।।১।।
-“সবাই তো এসে গেছে দাদা,শুরু করি তাহলে”, মোটাসোটা চেহারার মধ্য বয়সী চিত্র পরিচালক অনিমেষ গুহ নিজের হল ঘরের সোফায় বসতেই অ্যাসিস্টেন্ট ডিরেক্টর রাহুল বলে উঠলো। হলঘরে একবার চোখ বুলিয়ে অনিমেষ বললো,
-“আমার হিরোইন কোথায় গেল রাহুল”!!
অনিমেষের ঠিক পাশেই বসে থাকা বাংলা সিরিয়ালের জনপ্রিয় নায়ক রনদেব ওরফে রনি গলার স্বরে কিছুটা বিদ্রূপ মিশিয়ে বলে উঠলো,
-“বারান্দায়,মায়ের আঁচল ধরে বসে আছে অনি দা”।
রনির দিকে একটু কড়া ভাবে তাকিয়ে অনিমেষ রাহুল কে নির্দেশ দিয়ে বললো,
-“ওকে ভিতরে নিয়ে আয়”।
বাইরের বারান্দায় বসে সবটাই শুনতে পাচ্ছিলো রিমঝিম। রাহুল বাইরে ডাকতে আসার আগেই তাই গুটি গুটি পায়ে হলঘরের দরজার সামনে পৌঁছালো রিমঝিম। ওকে দেখতে পেয়েই অনিমেষ সাদর অভ্যর্থনা জানিয়ে বললো ,
-“আমার হিরোইন বাইরে দাঁড়িয়ে আছে কেন!আয় আয় ভিতরে এসে বোস্”।
অনিমেষের আন্তরিকতায় রিমঝিম কিছুটা জড়তা কাটিয়ে আস্তে আস্তে ঘরের ভিতরে এসে বসতেই অনিমেষ নিজের কথা শুরু করল,
-“তোমরা সবাই স্ক্রিপটা দেখে মোটামুটি বুঝতেই পেরেছো যে আমার এই ছবির মূল চরিত্র তিনটি, দুই নায়ক এবং এক নায়িকা। দুই নায়ক চরিত্রে অভিনয় করবে রনি আর ইন্দ্রনীল এবং নায়িকার চরিত্রে অভিনয় করবে রিমঝিম।এই ছবিতে তিনটে অন্তরঙ্গ দৃশ্য আছে সেটা তোমাদের আগেই বলেছি, কিন্তু তার দৃশ্যায়ন কিভাবে হবে সেটা নিয়ে আলোচনা করার জন্যই আজকের এই মিটিং”। একটু থামলেন অনিমেষ।রিমঝিমকে মাথা নিচু করে বসে থাকতে দেখে অনিমেষ ওকে প্রশ্ন করলো,
-“কিরে রিমঝিম অন্তরঙ্গ দৃশ্যে অভিনয় করতে হবে বলে ভয় পাচ্ছিস নাকি”!
মাথা নিচু করেই নখ খুঁটতে খুঁটতে রিমঝিম উত্তর দিল,
-“না ঠিক ভয় নয়। আসলে আমি তো অভিনয় জগতে একেবারেই নভিস, তাই একটু অসস্তি হচ্ছে। আর কিছু নয়”। রিমঝিমের কথা শুনে অনিমেষ কিছু বলার আগেই ইন্দ্রনীল বলল,
-“ডোন্ট ওরি রিমঝিম। টেলিভিশনে আমি আর রনি আগে অভিনয় করলেও অন্তরঙ্গ দৃশ্যে আমরাও নভিস।তাই এতো টেনশন নিস না।অনি দা ঠিক শিখিয়ে পড়িয়ে নেবে”।
ইন্দ্রনীলের কথা বলার ধরণ দেখে রিমঝিম সহ ঘরে উপস্থিত সবাই হাসতে থাকলে সবাইকে থামিয়ে অনিমেষ আবার শুরু করলেন,
-“শোন রিমঝিম এতো ভয় পাস না।পর্দায় যেভাবে আমরা একটা অন্তরঙ্গ দৃশ্য দেখতে পাই আর সেটা যেভাবে শ্যুট করা হয় দুটো পুরোপুরি আলাদা। আস্তে আস্তে শিখে যাবি সব”।
অনেকক্ষন চুপচাপ বসে থাকার পর এবার রনি অভিযোগ করে অনিমেষকে বললো,
-“তুমি কিন্তু আমার সাথে খুব অন্যায় করলে অনি দা”, রনির অভিযোগের মাথা মুন্ডু কিছুই বুঝতে না পেরে অনিমেষ প্রশ্ন করলেন,
-“আমি আবার তোর সাথে কি অন্যায় করলাম রে! যা পারছিস বলে যাচ্ছিস”।
-“একদিকে বলছো আমি তোমার ছবির নায়ক আর অন্য দিকে সব ইন্টিমেট সিনগুলো ইন্দ্রকে দিয়ে দিলে।এটা কি ঠিক করলে বলো তো”!
রনির বলার ভঙ্গিতে সবাই হাসতে থাকলে অনিমেষ সোফার একটা কুশন রনির দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বলে উঠলো,
-“খুব সখ হয়েছে না তোর ইন্টিমেট সিন করার”! তারপর রাহুলের দিকে তাকিয়ে বললো,”রীনাকে বলিস তো রনির জন্য একটা জিগোলো টাইপের স্ক্রিপ্ট লিখতে। গোটা ছবিতেই শুধু ইন্টিমেট সিনই থাকবে, অভিনয়ের দরকার নেই”।
-“আরে রেগে যাচ্ছো কেন!আমি তো শুধু তোমার হিরোইনের জড়তা কাটানোর জন্য একটু মজা করছিলাম। আচ্ছা এবার বলো কি করতে হবে”।
দুই অভিজ্ঞ সহ অভিনেতাই যেভাবে ওর অস্বস্তি কাটিয়ে ওকে সাবলীল করে তোলার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে সেটা দেখে অসম্ভব ভালো লাগলো রিমঝিমের। সেদিনের মিটিং শেষে যখন অনিমেষের ঘর ছেড়ে সবাই বাইরে এলো তখন দেখে বোঝার উপায়ই ছিল না পুরো টিমের সাথে এটাই রিমঝিমের প্রথম সাক্ষাৎ ছিলো।দুঘন্টার একটা মিটিং কখন যে ওকে ইউনিটের সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে ফেলেছিল সেদিন বুঝতেই পারেনি রিমঝিম।
।।২।।
রাহুলের স্ক্রীপ্ট নিয়ে আসতে এখনও মিনিট পাঁচেক দেরি আছে দেখে মেক-আপ রুমের বাইরে এসে একটা সিগারেট ধরালো ইন্দ্র।
-“আমাকেও একটা দাও দেখি”,পিছন থেকে রাহুলের গলা পেয়ে ঘুরে দাঁড়ালো ইন্দ্র।
-“অ্যাসিট্যান্ট ডিরেক্টর সিগারেট চাইছে মানে নিশ্চই কোনো খবর আছে। তাড়াতাড়ি ঝেড়ে কাশো তো দেখি”, সিগারেটের প্যাকেটটা রাহুলের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল ইন্দ্র।একটা সিগারেট ধরিয়ে মুখে একটু রহস্যের হাসি মাখিয়ে রাহুল গলা নামিয়ে বলল,
-“হিরোইন ম্যাডাম মনে হচ্ছে রনির প্রেমে পড়েছে”, রাহুলের কথায় সামান্য বিষম খেলো ইন্দ্র। কোনমতে নিজেকে সামলে বলল,
-“আরে রিমঝিমটা ইন্ডাস্ট্রিতে নতুন! এখনো সব ঠিকঠাক বুঝেই উঠলো না। আর রনি ওকে নিয়েও শুরু করে দিলো! “
-“না ইন্দ্র দা, এবার রনির দোষ নেই খুব একটা।ও বিশেষ পাত্তা দিচ্ছে না রিমঝিমকে। কিন্তু রিমঝিমের রকমসকম দেখে মনে হচ্ছে রনির উপর হেব্বি ফ্রাস্টু খেয়ে আছে। তবে এরকম বেশি দিন চলতে থাকলে রনিও কিন্তু সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে দেরি করবে না।ও মালকে তো চেনোই”, সিগারেটের ধোঁয়া ওড়াতে ওড়াতে নিজের উদ্বেগ প্রকাশ করল রাহুল।
-“ভুল কিছু বলিসনি! রনির স্বভাব চরিত্রের যা সুনাম চারিদিকে”, ইন্দ্রও দুশ্চিন্তা প্রকাশ করল।
-“নতুন বলে নয় জানো, মেয়েটা বড্ড সরল, সাধাসিধে।এখনকার সব নতুন মেয়েগুলোকে দেখেছো তো।শালা অ্যাটিটিউডের ঠ্যালাতেই অস্থির। কিন্তু রিমঝিমকে দেখেছো, প্রোডাকশনের সবার সাথে কি অমায়িক ব্যবহার করে! আমি কতবার বারন করেছি তাও ‘দাদা’ ছাড়া কথা বলে না।ওর সাথে যদি রনি উল্টোপাল্টা কিছু করে না ইন্দ্রদা,হেব্বি কেলাবো কিন্তু মালটাকে”, রাহুলের মাথা আস্তে আস্তে গরম হচ্ছে দেখে ইন্দ্র ওর কাঁধে হাত রাখলো।
-“এত মাথা গরম করিস না। তাতে হিতে বিপরীত হবে। একটু ভাবতে দে আমায়।দেখি কি করা যায়”। ইন্দ্রের আশ্বাসে তখনকার মতো শান্ত হয়ে আবার সেটে ফিরে গেল রাহুল।
।।৩।।
সন্ধ্যেবেলা সেটে রিমঝিমকে অন্যমনস্ক হয়ে বসে থাকতে দেখে ইন্দ্র ওর কাছে এগিয়ে এসে প্রশ্ন করল,
-“কিরে তোর প্যাক আপ হয়নি এখনো”?
আচমকা ইন্দ্রের ডাকে ভাবনার জালটা কেটে বেরিয়ে এলো রিমঝিম। আনমনা হয়েই ইন্দ্রকে জিজ্ঞেস করল,
-“কিছু বলছিলে”!
-“বললাম, তোর প্যাক আপ হয়নি এখনো”!
-“হ্যাঁ, এই হলো একটু আগে। আসলে..”,
ইন্দ্রের প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে গলাটা কেঁপে উঠলো রিমঝিমের।সেটা লক্ষ্য করেই ইন্দ্র পরিবেশটাকে একটু স্বাভাবিক করার চেষ্টায় রিমঝিমের হাত ধরে ওকে বললো,
-“চল ওঠ। চা খেয়ে আসি”।
-“কোথায় যাবো”, রিমঝিমের প্রশ্নের জবাবে ইন্দ্র এদিক ওদিক তাকিয়ে প্রোডাকশনের একটা ছেলেকে বলল,
-“বাবু আমার মেক-আপ রুমে দুটো চা পাঠিয়ে দিতে বল তো ভাই”।
নিজের মেকআপ রুমে সামনাসামনি দুটো চেয়ারে বসে ইন্দ্র সরাসরি প্রশ্ন করল রিমঝিমকে,
-“তুই কি রনির প্রেমে পড়েছিস”! প্রথমে একটু ইতস্তত করলেও ইন্দ্রের জোরাজুরিতে রিমঝিম এক নিঃশ্বাসে বলতে থাকলো,
-“আসলে আমি কলেজে লাইফ থেকেই রনির বিশাল ফ্যান ছিলাম জানো। কিন্তু যবে থেকে এই ফ্লিমের কাজটা শুরু করলাম ওর সাথে, বিশ্বাস করো পুরো ফিদা হয়ে গেছি ওর ওপর। কিন্তু হলে কি হবে, রনি তো আমায় পাত্তাও দেয় না। আমি তো শুনেছি, রনির কোনো গার্লফ্রেন্ডও নেই।তাহলে এরকম ব্যবহার করে কেন বলোতো আমার সাথে”!
নিষ্পলকে রিমঝিমের সরল স্বীকারোক্তি শুনতে শুনতে হেসে ফেললো ইন্দ্র।ওকে হাসতে দেখে রিমঝিম চোখ পাকিয়ে বললো,
-“এই জন্যই তোমাকে কিছু বলতে চাইছিলাম না। সেই প্রথম দিন থেকেই দেখছি কোনো কিছুই কখনো সিরিয়াসলি নাও না তুমি। একটা প্রবলেম বললাম, কোথায় কিছু একটা সলিউশন দেবে, তা নয় বাবু হাসছেন”। রাগে চেয়ার ছেড়ে উঠে যেতে গেলে ইন্দ্র হাত ধরে ওকে আবার বসিয়ে দিয়ে বললো,
-“আচ্ছা বাবা আর হাসবো না। এবার চুপটি করে বসে আমায় একটা কথা বল। তুই রনির সম্পর্কে কতটুকু জানিস”!
