ছন্দে ছড়ায় জাতককথাস্বাধীন রাজ্য বারাণসী,

সুসীমাদিত্য নরপতি সেথা,প্রজারা সতত খুশী।

সুজলা সুফলা রাজ্যে কাহারও ছিল নাকো অনটন,

ন্যায় বিচারক নৃপতি সুসীমকঠোর কোমল শাসন।

শুভ বসন্তে তাঁহার রাজ্যে প্রতি বৎসর কালে,

রাজা পালিতেন করী উৎসবঅভিনব বলা চলে।

হস্তীশালায় শতেক হস্তীশ্বেত শুভ্র বরণ,

উৎসবে ছিল তাহারা মুখ্যগাত্র অলংকরণ।

কনক ভূষণে ভূষিত হস্তীশোভাযাত্রার সাথে,

হইত বাহির একে একে সবে বারাণসী রাজপথে।

অনুষ্ঠানের পৌরহিত্যে রাজকুলপুরোহিত,

ত্রিবেদী পুরুষহস্তীসূত্রে বিশেষ সুপণ্ডিত।

উৎসবান্তে হস্তীযূথের যত কিছু আভরণ,

লভিতেন তিনি সাথে আরও কত উপহার অগণন।

সে জনমকালে বোধিসত্ব রাজপুরোহিত তনয়,

বয়স মাত্র পন্চদশেই পিতারে হারান হায়।

হস্তীবরণ উৎসব কাল বুঝি প্রায় সমাসন্ন,

এমত সময় পুরোহিত গতবারাণসী বিষণ্ণ।

রাজঋত্বিক অকালে প্রয়াতনৃপতির উদ্বেগ,

সহসা তাঁহার শিয়রে ঘনায় কৃষ্ণবর্ণ মেঘ।

করিবেন কেবা পৌরহিত্যকোথা সে বেদভ্যাসী,

চিন্তাক্লিষ্ট বারাণসী রাজপুরোহিতকুল খুশী।

ছিলেন তাঁহারা ঈর্ষাকাতর রাজপুরোহিত প্রতি,

যে কোন মূল্যে চাহিতেন সবে হউক তাঁহার ক্ষতি।

সহসা তাঁহার অকাল প্রয়াণমেঘ না চাহিতে জল,

বাহিরে কাতর,অন্তরে অতি সুখী ব্রাহ্মণদল।

মন্ত্রণা করিকহিলেন সবে সুসিমাদিত্য সনে,

রাজঋত্বিকে অকালে হারায়ে লভিয়াছি ব্যথা মনে।

কিন্তু রাজন দ্বিপউৎসবে নাহি বিলম্ব আর,

ত্রিবেদী পুরুষ আসিবেন কবে লভিতে পূজার ভার !

পুরোহিত যিনি ছিলেন তাঁহার পুত্রটি অপোগণ্ড,

বয়সে কিশোরকিন্তু মুর্খএকটি ধর্মষণ্ড।

হস্তীসূত্র কিংবা ত্রিবেদশাস্ত্র অনবগত,

কিভাবে তাহারে পূজার্চনায় করিবেন নৃপ রত !”

চিন্তিত স্বরে শুধান রাজন-“আছে কি অন্য উপায় !

কেমনে হইবে হস্তীবরণআপনারা দিন রায়।

ব্রাহ্মণকুল সুসীমাদিত্যে দেন আশ্বাস বাণী,

হস্তীসূত্রে অভিজ্ঞ মোরাত্রিবেদ শাস্ত্র জ্ঞানী।

মোদের তত্ত্বাবধানে হইবে মঙ্গল উৎসব”,

সহমত নৃপরাজ্যে পড়িল সাজ সাজ কলরব।

তিন দিন পরে করী উৎসবকরেন রাজন ঘোষণা,

ব্রাহ্মণকুল ভাবে এইবার পুরিবে সকল বাসনা।

বোধিসত্বের জননী কর্ণে পশিল সকলি কথা,

বারাণসীপতিএহেন কর্মেঅন্তরে হানে ব্যাথা।

পুরুষানুক্রমে পৌরহিত্যআজি নাহি তায় মূল্য,

লভিলে নারিল পুত্র তাঁহার নৃপতির আনুকুল্য  !

কি হেতু কাতর” – মাতারে প্রশ্ন করেন শ্রীবোধিসত্ব,

শুষ্ক কণ্ঠে ব্যক্ত করেন জননী সকল তত্ত্ব।

উদ্বেগ ত্যজ”-মাতারে অভয় দান করিলেন পুত্র,

অবাক জননী-“বিদিত কি তব ত্রিবেদ, হস্তীসূত্র”!

