কোড নেম প্রমিথিউস
“ম্যাজিক বলে কিছু হয়না অয়ন। যে বিজ্ঞানকে তুমি ব্যাখায় আনতে পারো না, সেটাই তোমার কাছে ম্যাজিক বলে মনে হয়। বিজ্ঞানের ছাত্র তুমি, বিজ্ঞানমনস্ক হও আগে।“ জিপসি মৃদু তিরস্কার করল, “আসলে আমরা একটা আলাদাই প্রজাতি ছিলাম মানুষের থেকে। উন্নত, বিজ্ঞানচর্চাতে এই যুগের থেকেও হাজার বছর এগিয়ে। আমাদের শহরকে তোমরা স্বর্গ বলতে, আমাদের মহাকাশযানকে তোমরা রথ বলতে। কিন্তু একটা সময় এল, যখন আমাদেরকে বিলুপ্তি গ্রাস করল। কারন কিছুই না, জনঘনত্ব বেড়ে গিয়েছিল আমাদের।“ জিপসি ভাবুক হয়ে বলল, “আমি তখন বেশি বড় নয়। তোমারই বয়সী। এটা সেটা নিয়ে গবেষণা করি। আমি দেখতাম, মানুষদের চাকরের মত খাটাত বাকিরা। এই অন্যায়টা আমার কোনকালেই সহ্য হয়নি। আমি তাই তোমাদের আগুনের ব্যবহার শেখালাম। বাকি গল্পটা তো জানই।
আমাকে তো ককেশাসে বেঁধে রেখে এল জিউস, কিন্তু সে যেটা জানত না, সেটা হল, ততদিনে আমি রিজেনারেশনের উপায় বার করে ফেলেছিলাম। আর তাই, আমাকে শাস্তি দিয়েও কোনও লাভ হয়নি। ভবিষ্যৎ দেখাটা তো এই আবিষ্কারের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। মস্তিস্কের কয়েকটা অংশের রিজেনারেশন বেড়ে যাওয়ায় মনন আর ইচ্ছাশক্তির অপরিসীম ক্ষমতার কিছু ভগ্নাংশমাত্র ব্যবহার করেই ভবিষ্যৎ দেখতে পারতাম আমি। কিন্তু যাক সে কথা। জিউসকে আমি কোনোদিন ক্ষমা করতে পারিনি, কারন জিউসের জন্য একটা লোকও আমাকে উদ্ধার করতে এগিয়ে আসেনি, একমাত্র হারকিউলিস ছাড়া। তাই আমার আবিষ্কারের কথা ওদের কাউকে জানতে দিইনি।
ফল যা হবার হল। আমার চোখের সামনেই আমার পুরো প্রজাতির অপমৃত্যু আমি দেখলাম, অথচ আমি কিছুই করলাম না। যত দিন গেল, তত আমার সেই রাগের মাথায় নেওয়া সিদ্ধান্তের জন্য অনুতাপ করতে লাগলাম। কিন্তু, তখন আর কিছু করার নেই।“
জিপসি অনেকক্ষণ বসে রইল চুপ করে।
আমি কিছুক্ষণ পর জিজ্ঞেস করলাম, “শেষ প্রশ্নটা করতে পারি?”
“হ্যাঁ, কর।“ জিপসি সোজা হয়ে বসল। দেখলাম, তখনও জিপসির চোখের তলায় জল টলমল করছে।
এই প্রশ্নটা করব বলেই এতক্ষণ বসে ছিলাম। কারন এই প্রশ্নটার গুরুত্ব, আমার কাছে অনেক, অনেক বেশি ছিল আমার জীবনের থেকেও। ধীরে ধীরে আমি বললাম, “ঝিনুকও কি তোমার মতই অমর থাকবে? আর ওর স্মৃতি কি লোপ পেয়ে যাবে?”
জিপসি হেসে বলল, “ এটা কিন্তু একসাথে দুটো প্রশ্ন অয়ন। কিন্তু না, ঝিনুক অমর নয়।“
খানিকক্ষণ আমার মুখে কোনও কথা সরল না। তারপর চিৎকার করে উঠলাম, “সত্যি?”
জিপসি হাতের ইশারায় আমাকে থামতে বলল। তারপর ধীরে ধীরে বলল, ”তোমার ভাষাতেই বলি। আমার মত ভবিষ্যৎ যাতে না হয় কারোর, তাই যে ট্যাবলেট আমি লিখিয়েছিলাম হেসিয়ডকে দিয়ে, তাতে কিছু নির্দেশ আমি ইচ্ছে করেই লিখিনি। তার জন্যই মিঃ সেন যে আবিষ্কারটি করেছেন, তাতে কারোর রিজেনারেশন ক্যাপাসিটি স্বাভাবিকের কয়েকশগুন বেড়ে গেলেও সে অমর হবে না। কারন তার টেলোমারেজ এনজাইমটা আর পাঁচটা মানুষের মতই। নিশ্চয়ই জানো, টেলোমারেজ অক্ষত থাকে বলেই ক্যান্সার কোশগুলো অমর। এক্ষেত্রে, আমি টেলোমারেজ এনজাইমটায় এমন কারিগরি করেছিলাম, যাতে একটা কোশের কোশবিভাজনের সংখ্যা, তোমরা যাকে হেইফ্লিক লিমিট বল, সেটা স্বাভাবিকের থেকে কয়েকশগুন বেড়ে গেলেও সীমিত থাকে।“
“আর তাছাড়া, এমন এমন জিনের কম্বিনেশন আমি বানিয়েছিলাম, যার জন্য মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হলেও নিজে নিজেকে তৈরি করতে পারবে না। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে ওদের ডিজেনারেশনের রেট কমে গেছে, কিন্তু তার মানে এই নয় যে ওরা নিজেকে নিজে পাল্টে নেবে। চিন্তার কিছু নেই অয়ন, ঝিনুক তোমাকে ভুলবে না। তোমাদের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল।“ জিপসি আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু মৃদু হাসছিল।
আমি লজ্জায় লাল হয়ে গেলাম। তারপর আমতা আমতা করে বললাম, “এটা কি ভবিষ্যৎ দেখে বললে?“
জিপসি হেসে উঠল। তারপর সে বলল, “আমাকে একটু উঠে দাঁড় করাবে? পেটের ডানদিকে ব্যাথাটা এখনও রয়ে গেছে। একবার বসে পড়লে দাঁড়াতে তাই কষ্ট হয়।“
আমি তখন জিপসিকে টেনে দাঁড় করালাম। উঠে দাঁড়ানোর সময় আলখাল্লাটা সরে গিয়েছিল। স্পষ্ট দেখলাম, জিপসির পেটের ডানদিকে, চামড়াটা অক্ষত নেই। সেখানে অজস্র ঠোকরানোর ক্ষতচিহ্ন।
আমার দৃষ্টি কোথায় গিয়ে পড়েছিল, তা জিপসির অগোচর হয়নি। সে একটা তিক্ত হাসি হেসে বলল, “থাক ওগুলো। প্রথমে ভেবেছিলাম, এই জায়গাটা ঠিক করে নেব। পরে ভাবলাম, কিছু চিহ্ন বয়ে নিয়ে বেড়ানোই ভাল। এগুলোই স্মৃতি।“
জাইফন ততক্ষণে আমার বাম কাঁধে এসে উড়ে বসেছে। প্রথমবারের মতই সে উড়ে এসে কাঁধে বসতেই সেই গরম তাপ লাগছিল। তারপর হঠাৎ করেই জাইফন আমার ব্যান্ডেজটা খুঁটতে থাকল। আমি সরাতে গিয়েও সরালাম না। মিনিট কয়েকের মধ্যেই পুরো জায়গাটা দৃশ্যমান হল। যেখানে কাটা জায়গাটা ছিল, সেদিকে জাইফন তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষন। দেখলাম, জাইফনের চোখ থেকে দুই ফোঁটা জল এসে পড়ল ক্ষতস্থানের ওপর।
মিনিটখানেকও গেল না। শুধু ঐ জায়গাটায় একটা পিন ফোটার মত লাগল। তারপর যে জায়গাটা দিয়ে আগে দগদগে মাংস দেখা যাচ্ছিল, সেখানে পড়ে রইল শুধু একটা গোলাপি গোল দাগ। আর কিছু পড়ে নেই সেখানে।
আমি হাঁ হয়ে রইলাম। কিন্তু গত দুই দিনে যেসব ঘটনার সম্মুখীন হয়েছি, তাতে অসম্ভব শুধুই একটা শব্দে পরিণত হয়েছে মাত্র। তবুও, বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলাম জায়গাটার দিকে। চোখের সামনেই একটা ফ্লেশ উন্ড এভাবে মিলিয়ে যাবে, না দেখলে বিশ্বাসই করতে পারতাম না।
“এটা আমাদের তরফ থেকে একটা বিদায়ী উপহার। আবার কবে দেখা হবে, তা তো ভবিষ্যৎ বলবে। আপাতত, সে অনেক দেরি।“ জিপসি চোখ টিপল। জাইফন আবার শিস দিয়ে ডেকে উঠল। সেই তীব্র, মিষ্টি শিস।
আমি ভাষা হারিয়ে ফেলেছিলাম। জাইফনের মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিলাম। জাইফন মিষ্টি করে ডেকে উড়ে গিয়ে বসল জিপসির কাঁধে।
জিপসি আন্তরিকভাবে বলল, “তাহলে আসি অয়ন। মেকরি না ডুওমে যানা।“
আমি কিছু বলার আগেই জাইফন একবার ডেকে উঠল। এবারের ডাকটা অন্য। পুরো শঙ্খধ্বনির মত শোনাচ্ছে এবারের ডাকটা। তারপরেই অবাক বিস্ময়ে দেখলাম, জাইফনের সারা শরীরে আগুনের শিখা বইতে লাগল। আগুনের তীব্রতা বাড়তে বাড়তে এমন জায়গায় গিয়ে পৌঁছল যে চোখে হাত চাপা দিতে বাধ্য হলাম, এত তীব্র আলো আর তাপ সেই আগুনের। এরমধ্যে যা ঘটছিল, দেখে নিজের চোখকেই বিশ্বাস হচ্ছিল না। জিপসি, পাখিটার গায়ের সেই তীব্র লেলিহান শিখায় পুড়ছে না, বরং হাসছে আমার দিকে তাকিয়ে। এ কীভাবে সম্ভব?
আগুনের শিখাটা যেরকম হঠাৎ শুরু হয়েছিল, সেরকমভাবেই জিপসিকে পুরোটা গ্রাস করেই হাওয়ায় মিলিয়ে গেল । প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আমি ছুটে এগিয়ে গেলাম। যেখানে জিপসি দাঁড়িয়ে ছিল, সেখানে কোনও কিছু অবশিষ্ট পড়ে নেই। যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে সে।
খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম পাথরের মত। আসলে এত কিছু একসাথে বোধগম্য হচ্ছিল না। ওটা কি আদৌ পাখি ছিল? না, জিপসিরই কোনও নতুন আবিষ্কার? হঠাৎ মাথাটা পরিষ্কার হয়ে গেল।
ইস, আমার উচিৎ কলেজের ডিগ্রিটা এনে সমুদ্রের জলে ভাসিয়ে দেওয়া। এত সোজা ধাঁধাটা কিভাবে মিস করে গেলাম?
পাখিটা যে ফেজান্ট নয়, সেটা বলাই বাহুল্য। কিন্তু পাখিটা যে কি, প্রথম দিনই জিপসি বলে দিয়েছিল। আমিই ধাঁধাটা ধরতে পারিনি। ইংরাজিতে জাইফনকে লেখা যায় XIPHONE হিসাবে। আর অক্ষরগুলো, যদি একটু এদিক ওদিক করি, তাহলেই পাখিটার নাম চলে আসে।
PHOENIX.
~ কোড নেম: প্রমিথিউস (পর্ব ২১) ~