সুদূর ইডেন উদ্যানের দেহ থেকে খসে যাওয়া তুষারকুচি পাক খেয়ে খেয়ে পরে আমার সোয়েটার হাতায়।ধূসর এই শহরের চোখ।চালশে।অনিমেষে চেয়ে থাকা সপ্তর্ষিমণ্ডল থেকে নীলাভ বিদ্যুৎরেখা ভল্ট খেয়ে নেমে আকাশচুম্বী বাড়িগুলোর বেয়াদপিতে শান দেয়।হলুদ ট্যাক্সি একঝটকায় এসে ফাটা প্লাস্টিকদের উড়িয়ে দিয়ে চলে যায় সিগনালের তোয়াক্কা না করেই।ভুলে পা পড়ে যায় নর্দমার স্রোতে,চিপসের পুরোনো প্যাকেট,বিলিতি জং ধরা রেজার,একটা মুঘল আমলের হ্যামের টিন,বুড়ো আরশোলা-সব চলেছে তীর্থযাত্রী হয়ে।সামনেই একটা পরিত্যক্ত পার্ক,বনানীর জাপ্টে ধরা সোহাগে সবুজ সবুজ তার সারাদেহ।ওই অব্যবহৃত দোলনায় শিশুর পা পড়েনি বহুদিন,পথের ধারের হাইড্রিঞ্জিয়ার ঝোপে অনেকদিন আদরের কুস্তি লড়েনি উন্মত্ত তারুণ্য।শুনেছি রাতের নির্জনতায় সামনের ছোট্ট পুকুরে পা ডোবাতে আসে জিনপরীরা,চাঁদের গুঁড়ো মেখে ত্বককে করে তোলে বসরাই গোলাপের মতো মোলায়েম।

নেতার আঙুল-উঁচানো,দাঁত বের করা মূর্তিতে টার্গেট করে কাকেরা নিক্ষেপ করেছে তাদের ক্ষেপণাস্ত্র,আর তার ঠিক নিচেই একটা পাগল বসে।ঝাঁকড়া চুল,ছেঁড়া জ্যাকেট,ইউকালেলে হাতে,ঠোঁটে উদ্দাম ব্লুজ।সামনের রঙ-ওঠা থালায় একটা পয়সা ফেলে হাঁটি।আড়চোখে দেখে সে আবার গান ধরে।দুচোখ দিয়ে মেয়েদের মেপে নিই,শীতবস্ত্রের ওপারে উদ্ধত বুক,না সব সমতল?নদী কি পথ হারাবে নাভির অতলতায়,না স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে রোদের রঙ ধরে মিশবে ঠিক ম্যানিকিয়োর করা বুড়ো আঙুলের ডগায়?যেতে যেতে ওদের নমনীয়তা পরখ করি হাতড়ে হাতড়ে,চেঁচিয়ে ওঠার আগেই আমি ভ্যানিশ!

একটু মদ খাব,তেষ্টায় গলা চৌচির।আজকাল খাইনা বেশি,শুধু দু-এক পেগ ঢেলে কষে গালাগালি দিই শহরের জমকালো মেদবহুল দেহটার উদ্দেশ্যে। পকেটে দেখছি একটাই নোট পড়ে,বাজার করব ভেবেছিলাম।কিন্তু যা হোক,ঢুকে পড়লাম একটা বাদামী শুঁড়িখানায়।পিছনের ঘরে মধুর ব্যাপারীরা জমেছে,কয়েকটা পিশাচ মিলে তারিয়ে তারিয়ে চাখছে নরম নরম তরুণ মাংস,আর উত্তেজনায় কেঁপে কেঁপে উঠছে গ্লাসের সারি।একটা অশালীন,অর্ধনগ্ন পোস্টারে চোখ রেখে চুমুক মারলাম।উফ,বড্ড কড়া,লিভারে জং ধরে যাবে।কোণের বুড়োটা,যাকে দেখলে মনে হয় যেন তিন দশকের মেঘের ওজন ওর শিরদাঁড়াকে চূর্ণ করছে প্রতি মুহুর্তে,ক্যাশবাক্সের সামনে বসে আছে আনমনা।সেদিন ওর ছেলেকে পুলিশ সাবাড় করেছে।মাদকের পুরিয়া নিয়ে দৌড়াচ্ছিল বন্দরের গলিঘুঁজি দিয়ে,একটা বুলেটের দৌরাত্ম্যে সে আজ ওক গাছে ঘেরা একটুকরো জমির নীচে শুয়ে।চেয়ে দেখলাম ভালো করে।বুড়োর দৃষ্টিতে ভাষা নেই,কাঁদতেও ভুলে গেছে হঠাৎ।এই শহরের সবাই কাঁদতে ভুলে গেছে আজকাল।

এ এক অদ্ভুত রোগ।আমার পাশের বাড়িতে কড়া নাড়লে যে দরজা খোলে,তার দৃষ্টিতে শুধুই দেখি ফেলে দেওয়া বোতলের শূন্যতা।বিলিরুবিনসিক্ত মুখে বাগান পরিষ্কার করে রাতে ওরা ঝালঝাল শুয়োরের মাংস খাবে,কিন্তু দেখা হলে একরাশ নিরুত্তর শূন্যতা নিয়ে তাকাবে আমার দিকে।একদিন এমন একটা ছেলের মুখে দিয়েছিলাম কষে এক থাবড়া।মুখ দিয়ে লালা বেরিয়েছিল,শুধু শব্দগুলো যেন মুছে গিয়েছিল চিরতরে,রিসাইকল বিনে বারবার ক্লিক করেও খুঁজে পাইনি।কাঁধ ধরে ঝাঁকালাম,চিৎকার করলাম পাগলের মতো,গলা ফাটিয়ে শাসালাম।তবু নিরুত্তর রইল ওর দুঠোঁট।

শরতের আভা নিয়ে ঝরে গেছে মেপলের লালচে চুল,ফুটপাথে ছড়িয়ে দিয়ে গেছে বেদনার রোদেলা মেঘ।স্বর্গের তুষারকুচি ঝরে পড়ল আমার গ্লাসের সোনালী তরলে।নিভে আসা আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি,পরদেশী মেঘের মাঝে বসে আছে আমার বিষণ্ণ সরস্বতী,তার তার-ছেঁড়া বীণাখানি বুকের পরে ধরে।

Print Friendly, PDF & Email
Previous articleতবুও খুঁজি তোমাকে
Next articleএই কি জাদু ?
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments