চোলাইটা আজ একটু বেশিই পড়ে গেছে দামা সোরেনের পেটে। টলতে টলতে গাঁয়ের পুরাতন বাস স্টপের অশ্বত্থ তলায় এসে বসলো দামা। রাত এখন আটটা সাড়ে আটটা হবে। গাঁয়ের পথে যানচলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। লোকচলাচল ও কমে এসেছে। নিঃশব্দ অন্ধকার ভেদ করে উঠেছে পূর্ণিমার চাঁদ। ক্ষণে ক্ষণে শোনা যাচ্ছে নেকড়ে আর শেয়ালের ডাক। প্রায় বছর দশেক বাদে আজ আবার দামার ভীষণভাবে মনে পড়ে যাচ্ছে মালতীর কথা।
মালতীর সঙ্গে যখন বছর একুশের দামার বিয়ে হয় তখন মালতী চোদ্দো বছরের এক ডাগর কিশোরী। মালতীর তেল চকচকে কালো বদনে হলুদ শাড়ি আর ধামসার তালে নাচ নেশা ধরায় দামার মনে। এদিকে পেটানো চেহারার যুবক দামা। বড়ম পরবের পূন্য লগ্নে যখন সে মালতীকে বিয়ার প্রস্তাব দেয়, মালতী ও অস্বীকার করতে পারে না।
বিয়ের পর প্রথম ক’বছর বেশ ভালোই কাটে দুজনের। একটি খোকাও হয়।
কিন্তু হায়, পুরুষের মন! বিয়ের চার বছরের মাথায় দামার আবার মনে ধরে অন্য এক রমনী। এ অবশ্য মালতীর মতো কুমারী নয়। গাঁয়ের চোলাই ঠেকের বিধবা মালকিন। বিরাট তার দাপট। পুলিশের চোখে চোখ রেখে কথা বলে। বছর তিনেক হলো তার মরদটি গাঁয়ের কূর্মী পুকুরে ডুবে মারা গেছে।
গাঁয়ের এই কূর্মী পুকুর কত লোকের যে প্রাণ নিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। লোকে বলে এই পুকুরে নাকি কুদ্রা বুড়ির বাস। শননুড়ি কুদ্রাবুড়ি আবার ইচ্ছাধারী। সুন্দরী রমণীর বেশ ধারণ করে রাতের অন্ধকারে সে বসে থাকে গাঁয়ের বট অশ্বত্থ তলায়। গাঁয়ের যুবকেরা তার রূপে প্রলুব্ধ হয়ে ফাঁদে পড়ে। কুদ্রা বুড়ির কোপ থেকে গাঁয়ের যুবকদের রক্ষা করতে মা কুদ্রা বুড়ির থানে পূজা দেয় গাঁয়ের রমনীরা।
সে যাই হোক, দামার সাথে চোলাই ঠেকের বিধবার সম্পর্কের কথা গাঁয়ে চাউর হতে বেশি সময় লাগে না। মালতীর কানেও পৌঁছায় সেকথা। এই নিয়ে শুরু হয় দামা আর মালতীর নিত্য অশান্তি। এদিকে বেড়ে চলে দামার চোলাইয়ের নেশাও। কাজকম্ম লাটে ওঠে। এখন দামা দিনরাত চোলাইয়ে বুঁদ হয়ে পড়ে থাকে বিধবার ঘরে। এইভাবেই একদিন বিধবার ও পেট ফোলে। সারা গাঁয়ে ছিছিক্কার পড়ে যায় দামা আর বিধবার নামে।
দশ বছর আগের সেই রাতে মালতীর সাথে দামার অশান্তি চরমে ওঠে। রাগের মাথায় দামা, মালতী আর তার খোকাকে মারধর করে চুলের মুঠি ধরে ঘর থেকে বের করে দেয়। এরপর থেকে দামার ঠাঁই হয় চোলাই ঠেকের বিধবার আঁচলের তলায়। ধুমধাম করে সারা গাঁয়ে খবর দিয়ে তারা বিয়েও করে। মালতীর সাথে বিচ্ছেদের পর থেকে দামা আরো বেশি করে নেশায় বুঁদ হয়ে যায়। এদিকে সেই বিধবা গাঁয়ের অন্য এক যুবকের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে আর সর্বক্ষণ মাতাল স্বামী দামাকে গালমন্দ করে। অতিষ্ঠ ও তিতিবিরক্ত দামা বেশিরভাগ সময় ই মদ খেয়ে গাঁয়ের পার্শ্ববর্তী জঙ্গলে ইতিউতি ঘোরাঘুরি করে অথবা মা কুদ্রা বুড়ির থানে গিয়ে পড়ে থাকে।
মালতীর সাথে তার সুখের জীবন আর এখনকার এই দুর্বিষহ জীবনের সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে কখন যে তার চোখ লেগে গেছে খেয়াল নেই। হঠাৎ দামার ঘুম ভাঙল নূপুরের শব্দে। এই শব্দ তার খুব চেনা। চোখ মেলে ই চমকে উঠলো দামা। পুরাতন বাসস্টপের অশ্বত্থ গাছ পেরিয়ে দক্ষিণে বনের পথে এত রাতে একাকী চলেছে কে ঐ ঘোমটা ঢাকা রমনী? সসন্দেহে তার পিছু নিলো দামা। রমনী টি নির্বিকার চিত্তে বনপথ ধরে চলতে লাগল। কেউ যে তার পিছু নিয়েছে সেকথা যেন সে বুঝে ও বুঝলো না। নূপুরের শব্দে ছিন্নভিন্ন হতে থাকলো রাত্রির নৈঃশব্দ্য। দামার মনে অস্থিরতা ও বেড়ে চললো। কিছুতেই সে মনে করতে পারছে না এই শব্দ সে আগে কোথায় শুনেছে। একবার তার মনে হলো পিছন থেকে রমনীটিকে ডাক দিই। পরক্ষনেই এক অজানা আতঙ্ক তাকে গ্রাস করলো। জিভ জড়িয়ে গেলো, গলা দিয়ে কোন শব্দ বেরোলো না। কিন্তু মুখে কোন শব্দ না বেরোলে ও সে রমনীটির পিছু পিছু চললো। রাতের অন্ধকারে অতি পরিচিত নূপুরের শব্দে তাল মিলিয়ে এই একাকী রমনীর পথচলার রহস্য এক অমোঘ আকর্ষণে দামাকে টেনে নিয়ে চললো বনের পথে। কুদ্রা বুড়ির থান পেরিয়ে রমনীটির পিছু পিছু সে এসে পৌঁছালো কূর্মী পুকুরের পাড়ে। এবার জড়তা কাটিয়ে সমস্ত শরীরে সাহস সঞ্চারিত করে সে হাঁক দিলো – “কে তুই?” দামার হাঁকে সচকিত রমনী ঘুরে দাঁড়াতেই খুলে গেলো ঘোমটার আড়াল। ” আরে ই তো মালতী বুটে” চমকে উঠলো দামা। পূর্ণিমার প্রগলভ ছটায় মালতীকে মনে হলো যেনো এখনো সেই বছর চোদ্দোর ডাগর কিশোরী। ” নাহ ই মালতী লয়……”
পরদিন সকালে কূর্মী পুকুরে ভেসে উঠলো দামা সোরেনের মৃতদেহ। পুলিশ এলো, বিডিও এলো। সুরতহাল হলো। কিন্তু দামা সোরেনের জলে ডুবে মরার রহস্য কুদ্রা বুড়ির লোককথায় মিলিয়ে গেলো। দশ বছর আগে এই কূর্মী পুকুরে ঝাঁপ দিয়েই সপূত্র আত্মহত্যা করেছিলো মালতী সোরেন।