।নয়।
বেশ ভালোই সময় কাটছিল আজ, মানে কাজ টাজ একটু কম এই আর কি। গৌরী ঠান্ডা ঘরে থাকায় সবাই একটু আনমনা। লোকটার হোল কি, এতক্ষণ ধরে বসের ঘরে কি কাজ। গালিগালাজ যে চলছে না সেটা সিওর কারণ সেই ডেরটায় লোকটা ঘরে ঢুকেছে আর এখন প্রায় তিনটে। ডের ঘন্টা ধরে চিল্লামিল্লি করার মতো সময় বটব্যাল সাহেব বা ত্রিপাঠি সাহেবের নেই, ওরা ব্যাস্ত মানুষ … কখন সল্ট লেক থেকে বা রাইটার্স থেকে জরুরি ফোন আসবে তার ঠিক নেই। অনেক সময় দিল্লি থেকেও নানা জরুরি কাজের খতিয়ান চেয়ে ফ্যাক্স বা ফোন আসে। তাহলে কি?
ফ্লোরে কাজ চলছিল আবার কাজের ফাঁকে ফাঁকে ফিস ফিস করে নানা কথাও চালাচালি হচ্ছিল। কি হোল রে ভাই, গৌরীদা যে বসেদের কাছে এতো আপন তা তো জানা ছিল না।
কিন্তু সব কিছুরই শেষ আছে। প্রায় সাড়ে তিনটে নাগাদ স্যুইং ডোর ওপেন হোল, গৌরী বার হলেন। ঘাড়টা একটু নুয়ে রয়েছে মাটির দিকে, কেমন যেন নিরাশক্ত ভাবে মাটির দিকেই বোধহয় তাকিয়ে আছেন। হাতে একটা রুমাল, দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রুমাল দিয়ে একটু নাকটা মুছে নিয়ে আসতে আসতে নিজের ডেস্কের দিকে হাঁটতে লাগলেন। হাঁটার মধ্যে কোথায় যেন একটা শিথিলতা, এর চেয়ার ওর ডেস্কের কোনা ধরতে ধরতে গৌরী কোনোক্রমে নিজের চেয়ারে এসে বসে পরলেন। সারা ঘর সমস্ত কাজ থামিয়ে কেউ সোজাসুজি কেউ বা আর চোখে গৌরীর দিকেই তাকিয়ে আছে। গৌরী চেয়ারে এসে বসলেন কিন্ত চোখটা কেমন নিরাশক্ত, টেবিলের কোন হাবিজাবি জিনিসের ওপর ফোকাস করা। ঘরের সবাই কেমন বিমূঢ়, এই সময় ঠিক কি করা উচিৎ তা কেউই ঠিক করে উঠতে পারছে না।
হঠাৎ অম্বুই এগিয়ে এলো …
অম্বু। কি গো গৌরীদা, চা আনবো? বিকালের চায়ের তো সময় এসে গেলো …।
কানের পাশে একটা স্বর শুনে গৌরী একটু যেন বাস্তবে ফিরে এলো, ঘার ঘুরিয়ে একবার অম্বুকে দেখলো … তারপর একটু স্বভাব বিরুদ্ধ গম্ভীর গলায় বললো …
গৌরী। যা, একটা স্পেশাল নিয়ে আয়।
অম্বু একটু হকচকিয়ে গেল … স্পেশাল … তাও গৌরীদার জন্য? এমনি চা এখন তিনটাকা চলছে, তাও অফিসের ভিতরে … বাইরে হলে এটাই পাঁচ টাকা। কিন্তু স্পেশাল তো অফিসের ভেতরেই ছয় টাকা, গৌরীদা কোনদিনই স্পেশাল খান না। অম্বু একটু আমতা আমতা করে বলেই ফেললো …
অম্বু। গৌরীদা, আজ স্পেশাল … দেবো?
