কোড নেম: প্রমিথিউস
আথেন্স এয়ারপোর্টের বাইরে এসে মুগ্ধ হয়ে গেলাম আমি। মুখ দিয়ে কেবল একটা শব্দই বেরিয়ে আসতে চাইল, “বাহ!“
চারদিকে এত লোকের ছড়াছড়ি দেখে খানিকটা ঘাবড়েই গিয়েছিলাম আমরা। কিন্তু, সবার আগে সমুদ্রই সামলে নিল। গলা খাঁকরে সে বলল, “যাক, তাহলে এসেই পড়লাম এই নীল সাদার দেশে।”
টানা কুড়ি ঘন্টার জেট ল্যাগ, তার ওপর মেঘ কেটে গেছে। সকালের আলোয় ঝলমল করছে চারদিক। চারদিকে লোক ভর্তি, অবশ্য এর একটাই কারন, যে এটা গ্রীষ্মকাল, আর এসময়ই ভরা সিজন থাকে। পেছন পেছন আমি আর বর্ণালী এগিয়ে এসেছি। সমুদ্রর হাফ জ্যাকেটটা বেশ ভালই মানিয়েছে সাদা ফ্লানেলের শার্টের উপর। তিনজনের হাতেই ট্রলি ব্যাগ, আর সমুদ্রের কাঁধে একটা বড় ডিএসএলআর ক্যামেরার ব্যাগ ঝোলানো।
বর্ণালীর হাতে একটা গাইডবুক ধরা, সেখানে থেকে চোখ না সরিয়েই বলল, “হু। কিন্তু, এখানে দাঁড়িয়ে কাব্য করলে তো চলবে না, কোথাও একটা থাকার ব্যবস্থা তো করতেই হবে। স্যার তো বলে দিয়েছিলেন, আমাদের জন্য এয়ারপোর্টে লোক দাঁড়িয়ে থাকবে। সে কই?”
আমি বললাম, “আরে দাঁড়া। এত তাড়াহুড়ো করিস না। স্যার যখন ডেকেছেন, নিশ্চয়ই কোনও ব্যবস্থা করে রেখেছেন। দাঁড়া, লাউঞ্জে গিয়ে দেখি কেউ আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন কি না।“
সমুদ্র তাড়া লাগাল, “হ্যাঁ, চল চল। আর দেরি পোষাচ্ছে না।“ বলতে বলতেই সে হাঁটা লাগিয়ে দিয়েছে লাউঞ্জের দিকে। বাধ্য হয়েই আমাদেরকেও একরকম ছুটতেই হল ওর সাথে।
পেছন ফিরে দেখলাম একবার। এখনও এয়ারপোর্টের নামটা দেখতে পাচ্ছি স্পষ্ট অক্ষরে ঐ বড় ডিসপ্লে বোর্ডটায়। আথেন্স ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট ইলেফথেরিওস ভেনিজেলোস, সংক্ষেপে এ.আই.এ।
সত্যিই তাহলে গ্রিসে পৌঁছেছি আমরা।
আমাদের এখানে আসাটা একদমই কাকতালীয়। আমরা তিন মূর্তি, মানে, আমি, সমুদ্র, বর্ণালী একসাথেই কলেজ লাইফটা কাটিয়েছি স্কটিশচার্চে। আড্ডা, ফুর্তি প্রায় সব হরদম চলত। তবে, আমাদের তিনজনের লাইন ছিল তিনরকম। আমি আর বর্ণালী কেমিস্ট্রির লোক, সমুদ্র বায়োলজির। তবু, বন্ধুত্বে ছেদ পড়েনি। আমাদের তিনজনের এক জায়গা হবার স্থান ছিল, বায়োলজির ক্লাস। আমার আর বর্ণালীর ইলেকটিভ ছিল, সমুদ্রের মেন। অবশ্য সেই ক্লাসে, রাজা সমুদ্রই থাকত। হেন জিনিস ছিল না, ব্যাটা জানত না।
বুধবারের বায়োলজি ক্লাসটা করতে যাবার একটা আলাদা কারন ছিল। সেটা হল, মণিময় সেন, আমাদের এমএমসি স্যার। স্যারের ক্লাস করতে যেতাম বটে, কিন্তু, স্যার সিলেবাসের বাইরেও যে অনেক কিছু আছে, সেটা প্রতিটি মুহূর্তেই পড়ার মাধ্যমে বুঝিয়ে দিতেন আমাদের। স্যারের জ্ঞানের গভীরতার কাছে সমুদ্রও ডোবার বেশি কিছু ছিল না, কিন্তু সেটা ও মাইন্ড করত না কোনওকালেই। ওর কথা অনুযায়ী, “ভাই, জানার জন্য সব করতে রাজি আছি।“ স্যারও ওকে একটু বেশিই স্নেহ করতেন ঐ জানার আগ্রহের জন্য। স্যারের ক্লাস করতে ঢোকার মিনিট খানেকের মধ্যেই ভুলে যেতাম সময় কত। স্যারের পড়ানোর সময় যেন স্যারের চোখদুটো জ্বলত, আর আমরা হাঁ হয়ে থাকতাম। স্যার বেরিয়ে যাওয়ার পাঁচ মিনিট পরেও পড়ানোর সেই রেশটা থাকত।
এহেন স্যারকে যে কলেজ আগলে আগলে রাখবে, এটা বলাই বাহুল্য। কিন্তু, আমাদের ফাইনাল ইয়ারে কোনও এক অজানা কারণেই স্যার কলেজ থেকে ভি.আর.এস নিয়ে চলে গেলেন। অফিসিয়ালি জানতে পারলাম, কি একটা পারিবারিক কারনে স্যার ছুটি নিচ্ছেন, তাই আর ওনার পক্ষে ক্লাস করানো সম্ভব হচ্ছে না। একটা ফেয়ারওয়েল হল বটে, কিন্তু সেটা স্যারের অনুপস্থিতিতেই হল। আমরা মুখ গোমরা করেই সেই অনুষ্ঠানে গেলাম, গিয়ে দু চারটে বক্তৃতা শুনে চলে এলাম।
যথারীতি আমরা গ্র্যাজুয়েট হলাম। সমুদ্র ব্যাচ টপার হল। সবাই প্রেসিডেন্সিতে এসে মাস্টার্স করছি। জীবন রোজকার মতই চলছে। এমন সময়ই হঠাৎ করেই এক বিকেল বেলায় সমুদ্র ফোন করল আমাকে।
উত্তেজিত কণ্ঠে সে শুরুই করল এভাবে, “ভাই, একটা কাজ করবি?”
আমি তখন প্র্যাকটিক্যালের রেজাল্টগুলো লিখছিলাম। ওর করা ফোনটায় চমকেই গিয়েছিলাম। বরাবরই ও অনেকটা আবেগপ্রবন, কিন্তু আজ যেন একটু মাত্রাছাড়াই লাগছে। ওর গলায় এই উত্তেজনা দেখে আমি অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করলাম, “কি রে? এত লাফাচ্ছিস আজকে? কি কাজ তো বল আগে।“
“আরে, আমাদের স্যার রে, মণিময় স্যার, একটু আগে আমাকে ফোন করেছিলেন। স্যারের সাথে বরাবরই ইমেলে যোগাযোগ ছিল, ভি.আর.এস. এর পরেও সেই যোগাযোগে ঘাটতি পড়েনি। কাল সকালে মেলবক্সটা চেক করতে গিয়ে দেখি, স্যার আমাকে মেল করেছিলেন। রিটার্ন মেল করার পর আমার ফোন নম্বর চেয়ে আমাকে ফোন করলেন। আমার, তোর, বাকিদের খবর নিলেন।“ সমুদ্র একটানা বলে যাচ্ছে, “উনি বললেন, উনি গ্রিসে আছেন পারিবারিক কারনে। একটা বিপদে পড়েছেন বলে আমাদের সাহায্য চান।“
এতদিন পর, স্যার আমাদের সাহায্য চাইছেন? কিন্তু বিপদ? “কিরকম বিপদ কিছু বললেন কি?” আমি খানিকটা উৎকণ্ঠিত হয়েই জিজ্ঞেস করলাম।
“না, সেটার ব্যাপারে বললেন যে ফোনে বলা যাবে না। দেখা হলে সব বলবেন। আমি তখন তোদের কথা বলতে এক কথায় রাজি হয়ে গেলেন। বললেন, যে চেনা লোক হলে খুব ভালো হয়, তাতে বিপদের ঝুঁকিটা কমে। উনি আমাদের গ্রিসে আসতে বলছেন।“
আমি খানিক চুপ থেকে ভাবলাম। ব্যাপারটা কিরকম একটা রহস্যময় তো বটেই। গ্রিস? যে স্যারের খোঁজ আমরা গত দুবছরেও হাজার খুঁজে পাইনি, আজ তিনি কিনা গ্রিস থেকে আমাদের ডাকছেন? স্যার সেখানে গেলেনই বা কেন? আর আমাদেরকেই ডাকছেন কেন?
মনের কোণে একটা সন্দেহ হঠাৎ করেই মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। আচ্ছা, অনেকেই এরকম ভাবে ফেক কলের শিকার হন। এটা সেরকমই কোনও ট্র্যাপ নয় তো? আমাদের স্যারই আমাদের ডেকেছেন তো?
সমুদ্রকে আমার সন্দেহটা বলতেই ও হেসে উড়িয়ে দিল। বলল, “দূর পাগলা, ওই কথাটা কি আর আমি ভাবিনি? স্যারের সাথে এরপর ভিডিও কলও হয়েছে। উনি আমাদের স্যারই রে, কোনও ইমপোস্টার নয়।“
যাক একটা ফাঁড়া কাটল। কিন্তু গ্রিস? সে তো এখান থেকে দুটো মহাদেশ পেরিয়ে? কিভাবে সম্ভব?
আমার মনের কথাটা পড়ে নিয়েই সমুদ্র বলল, “দূর বলে ভাবছিস তো? স্যার টিকিট কেটে দিয়েছেন আমাদের তিনজনের। এখান থেকে কাতার এয়ারওয়েজের প্লেনে উঠব। একটা স্টপ মাঝখানে। তারপরই নেমে পড়ব আথেন্সে। ভিসার ব্যবস্থাও করে দিয়েছেন স্পেশাল পারমিশন করে। আর দুই সপ্তাহ পরেই ফ্লাইটের ডেট। যাবি তো?“
খানিকটা দোটানাতেই পড়লাম। মানছি, স্যারের প্রতি আমাদেরও কম ক্রেজ ছিল না, কিন্তু তাই বলে সুদূর গ্রিস? খানিকটা মশা মারতে কামান দাগার মত হয়ে যাচ্ছে না? যাব, না যাব না, এর মধ্যেই খানিক দুললাম। শেষে সমুদ্রর জোরাজুরিতেই নিমরাজি হয়ে গেলাম। এখন মনে হচ্ছিল, ভাগ্যিস হয়েছিলাম। গ্রিস যাবার সুযোগ কি আর জীবনে বারবার আসে?
“ঠিক আছে। আমি যাব। তার আগে একবার বাড়িতে বলে রাজি করাই।“ আমি ভেবেচিন্তে বললাম।
“হুররে… তাহলে আমাদের তিন জনের যাওয়া হচ্ছেই নীল সাদার দেশে…” সমুদ্র নেচেই উঠল প্রায়।
“এক মিনিট। বললি তিনজনের টিকিট। তুই একটা, আমি একটা। অন্যজন তবে কি…” বলতে বলতেই বুঝতে পারলাম, কে আমাদের সাথে যাচ্ছে। মিচকি হাসতে হাসতে বললাম, ”ওরে ব্যাটা, ভালই আছিস তাহলে, বেশ মজাতেই যাবি, কি বল।“
বলাই বাহুল্য, তৃতীয় ব্যক্তিটি বর্ণালী, যে সমুদ্রর বান্ধবী গত চার বছর ধরে, এবং সমুদ্র যার জন্য বোধহয় সাত সমুদ্র তেরো নদীও পেরোতে রাজি আছে। এবং অবশ্যই তার কথাই সমুদ্র বলেছে স্যারকে।
ওপার থেকে সমুদ্রর অট্টহাসি কানে এল।
~ কোড নেম: প্রমিথিউস ~