কয়েক মূহুর্ত চুপচাপ ইন্দ্রের দিকে তাকিয়ে, ওর প্রশ্নটা ভালো করে বোঝার চেষ্টা করে রিমঝিম জবাব দিলো,
-“ইন্ডাস্ট্রির আনাচে কানাচে রনির যে ক্যারেকটার সার্টিফিকেট উড়ে বেড়ায় তুমি যদি সেটাই মিন করতে চাও তাহলে বলি, বেশ কয়েক মাস তো হলো এখানে কাজ করছি, তাই মোটামুটি অনেকটাই জানি”।
-“আর সবটা জেনেও তুই বোকার মতো সেই আগুনেই হাত পোড়াতে চাইছিস”! ইন্দ্রের প্রশ্নে রিমঝিম দীর্ঘশ্বাস গোপনের চেষ্টা না করেই বললো,
-“ফ্লোরে এমন কেউ নেই যে আমার রনির প্রতি ফিলিংসটা বোঝে না। তুমিও তো বুঝেছো বলেই না আমরা এখন এই টপিকে ডিসকাস করছি। আমার মনে হয় রনি যদি এতই খারাপ হতো তাহলে ও অনেকদিন আগেই আমার সুযোগ নিতে পারতো। কিন্তু বিশ্বাস করো রনি কাজের বাইরে আমার সাথে হাই হ্যালো ছাড়া সেভাবে কোনো কথাই বলে না। আমার তো সাম হাউ মনে হয়, মনে মনে ও আমায় পছন্দ করলেও কোনো অজ্ঞাত কারণে নিজের ফিলিংসটা আমার সাথে শেয়ার করতে চায় না। মে বি ওর চরিত্র নিয়ে যে সব কথাগুলো চাউর হয়ে আছে এখানে, সে গুলোর জন্যেই আনকম্ফোর্টেবল ফিল করছে আমার সাথে মিশতে”।
রিমঝিমের কথা শুনতে শুনতে ইন্দ্র বুঝতে পারছিলো,মেয়েটা অন্ধের মত বিশ্বাস করতে শুরু করেছে রনিকে। তাই বুঝতে পারছে না যে এই খেলায় রনি মাহির। প্রতিবারই ও এটাই করে। প্রথমদিকে কোনো মেয়েকে পাত্তা দেয় না। এরপর পাত্তা না পেয়ে মেয়েটা যখন মরিয়া হয়ে ওঠে রনির কাছে আসার জন্য, তখন রনি নিজের জীবনের কোনো এক মন গড়া দুঃখের কাহিনী ফেঁদে বসে। এরপর আস্তে আস্তে প্রথমে কফিশপ, তারপর লং ড্রাইভ করতে করতে হোটেলের বেড পর্যন্ত পৌঁছে যায়।যে কোনো মেয়ে রনির কাছে ততক্ষনই ইম্পর্টেন্ট থাকে যতক্ষন না ও নতুন কাউকে খুঁজে নিচ্ছে। কিন্তু এই কয়েক মাসে রিমঝিমের সাথে একটা সুন্দর বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে ওর আর রাহুলের।তাই এই সহজ সরল মেয়েটাকে রনির জালে জড়িয়ে পড়বে এটা ভাবলেই একটা অদ্ভুত কষ্ট হচ্ছে ইন্দ্রের। কিন্তু রিমঝিমকে বুঝিয়ে এভাবে আটকানো যাবে না।তাতে হয়ত ওকেই ভুল বুঝবে রিমঝিম। তাই ইন্দ্র রিমঝিমকে বাঁচানোর অন্য উপায় ভাবতে থাকে।
ওদিকে ইন্দ্রকে চুপ করে থাকতে দেখে রিমঝিম অস্থির হয়ে উঠলো। ইন্দ্রকে ধাক্কা দিয়ে বলল,
-“কি হলো! চুপ করে গেলে যে”!
রিমঝিমের ডাকে নড়েচড়ে বসল ইন্দ্র।নিজেকে একটু গুছিয়ে নিয়ে বললো,
-“দ্যাখ এই কয়েক মাসে তুই আমার খুব ভালো বন্ধু হয়ে গেছিস।তাই আমি তোকে এ ব্যাপারে সাহায্য করতে পারি, কিন্তু একটা শর্তে”।
ইন্দ্রের কথায় আচমকা আশার আলো দেখতে পেয়ে রিমঝিমের চোখ দুটো আনন্দে জ্বলজ্বল করে উঠলো। গলার স্বরে আর শরীরের ভাষায় উচ্ছাস ঢেলে দিয়ে ইন্দ্রের হাত দুটো ধরে বললো,
-“থ্যাঙ্ক ইউ,থ্যাঙ্ক ইউ,থ্যাঙ্ক ইউ।তুমি যা বলবে তাই করবো ইন্দ্র। শুধু আমাকে একটু হেল্প করো প্লিজ”।
-“বেশ তবে শোন”, ইন্দ্রের মুখে পুরো প্ল্যানটা শুনে রিমঝিম কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত মনে আমতা আমতা করতে করতে প্রশ্ন করল,
-“ডু ইউ থিঙ্ক, এই প্ল্যানটা কাজ করবে”!
-“আমাকে বিশ্বাস করিস”, ইন্দ্রের চোখের নিষ্পলক দৃষ্টিতে চোখ রেখে রিমঝিম অস্ফুটে জবাব দিলো,
-“বিশ্বাস করি বলেই না নিজের মনের কথা তোমার কাছে ব্যক্ত করতে পারলাম”।
রিমঝিমের হাতে হালকা চাপ দিয়ে ইন্দ্র বললো,
-“তা হলে আমাতে ভরসা রাখ একটু।এই প্ল্যানটা আসলে রাহুলের।তাই একটা কথা মাথায় রাখিস এই প্ল্যানটা যেন শুধুই তোর, আমার আর রাহুলের মধ্যে থাকে।আর কেউ যেন ঘুনাক্ষরেও টের না পায়”।
-“বেশ,তুমি যা বলবে তাই হবে”, গালে টোল ফেলে মিষ্টি করে হাসলো রিমঝিম।
।।৪।।
-“লিসেন এভরিওয়ান.. উই হ্যাভ অ্যা সিচুয়েশন”, অনিমেষের ডাকে সেটে বসে থাকা সবাই এগিয়ে এলো ওর দিকে। সবাইকে একবার দেখে নিয়ে অনিমেষ আবার বলতে থাকলো,
-“আমাদের যে দুটো গাড়ি বুক করা ছিল তার একটা আজ ভোরে অ্যাকসিডেন্ট করেছে। তাই আমাদের একটু অ্যাডজাস্ট করতে হবে এখন। আই হোপ কারুর কোনো সমস্যা নেই”। সবাই হাসি মুখে রাজি হয়ে গেলেও রনি অনিমেষের কথা শুনে ব্যাজার মুখে দাঁড়িয়ে রইল। রনিকে ওভাবে ব্যাজার মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ইউনিটের ক্যামেরাম্যান আর ওর পুরানো বন্ধু স্বরূপ এগিয়ে এসে ওর কাঁধে হাত রেখে বললো,
-“চাপ নিস না, আমি আছি তো।নে চল এখন”।
-“অগ্যতা”,ব্যাজার মুখে অনিমেষের কাছে এগিয়ে এসে প্রশ্ন করল,
-“কোন গাড়িতে যাওয়া হবে তাহলে অনি দা”!
-“আমি প্রসাদ বাবুর গাড়িতে আসছি।ওই গাড়িটা ছোট তো, আমি বরং সোমনাথকে আমার সাথে নিয়ে নিচ্ছি আর তোরা বাকিরা ইনোভাটায় চলে আয়”, অনিমেষের কথা শুনে আড়চোখে একবার রিমঝিমকে দেখে নিয়ে চটজলদি মাথায় একটা প্ল্যান ভেঁজে নিল রনি।এতোটা রাস্তা কি আর এমনি এমনি যাওয়া যায়!
গাড়িতে উঠেই আর এক বিপত্তি। রনির সব প্ল্যান বানচাল করে দিয়ে লাস্ট সিটে বসা রিমঝিম ইন্দ্রকে নিজের পাশে ডেকে নিল।মাঝের সিটে রনির সাথে স্বরূপ আর সামনের সিটে রাহুল বসল।
-“এই রাহুল দা, বোলপুর পৌঁছাতে কতক্ষন লাগবে মোটামুটি”, রাহুলকে চোখের ইশারায় থামিয়ে দিয়ে ইন্দ্র রিমঝিমের প্রশ্নের উত্তরে বলল,
-“চার সাড়ে চার ঘণ্টা তো লাগবেই।বেশিও লাগতে পারে তবে সকাল সকাল বেরোনোর জন্য ট্রাফিকটা হয়ত কম পাবো একটু”। ইন্দ্রের উত্তর শুনে স্বরূপ ফুট কাটলো,
-“না গো ইন্দ্র। সকাল সকাল ডানকুনিতে লড়ির হেব্বি জ্যাম থাকে। ওখানে অনেকখানি টাইম খেয়ে নেবে মনে হচ্ছে”।
-“এই নীল, তুমি আগে গেছো বোলপুর”! রিমঝিমের হঠাৎ করে ইন্দ্রকে নীল বলে ডাকাতে স্বরূপ আর রনি দুজনেই জোর বিষম খেয়ে পিছনের সিটে বসে থাকা রিমঝিমের দিকে ফিরে তাকালো।
-“হোয়াট! তোমরা সবাই ইন্দ্রনীলকে ইন্দ্র বলতে পারো আর আমি নীল বললেই প্রবলেম”! রিমঝিমের সোজা সাপটা উত্তরে ওরা আর কিছু বলতে পারলো না।
-“কি গো,বললে না তো! গেছো তুমি আগে বোলপুর”! রিমঝিমের প্রশ্নে এবার উত্তর দিয়ে ইন্দ্র বললো,
-“অনেক দিন আগে একটা অ্যাড শ্যুট করতে এসেছিলাম একবার”,
-“বিশ্বভারতী ছাড়া আর কোনো ঘোরার জায়গা আছে বোলপুরে”! রিমঝিমের প্রশ্ন চলতেই থাকে।
-“আছে তো। সোনাঝুরি হাট, খোয়াই নদী, কিছু আদিবাসী গ্রাম সবমিলিয়ে বোলপুর এক বর্ণময় জায়গা”, ইন্দ্রের কথা শুনতে শুনতে রিমঝিম তখন মনেমনে বোলপুরের ছবি আঁকতে শুরু করে দিয়েছে। সম্বিৎ ফিরল রাহুলের ডাকে।
-“মিনিট পাঁচেক পর একটা ছোট খাটো ধাবা আছে। চা জলখাবার খাবে নাকি”!
-“সিরিয়াসলি, সকাল থেকে চা খাওয়া হয়নি গো”, রিমঝিমের
কথায় রনি পিছনের সিটে বসা রিমঝিমকে একঝলক দেখে নিয়ে ব্যাঙ্গ করে বললো,
-“যাক,তুই অন্তত গাড়িতেই আছিস। না হলে বাকিরা তো মনেমনে সোনাঝুরি হাটে শপিং করতেও শুরু করে দিয়েছে”।
রিমঝিম অবশ্য রাহুলের কথা গায়ে না মেখেই ইন্দ্রের সামনে হাতজোড় করে শুরু করল,
-“প্লিজ আমায় একটু ঘুরিয়ে দেখাবে। একসাথে নয়, রোজ একটু একটু করে প্লিজ”।
নাছোড়বান্দা রিমঝিমকে শান্ত করতে ইন্দ্র ওর হাতটা ধরে বললো,
-“তোকে পুরো বোলপুর ঘোরাবো মা, এবার থাম একটু”।
কথায় কথায় গাড়িটা ধাবার সামনে এসে দাঁড়াতেই রিমঝিম লাফালাফি করে গাড়ি থেকে নেমে এলো।ওর দেখাদেখি সবাই নামলেও রনি গাড়িতেই বসে রইল। চায়ের অর্ডার দিয়ে রাহুল আর স্বরূপ একটা একটা সিগারেট ধরিয়ে একটা টান দিতেই স্বরূপ দূরে দাঁড়িয়ে গল্পে মশগুল ইন্দ্র আর রিমঝিমকে দেখতে দেখতে প্রশ্ন করল,
-“কেসটা কি বলত ভাই”!
