পুরনো ধনী পরিবারগুলির দুর্গাপুজো ‘বনেদি বাড়ির পুজো’ নামে পরিচিত। দুর্গাপুজো বাঙালির আনন্দের উৎসব। বঙ্গদেশের দুর্গাপুজোর বিস্ময় ফুরিয়ে যায় না এখানেই। দুর্গাপুজো বা বঙ্গদেশের এই শ্রেষ্ঠ উৎসবকে ঘিরে বলার মতো আছে আরও অনেক কিছু। সব জায়গার সার্বজনীন পুজোর সাথে সাথে কতগুলি বনেদি বাড়ির পুজো দুর্গাপুজোর আকর্ষণকে আরো বাড়িয়ে তোলে। পারিবারিক স্তরে দুর্গাপুজো প্রধানত ধনী পরিবারগুলিতেই আয়োজিত হয়। এরকমই বনেদি বাড়ির পুজোর গল্প আজ আমার আলোচ্য। প্রথমেই শুরু করি আমার শহরে আমাদের সাহাবাড়ীর পুজো দিয়ে !
আমাদের সাহাবাড়ির পুজো :
আমার শহর পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব বর্ধমান জেলার কাটোয়া মহুকুমায়। এই শহরে কেটেছে ২৫ টা বছর। কালক্রমে জীবন আবর্তে এসেছি আমেরিকায়। প্রবাসে বসে দুর্গাপুজোর কথা বলতেই প্রথমেই যেটা আমার মনে ভিড় করে সেটা হলো আমাদের সাহা বাড়ির দুর্গাপুজো।
আমাদের এই সাহা বাড়ির পুজো প্রায় দুই দশক ধরে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সাবেকিয়ানা এখনও অটুট সাহা বাড়ির পুজোয়। এই সাহা বাড়ি পুজো শুরু করেছিলো সাহা বাড়ির ছোট ছেলে বিদ্যুৎ সাহা (আমার দাদা)। তারই উদ্যোগে প্রথা অনুযায়ী দুর্গাপুজো পালিত হয়ে আসছে এখনও। চতুর্থীতে আমাদের বাড়িতে মাকে কুমোর টুলি থেকে নিয়ে আসা হয়। মূলত মহালয়ার দিন থেকেই আমাদের একটা পুজো পুজো ভাব তৈরি হয়ে যায়। ষষ্ঠীতে বোধনের পর সপ্তমীতে নবপত্রিকা স্নানের মাধ্যেমে দেবীর পুজো শুরু হয়।মূলত বাড়ির গৃহবধূরা খুব নিষ্ঠার সঙ্গে পুজোর সমস্ত উপকরণ প্রস্তুত করেন। দেবী দুর্গার বাহন পাখাযুক্ত শ্বেত সিংহ এবং বাঘ সহ গণেশ, কার্তিক, লক্ষ্মী, সরস্বতী ছাড়াও থাকেন উনাদের বাহন । দেবীকে নবরত্নের হার ও সোনার হার পরানো হয়। দশ হাতে থাকে বালা। পরানো হয় সোনার টায়রা-টিকলি। হাতে দেওয়া হয় রুপোর অস্ত্র।ষষ্ঠী থেকে মানুষের ঢল নামে সাহা বাড়িতে। সাধারণত আশ্বিন মাসের শুক্ল পক্ষের ষষ্ঠ থেকে দশম দিন পর্যন্ত শারদীয়া দুর্গাপুজো অনুষ্ঠিত হয়। এই পাঁচটি দিন যথাক্রমে মহাষষ্ঠী, মহাসপ্তমী, মহাষ্টমী, মহানবমী ও বিজয়াদশমী নিয়মমাফিক ভাবেই পালিত হয় । বছরভোর প্রতীক্ষার পর ষষ্ঠীতেই বিশুদ্ধ পঞ্জিকা মতে সাহা বাড়িতে শুরু হয় দেবী দুর্গার বোধন।
বাড়ির আত্মীয়-পরিজনে ভরে ওঠে দুর্গাদালান। দুর্গতিনাশিনীর প্রতি নিবেদিত ফুল বিল্ব পত্র এবং মন্ত্রে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে বাড়ি। এক একদিন এক এক ফুলের মালায় দেবীকে সুসজ্জিতা করে তোলেন বাড়ির সদস্যরা। সপ্তমীতে কলাবউ স্নান একটি বিশেষ আকর্ষণের। বাড়ির ছোট ছেলে যিনি এই পুজো শুরু করেছেন তিনি নিজেই গঙ্গা নদী থেকে কলাবৌ সমেত ঘট নিয়ে আসেন ,সঙ্গে থাকে বাড়ির অন্য অনেক সদস্যরা। সকাল হতেই সবাই দল বেঁধে যাওয়া হয় গঙ্গায়। সেসব স্মৃতিপটে আজও স্পষ্ট ধরা পড়ে। প্রবাসে দুর্গাপুজোর এরকম স্বাদ পাওয়া কোনোদিনই সম্ভব নয়।
