নতুন ফ্ল্যাটে shift করবো বলে, এ বাড়ীর সব পুরনো জিনিস আর কাগজ পত্র, ফেরিওয়ালাকে বিক্রি করার তোরজোড় করছিলাম। সেই সূত্রেই একটা পুরনো ডিভান ঘাটতে ঘাটতে, হঠাৎ জিনিসটা খুঁজে পাই। জিনিসটা খুবই সাধারন, একটা ডাইরি। কোন চামড়ায় বাধানো, নতুন বছরের gift পাওয়া ডাইরি নয় , এটা আমার স্কুলের ডাইরি। কেন জানিনা, জিনিসটাঠিকফেরিওয়ালাকেদিতেপারিনি।

সন্ধ্যেবেলায় ঘরে বসে, আস্তে  আস্তে আবার পুরনো পাতাগুলো ওলটাতে শুরু করলাম।    

বড়জোর শদেড়েক পাতার, বাধানো ডাইরি। প্রত্যেকটি পাতায় রুল টানা । মলাটে, সাদা কালিতে, আমাদের স্কুলের মনোগ্রাম আঁকা।  প্রথম পাতায়, পাকা অক্ষরে আমার বাবার হাতে লেখা ,

Abhendu Chatterjee

Class – 7 Section – B

Roll No.- 36

Year:- 2003

এর ঠিক পরের পাতাগুলোতে  মোটা হরফে ছাপা আমাদের স্কুলের প্রার্থনা, আর কয়েকটা Hymns. এই গান গুলো সপ্তাহের বিশেষ বিশেষ দিনে গাওয়া হত। অনেক চেষ্টা করেও মনে করতে পারলাম না, কোনগানটাকবেগাওয়াহত।

প্রার্থনাটা অবশ্য খুবই সাধারন , “ হে বিশ্ববিধাতা, করুণাময় ঈশ্বর, তোমারি চরণে নিজেরে অরপিলাম আমিইত্যাদি ইত্যাদি “ – এরই একটা ইংরেজি সংস্করণ। এর এক লাইনও বুঝতাম না, তবে যখন সবাই মিলে প্রত্যেক সকালে হাতজোড় করে, চোখবুজে, সমবেত কণ্ঠে school assembly তে প্রার্থনা করতাম, সেটা শুনতে বেশ লাগত। পুরো এসেম্বলিটা যে চোখবুজে কাটাতুম, তা  কিন্তু নয়, খানিকের জন্যে মিট মিট করে, চোখ খুলে, একটু এদিক ওদিক তাকিয়েও নিতাম । কিছু কিছু টিচারেরা দেখতাম, সে সময়ে ফিস ফিস করে নিজেদের মধ্যে বেশ একটু গল্প করে নিচ্ছেন । এসেম্বলির পিছনের সারির ছেলে মেয়েরা নিজেদের মধ্যে, chewing gum হাতাহাতি  করে নিত এই ফাঁকে। এ কাজটা অবশ্য খুব সাবধানে করতে হত, কারন দু জোড়া  প্রখর দৃষ্টি সর্বক্ষণ সে সময়ে আমাদের উপর কড়া নজর রাখত। এক জোড়া ছিল আমাদের পি টি স্যারের (যার নাম আজ অবধি জানতে পারিনি ) আর দ্বিতীয় জোড়াটি ছিল আমাদের Moral Science Teacher- এর। দুজনের কেউ, কোনরকম বেয়াদপি ধরতে পারলে আর রক্ষা ছিল না । তবে ওই মানুষ হয়ে জন্মানোর দোষে, যে জিনিসটা বারণ করা হত, তার প্রতি কৌতূহল আরও বেশি করে জন্মাত আমাদের । তাই প্রতিদিনই কোন না কোন হতভাগ্য ছাত্র বা ছাত্রীকে, এসেম্বলির পর, প্রিন্সিপালের ঘরের বাইরে, অতিশয়করুনমুখেদণ্ডায়মানদেখাযেত।

ক্লাসসিক্সঅবধি, আমাদের school unifrom ছিল, নীল হাফ প্যান্ট আর সাদা শার্ট। Class 7- এ ওঠায়  সেটা হয়ে যায়, ছাই রঙের ফুল প্যান্ট, সাদা শার্ট আর মেরুন টাই । সদ্য, ঠোটের উপর হাল্কা গোঁফের রেখা বেরনোর সাথে এই ফুল প্যান্ট পরে স্কুল যাওয়াটা, আমাদের কাছে হয়ে ওঠে, বড় হয়ে যাওয়ার পরোয়ানা ।   তখনও Facebook বা  Whatsapp-এর যুগ আসেনি, তাই পূজাবার্ষিকী আনন্দমেলা আর চন্দ্রবিন্দুর নতুন গান শোনাটাই আমাদের কাছে সবথেকে বড় বিনোদনের কেন্দ্র ছিল। ফুল প্যান্ট পরে, আমাদের আত্ম্যবিশ্বাস তখন নতুন করে ফুলে ফেঁপে উঠেছে। অবশ্য সে অহংকার দমিয়ে দেওয়ার জন্যে, আমাদের মাবাবারা কিংবা স্কুল টিচাররা কোন রকম ত্রুটি রাখতেন না।

স্কুলডাইরিতেপ্রথমলেখারতারিখদেখলাম, ২৭শে মার্চ, ২০০৩। লেখার বিষয় হল নতুন সেশনের সিলেবাস । আজও যখন টানা ১৫ পাতা জুড়ে বিভিন্ন সাবজেক্টের, চ্যাপ্টার গুলো দেখলাম , তখন পুরনো স্মৃতির সাথে পরীক্ষার ভয়টাও যেন সুড়সুড়ি দিয়ে উঠল, আর তার সাথেই মনে পরে গেল শুভেন্দুর কথা । ও আমাদের স্কুলে ক্লাস সেভেনেই জয়েন করে । যেদিন ব্ল্যাক বোর্ড থেকে, আবছা চকের এই লেখা গুলো, বহু কষ্টে ডাইরিতে টুকছিলাম, ঠিক তখনি ক্লাসরুমের দরজার কাছ থেকে, একটা অত্যন্ত সরু স্বরে ভেসে আসে, এক নির্দোষ প্রশ্ন ,

ভিতরে আসব ম্যাডাম ? ‘

দরজার দিকে সবাই কৌতুক দৃষ্টি হানলাম। দেখলুম অত্যন্ত রোগা ( রীতিমত রুগ্নও বলা চলে ) একটি ছেলে দাড়িয়ে আছে কাঁচুমাচু মুখে, প্যান্টটা যে ওর থেকে প্রায় দু সাইজ বড় সেটা প্যান্টের নিচের দিকে হয়ে থাকা কাপড়ের ভাঁজ দেখেই বোঝা যায়, জামাটাও নেহাত ছোট নয়, হাফ হাতা জামাটা মোটামুটি ওর কনুইয়ে গিয়ে ঠেকেছিল। সব মিলিয়ে বেশ মজার পাত্র বলেই তাকে ঠাহর করেছিলাম । যাইহোক, ক্লাস টিচার চশমার ফাঁক দিয়ে তাকে একটু পর্যবেক্ষণ করে, ঘরেঢোকালেন।

‘Come Inside. What is your name?’

‘Thank you Mam.’ বলে সবিনয়ে ক্লাসে ঢুকে, ঢোক গিলে শুভেন্দু যেই না বলল , ‘আমার নাম শুভেন্দু মণ্ডল।

অমনি তীব্র প্রতিবাদ, আছড়ে পরল, ‘Speak in English !!’

একটু ঘাবড়ে গিয়ে, তাই আবার চেষ্টা করল বেচারা,

‘My name is Shuvendu Mondol. I am in class 7 B study. My first day today. Principal call me, give me books and tell me, go class, 2nd floor.’

বেশগলদঘর্মহয়েএকটানাইংরেজিবলেহাঁফছাড়ল।

‘OK. Go find a seat.’- এই বলে রেজিস্টারে শুভেন্দুর নামটা লিখে নিলেন ক্লাস টিচার ।

শুভেন্দুও, ইংরেজির নাগপাশ থেকে ছাড়া পেয়ে, বেছে বেছে থার্ড বেঞ্চে আমার পাশে এসেই বসল, আর সেই থেকেই হল আমাদের বন্ধুত্বের সূত্রপাত। প্রথম থেকেই নতুন বন্ধুকে আমার বেশ ভালো লেগেছিল, বিশেষকরেএটাভেবেযেএবারথেকেক্লাসেআমারথেকেওখারাপইংরেজিকেউবলবে।

আসলে শুভেন্দু ক্লাস সিক্স অবধি, সোদপুরের একটি বাংলা মিডিয়াম স্কুলে পরত, কাজেই ইংরেজিটা তাকে একটু বেকায়দায় ফেলেছিল প্রথমে, ক্লাসসেভেনেইংরেজিমিডিয়ামেএসে।

একটা ব্যাপারে ও ছিল একেবারে আমার সহোদর, সেটা হল হাতেরলেখায়। মনে পরে, বাংলা টিচার, প্রায়ই ক্লাসে চেঁচিয়ে বলতেন,

শুভেন্দু আর অভেন্দু, এই দুই বন্ধু, তাদের স্বর্ণাক্ষর ও মুক্তাক্ষর দিয়ে নিজেদের খাতা সাজিয়ে আমাদের ধন্য করেছে। এই অক্ষরমালা যেগুলোকে এরা হস্তাক্ষর বলে চালাতে চাইছে, সেগুলি পড়তে গিয়ে পরের মাসেই আমার চশমা পালটাতে হবে।

যদিও এইসব বাক্যবাণ, হঠাৎ হঠাৎ আমাদের উপর হানা হত বলে, মাঝে মাঝে অপ্রস্তুত হয়ে পরতাম, তবে হাফ ইয়ারলি পরীক্ষায় যখন শুভেন্দু বাংলায় সবার থেকে বেশি নম্বর পেত, তখনকিন্তুতারগর্বেআমারওবুকফুলেউঠত।আমিনিজেঅবশ্যলেখাপড়ায়স্কুলেখুবইসাধারনছিলাম।

শুভেন্দুর সাথে আরেকটি মিলের জন্যে, আমরা একেবারে হয়ে উঠেছিলাম মানিকজোড়। দুজনেই আমরা সত্যজিৎ রায়ের ভীষণ ভক্ত। বিশেষ করে গুপী বাঘা  আর ফেলুদার ব্যাপারে তো PhD বললেও খুব একটা বাড়িয়ে বলা হত না। গুপী বাঘার প্রত্যেকটি গান ছিল আমাদের একেবারে কণ্ঠ্যস্থ। কাজেই সুযোগ পেলেই গলা ছেড়ে গান গাইতে দ্বিধা করতাম না। লোকে যাই  ভাবুক, আমরা নিজেদের কোকিল কণ্ঠি ভাবতে, বিন্দুমাত্রকুণ্ঠাকরতামনা।

