মা, ভাই, দুষ্টুমি.. মন দিয়ে শুনছে মনামী | এক অন্য দুনিয়ার গল্প | মাটির অনেক কাছাকাছি | গ্রামে মানুষ চঞ্চল | সেখানে তার জীবন ধারা সম্পূর্ণ আলাদা মনামীর জীবন থেকে | ক্রমে ক্রমে উঠে আসে, চঞ্চলের গ্রাম ছেড়ে শহরে উঠে আসার গল্প | চঞ্চলের বাবার পরিশ্রম, ফেরিওয়ালার জীবন, বাবার স্বল্প আয়ে মায়ের নিপুন ভাবে সংসার চালনা, চঞ্চল আর তার ভাইয়ের পড়াশোনা, অভাবের সাথে লড়াই…আজও ……. ইত্যাদি ইত্যাদি | সে অনেক গল্প… অনেক অনেক কথা ……… আস্তে আস্তে পরিচিত হতে থাকে মনামী চঞ্চলের জগতের সাথে |
অদ্ভুত একটা ঘোর নিয়ে বাড়ি ফেরে মনামী | এমন জীবনের গল্প সে ছাপার অক্ষরে পড়েছে | আসে পাশে এমন অনেক মানুষ-অনেক জীবন আছে, কিন্তু মনামী কোনদিন মাথা ঘামায়নি | সে তার নিজের পড়াশোনা, গান, স্বপ্ন, বন্ধু, আবদার, নিজের প্রটেক্টেড জীবনের ঘেরাটোপে পরম শান্তিতে থেকেছে |
রাতে সমস্ত বাড়ি নিশ্চুপ | সবাই ঘুমের দেশে | একমাত্র মনামীর চোখে ঘুম নেই | সারা শরীর জুড়ে এক তীব্র অস্বস্তি ছেয়ে ফেলেছে ওকে | কিছুতেই শান্তি পাচ্ছে না সে | কিছুতেই নিজেকে মেলাতে পারছে না চঞ্চলদার জীবনের সাথে | কিছুতেই সে ভাবতে পারছে না তার নিশ্চিন্ত ঘেরাটোপের জীবন ছেড়ে সে অনিশ্চয়তার এক জীবনে প্রবেশ করবে, যেখানে অভাব নিত্যসঙ্গী… যেখানে গ্রাম্যতা পরতে পরতে জড়িয়ে আছে …… যেখানে ভোর হলেই চিৎকার-চেঁচামিচি … জলের লাইন.. কলতলায় কাপড় কাচা…. মাটির রান্নাঘরে স্বল্প যোগানে রান্না করা ….. আরো কত কি সব বলে চলেছিলো চঞ্চলদা | মাথার ভিতর ঝিঁ ঝিঁ পোকা ডেকে চলেছিলো অনবরত মনামীর | সব কথা কি আদৌ কর্ন হইয়া মরমে পৌঁছেছিলো? জানে না .. মনামী জানে না | এই মুহুর্তে শুধু জানে, ছাপার অক্ষরে যা পড়তে ভালো লাগে, সিনেমায় দেখতে যা ভালো লাগে… বাস্তবে তা সহজ ভাবে মেনে নিয়ে জীবন কাটানো সম্ভব নয় | অন্তত মনামীর পক্ষে তো নয়ই | কঠিন সিদ্ধান্তটা নিয়েই ফেলে সে |
বাবাকে বোঝাতে অসুবিধা হয়নি মনামীর | হঠাৎ কেন মেয়ে বাড়িতে থাকতে চায় আবার, সেই নিয়ে মাথাও ঘামায়নি সে | শুধু দৃষ্টি এড়ায়নি মায়ের | রেজাল্টের দিনও ঘোষনা হয়ে গেছিলো… মনামী ভবিষ্যৎ গঠনে মন দেয় | পিছু ফিরে তাকাতে সে আর রাজি নয় |
মাঝে একদিন খবর আসলো… চঞ্চল চাকরি ছেড়ে চলে গেছে | কোথায় আছে এখন.. কি করে.. কেউ জানে না | মনামীর কোনো হেলদোল হলো না এই খবরে | নিজেও খুব অবাক হলো | হোক না অল্প কিছুদিনের জন্য একটা সম্পর্ক… হয়তো তার বয়স খুবই কম.. তবুও, কোনো একটা সময়ে যার জন্য তীব্র টান অনুভব করত সে.. আজ তার খবর থাকা বা না থাকাতে মনামীর কিছুই এসে যায় না ! এতটাই স্বার্থপর সে !!
……….
আজও ভেবে পায় না মনামী | কিভাবে সে এত স্বার্থপর হয়ে উঠলো ! হয়তো অসুখের ঘরে বাঁধা পরার তীব্র ভয়েতেই সুখের সাগরে ভেসে থাকতে চেয়েছিলো ! উত্তর আজও অজানা |
প্রতিবেশিনীদের মুখে ঘোষাল বাড়ির কোনো একটি তরুণী মেয়ের কথা শুনে আজ কোনো অংশেই নিজেকে তার থেকে আলাদা ভাবতে পারছে না মনামী | তফাৎ একটিই, মেয়েটি ঘর ছেড়েছিলো…আর মনামী নিজের ঘর আঁকড়ে ধরেছিলো | হোক না অল্প কিছু সময়ের জন্য..তবুও মেয়েটি তার ভালবাসার জন্য যে সাহস দেখাতে পেরেছিলো, মনামী সেটাও পারেনি | অভাবে থাকার ভয়েই সে কুঁকড়ে গেছিলো |
আজ সে সমাজের উন্নত এক প্রজাতির অংশ-বিশেষ | সকলের কাছে শ্রদ্ধার পাত্রী | বাবা-মা সকলের কাছে গর্ব করেন মনামীকে নিয়ে | হয়তো ব্রত-ও মনামীকে ঘিরে প্রচ্ছন্ন অহং বোধে সিক্ত….. কিন্তু আজ নিজের তৈরী কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে মনামীর বারবার নিজেকে প্রশ্ন করতে ইচ্ছা করে… যে প্রশ্ন একদিন কাগজ-কাটার মেশিনের ব্লেডটাকে করতো.. এত নিষ্ঠুর কেন তুমি ?? আজ বড্ড জানতে ইচ্ছা করছে… সে আর ঘোষাল বাড়ির মেয়েটির মধ্যে কতটুকু প্রভেদ !! প্রকারান্তে হলেও বিশ্বাসঘাতক তো দুজনেই | তাই নয় কি !!!