চিরাচরিত নিয়মানুসারে অষ্টমীর ভোগে নিবেদন করা হয় লুচি, আলুর দম , বাঁধাকপির তরকারি, চাটনি, মিষ্টি এবং ফলফলাদি। পাশাপাশি সপ্তমী থেকেই চলে পূজোর নৈবেদ্যর ডালি। প্রত্যেক বছর আসা চিন্ময়ী মায়ের সমাদরের আয়োজন বিন্দুমাত্র খামতি রাখেন না সাহা বাড়ির সদস্যরা। পুজোর সবকটা দিন নৈবেদ্য দেওয়া হয়, তার আয়োজনও বিশাল। বাড়ির সকলে আনন্দে মেতে ওঠে এই পুজোর দিন গুলোতে। প্রত্যেকদিন নতুন নতুন পোশাকে সজ্জিত হয় সকলে। বাড়ির ছোট সদস্যরা অর্থাৎ বাচ্চারা হই হুল্লোর করে পুজোর আনন্দ কে দ্বিগুণ মাত্রা দান করে। অষ্টমীতে একসঙ্গে ‘নারায়ণী নমস্তুতে’ মন্ত্রে অঞ্জলি, পরবর্তীতে ১০৮টি প্রদীপে সন্ধিপূজো – এসবের জন্য অপেক্ষা করে থাকে প্রত্যেকই। পুজোর দিনগুলোয় সন্ধ্যায় হতো আরতি; আরতির সময় ধূপ-ধোঁয়ায় চারদিক হয়ে যেত গন্ধময়। ধোঁয়াটে পরিবেশ আর ঢাক-ঢোল-কাঁসর ধ্বনিতে নাচতো অনেকে । প্রতিমার সামনে ধুনুচি হাতে নিয়ে নাচ সেতো চির বাঙালিয়ানায় ভরপুর। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আত্মীয় পরিজনেরা মিলিত হন এই পুজোকে ঘিরে। তবে ধ্রুবতারা জগন্ময়ীকে ঘিরে নবমী নিশি আটকে থাকতে চায় সাহাবাড়ির এই দুর্গাদালানটিতে। দশমীর আরতি অঞ্জলিতে ভারাক্রান্ত মনে তখন একটাই রব, “আসছে বছর আবার হবে ”।
দশমীর ভাসানে তা যেন উন্মাদনা। বেলা তিনটের দিকে উলু ধ্বনি করে বিসর্জন শুরু হয়। নাটমন্দির থেকে দেবীকে নামিয়ে শহর সংলগ্ন গঙ্গা নদীতে দেওয়া হয় দেবী বিসর্জন। দুর্গাপুজোয় পারিবারিক আত্মীয়দের সমাগম এবং বন্ধু-বান্ধবদের মিলন এগুলো ছিল সত্যি খুব আনন্দের। বিবাহিত রমণীদের কাছে সিঁদুর দান অনুষ্ঠানটির তাৎপর্য অনেক বেশি। তাঁরা তাঁদের স্বামীর দীর্ঘায়ু কামনা করে দেবীকে সিঁদুর দিয়ে থাকেন। তারপর অন্য রমণীদের সিঁদুরের লাল রঙে রাঙিয়ে তোলেন। তখন শঙ্খ, ঘণ্টা, ঢাক, কাঁসর প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্র বাজতে থাকে।বিসর্জনের বিদায়ের সুরকে সঙ্গে রেখেই বাড়ির সদস্যরা গান নাচে মেতে ওঠে। সবার মিলনই দুগাপুজোর আসল রূপ। আমাদের আনন্দ সবার সঙ্গেই ভাগ করে নিই। সবার সঙ্গে পুজো করতে, আনন্দ করতে আর পুজোর প্রসাদ সবাই একসঙ্গে খেতে কী যে আনন্দ, তা বলে বোঝানো যাবে না। পূজার প্রসাদ সবাইকে দিয়ে খাওয়া হতো। প্রথম দেওয়া হতো ফলমূল। দুপুরে দেওয়া হতো ভোগ, তাতে খিচুড়ির অন্ন সঙ্গে লাবড়া অর্থাৎ নানা রকম শাকসবজি দিয়ে তৈরি নিরামিষ তরকারি,পনির,ধোকার ডালনা।সবার মধ্যে এই আনন্দ আর তৃপ্তি দেখে খুবই আনন্দিত হতাম।
আমাদের শহরে আরো বেশ কিছু বনেদি বাড়ির পুজো হয়। বাংলার বুকে ছড়িয়ে আছে কত বনেদি বাড়ির ইতিহাস। কোথাও রাজবাড়ির পুজো, আবার কোথাও জমিদার বাড়ির পুজো। পুরনো সেই সব বাড়ির সঙ্গে জড়িয়ে আছে বহু লোকশ্রুতি ,গল্পগাথা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বনেদি বাড়ির পুজোর জৌলুস কমলেও, সাবেকিয়ানা এখনও অটুট ইতিহাসের গন্ধমাখা শতাব্দী প্রাচীন সব পুজোয়। দুর্গাপুজোতে সব সম্প্রদায়ের লোকই সমবেত হন পুজোমণ্ডপে । কারণ, ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সবার মঙ্গল কামনায় দেবী দুর্গা এই ধরণিতে আসেন।আমাদের দেবগণ নিজ নিজ দেহ নিঃসৃত তেজ দ্বারা যেমন দেবীর অঙ্গ সকল সৃষ্টি করে তাকে পূর্ণরূপ দিয়েছিলেন, সেভাবেই তাঁরা নিজ নিজ শ্রেষ্ঠ অস্ত্রও তাঁর হাতে তুলে দিয়ে তাঁকে করেছিলেন রণসাজে সজ্জিতা। অশুভ শক্তির প্রতীক পরাজিত অসুরকে পায়ের তলায় রেখে যুদ্ধ করে মা শিক্ষা দিলেন জীবজগৎকে। সংসার রঙ্গনে বাঁচতে মানুষের লাগে বুদ্ধি, ঋদ্ধি, সিদ্ধি ও ক্ষাত্রশক্তি। তাই তো আদ্যশক্তির মহিমায়ায় আছেন লক্ষ্মী, সরস্বতী, গণেশ ও কার্তিক। ধনের দেবী লক্ষ্মী, বিদ্যার দেবী সরস্বতী, দেব সেনাপতি কার্তিক, গণদেবতা ও সিদ্ধিদাতা গণেশও হচ্ছেন পূজিত। অন্যদিকে সরস্বতীর বাহন রাজহংস, লক্ষ্মী দেবীর বাহন প্যাঁচা, গণেশ ঠাকুরের ইঁদুর ও কার্তিকের বাহন ময়ূর—প্রতিটি প্রতীকই আধ্যাত্মিক তত্ত্বের ভাবমণ্ডিত। দশমীর দিন রাবণ বধ করে সাড়ম্বরে বিজয়া দশমী পালন করা হয় তখন থেকে বসন্তকালে ও শরৎকালে দুর্গাপুুজো ও শুভ বিজয়া দশমী পালিত হয়ে আসছে। প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই চলে আসছে মাতৃ পুজার চিরন্তন ধারা।
বাঙালি হিন্দুরা সবাই দুর্গাদেবীর পুজো করে। তবে প্রাচীনকালে রাজা, জমিদার আর ধনাঢ্য বণিক সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যেই এ পুজোর প্রচলন বেশি লক্ষণীয়।তবে বহুকাল থেকে আর্থিকভাবে সচ্ছল ও ধনী ব্যক্তিরাই পারিবারিকভাবে বংশপরম্পরায় দুর্গাপুজো করে আসছেন।
প্রতিবছর মা আসেন মর্ত্যে , ভক্তের পুজো নিয়ে আবার ফিরেও যান কৈলাসে। মায়ের আগমনে সন্তানের আনন্দ। মায়ের কাছে সন্তানের অধিকার সমান। কারণ, তিনি বিশ্ব জননী। সনাতন ধর্মশাস্ত্রে দুর্গা নামটির ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে ‘দ’ অক্ষর দৈত্যনাশক, উ-কার বিঘ্ননাশক, রেফ রোগনাশক, গ অক্ষর পাপনাশক ও অ-কার ভয় শত্রুনাশক। তার মানেই দৈত্য, বিঘ্ন, রোগ, পাপ ও ভয় শত্রুর হাত থেকে যিনি রক্ষা করেন, তিনিই শ্রীদুর্গা। অন্যদিকে শ্রীশ্রী চণ্ডী অনুসারে এই দেবীই ‘নিঃশেষদেবগণশক্তি সমূহমূর্ত্যাঃ’ বা সকল দেবতার সম্মিলিত শক্তির প্রতিমূর্তি। তিনি আমাদের দুর্গতি থেকে ত্রাণ করেন বলেই দেবীর নাম হয়েছে দুর্গা।