তখনওনিজেদেরপকেটেপকেটে, মোবাইল হয়নি, তাই BSNL-এর ল্যান্ড লাইনই ছিল আমাদের যোগাযোগের ভরসা। তাই সন্ধ্যেবেলা প্রায়ই অনেকক্ষণ ফোনে কথা বলতাম। অবশ্য বাবা অফিস থেকে ফেরার আগে, কারন অপ্রয়োজনে ফোন ব্যাস্ত রাখাটা আমাদের দুজনের বাবারই ভীষণ অপছন্দ ছিল।

ডাইরিরপাতাআরওউলটে, চোখে পরল একটা Teacher’s Note । কিছু কিছু সময়ে অত্যন্ত বেশি রকমের বেয়াদপি করলে এরকম নোট ডাইরির পাতায় ফুটে উঠত। আমার ডাইরিতে ভুঁইফোড়ের মতো এরকম কত যে নোট শোভা পেয়েছে, তার সঠিক হিসেব দিতে আজও লজ্জা করে। যাইহোক, এই বিশেষ নোটটায় লেখা ছিল,

Dear Parents,

Abhendu has become an extremely talkative kid. His non-stop jabbering has become a nuisance for the class. I’m afraid, if he doesn’t stop this immediately, then the Principal will have to take some harsh actions against him.

এই রকম নোট যখন মা বাবার কাছে সই করাতে যেতাম, তখনকার ঘটনা ব্যাক্ত করে আর নিজের সম্মান বাড়াতে চাই না। তার চেয়ে কেন এই বিশেষ নোট টা, ডাইরিতে স্থান পেল, সেটাবলি।

ইতিহাসে, আমাদের মাথা, চিরকালই অত্যন্ত উর্বর ছিল। তাই ইতিহাস পিরিয়ডে পড়ায় মন না দিয়ে, মাথা নিচু করে শুভেন্দু আর আমি ফিস ফিস করে, দেশের কথা, দশের কথা আলোচনা করতাম। সেদিনও এর ব্যাতিক্রম হয়নি। কথায় কথায় সেদিন খাবারের প্রসঙ্গে আলোচনা শুরু হয়েছিল। এ খাবার সে খাবারের পর, আমি সরষে বাটা দিয়ে ইলিশ মাছের ঝালের শুখ্যাত শুরু করি। কিন্তু ব্যটা বেরসিক শুভেন্দু, ব্যাপারটাকে তেমন আমলই দিলে না !  বলে কিনা লাল টকটকে পাঁঠার ঝোলের কাছে আর বাকি সব খাদ্য নগণ্য। এরকম যুক্তিহীন বক্তব্যের সমালোচনা না করলে, ইলিশমাছেরওতথাপিগোটাবাঙালীসমাজেরঅপমান।তাইবেশগুরুতরতর্কজুড়েদিয়েছিলুম।

আমি যতো বলি,

আরে সর্ষে বাটার ঝোলে, ডিম ওলা ইলিশের পেটি, আর তার উপর একটা পেট চেরা কাঁচা লঙ্কা , উফফ !! এই দৃশ্য কল্পনা করলেও গায়ে কাঁটা দেয় ।

সে তবু তর্ক করে,

ধুর , কচি পাঁঠার ঝোল আর ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত, একসাথে হলে, গোটা পৃথিবীর লোকের জিভে, Niagra Falls ছুটিয়ে দিতে পারে।   

এই তর্কাতর্কির মধ্যে, হঠাৎ যে কখন আমাদের গলার স্বর,  ফিস ফিস থেকে, বজ্রনাদে পরিণত হয়ে গেছিল সেটা আর খেয়ালই করিনি। খেয়াল হল, যখন দুজনেই কানে একটা টান অনুভব করলাম। ফিরে দেখি, হিস্ট্রি দিদিমণির, দু হাতে আমাদের দুজনের কানের ডগা গুলো শোভা  পাচ্ছে।  তার পরের ঘটনা আর নতুন করে বলার কিছু নেই, আমাদের ভবিষ্যতের সঙ্গে, শুক্লপক্ষের অমাবস্যার একটা তুলনা টেনে, আমাদের দুজনকেই ক্লাসের বাইরে যাওয়ার হুকুম করলেন, আর পিরিয়ড শেষ হবার পরে দুজনের ডাইরিতেই এই নোট লিপিবদ্ধ্য করে, লালকালিতেস্বাক্ষরকরলেন।

এইরকমতুচ্ছবিশয়েযেকতশাস্তিপেয়েছিস্কুলজীবনে, তা বর্ণনা কড়া শক্ত, কিন্তু আজও কখনো রাস্তায়, বা দুর্গা পূজার প্যান্ডেলে, পুরনো টিচারদের সাথে দেখা হলে, তারা মাথায় হাথ দিয়ে আশীর্বাদ করেন এবং এই পুরনো দুষ্টুমিগুলোর কথা মনে করিয়ে দিয়ে, হাসতে হাসতে বলেন,

তোদের সাথে সাথে, তোদের এই বেয়াদপিগুলোও যেন স্কুল ছেড়ে চলে গেছে। আজকালকার ছাত্রদের বেয়াদপির মধ্যে, কেমন যেন আর ছেলেমানুষি খুঁজে পাই না।

আগেইবলেছি, শুভেন্দু সবেমাত্র বাংলা মিডিয়াম স্কুল থেকে আসার জন্যে, ক্লাস সেভেনে ইংরিজি তাকে খুব কাহিল করেছিল। এদিকে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে, বেশিরভাগ কথা ইংরিজিতে না বললে খুবই সমস্যা। তাই মাঝে মাঝেই, কোন কথা ইংরিজিতে বলার আগে আমার শরণাপন্ন হতে হত ওকে। আমিও যে ইংরিজিতে Shakespear ছিলাম, তা অবশ্য নয়, কিন্তু সেই সময়ে হাতে হাতে, smart phone-, google translator-এর বিলাসিতা ছিল না বলে, আমিই ছিলাম ভরসা। একদিন, আমাদের ক্লাসের, সবথেকে ডাকাবুকো ছেলে,  অকসৎ তেওয়ারি, শুভেন্দুকে মারল এক থাপ্পড়। কারনটা অবশ্য টিফিন সংক্রান্ত। এমনিতে আমাদের কেউ ভিতু বলে অপবাদ কখনো দেয়নি, তবে অকসতের দেওয়া থাপ্পড় ফিরিয়ে দেওয়াটা,  ঠিক সে সময়ে, কেউ বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে করে নি। তবে ব্যাপারটা শুভেন্দুর যতো না গালে, তার চেয়ে অনেক বেশি মানে লেগেছিল। কাজেই বেমালুম হজম করাটাও তারপক্ষে সম্ভব ছিল না। অনেক ভেবে ঠাহর করল ক্লাস টিচারকে ব্যাপারটা জানালে এর একটা সঠিক বিহিত হবে। কাজেই ফের আমার কাছে হন্তদন্ত হয়ে এসে জিজ্ঞেস করল,

আচ্ছা, চড়ের ইংরিজিটা ঠিক কি বলতো ?’

আমার কানের দোষেই হোক কিংবা শুভেন্দুর জিভের দোষেই হোক, আমিচড়না শুনে, শুনলামচোর। তাই তৎক্ষণাৎ উত্তর দিলুম, ‘Thief’। পরক্ষনেই নিজের ভুলটা বুঝলাম, যখন শুভেন্দু গোটা ক্লাসের সামনে বীরদর্পে চেঁচিয়ে উঠল,

‘Mam, Akshat thief me ! Mam, Akshat thief me !’

পর পর দুবার এরকম অভিযোগ শুনে, ক্লাস টিচার অকসৎকে দুটি চড় কশিয়ে, ক্লাসের বাইরে বের করে দিতে দিতে, প্রিন্সিপালেরকাছেতারকুকর্মেরনালিশজানাবারপরিকল্পনাঘোষণাকরলেন।

এতক্ষণে শুভেন্দু আর আমি দুজনেই বুঝতে পেরেছি, নেহাত আমাদের ভাষাজ্ঞ্যানের দোষে, বেচারা লঘু পাপে গুরু দণ্ড পেতে বসেছে। এরকম ঘটতে দেওয়াটা, বিবেকে সইল না, তাই দুজনে মিলে আবার টিচারের কাছে গেলাম ব্যাপারটা ভালো করে বুঝিয়ে বলতে। সব শুনে, ম্যাডাম বেশ খানিকটা হেসে নিয়ে, তিনজনেরই কান মুলে দিয়ে ক্ষমা করলেন, আর  বললেন,

আজ থেকে তোমরা তিনজনেই, ইংলিশ ক্লাসে, ফার্স্ট বেঞ্চে বসবে।

শুভেন্দুর এরকম ইংরিজি ভীতি,  অবশ্য খুব বেশিদিন ছিলনা। পরের বছরেই ফাইনাল পরীক্ষায়, সে ইংরিজিতে সব থেকে বেশি নম্বর পেয়ে, নিন্দুকদেরমুখেকালিদিয়েছিল।

এইরকমইস্মৃতিভরাকয়েকটাপাতারপর, ডাইরির মাঝামাঝি এক জায়গায় চোখে পরল, দু পাতা জোরা, আমাদের টাইম টেবিল। দৈনিক মোট ৭টা পিরিয়ড ছিল ক্লাস সেভেনে, আর প্রথম পাঁচটা পিরিয়ড পর, বেশ মোটা হরফে ‘Lunch Break’, লেখাটা চোখে পরতেই, আবার এক রাশ স্মৃতির ঢেউ আছড়ে পরল। ৪৫ মিনিটের ব্রেকটা ছিল, আমাদের কাছে একেবারে, দৈনন্দিন স্বাধীনতা দীবস। প্রথম ১৫মিনিটে টিফিন সেরে, বন্ধুদের সাথে বাকি ৩০ মিনিট, হয় আড্ডা, নাহয় নানান প্রকার খেলার মধ্যে দিয়ে কাটত। ক্লাস টু তেলক এন্ড কিথেকে শুরু করে ক্লাস সেভেনে, রুমাল বেধে ক্যাচ ক্যাচ আর বাস্কেট বল খেলায় বিবর্তন ঘটেছিল। আমি নিজে অবশ্য কোন কালেই খুব একটা ক্রীড়াবিদ ছিলাম না। মানে, কোন খেলায় যোগ দিতে গেলে, আমায় নিয়ে রীতিমত লটারি হত, ‘হারলে পরে অভেন্দুকে টিমে নিতে হবে‘ – এই সর্তে। কাজেই একরকম বাধ্য হয়েই খেলাধুলার জগৎটাকে খুব অল্প বয়সেই বিদায় জানিয়েছিলাম। আমার জগৎটা ছিল খাদ্য আর সাহিত্য দিয়ে তৈরি। ভালো খাবারের গন্ধ আর নতুন গল্পের বইএর পাতার গন্ধ, এদুটোই আমায় একেবারে মাতিয়ে তুলত। আমার নিজের টিফিন অবশ্য খুব একটা উপাদেয় হত না, ‘Ferini’ কোম্পানির একটা কেক, শশার টুকরো আর একটা আপেল ছিল আমার দৈনন্দিন বরাদ্দ। আসলে সকাল সকাল, বাড়ী থেকে  পেট ভরে ভাত খাইয়ে, তারপর স্কুলে পাঠাত, তাই টিফিনটা একটু হাল্কা থাকত। সেই জন্যেই বন্ধুদের টিফিন বক্সে, চাউমিন, লুচি, পরটা কিংবা নিদেনপক্ষে ‘Maggie’-  দেখা পেলেই, আমি যেতুম ছুটে। একটু আধটু করে সবারই টিফিন চেখে দেখাটা আমার অভ্যাস ছিল। আর সবাইকেই সেই এক প্রতিশ্রুতি দিতে হত,

আজ তোর থেকে একটু নিলাম, তবে যেদিন আমি ভালো টিফিন আনব, সেদিন তোকে একেবারে ভোজ খাইয়ে দেব।

এ কাজটা শুধু আমি একা নয়, ক্লাসের প্রায় সব ছেলে মেয়েরাই কখনো না কখনো করত। বন্ধুর টিফিন বক্স থেকে টিফিন খাওয়ার আনন্দটা, কোন ফাইভ স্টার হোটেলে ডিনার খেয়েও উপভোগ করা যায়না।  যাইহোক, ক্লাসের কয়েকজন আবার একটু বেশি হিসেবি বলে দুটো টিফিন বক্স আনত। একটা ছোট টিফিন, যাতে খুব সামান্য কিছু থাকত, সেই অল্পেই নিজেদের দৈন্য দশা ফুটিয়ে তুলে, করুন মুখে, সবার সাথে ভাগ করে খেত। আসল টিফিন থাকত দ্বিতীয় বক্সে, যেটা বার করা হত অতি সমর্পণে, বাকি ছেলে মেয়েরা খেলতে চলে যাওয়ার পর। আমরা কয়েকজন, পাকা জুহুরি অবশ্য, এই অবকাশের অপেক্ষাতেই থাকতাম। ভিড় একটু কমলেই, গিয়ে হাজির হতুম এই সমস্ত টিফিন বক্সের সামনে। আর আবার সেই অদূর ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি দিয়ে, সুস্বাদু আহারাদি চাখতাম। এমনি করেই নিজের বেখায়েলে টিফিন ঋণের  বোঝাটা বেশ ভারি হয়ে উঠেছিল। হঠাৎ একদিন  বাড়ী থেকে, আমায় লুচি আর আলুভাজা টিফিনে পাঠাল। অসাবধানতায় টিফিনটা বেশ লোকজনের সামনেই খুলে ফেলেছিলাম। ব্যাপারটা সামলানর আগেই, গোটা ক্লাসে রটে গেল আমার লুচির কথা। ব্যাস ! আর যাই কোথা? কোন এক গল্পে পরেছিলাম, দেনায় জর্জরিত পথিকের পিছনে পাওনাদার কাবুলিওয়ালা কিরকম ভাবে ধাওয়া করে, সেদিন ক্লাসেও এরকমই একটা ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটল। সে এক অদ্ভুত দৃশ্য, আমি মাথায় টিফিন বক্স নিয়ে দৌড়াচ্ছি ক্লাসের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে, আর আমার পিছন পিছন দৌড়াচ্ছে কাবুলিওয়ালার দল, থুড়ি, ভালো টিফিনওয়ালার দল। এতো দৌড় ঝাঁপ করেও শেষ রক্ষা হল না। সবাই আমায় ধরে ফেলল, আর আমার বাক্সটা, পি সি সরকারের ম্যাজিকের মতো ভ্যানিশ হয়ে গেল। খানিক পরেই অবশ্য সেটা ফেরত পেলাম। কেউ একজন দয়া বসত, দুটো আলুভাজা রেখে গেছিল। সেই আলুভাজাই চিবতে চিবতে, তখন সুধু ভাবছিলুম,

কি ভাগ্যিস ! টিফিন বক্সটাই খেয়ে ফেলেনি ।

আরো কয়েকটা পাতা উলটে, ডাইরিতে লেখা দেখলাম একটা ভূগোল হোম ওয়ার্ক ,

Geography H.W.

Chapter 16, SAARC Countries and their Agricultural Landscape,

page-72, Exercise- 15A.

Should be submitted on Monday.

ডাইরিতে লেখা আরও অজস্র হোমওয়ার্কের মধ্যে, শুধু এটার কথাই আজও বিশেষ ভাবে মনে আছে, সঞ্চারীর জন্যে। সঞ্চারী আমার খুব ভালো বন্ধু, কিন্তু মাঝেমধ্যেই ওর সাথে খুঁটিনাটি বিশয়ে খুব ঝগড়া লাগত। সেদিনও এরকমই কিছু একটা কথা কাটাকাটি হওয়ার পর, আমাদের কথা বন্ধ ছিল। অন্যান্য টিচারদের থেকে ভূগোলের টিচার একটু বেশি স্ট্রিক্ট ছিলেন। তাই তার ক্লাসে কোন রকম ইয়ার্কি বা ফাজলামির জায়গা ছিলনা। কিন্তু সেদিন যখন ক্লাসে বিভিন্ন দেশের জমির উর্বরতা নিয়ে পড়াশুনা হচ্ছে, আমার উর্বর মস্তিষ্কে তখন একটা অদ্ভুত দুষ্টুমি বুদ্ধির অঙ্কুর, চারা গাছে পরিনত হচ্ছিল। মেঝেতে একটা খুব ছোট্ট চটের দড়ির টুকরো, আমার পায়ের কাছে পরে থাকতে দেখে, কি মনে করে, তুলে নিলাম, আর সেটাকে খুব সাবধানে, সন্তর্পণে সঞ্চারীর ডান কাঁধে রেখে দিলাম। ব্যাপারটা সহজেই করা গেল, কারন সঞ্চারী ঠিক আমার সামনেই বসত ক্লাসে। অন্যমনস্কভাবে, যেই না দড়ির টুকরোটার উপর চোখ পরল, অমনি, ‘ওরে বাবারে! শুয়ো পোকা !!’ – বলে এক ক্লাস ফাটা চিৎকার করে বেঞ্চ থেকে লাফিয়ে উঠল, সঞ্চারী। পরক্ষনেই অবশ্য বুঝতে পারল আসল ব্যাপারটা, আর এটাও বুঝতে বাকি রইলনা এর পিছনে আমার হাত রয়েছে। ভূগোলের টিচার কটমট করে রক্তবর্ণ চোখে, সঞ্চারীকে প্রায় ভস্ম করে দিয়ে, তার দিকে তেড়ে এলেন। আমিও ততক্ষণে ইষ্টনাম জপতে শুরু করেছি। ব্যাপারটার পরিণামটা যে ঠিক কি হবে, সেটা কিছুতেই, দুষ্টুমিটাকরবারআগেমাথায়আসেনি।

‘Sanchari, Get out of My Class !!’             

ভূগোলেরটিচারেরচিৎকারে, সে সময়ে যেন একটা মৃদু ভৌগলিক ভূমিকম্প অনুভব করেছিলাম। আমিও প্রস্তুত হচ্ছিলাম, কারন জানি যে এখুনি সঞ্চারী নির্ঘাত বলবে যে এই কাণ্ডের আসল কাণ্ডারি আমি। কিন্তু কি আশ্চর্য! ও বিন্দুমাত্র বাক্যব্যায় না করে, চুপচাপ মাথা হেট করে ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেল। রাগের মাথায় যে বন্ধুর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে নেই, তার এর চেয়ে বড় শিক্ষা আমি আজ অবধি আর পাইনি। বলাই বাহুল্য ক্লাস শেষ হবার পরেই, সঞ্চারী ফিরে এসে আমার উপর অনেকক্ষণ চোট পাট করল, কিন্তু এইবার আমি আর কোন বাক্যব্যায় না করে, চুপচাপ সব শুনে গেলাম । বলতে গর্ব হয়, যে গুটিকতক স্কুলের সহপাঠীর সাথে আজও বন্ধুত্ব বজায় আছে, তাদের মধ্যে সঞ্চারীর নামটা, বেশউচুস্থানে।

ডাইরিরপ্রায়শেষেরদিকে, আমাদের ক্লাস সেভেনের ফাইনাল পরীক্ষার Agenda চোখে পরল। উফফ ! কি ভয়ানক Agenda । রোজ দুটো করে পরীক্ষা, আর তাও আবার দুর্দান্ত সব combination। অঙ্কের সঙ্গে ভূগোল, ফিজিক্সের সাথে কেমিস্ট্রি, হিস্ট্রির সাথে বাংলা ইত্যাদি ইত্যাদি। বুঝতেই পেরেছিলাম সে বছর পরীক্ষার সময় আরও ২ কিলো ওজন কমে যাবে। মোটামুটি বলিষ্ঠ হলে, এ নিয়ে অতটা মাথা ঘামাতুম না; তবে আমার তখনকার চেহারার সাথে, সরষে খেতের কাকতাড়ুয়ার বেশ একটা সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যেত বলে, এরকমপড়ারচাপেবেশঘাবড়েগিয়েছিলুম।

ক্লাসের ভালো ছাত্রদের অবশ্য, এসবে কোন হেল দোল লক্ষ করা যেত না। যেমন নিলেন্দু আর গগন। এরা দুজনেই ক্লাসের প্রথম সারীর ছাত্রদের মধ্যে ছিল, কিন্তু দুজনের কাউকেই কিন্তু, স্কুলে সারাক্ষণ বই নিয়ে বসে থাকতে দেখা যেত না। বরং ক্লাস থেকে টিচার চলে গেলেই, আমরা সবাই মিলে কোন না কোন খেলায় মেতে উঠতাম। যে সময়ে আমরা ক্লাস সেভেনে পড়ি, সেসময়েই ভারতের সহস্র কিশোর কিশোরীর প্রথম পরিচয় ঘটে পোকেমনের সাথে। পোকেমন কার্টুন তখন সন্ধ্যে বেলায় প্রায় প্রত্যেক ঘড়ে চলত, আর এই পোকেমনপ্রীতি উস্কে দিত, বিভিন্ন chips, chewing gum আর chocolate কোম্পানিরা। তখন একটি বিশেষ chips-এর প্যাকেটে, পোকেমনের গোল চাক্তি, বা Tazzo পাওয়া যেত। এই Tazzo জমানো, তখন নেশার মতো ছেয়ে ফেলেছিল আমাদের । আমাদের সবার কাছেই প্রায় দু ডজন Tazzo ছিল, আর সেই Tazzo দিয়েই হত আমাদের বিভিন্ন সব খেলা। নিলেন্দু আর গগন দুজনেই ছিল এই সব খেলায় একেবারে এক্সপার্ট, কিন্তু তার জন্যে ওদের লেখাপড়ায় কোনদিন ব্যাঘ্যাত ঘটেনি । পরীক্ষায় দুজনেই দুর্দান্ত নম্বর পেত, তবেতানিয়েকোনদিনবন্ধুদেরকাছেগর্বকরতেদেখিনিওদের।

শুভেন্দুওছিলএসবখেলারপোকাএবংতারজন্যেপ্রায়ইওকে, হয় chewing gum, না হয় chips এর প্যাকেট হাথে দেখা যেত। ওর একটা বড় মুদ্রাদোষ ছিল, ক্ষণে ক্ষণে কপালে ডান হাথ ঠেকিয়ে নমস্কার করা। না, কোন ঠাকুর বা গুরুর উদ্দেশ্যে নয়, এমনি এমনি। সারাদিন, এরকম উদ্দেশ্যহীন প্রণামের ঠেলায়, ছেলেটার কাঁধ ব্যাথা হয়ে যেত, তবু থামতে পারত না। একবার মনে আছে, ভূগোল পিরিয়ডে বসে চুয়িঙ্গাম চিবচ্ছিল, দিদিমণি সেটা দেখে ফেলে, বেশ খানিকটা বকাবকির পর, চুয়িঙ্গামটা ফেলে আসতে বলে, ক্লাসের কোনে রাখা ডাস্টবিনে। হতভাগা, সেটাও ফেলার আগে, হাতেনিয়েকপালেঠেকিয়েনমোকরেতারপরডাস্টবিনেফেলল।একাণ্ডদেখেআমাদেরভূগোলটিচারেরমতোগম্ভীরদিদিমণিওটানাপাঁচমিনিটনাহেসেপারলেননা।

যাই হোক, এসব Tazzo আর পোকেমনর আকর্ষণ সামলেও নিলেন্দু, গগন বা শুভেন্দুর পরীক্ষার নম্বরগুলো কোনদিন নিম্নগামি হয়নি, আর এদিকে আমার হতভাগ্য পরীক্ষার খাতাগুলো কোনদিন ভালো নম্বর, বাভেরি গুডজাতিও শব্দগুলোর আস্বাদ পায়নি। বলাই বাহুল্য, এর জন্যে বাড়ীতে গঞ্জনা শুনতে শুনতে মাথা ভো ভো করত, তবুও ভগবানের দয়ায় পাওয়া এই নিরেট মাথা, কিছুতেই তার মধ্যবিত্ত অস্তিত্ব থেকে, উপড়ে ওঠার কোনরকম উচ্চাকাঙ্খা পোষণ  করত না। কাজেই উৎকৃষ্ট মস্তিষ্ক পাওয়ার স্বপ্ন নিয়ে মাথা ঘামানোটা, বহুদিন আগেই বন্ধ করে দিয়েছিলাম ।    

ক্লাসসেভেনেরফাইনালপরীক্ষা, তখন অবধি আমাদের ক্ষুদ্র স্কুল জীবনের অভিজ্ঞতায়, সব থেকে কঠিন পরীক্ষা ছিল। বিশেষ করে ভূগোলের কোশ্চেনটা দেখে, আমার তো ক্রমাগত ১৫ মিনিট হেঁচকি উঠেছিল। কিন্তু পরীক্ষার দিনটা আমার আজও মনে আছে, পরীক্ষার ঠিক আগের একটা ঘটনার জন্যে। পরীক্ষার দিনে, সকাল সকাল স্কুলে এসে, বই নিয়ে উন্মাদনা করাটা আমাদের পরীক্ষার একটা রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাই সেদিন সকালেও পরীক্ষা শুরুর আগে, যথারীতি বই খুলে, যখন সবাই দশ মিনিটে বিশ্ব উদ্ধার করার ambition নিয়ে, একে ওপরের পড়ার ব্যাপারে টিপ্পনী কাটতে ব্যাস্ত, ঠিক সেই সময়ে মুখের সামনে বই ধরে, ক্লাসে প্রবেশ করল শ্রীমান শুভেন্দু। আর তখনি ক্লাসের বাইরে যাচ্ছিল অকসৎ। এই পরিস্থিতিতে, এক মোক্ষম মুহূর্তে, দুজনের লাগল এক ভীষণ ধাক্কা। পালকের ছোঁয়ায় পর্বতের আর কিই বা হবে? তাই অকসতের বিশেষ কিছুই অনুভূতি হল না, কিন্তু শুভেন্দু ছিটকে গিয়ে পড়ল পাশে থাকা একটা টেবিলের উপর, আর বেকায়দায় ওর মাথাটা গিয়ে পরে টেবিলের ঠিক কোনায়। ব্যাস! রক্তারক্তি কাণ্ড ! সবাই তখন পরীক্ষা ভুলে শুভেন্দুকে নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পরল। বেচারা অকসৎ তখন কি করবে ভেবে না পেয়ে, শুভেন্দুকে চ্যাংদোলা করে নিয়ে, দৌড়ল স্কুলের ডিসপেনসারি রুমের দিকে। আর সে সময়ে শুভেন্দু যেরকম কান্না শুরু করেছিল, তাতে ছেলেটাকে আর আগের অবস্থায় ফিরে পাব কি না, সে বিষয়ে আমাদের সবার মনে বিশেষ সংশয় উকি দিয়েছিল। সৌভাগ্য বসত, চোটটা যতটা ভাবা হয়েছিল, ততটা গুরুতর লাগেনি। তার উপর টিচারদের তৎপরতায়, Iodine Tincture দিয়ে, ওর মাথায় একটা বিরাট ব্যান্ডেজ বাধা হল, এবং শুভেন্দুকে নিয়ে আমাদের প্রিন্সিপাল নিজে একটা বেসরকারি হাসপাতালে গিয়ে, ডাক্তার দেখিয়ে তারপর নিশ্চিন্ত হলেন, যে কোন গুরুতর আঘাত লাগেনি। তবে সেদিন ওকে আর পরীক্ষা দিতে হয়নি, হাসপাতাল থেকে সোজা বাড়ী নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেবারের মতো গ্রেস মার্ক্স দিয়ে, তাকে ভূগোলে পাশ করিয়ে দেওয়া হল।  এরই মধ্যে অবশ্য, শুভেন্দু প্রিন্সিপালকে বুঝিয়ে বলেছিল যে ব্যাপারটা নেহাতই একটা accident, তাই অকসৎকেও সেদিন, আর কোন গুরুতর শাস্তি ভোগ করতে হয়নি ( ভূগোলের প্রশ্নপত্র ছারা ) 

সেদিনসন্ধ্যেবেলায়শুভেন্দুআমায়ফোনকরেজিজ্ঞেসকরল, ‘ ভাই, আজ কি ভূগোল পরীক্ষা ছিল নাকি?’

ওর মাথার আঘাতটা ঠিক কতটা গুরুতর লেগেছে, সেটা আবার ভাবতে ভাবতে বললাম, ‘হ্যা, তবে পরীক্ষা না বলে অগ্নি পরীক্ষাও বলতে পারিস। মানে পরীক্ষা দিতে দিতে আগুনে জ্বলে পুড়ে মরেছি আরকি, সাংঘাতিক প্রশ্নবাণের ঠেলায়।

উফফ ! শাপে বড় হয়েছে রে ভাই । আমি তো পরীক্ষার টাইম টেবিলটা ভুল টুকেছিলাম, তাই আজ কেমিস্ট্রি পরে গেছিলাম। আজ ভুগোল পরীক্ষায় বসলে, নির্ঘাত ফেল করতাম।

আমার ভাগ্যে, এরকম ঠিক সময়ে ছোট খাটো accident জোটে না কেন, তাইভাবতেভাবতেফোনটারেখেদিলাম।

তবে যেদিন ভূগোল পরীক্ষার খাতা বেরল, সেদিন মোটামুটি আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পরার পরিস্থিতি হয়েছিল।

দিদিমণিক্লাসেঢুকে, এক বান্ডিল পরীক্ষার খাতা টেবিলের উপর নামিয়ে রেখে, ক্লাস সেভেনের সমগ্র ছাত্র ছাত্রীগনকে, ভূগোলে পারদর্শী করে তোলার জন্যে, এই গোটা বছর যে তিনি অক্লেশ পরিশ্রম করেছেন, সেটা যে সম্পূর্ণ ভস্মে ঘী ঢালা হয়েছে, এই বক্তব্য অত্যন্ত কঠিন ভাষায় ও সুরে ব্যাক্ত করে, একটু দম নিলেন, তার পরের বক্তব্যের জন্য। দম নিয়ে, তিনি সটান, আমার দিকে দৃষ্টি হেনে শুরু করলেন,

‘Mister Abhendu, you are a powerful man! You have changed the World !! ‘

নিজের কোন গুনে, এই বিশ্বের কোন পরিবর্তন করতে পেরেছি, এই বিস্ময় পুরোপুরি কাটবার আগেই, তিনি গোটা ক্লাসকে তার বক্তব্য নিজেই বিস্লেশন করলেন,

পরীক্ষায় World Map-এ মার্ক করতে বলেছিলাম SAARC দেশগুলির কোথায় ধান চাষ হয়, তা আমাদের শ্রীমান অভেন্দু, সোনার বাংলা থেকে শুরু করে সুদূর রাশিয়া অবধি, ধন ধান্যে পুষ্পে ভরিয়ে তুলেছেন। আর, Siberia পয়েন্ট করতে গিয়ে, সেটাকে North America-র মধ্যমণি করেছেন ইনি। ভাবছি প্রিন্সিপালের কাছে একটা আবেদন জানাব, এবার থেকে ভূগোল ক্লাসগুলো আমার বদলে আভেন্দু নিলেই বোধয় ভালো হবে।

ভৌগলিকবিদ্যাযে, শ্রী অভেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের  গোলাকার মাথায়, কোনদিন খুব একটা আঁচড় কাটতে পারবেনা, এবিশয়েসেদিনথেকেআরকারুরখুবএকটাসন্দেহছিলনা।

আজএইসব, টিচারের বকুনি, দুর্ধর্ষ পরীক্ষার ভয়, বন্ধুদের টিফিন নিয়ে কাড়াকাড়ি, ইত্যাদি, ভরা মুহূর্তগুলো, শুধুই রয়ে গেছে এই ডাইরির পাতায়। এই স্মৃতি জর্জরিত পাতাগুলোর মধ্যে দিয়েই, আমরা, এক সময়ের ক্লাসের outstanding ছেলে মেয়েরা, যারা বেশির ভাগ সময়, ক্লাসের বাইরে দাড়িয়ে, অর্থাৎ punishment পেয়ে কাটিয়েছে, তারা হঠাৎ ব্যারিস্টার, এঞ্জিনিয়ার, বিসনেসম্যান, সাহিত্যিক ইত্যাদিতে পরিনত হয়ে গেছি, এটাভাবলেইআজযেনহাসিপায়।

এখনযদিওসবাই, পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছে, তবুও হলফ করে বলতে পারি, এই রকম ডাইরি খুঁজে পেলে, সব্বাই,  স্মৃতির বেঞ্চে, আবার পাশাপাশি বসে, ব্ল্যাক বোর্ড থেকে সেই পুরনো দিনগুলো, আরেকবার ডাইরিতে টুকে নিতে চাইবে।               

Print Friendly, PDF & Email
Previous articleনিউটনের সূত্রে ভুল
Next articleআমরা হাসতে চাই।
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments