তখন আমার আস্তানা জঙ্গলের ভেতর নদীর ধারের বাংলো। এক সন্ধ্যেবেলা বারান্দায় বসে আছি। সামনে কুয়াশার চাদরে মোড়া অমাবস্যার জঙ্গল। কানে আসছে নদীর জলের আওয়াজ। আশেপাশে কয়েক মাইলের মধ্যে কোনো জনবসতি নেই। আধারে এই জঙ্গলের মাঝে নিজের অস্তিত্বকে বড়ই তুচ্ছ মনে হচ্ছে। এই যে প্রকৃতির সাথে একাকী অভিসার, এই আইডিয়াটা আর কারোর নয় আমার নিজের ছিল।
আমি কে? না আমি কোন কবি বা সাহিত্যিক নই; কোলকাতায় কর্পোরেট সেক্টরে চাকুরীরত এক সাধারন কর্মচারী মাত্র। তবে আমি গ্রামের ছেলে হওয়াতে মাঝেমাঝে শহরের ব্যস্ততা আর যান্ত্রিকতাকে ছাড়িয়ে কয়েকদিনের ছুটি নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। আমার সেবারের বনবাসের আইডিয়াটাও আমারই ছিল। তিনদিনের ছুটি নিয়ে যে জায়গাটাতে আমি গিয়েছিলাম তার নাম ডাও হিল ফরেস্ট। বলা যায় কার্শিয়াং এর এক কুখ্যাত জঙ্গল এটা। লোকাল মানুষরা এই জঙ্গলটাকে বেশ এড়িয়েই চলে দেখলাম। যাওয়ার সময় এক চা ওলার থেকে জায়গাটার হদিস জানতে চাইলে সে আমার দিকে এমন ভাবে তাকালো যেন মনে হল আমি যেন কোনো অপরাধের কথা বলে ফেলেছি ।
“বাবু, আপনি শহরের লোক, আপনাকে কিই বা বলতে পারি? তবে ওই জঙ্গলে যারাই গেছে তারা আর কখনো ফিরে আসেনি ।”
চাওলার কথা শুনে আমি বললাম ” সেকি ? দিনে দুপুরে জ্যান্ত মানুষ উধাও হয়ে যাচ্ছে? “
” হ্যাঁ বাবু, আর যাইহোক ওই জঙ্গলে আপনি রাত কাটাবেন না। “
আমি হাসতে হাসতে বললাম, ” এটা তো অন্য কিছুও হতে পারে। যাই হোক এবার আসি, অনেকটা পথ যেতে হবে এখনো। ” বলে আমি বেরিয়ে পড়েছিলাম।
এখন হাতে চায়ের কাপ নিয়ে বসে ভাবছি কোনো জঙ্গল এতটাও নিঃশব্দ হতে পারে?
যাই হোক চায়ের কাপটা নামিয়ে রেখে আরো কিছুক্ষণ বাংলোর বারান্দায় বসে থাকলাম। এখানে মোবাইলের নেটওয়ার্কও পাওয়া যাচ্ছে না। এখন রাত আটটা বাজে।
শেষমেশ কি করব বুঝতে না পেরে আমার রুকস্যাকে থাকা ব্রেড আর বাটারের প্যাকেটটা বের করে আমার ডিনারের আয়োজন করতে লাগলাম। ন’টার মধ্যে ডিনার শেষ আর এখানে কোনো ইলেকট্রিক্ আলোও নেই যে কিছুক্ষণ আরও বসে থাকা যায়। ভাবলাম এই জঙ্গলে তো কোন জন্তু জানোয়ার সেরকম নেই তাই একটুখানি বেরিয়েই আসি। যে ভাবা সেই কাজ। হাতে আমার টর্চটা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।
বাংলা থেকে অনেকটাই দূরে চলে এসেছি, জঙ্গল অতটা ঘন নয় যতটা ভেবেছিলাম। হঠাৎ দূরে কিসের একটা আলো আর কিছু ব্যস্ততার চিহ্ন আমার চোখে পড়ল। যেন মনে হচ্ছিল ওখানে কোনো কিছুর আয়োজন করা হচ্ছে তবে সবটাই যেন গোপনীয়তার আড়ালে রাখা হয়েছে। অতটা ব্যস্ততার মধ্যেও একটুও অকিঞ্চিৎ চেঁচামেচি বা রেস্টলেসনেস চোখে পড়ল না। আমি আরও কিছুটা এগিয়ে যা দেখলাম তাতে আমার চক্ষু চড়কগাছ। দেখি অতি গোপনীয়তার সাথে 4-5 জন লোক কীসব মেশিন নিয়ে জঙ্গলের গাছগুলোর কাছে দাঁড়িয়ে আছে; যেন কারোর অপেক্ষা করছে। আমিও অপেক্ষা করতে লাগলাম। একটু পরে পেছনে কার একটা উপস্থিতির আভাসে পিছনে ফিরতেই মাথায় একটা সজোরে আঘাত টের পেলাম।
যখন জ্ঞান ফিরলো দেখলাম সামনের লোক গুলো অতি ব্যস্ততার সাথে অথচ নিস্তব্ধ ভাবে গাছগুলোকে কাটছে। মুহূর্তের মধ্যে বুঝে গেলাম আমি কি পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছি। আমার হাত পা ও শক্ত করে বাঁধা, মাথায় প্রচন্ড যন্ত্রণা। হঠাৎ করে সামনে একজন বেশ লম্বা-চওড়া লোক, সম্ভবত এদেরই লিডার আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। তার হাতে থাকা অস্ত্র টা দেখে অতি সাহসীরও বুকটা একবার হলেও কেঁপে উঠবে।
রিভলবারটা আমার মাথায় ঠেকিয়ে সে বলে উঠল,” কিরে, আমাদের ওপর গোয়েন্দাগিরি করতে এসেছিস? আর একটু দাঁড়া আমাদের কাজ হয়ে গেলে তোর ভবলীলা সাঙ্গ করে দেবো। “
আমি মিনমিন করে বললাম, ” আমি একজন চাকুরীজীবি মাত্র। আমি কোনো গোয়েন্দাও নই কোন পুলিশও নই। “
” চুপ আর একটা কথাও বলবি না নইলে এখানেই মেরে তোর লাশটা পুঁতে রেখে দেবো। ” বলে সে আমার কোনো কথা না শুনেই চলে গেল সেখান থেকে। আরো বেশ কিছুক্ষণ পর সেই লিডারটা আবার আমার সামনে এসে দাঁড়ালো।
” নে এবার ভগবানের নাম জপতে শুরু কর। ” বলে রিভলবারটা আমার মাথায় ঠেকিয়ে যেই না ট্রিগারটা টানতে যাবে অমনি কিছু একটা যেন ঘটে গেল।
যখন চোখ টা খুললাম দেখি ওই গ্যাংটার একটা লোকও আর সেখানে নেই। তার বদলে আছে এক উজ্জ্বল আলোর গোলক। ধীরে ধীরে সেই আলোর গোলক টা আমার কাছে এগিয়ে আসতে লাগল, আমি ভয়েতে জ্ঞান হারালাম।
পরে যখন আমার জ্ঞান ফিরল আমি তখন একটা হাসপাতালের বেডে শুয়ে। মাথায় হাত দিয়ে দেখলাম অদ্ভুতভাবে সেই রাতের চোটটা আর সেখানে নেই। বরং তার বদলে আমার মধ্যে এক অদ্ভুত ভালোলাগা আর ভালোবাসার অনুভূতি পেলাম। যা পড়েছিলাম বইতে তাই সত্যি, ওই জঙ্গলে আজও কিছু অদ্ভুত ঘটে। সেই ঘটনার পর থেকেই আমার মধ্যে কিছু অদ্ভুত শক্তির বিকাশ ঘটে।
কিন্তু সেই গল্প আরেকদিন। এ ছিল এক নতুন মানুষের জন্ম, আমার জন্ম।
~ গার্ডিয়ান এঞ্জেল ~