-“কোন কেসটা”! রাহুলের উল্টো প্রশ্নে স্বরূপ বললো,
-“আরে ইন্দ্র আর রিমঝিমের কেসটা। আগের সপ্তাহ অব্দি দেখলাম মেয়েটা রনির জন্য ফিদা ছিল।আর চারদিন পর ইন্দ্রের সাথে লাইন মারছে! সত্যি করে বলতো কেসটা কি”!
-“রিমঝিম অনেক উপর দিয়ে যায় বুঝলে স্বরূপ দা। ওর প্রথম থেকেই ইন্দ্রদাকে পছন্দ। কিন্তু ইন্দ্রদাকে তো চেনো। কোনো মেয়েকে পছন্দ হলেও জিন্দেগিতে মুখ ফুটে কিছু বলতে পারবে না। কিন্তু এই মেয়েও কিছু কম যায় না।ও ইন্দ্রদাকে দিয়ে প্রপোজ করাবেই ঠিক করে নিয়েছিল।তাই প্ল্যান করে রনিকে বেশি ইম্পোর্টেন্স দেওয়ার নাটক করছিল।এই তিনমাস পর দু তিনদিন আগে ইন্দ্রদা আর সহ্য করতে না পেরে রিমঝিমকে অবশেষে বলেতে পেরেছে যে ওকে ইন্দ্রদার ভালো লাগে।তবে প্রোপজ করতে পারেনি এখনো”।
-“ওহ্ মাই গড! এ মেয়ে তো গভীর জলের মাছ”, রাহুলের কথা শুনে বিস্মিত স্বরূপ হাঁ করে রইল।
-“তাহলে আর বলছি কি।তবে দাদা তুমি আবার রনিকে বলো না এসব।ও যা ছেলে! এসব কথায জানলে তাতে ইগো মিশিয়ে যে কি করে বসবে।তখন আবার লেনে কে দেনে পড়ে যাবে”, স্বরূপকে সাবধান করে দিয়ে রাহুল ইন্দ্র আর রিমঝিমের কাছে ফিরে গেলেই, স্বরূপ আর সময় নষ্ট না করে ছুটল রনিকে সব বলতে।
এদিকে রিমঝিমের কাছে এসেই একবার পিছনে তাকিয়ে স্বরূপকে গাড়িতে উঠতে দেখে রাহুল হাসতে হাসতে বলল,
-“কাজ হয়ে গেছে। স্বরূপ দা এতক্ষনে রনির কাছে সব উগলাতে শুরু করে দিয়েছে”।
-“তুমি ধন্য রাহুল দা। সিরিয়াসলি কি বুদ্ধি গো তোমার”! রিমঝিমের কথায় রাহুল ইন্দ্রকে বলল,
-“গাড়িওলাকে কিন্তু লাস্ট মোমেন্ট মিথ্যে বলে গাড়ি ক্যানসেল করানোর জন্য গাড়ি ভাড়া প্লাস আরও তিন হাজার টাকা দিতে হবে”।
ইন্দ্র কিছু বলার আগেই রিমঝিম রাহুলকে বলল,
-“ওটার জন্য ইন্দ্রকে বদার করো না প্লিজ।ওটা আমার থেকে নিয়ে নিও”।
রাহুল ঘাড় হেলিয়ে অল্প হেসে বলল,
-“ঠিক আছে। কিন্তু এখন চল।আরো নাটক তো বাকি আছে এখনো”!
।।৫।।
-“বোলপুরে পৌঁছে থেকে রনির মেজাজটা কেমন তিরিক্ষি হয়ে আছে দেখেছিস।গত সাত দিন ধরে গোটা ইউনিট ওর মেজাজের চোটে অতিষ্ঠ হয়ে গেছে।আসলে সবাই ওর মেজাজের ঠ্যালায় ওকে তোয়াজ করছে শুধু তোর কোনো হেলদোল নেই ওর ব্যাপারে। তুই দিব্যি শ্যুটিং করছিস আর ফাঁকা সময়ে ইন্দ্রদার সাথে আজ এই সাঁওতাল গ্রাম তো কাল সোনাঝুরি হাটে ঘুরতে চলে যাচ্ছিস।একটা নতুন মেয়ে এসে একে তো ওকে এমনভাবে ইউজ করলো যেটা ও বুঝেই উঠতে পারলো না, তার ওপর আবার এখন কাজ মিটে যাওয়ার পর রনিকে পাত্তাও দিচ্ছে না, এটা রনি ঠিক মেনে নিতে পারছে না বুঝলি রিমঝিম।মালটার হেব্বি ইগো হার্ট করেছিস তুই”, ইন্দ্রের ঘরের ব্যালকনিতে বসে আড্ডা দিতে দিতে হঠাৎই রিসর্টের করিডরে একা একা দাঁড়িয়ে সিগারেট টানতে থাকা রনির দিকে চোখ পড়তেই কথাটা বলে উঠলো রাহুল।
-“ইন্দ্র যেদিন আমায় রনিকে ইগনোর করার প্ল্যানটা শুনিয়েছিল সেদিন কিন্তু একেবারেই বিশ্বাস হয়নি যে প্ল্যানটা এইভাবে কাজ করবে। কিন্তু এখন এই সিনেমার শ্যুটিংয়ের থেকে বেশি মজা পাচ্ছি রনিকে জ্বালিয়ে। বাই দা ওয়ে, এর পরের স্টেপটা কি হবে রাহুল দা”! রিমঝিমের প্রশ্নে একটু মাথা চুলকাতে চুলকাতে হঠাৎই রাহুলের মাথার সব আইডিয়াগুলো একসাথে কিলবিল করে উঠলো।মুখে একটু রহস্যের হাসি ঝুলিয়ে রিমঝিমের কাছে এসে বললো,
-“ওঠ ওঠ,রেডি হয়ে নে এক্ষুনি”,
-“এখন আবার কোথায় যাবো রাহুল দা।দিব্যি তো একটু ল্যাদ খাচ্ছিলাম”, রিমঝিমের কথায় ওকে ধাক্কা মেরে রাহুল বলে উঠলো,
-“ল্যাদ পরে খাবি। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে বেরিয়ে পর। নাটকের দ্বিতীয় অধ্যায়ের সূচনার জন্য এটাই আইডিয়াল টাইম।লেগে পড়”।
রিমঝিমের চোখে মুখে একটা খুশির শিহরন খেলে গেল। একটু নড়েচড়ে বসে বললো,
-“তাহলে দ্বিতীয় অধ্যায়ের স্ক্রিপ্টটাও একটু শুনিয়ে দাও ঝটপট”।
-“কোনো স্ক্রিপ্ট নেই। তোকে এখন বেরিয়ে যেভাবেই হোক রনিকে নিয়ে আশেপাশটা একটু ঘুরে আসতে হবে। এইটুকুই। তুই যথেষ্ট বুদ্ধিমতি, তাই কিভাবে কি করবি দ্যাটস আপ টু ইউ। শুধু মনে রাখবি যে তুই ইন্দ্রদার প্রেমিকা।রনি জাস্ট তোর কো-স্টার।পারবি তো”! রাহুলের পরিকল্পনা শুনে উত্তেজনায় টগবগ করে ফুটতে থাকা রিমঝিম এবার, এতক্ষন নির্বাক হয়ে বসে ওদের কথোপকথন শুনতে থাকা ইন্দ্রের দিকে তাকিয়ে বলল,
-“তুমি কি বলো! সেকেন্ড ইনিংস শুরু করে দিই তাহলে”!
ভ্রূ নাচিয়ে,ঠোঁটের কোনে হালকা হাসি ফুটিয়ে চোখের ইশারায় রাহুলকে ইঙ্গিত করে ইন্দ্র রিমঝিম কে বলল,
-“ডাইরেক্টর মশাই যখন আদেশ দিয়েছেন তখন আর তো দেরি করার কোনো মানেই হয় না।এখনি শুরু করে দে”।
-“ফাইন,যাচ্ছি তাহলে এখন।বাই”, ঝড়ের বেগে দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল রিমঝিম।
।।৬।।
-“তোর কি কোনদিনও বোধবুদ্ধি কিছুই হবে না রাহুল”! ইন্দ্রকে রীতিমতো জোরে চিৎকার করে উঠতে দেখে রাহুল একটু ঘাবড়ে গিয়ে বলল,
-“আমি আবার কি করলাম”!
-“চোখের সামনে গত সাতদিন ধরে রনির অ্যাটিটিউডটা দেখছিস। রিমঝিম কিন্তু সাপের লেজে পা দিয়েছে।রনি কিন্তু ভিতরে ভিতরে ফুঁসছে,একটা সুযোগ পেলেই রিমঝিমের ওপর শোধ তুলতে পিছুপা হবেনা। আর তুই এরই মধ্যে রিমঝিমকে ওর সাথে পাঠিয়ে দিলি! মানে কি বলব আর তোকে। জাস্ট ডিসগাস্টিং”, ইন্দ্রের রাগের কারনটা বুঝতে পেরে রাহুল ওর কাছে এসে বলল,
-“আমি অনেক ভেবেই রিমঝিমকে পাঠিয়েছি ইন্দ্র দা। ডোন্ট ওয়ারি। কিন্তু তোমার কেসটা কি বলোতো! তুমিও কি রিমঝিমের প্রেমে পড়ে গেলে নাকি”!
রাহুলের কথা শুনে কয়েক মুহুর্তের জন্য ইন্দ্রের মনে হল ওর ঠোঁটের মাঝে কেউ কয়েক ফোঁটা ফেভিকল ঢেলে দিয়েছে। কোনো কথাই বলে উঠতে পারছিল না ইন্দ্র। একটু সময় নিয়ে অনেক কষ্টে শেষে বললো,
-“তুই কি সত্যি পাগল হয়ে গেলি রাহুল”! ইন্দ্রের কথা গায়ে না মেখেই মুখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে রাহুল বলতে থাকে,
-“তুমি মতই লুকানোর চেষ্টা করো না কেন ইন্দ্রদা তোমার মনের মধ্যে কি চলছে সেটা আমি ভালোই বুঝতে পারছি। তোমাকে তো আর আজ থেকে দেখছি না,সেই কবে থেকে চিনি বলোতো তোমায়।তাই রিমঝিম বুঝুক বা না বুঝুক আমি কিন্তু ঠিকই বুঝতে পারছি যে তুমি ওর প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ছো”, রাহুল একটু থামতেই ইন্দ্র তীব্র ভৎসনা করে ওঠে ওকে,
-“রিম আমাদের খুব কাছের বন্ধু রাহুল। আমরা চায়নি ও রনির প্রেমের জালে জড়িয়ে পড়ুক। রনিও যাতে ওকে নিজের লাইফের একটা সিরিয়াস অংশ হিসেবে গ্রহণ করে, ওকে সত্যি করের ভালোবাসে তাই তোর পরিকল্পনা মাফিকই এই নাটকটা করছি আমরা।এর মধ্যে আমার ভালোবাসার কথা আসছে কেন”!
-“কারন যখন তুমি রিমঝিমের সাথে থাকো, তখন তোমার অভিব্যক্তিই তোমার মনের কথা ব্যক্ত করে দেয় ইন্দ্রদা। যেভাবে তুমি ব্লাশ করো,যেভাবে একাত্ম হয়ে যাও নিজের ক্যারেকটারে তাতে যে কেউ বুঝতে পারবে তোমার অবচেতন মনের কথা।আর প্লিজ এটাকে নিজের গ্রেট অ্যাকটিং স্কিল বলে ভাঁটিও না। আমারও অনেক দিন হলো ইন্ডাস্ট্রিতে, তাই রিল আর রিয়েলের তফাৎটা আমি বুঝি।তোমার যাবতীয় ইমোশন তুমি আমার কাছে গোপন করতেই পারো কিন্তু নিজের কাছে কেন মিথ্যে বলছো দাদা।তাতে তো শুধুই কষ্ট পাবে”, রাহুলের কাছে ধরা পড়ে গিয়ে লজ্জায় দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁটটাকে চেপে ধরল ইন্দ্র। মূহুর্ত খানেক মূক হয়ে থাকার পর ইন্দ্র নিজের কাঁপা ঠোঁটে কথা ফুটিয়ে বললো,
-“তাহলে কি করব বল।রিমের মতো বন্ধুকে আমি কোনো মূল্যেই হারাতে চাইনা।আজ যদি ও কোনো ভাবে আমার মনের কথাটা জেনে যায় আর কোনোদিন আমার সাথে কোনো সম্পর্ক রাখবে! ভালোবাসা তো অনেক দূরের কথা রাহুল ও হয়ত আমার সাথে বন্ধুত্বটুকুও রাখবে না আর”।
-“কোথাও একটা পড়েছিলাম জানো, মেয়েদের একটা তৃতীয় নয়ন থাকে। সেই নয়নে ওরা সামনের জনের প্রেমে পড়াটা চট করে বুঝে ফেলে।হয়ত তোমার মনের গোপন কথাটা রিমঝিমের মনের ক্যানভাসে অনেক আগেই ধরা পড়ে গেছে! একবার নিজের মনের কথাটা ওর সামনে রেখেই দেখো না”, রাহুলের কথায় ইন্দ্রের চোখের সামনে মনের অন্তরালে দেখা স্বপ্নটা একবার ভেসে উঠেও অজানা আতঙ্কে তার আবার মিলিয়ে গেল।মুখে বিষন্নতার হাসি ঝুলিয়ে বলল,
-“রিম পাগলের মত রনিকে ভালোবাসে রাহুল। ওর মন এখন রনির ভালোবাসার হাতছানির প্রতীক্ষা করছে।আমার কথা ওর মনে এখন শুধুই বিদ্বেষ তৈরি করবে।তার থেকে এই ভালো।অন্তত বন্ধু হিসেবে তো ওকে পাশে পাবো”।
ইন্দ্রের গলার বিষন্নতা রাহুলের মন ছুঁয়ে গেলেও ওর অতিরিক্ত ভালোমানুষি এই মুহূর্তে রাহুলের কাছে অসহ্য লাগলো।মনে মনে ইন্দ্রকে উদম গালাগালি দিলেও ঠোঁটে শুধু কিছুটা ঘৃনা মিশিয়ে বললো,
-“বুলশিট! তুমি রিমঝিমকে ভালোবাসো না ইন্দ্রদা। যদি বাসতে তাহলে রনির মতো একটা অমানুষ, হারামীর হাতে ওকে তুলে দেওয়ার চেষ্টা করতে না”।ইন্দ্রের উত্তরের অপেক্ষা না করেই ওর ঘরের দরজাটা সজোরে বন্ধ করে বেরিয়ে গেল রাহুল।
।।৭।।
-“এই সীনটা কিন্তু আমরা লং শট নেব রিমঝিম।সূর্যাস্তের পর তোর আর ইন্দ্রের হাত ধরে এখানে ঘোরা থেকে শুরু করে চাঁদের আলোয় তোদের কিসিং পর্যন্ত পুরোটা একটাই শর্ট হবে, বুঝেছিস! একটা টেকেই পারফেক্ট ডেলিভারি লাগবে কিন্তু। প্রকৃতি কিন্তু রিটেকের স্কোপ দেয় না”, অনিমেষের কথায় ইন্দ্র আর রিমঝিম সম্মতি জানিয়ে একটু একান্তে একটা গাছের তলায় এসে বসল।এত বড় একটা শর্টের আগে নিজেদের মধ্যে একটু আলোচনা করাটা ভীষন জরুরী।তার ওপর আবার কিসিং সীন আছে।তাই ক্যারেকটারের সঙ্গে একাত্ম হতে গেলে একটু আগে থেকে নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা হওয়াটা খুব দরকার।
যদিও গত দু’দিন রনি আর রিমঝিমের একটু বেশিই মেলামেশাটা ইন্দ্রকে বড্ড কষ্ট দিচ্ছে। ওদের একসাথে দেখলেই বুকের বাঁ পাশটা বড্ড মোচর দিয়ে উঠছে।তার ওপর রাহুলটাও গত দু’দিন ধরে অবুঝের মত রাগ দেখিয়ে কথা বন্ধ করে দিয়েছে। কিছুতেই বুঝতে পারছে না যে সবসময় সব অনুভূতি প্রকাশ করা যায় না।তাতে সম্পর্কের অবনতি ঘটে।
-“ও.কে। সাইলেন্স প্লিজ। রোল ক্যামেরা, সাউন্ড অ্যান্ড অ্যাকশন”,
-“তোমার মনে পড়ে, প্রথম যেদিন বিকেলে আমায় এখানে নিয়ে এসেছিলে! ঝরা-পাতা আর হাড় কাঁপানো শুকনো ঠান্ডায় লাল মাটির রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে যখন পৌঁছে গিয়েছিলাম খোয়াইয়ের ধারে,এবড়ো খেবড়ো খোয়াইয়ে সোনাঝুরী গাছের ফাঁক দিয়ে সূর্যটাকে যখন টুক করে পালিয়ে যাওয়ার আগে আকাশের বুকে এক বালতি কমলা রং ঢেলে দিয়ে যেতে দেখেছিলাম,সেই কমলা রঙে হারিয়ে যেতে যেতেই আমি বারবার প্রেমে পড়েছিলাম জানো”, রিমঝিমের সমুদ্রের মতো গভীর চোখের অতলে তলিয়ে যেতে যেতে ইন্দ্র ওর হাতটা শক্ত করে ধরে বললো,
-“আমি তো জোৎস্না রাতে,এই সোনাঝুরির নির্জনতায় শুধু তোকেই চেয়েছিলাম রিম। কিন্তু তোর চোখ তখন অন্য স্বপ্নের হাতছানিতে মেতে ছিল।তাই কাছে থেকেও তুই আমার মনের কথাটা একটুও বুঝতে পারিসনি”।