হাসিয়া তনয় কহেন-“হে মাত,দাও মোরে সন্ধান,

কোথায় লভিব আচার্য মোরশাস্ত্রে অতুল জ্ঞান !”

কহিলেন মাতা-“নিবাস তাঁহার গান্ধার দেশ পরে,

তক্ষশীলার মহাজ্ঞানী তিনিকিন্তু সে বহু দূরে।

কিভাবে সেথায় যাইবে পুত্রনাহি মোটে সম্ভব,

হায়রে ভাগ্যবিনষ্ট বুঝি বংশের গৌরব।

তক্ষশীলায় যাইবই আমিলভিব শাস্ত্রশিক্ষা,

হস্তীবরণ উৎসবে দিব পৌরহিত্যে দীক্ষা।

মায়ের আশীষ মস্তোকপরেনিশা অবসানে যাত্রা,

দুর্গম পথে শ্বাপদ শঙ্কাবিপদের নাহি মাত্রা।

কিন্তু যাঁহার দেবতা সহায়তাঁহার কিসের ভীতি,

অশ্বপৃষ্ঠে শ্রীবোধিসত্বমানসে অসীম দ্যুতি।

গান্ধার দেশে অতি অনায়াসে নগর তক্ষশীলায়,

আসিলেন রাজপুরোহিত সুত বুঝি কোন্ লহমায় !

ক্ষুধায় কাতর, শ্রান্ত তথাপি উদ্যম নহে ভগ্ন,

উপনীত শেষে আচার্য গেহেতখন গোধূলী লগ্ন।

হে গুরুদেব,আপনার পদে বোধিসত্বের প্রণাম,

আগমন হেথা বিশেষ কারণেবারাণসী মোর ধাম।

দিন শিষ্যেরে ত্রিবেদ এবং হস্তীবিদ্যা শিক্ষা,

আপনার সনে দীন বালকের আর কিছু নাহি ভিক্ষা।

ব্যক্ত করেন তাঁহার শপথ তথা সংকট কথা,

ব্যাথিত বিপ্র ভঙ্গ করেন গুরুকুল পাঠ প্রথা।

বেদমন্ত্রের শ্লোকোচ্চারণে চৌদিক বাঙ্ময়,

বোধিসত্বের চিত্ত দৃঢ়তা আচার্যে করে জয়।

ভগবতকৃপা বর্ষিত হয় বোধিসত্বের মাথে,

হস্তীসূত্র,ত্রিবেদমন্ত্র অধিগত এক রাতে।

বারেক শ্রবণে অন্তরস্থশিষ্যটি শ্রুতিধর,

অবিশ্বাস্য ক্ষমতা হেরিয়া আচার্য বাকহর।

নিশীথে উজল করিল গৃহটি জ্ঞানৈশ্বর্য্য আলোক,

দুর্লভ এই শিষ্যেরে হেরি মুগ্ধ অধ্যাপক।

উজাড় করিয়া দিলেন ছাত্রে বেদ শাস্ত্র জ্ঞান,

আপনারে কি বা দিব দক্ষিণা”-শিষ্যটি হতমান।

চরৈবতি,জয়োহস্তুশিষ্যে গুরুর আশীষ,

তব সিদ্ধিই মোর দক্ষিণা”-কহিলেন জ্ঞানাধীশ।

পরদিবসেই আসিলেন ফিরিবারাণসী বোধিসত্ব,

শুনালেন মাতা-“পুত্র কি তব বেদজ্ঞান করায়ত্ত !”

পুত্র তাঁহার দিলেন অভয়-“আর নাহি রবে কষ্ট,

কাহার সাধ্য মোদের বংশ গরিমা করিবে নষ্ট !

আচার্য সনে লভিনু শিক্ষাপ্রমাণ হইবে কল্য,

নাহি হেথা কোন ত্রিবেদী পুরুষ তোমার পুত্রতুল্য।

পরদিন প্রাতে রাজময়দানে হৈ চৈ কলরব,

শুভারম্ভের পল আসন্নহস্তীর উৎসব।

শতেক হস্তী সজ্জিত সবে স্বর্ণ অলংকারে,

সম্পদ লোভী ব্রাহ্মণকুলউল্লাস নাহি ধরে।

সুসীমাদিত্যবারাণসীরাজগ্রহণ করেন আসন,

এহেন ক্ষণেই রাজপুরোহিত পুত্রের আগমন।

জিজ্ঞাসিলেন মহারাজে তিনিরাজন, কি একথা সত্য !,

অধুনা আপনি ন্যায়বিচ্যুত ভোগ বিলাসেই মত্ত।

রাজপরিবারে যুগযুগ ব্যাপী চলমান কুলপ্রথা,

কি বা আছে হেতুনৃপতি তাহার করিলেন অন্যথা !”

অবাক নৃপতি শুধান-“কে তুমি, কি বা তব পরিচয় !

স্পর্ধা তোমার গগনচুম্বিঅন্তরে নাহি ভয় !

রাজকর্মের চাহিছ ব্যাখ্যা এরূপ সাহসভরে !

দিব কি আজ্ঞা মৃত্যুদণ্ড বসিবে শূলের পরে !”

রাজপুরোহিত নন্দন আমিঅধুনা পিতৃহারা,

শোকাতুরা মোর দুখিনী জননীবরষে অশ্রুধারা।

এহেন বিপাকে প্রত্যাশা ছিল নৃপতির সহায়তা,

কিন্তু কি হেরিরাজাদেশে বুঝি বিলুপ্ত কুলপ্রথা।

কোন্ অপরাধে বোধিসত্ব আজিকে হইল ব্রাত্য !

হস্তীবরণ উৎসবকালে জানিতে চাহি সে সত্য।

বোধিসত্বের উক্তি শ্রবণে মহারাজ রোষায়িত,

কহেন-“তনয়,তুমি নির্বোধসেইহেতু বন্চিত।

বয়সে কিশোর তথাপি নাহি কোনই শাস্ত্রজ্ঞান,

স্পর্ধায় তব হতবাক আমিকর নৃপে অপমান !

জননীর ক্লেশে ক্লিষ্টই বটেযাও এবে গেহে পুত্র,

করিলেম ক্ষমাশিখিয়া আইস ত্রিবেদ, হস্তীসূত্র।

ধন্যবাদার্হ ব্রাহ্মণকুললভিনু সঠিক তথ্য,

অনুভব করঅবোধ বালককি হেথা প্রকৃত সত্য।

বোধিসত্ব্রের সিংহনিনাদ-“মোর নাহি কোন শিক্ষা !

কে বলে রাজনতাঁহার জন্য দিলেম করুণা ভিক্ষা।

পণ্ডিতগণে মোর আহ্বানকরুন শ্লোকোচ্চারণ,

মম সম জ্ঞানী থাকিলে রাজ্যে করিব তাঁহারে বরণ।

উদাত্ত স্বরে বেদমন্ত্রে তাঁহার স্তোত্রপাঠ,

বিমোহিত নৃপআর যত দ্বিজরক্তবর্ণ ললাট।

শঙ্কিত সবেএকে একে হায় ত্যজিলেন রাজসভা,

কম্পিত হিয়া বোধিসত্বের হেরিয়া এহেন প্রভা।

মহারাজ আসিঋত্বিক সুতে করেন আলিঙ্গন,

অশ্রুধারায় বুঝি বাণভাসি তাঁহার দুইটি নয়ন।

জননীর সনে অপরাধী আমিমাগিনু তাঁহার ক্ষমা,

এমন পুত্র গর্ভে ধারণতিনি ঈশ্বরী সমা।

সীমাহীন মোর অপকৃষ্টতাকরি না অস্বীকার,

দাও মম এবে দণ্ড বৎস”-নৃপের মনোবিকার।

ন্যায়বিস্মৃত নৃপতির জ্ঞানচক্ষু উন্মীলন,

ত্রিবেদী কিশোরে সঁপিলেন তিনি পার্থিব তনুমন।

বোধিসত্বের পদতলে বসিকহেন সুসীমাদিত্য,

হে সুততব পূত পরশে শোধিত হইল চিত্ত।

যাচিনু তাপস তোমার শরণদান কর শিষ্যত্ব,

নৃপের এহেন ভাবান্তরে আপ্লুত বোধিসত্ব।

কহিলেন তিনি-“এই ধরাপরে যাহা কিছু ঘটমান,

হে মহারাজ,জানিবেন পিছে সর্বশক্তিমান।

তাঁহার নিকট সততই চলে মোদের পরীক্ষা,

যদি হই সেথা সফলকামদিব আপনারে দীক্ষা।

এইক্ষণে মোরে দিন অনুমতিআরম্ভি করী উৎসব,”

বোধিসত্বের পৌরোহিত্যধন্য ধন্য রব।

কালক্রমে তিনি সুসীমাদিত্যে করিলেন দীক্ষিত,

জ্ঞানরূপ জ্যোতি বোধিসত্বেরধরণী উদ্ভাসিত।

জাতকের গীতিটানি তায় ইতিপ্রণমি শ্রী তথাগতে,

আশীষ তাঁহার যেন সততই বর্ষে কবির মাথে।

Print Friendly, PDF & Email
Previous articleChristmas Visit
Next articleইতিহাসে কাশ্মীর।
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments