প্রতিদিনই এসে দাঁড়ায় ওরা। একজন, দুইজন, কোনদিন বা চারজন। মিষ্টু হা করে চেয়ে থাকে ওদের দিকে। গাড়িটার জানালার কাঁচের ওপাড়ে এসে দাঁড়ায় ওরা। মিষ্টুকে টা টা করে। ড্রাইভার কাকু ওকে বারণ করে দিয়েছে জানালার কাঁচ নামাতে। ইস্কুলে ঢুকতে বেড়তেও ওদের দেখেছে মিষ্টু। কেমন যেন ওরা সবার দূরে দূরে থাকে। বাড়ি ফিরে মিষ্টু ওদের কথা খুব বলে। সেই শুনে ওর মা ওকে বকা দিয়েছে খুব। বলে দিয়েছে ওদের সাথে কথা না বলতে, ওদের কাছে না যেতে। তাও যেন মাত্র সাত বছর বয়সেই মিষ্টু ওদের বহুদিন ধরে চেনে। এই পৃথিবীর জন্মলগ্ন থেকে যেন মিষ্টুর সাথে ওদের পরিচয়।
সেদিন সন্ধ্যে ছটা বেজে গেছে। মিষ্টু তখনও ইস্কুল থেকে বাড়ি ফেরেনি। মিষ্টুর মা কেঁদে কেটে চোখ নাক ফুলিয়ে ফেলেছে। মায়ের মন তো! মিষ্টুর বাবা এক ঘণ্টা ধরে গাড়ির ড্রাইভারকে বার বার ফোন করেও পায়নি। যে মেয়ে রোজ সাড়ে চারটেতে বাড়ি ঢোকে, সে আজ সাড়ে ছটাতেও অধরা। মিষ্টুর বাবা ইতিমধ্যে ইস্কুলে ফোন করেছিল, কিন্তু দারোয়ান জানিয়েছে ইস্কুলে আর কেউ নেই। ইস্কুলের শিক্ষিকা থেকে শুরু করে অনেককেই ফোন হয়ে গেছে, কিন্তু কেউ জানেনা মিষ্টু কোথায়। যার দায়িত্ব ছিল মিষ্টুকে বাড়ি আনার, সেই ড্রাইভারেরই ফোন সুইচড অফ। সে বেমালুম বেপাত্তা।
ফোনটা নিয়ে লোকাল থানার নম্বরটা সবে ডায়াল করতে যাবে মিষ্টুর বাবা এমন সময় দরজার বাইরে কলিং বেলটা বেজে উঠল। ছুটে গিয়ে এক নিঃশ্বাসে দরজাটা খুলে ফেলল মিষ্টুর মা। মা কে দেখে একগাল হেসে ‘মা’ বলে জড়িয়ে ধরল মিষ্টু। মিষ্টুর মা ততক্ষণে মিষ্টুকে জড়িয়ে ধরে স্নেহের আলিঙ্গন ও চুম্বন শুরু করে দিয়েছে। কিছুক্ষণ এই পর্ব চলার পর সম্বিৎ ফিরলে মিষ্টুর মা দেখে দরজার বাইরে কারা যেন দাঁড়িয়ে আছে। তাদের দেখে চমকে ওঠেন তিনি। দরজার ওপাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশ অফিসার এবার বলতে শুরু করলেন, “আজ এই লক্ষ্মী’দির জন্য আপনার মেয়ে নতুন জীবন পেয়েছে, আবার আপনাদের কাছে ফিরতে পেরেছে। আপনাদের গাড়ির ড্রাইভার আপনাদের মেয়েকে বিক্রি করে দিতে গেছিল। লক্ষ্মী’দি ও ওনার সহকর্মীরা মিষ্টুকে উদ্ধার করেছে। আপনাদের ড্রাইভার এখন আমাদের হেফাজতে। আপনারা একটু পরে থানায় এসে দেখা করে যাবেন। আমি এখন আসলাম। ভালো থেকো মিষ্টু।” অফিসার মিষ্টুর মাথায় হাত বুলিয়ে চলে গেলেন। মিষ্টুর মায়ের চোখ এতক্ষণে এক শ্রদ্ধা ও আন্তরিকতার জলে আবার পূর্ণ হয়ে গেছে। মিষ্টুর বাবার চোখেও জল। মিষ্টুর মায়ের মনে হল স্বয়ং যেন ইশ্বর আজ তাদের দ্বারের নিকট উপস্থিত। একই দেহে পুরুষ ও প্রকৃতি রূপী এক শক্তি যেন সমগ্র জগতের জ্যোতি একত্রিত করে তাদের সম্মুখে বিরাজমান। মিষ্টুর মা ‘দিদি’ বলে দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরল একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা লক্ষ্মী’দিকে।