-“আরে ইন্দ্র আউট অফ স্ক্রীপ্ট ডায়লগ বলছে”, অনিমেষ উত্তেজিত হয়ে কাট বলতে গেলে রাহুল আর রনি একসাথে ওর মুখ চেপে ধরলো।রনি আকুতি মিনতি করে বলতে থাকে,
-“অনি দা প্লিজ কাট বলো না।না হলে জিন্দেগিতে ইন্দ্র প্রোপোজ করতে পারবে না”।
-“মানে”, বিস্মিত অনিমেষের কথায় রাহুল বলল,
-“পরে বোঝাবো অনি দা।এখন সীনটা দেখো”।
-“আর যদি বলি, তোমার মনের সব গোপন কোনের খবর আমার কাছে অনেক আগেই ছিল নীল।আমি শুধু তোমার মুখ থেকে শোনার প্রতীক্ষায় দিন গুনছিলাম”, রিমঝিমের কথায় ইন্দ্র উপলব্ধি করল ওর হৃদয় দ্রুত গতিতে স্পন্দিত হতে শুরু করেছে। অগোছালো, এলোমেলো ইন্দ্র কাঁপা গলায় বললো,
-“ভালোবাসার অভিনয় করতে করতে কখন যে তোকে সত্যিকরের ভালোবেসে ফেলেছি বুঝতে পারিনি। যখন বুঝলাম তখন তুই রনির অনেক কাছে পৌঁছে গেছিস”, নিজের হাতটা ইন্দ্রের ঠোঁটে ঠেকিয়ে রিমঝিম নিচু স্বরে ফিসফিসিয়ে বলে উঠলো,
-“এই সন্ধ্যেটা শুধু আমাদেরই থাক না নীল।আজ না হয় আমাদের মধ্যে তৃতীয় ব্যাক্তির প্রবেশটা নিষিদ্ধই থাক”।
অবাক হয়ে রিমঝিমের কথা শুনতে থাকা ইন্দ্র লক্ষ্য করল রিমঝিমের মুখে বহু রংয়ের সমাগমেও ভালোবাসার গোলাপী আবেশটা যেন একটু বেশিই ছুঁয়ে গেছে। নিজের দু’হাত রিমঝিমের গালে ছুঁয়ে বললো,
-“বেশ। তাহলে এই জ্যোৎস্না রাত আর খোয়াইকে সাক্ষী রেখেই বলছি, আমি স্বপ্নে নয় বাস্তবে তোর স্নিগ্ধ সান্নিধ্য সারাজীবন এভাবেই পেতে চাই।তোর সাথেই নিজের ভবিষ্যৎ এক সুতোয় গাঁথতে চাই রিম।আই লাভ ইউ,আই ওয়ান্ট টু বি উইথ ইউ টিল দা লাস্ট ব্রেথ রিম”।
ইন্দ্রের কথায় রিমঝিমের মনের ভিতর এক অদ্ভুত শিহরন ঝড় তুলতে শুরু করে,এক অজানা অনুভূতির আবেশে অবশ হয়ে আসছিল ওর শরীর।ইন্দ্রকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই তিরতির করে কাঁপতে থাকা ওর শুষ্ক ঠোঁট দুটোকে নিজের ঠোঁটের আদ্রতায় ভিজিয়ে দিল রিমঝিম।কতক্ষন একে অপরের ঠোঁটের গভীরে ডুবে ছিল সে হিসেব ওরা দুজনেই রাখেনি।তবে ওদের সম্বিৎ ফিরল অনিমেষের ‘কাট ইট’ চিৎকারে।
।। ৮।।
-“মাইরি ইন্দ্র, রিমঝিমের মত সুন্দরীকে প্রোপজ করতে কারুর চারমাস সময় লাগে”!
অনিমেষের কথায় লাজুক ইন্দ্রকে মাথা নিচু করে থাকতে দেখে হঠাৎ করে রনি বলে উঠলো,
-“আমি তো রিমঝিমকে বলেই রেখেছিলাম, তুই যদি আজ ওকে প্রোপজ না করিস তাহলে আমি কাল ওকে সিওর প্রোপজ করব। শালা তোর মতো ক্যালানে পাবলিকের জন্য কেন যে এত পরিশ্রম করতে গেল মেয়েটা, ভগবানাই জানে”!
রনির কথয় জোর বিষম খেয়ে কোনো মতে নিজেকে একটু সামলে নিয়ে কূলকিনারাহীন ইন্দ্র রনিকে প্রশ্ন করল,
-“বলে রেখেছিলি মানে”!
ইন্দ্রের মুখের প্রশ্ন কেড়ে নিয়ে এবার রাহুল উত্তর দিল,
-“মানে তোমার মতো লাজুক লোককে দিয়ে প্রোপজ করানোর জন্য আমি আর রনি গত তিনমাস ধরে রিমঝিম ম্যাডামের নির্দেশনায় নাটক করে চলেছি। তুমি জাস্ট আমাদের স্ক্রীপ্টের ক্ষুদিরাম। যাকে ফাঁসিকাঠে ঝোলানোর জন্য এত আয়োজন”।
বিস্মিত ইন্দ্রের ঠোঁট দুটোর মধ্যে দূরত্ব বাড়তে থাকালে রনি আবার বলতে থাকে,
-“তোর হিরোইন অনেক ঝানু পিস্ বুঝলি তো! ওর প্রথম থেকেই তোকে পছন্দ। কিন্তু কোনো মেয়েকে পছন্দ হলেও জিন্দেগিতে তুই যে মুখ ফুটে কিছু বলতে পারবি না সেটা ও অনেকদিন আগেই বুঝে গিয়েছিল।কিন্তু এই মেয়েও তোকে দিয়ে প্রপোজ করাবেই ঠিক করে নিয়েছিল।তাই প্ল্যান করে আমাকে বেশি ইম্পোর্টেন্স দেওয়ার নাটক শুরু করেছিল।আর এরপরের ঘটনাগুলো তো রাহুলের স্ক্রীপ্ট অনুযায়ী তুই ই সাজিয়েছিস”।
-“ওহ্ মাই গড! এ মেয়ে তো তোদের সবাইকে এক ঘাটে কিনে আরেক ঘাটে বেঁচে দিয়ে আসবে রে”, রনির কথা শুনে বিস্মিত অনিমেষের কথায় তাল মিলিয়ে ইন্দ্রও মিথ্যে রাগের ভান করে অনিমেষকে বললো,
-“তুমি রানিদিকে বাদ দিয়ে দাও অনি দা।তোমার অ্যাসিস্টেন্ট তো এখন স্ক্রীপ্ট রাইটার হয়ে উঠেছেন।আর কোনো চিন্তা নেই”।
তারপর আস্তে করে পাশে বসে থাকা রিমঝিমের হাতে চাপ দিয়ে ওর কানের কাছে মুখটা নামিয়ে এনে বললো,
-“এক মাঘে শীত যায় না রিম,এর শোধ আমি প্রতি মাঘে তুলব”,মিষ্টি লাস্যময়ী হাসিতে ইন্দ্রের বুকে আলোড়ন তুলে রিমঝিম ফিসফিসিয়ে বললো,
-“প্রতীক্ষায় রইলাম”।
#সমাপ্ত