গৌরী কেমন একটা অদ্ভুত দৃষ্টিতে অম্বুকে দেখলেন, তারপর মুখটা ঘুরিয়ে নিয়ে টেবিলের ওপর রেখে সেই রকম ভরাট গলায় বললেন – তাই তো বললাম।
অম্বু আর ওখানে দাঁড়াল না, সোজা তার ছোট্ট দোকানে। এই লোকটার আবার কি হোল, বেশ তো শান্ত চুপচাপ ছিল এখন তো গলা দিয়ে মেঘ ডাকছে। দুত্তোর, তার আর কি, সে চায়ের দোকান চালায়। লোকে যদি একটু বেশী খায় তো ভালোই হবে।
সমীর, রমেনরা এতক্ষণ চুপচাপ ছিল, অম্বু চলে যেতেই ওরা সবাই একসাথে এসে গৌরীদার ডেস্কের আসে পাশে ভিড় করে দাঁড়িয়ে পরলো। একসাথে বেশ কয়েক জনের কন্ঠ শোনা গেল … ঠান্ডা ঘরে কি হোল গৌরীদা …। গৌরী নিচু মুখটা তুলে সবার দিকে একবার তাকালেন, ঠিক কি বলা যায় ঠিক করতে না পেরে আবার কেমন আনমনা হয়ে জানলার দিকে চোখ ফেরালেন।
রমেন এই সময় কন্ট্রোল নিল, ভারি সুন্দর মিস্টি করে জিজ্ঞাসা করলো – স্যারেরা কি বললেন গৌরীদা? সব ভালো তো?
গৌরী একটু সময় নিল, চশমাটা খুলে হাতে নিয়ে রুমাল দিয়ে ঘষতে লাগলো, সবাই চুপচাপ, গৌরীও কিছু না বলে কেমন আনমনা ভাবে একবার রমেনের দিকে তাকিয়ে চোখটা সরিয়ে নিল। রমেনের একটা বাজে স্বভাব যে সে বড় ছটফটে আর মনের মধ্যে প্যাঁচ কষেই চলেছে। সে অস্থির ভাবে নিজের নাকটা একটু চুলকে আবার মুখটা গৌরীর কানের কাছে নিয়ে এসে বললো – কি ব্যাপার গৌরীদা? আমাদের বলবেন না? আমরা এক ফ্লোরে ন বছর আছি, প্রায় বন্ধুই তো, নাকি? অতক্ষণ বসের ঘরে কি কথা হোল? আপনি আমাদের মধ্যে থাকছেন তো … নাকি সেকশান পালটে দিল?
গৌরী মাঝে মাঝে একটু মানসিক অশান্তিতে পরলে চিবোবার ভান করেন যেন মুখে কিছু পোরা আছে কিন্তু আসলে কিছুই নেই। এখনও সেই রকম তলাকার চোয়ালটা ওপরে নিচে ওঠা নামা করতে লাগলো। ঠিক কি বলবেন বুঝতে না পেরে মরিয়া হয়ে রমেন আর সমীরের দিকে একবার তাকালেন। চোখের গভীরে কোথায় যেন মানুষটা একটু আলাদা হয়ে গেছে। তারপর চশমাটা আবার চোখে দিয়ে চেয়ারটা একটু সরিয়ে বসলেন …
গৌরী। তোমাদের সামনে কিন্তু ভাই সামান্য একটু অসুবিধা রয়েছে। ব্যাপারটা যে এতটা কড়া হয়ে যাবে তা ঠিক বুঝতে পারিনি। কিন্তু টেবিলের ওদিকে দুজন বড় বস বসে আছেন কাজেই বাধা দেওয়া গেল না।
রমেন কেমন যেন হকচকিয়ে গেল … এ কেরে বাবা, এতো পুরনো গৌরীদা মনে হচ্ছে না। তবুও সে মরিয়ার মতো একবার বললো – কি বলছেন গৌরীদা … আমাদের মানে আমার আর সমীরের অসুবিধা…? মানে ইয়ে … আপনার সব ঠিক আছে তো? মানে বলছিলাম … এতক্ষণ ধরে বসের ঘরে ঝামেলা …!
গৌরী মাঝপথে ওকে হাত নারিয়ে থামিয়ে দিল – আরে ফাজলামি না করে শোন। আমাদের সেকশান থেকে তোমাকে আর সমীরকে আর ওপর থেকে আরো তিন জনকে আর কোলকাতায় রাখবে না। ডেপুটেশানে কলকাতার বাইরে পাঠিয়ে দেবে। চিঠি তোমরা আর আধ ঘন্টার মধ্যেই পেয়ে যাবে, টাইপ হচ্ছে ওপরে। সেই অফার অ্যাকসেপ্টের ওপর তোমাদের ডি.এ., গ্র্যাচুইটি সব নির্ভর করছে।
সমীর এবার খ্যাঁক করে উঠলো – তা এই অর্ডারটা কে দিল? আপনি নাকি?
গৌরী কিন্তু এই অপমান গায়ে মাখলেন না, ঠিক সেই রকম গম্ভীর স্বরে বললেন – ভাই, সব খেলারই তো শেষ আছে, নাকি? তোমার সেই মামা না মামাশ্বশুর … সে তো রিটায়ার করে গেছে, আর কত্দিন নির্ভাবনায় থাকবে? আমি ভাই অর্ডারে সই করে দিয়েছি। আমাদের ফ্লোরে তো এতো লোক দরকার নেই।
সমীর এবার সত্যিই ঘাবরে গেল, লোকটার মাথাটা সত্যিই খারাপ হল নাকি? সে শুধু বলতে পারলো – আপনি?
পেছনে হঠাৎ বটব্যালের বাজখাঁই গলাটা পাওয়া গেল – কেন ভাই? সন্দেহ হচ্ছে নাকি?
চারি দিকে নানা কথার মধ্যে কেউ খেয়াল করেনি যে বসরা দুজনেই তখনও বটব্যালের ঘরেই ছিলেন, কখন পা টিপে টিপে ওদের সবার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছেন। ত্রিপাঠি তার মোলায়েম গলায় বললেন …
ত্রিপাঠি। ওনাকে এখন আর কেউ বিরক্ত করবেন না। উনি আজ থেকেই এই ফ্লোরের ইনচার্জ, অফিস অর্ডার অলরেডি আমরা দুজনেই সই করে দিয়েছি। কালকে সকালেই ওনার বসার জায়গাটা প্লাই উডের পার্টিশান দিয়ে ঘিরে দেওয়া হবে, যতক্ষণ না আলাদা একটা ঘর ওনাকে দেওয়া যায়, তবে সেটারও ব্যাবস্থা হচ্ছে। অফিস অর্ডারে যাদের নাম থাকবে তারা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নতুন যায়গায় জয়েন করার চেস্টা করুন।
তারপর গৌরীর দিকে ফিরে বললেন – চল গৌরী, তোমার সাথে হেমন্ত কানিতকারের আলাপ করিয়ে দিই। উনি দিল্লী থেকে ডেপুটেশানে এসেছেন, ভীষণ দায়িত্বপূর্ন পদে আছেন।
গৌরী, বটব্যাল আর অমল ত্রিপাঠি ঘর থেকে বার হয়ে ওপরের ফ্লোরের দিকে পা বারালেন।
রমেন ততক্ষণে আর দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে একটা চেয়ারে বসে পড়েছে, ঘারটা কেমন কাত হয়ে আছে, কোন দিকে তাকিয়ে আছে বোঝা যাচ্ছে না। সমীরের চোখ দুটো লাল, চোয়ালটা শক্ত হয়ে আছে, হাতের মুঠো দুটো মোড়া, কাকে ঘুষি মারবে কে জানে।
০ শেষ ০