ট্রেনটা ছেড়ে দিল। বেশ ভিড় আছে ট্রেনে কিন্তু আজকে একটু আগে আসায় জানলার ধারে একটা সিট পেয়ে গেছি। যাওয়া অবশ্য খুব বেশি দূর নয়, এই খড়গপুর পর্য্যন্ত। গাড়ী স্টেশান পার হতেই আমি বেশ জমিয়ে বসলাম, হ্যান্ড ব্যাগ থেকে নতুন কেনা বইটা বার করে নাকের ডগায় চশমাটা আটকে জানলার দিকে একটু কাত হয়ে বাইরের দিকে ফিরলাম।
গাড়ী তখন প্ল্যাটফর্ম ছাড়িয়ে একটু এগিয়েছে, জানলা দিয়ে দেখলাম লেভেল ক্রসিং, রাস্তা একটু একটু করে অদৃশ্য হোল … প্রথমে শহুরে পিচের রাস্তা শেষ হয়ে একটু সাদা মাটি, একটু সবুজ বড় বড় ঘাস, তারপর আস্তে আস্তে লাইনের ধারের রেলের কোয়ার্টার আর বসত বাড়ীগুলো কমে এলো। এবড়ো খেবড়ো মাঠ, এর ওর জমির পার্টিশান দেওয়া আধ ভাঙা পাঁচিল, মাঠের মধ্যে কোন এঁদো নিচু জায়গায় জমে থাকা জল … আর তার পাশেই চড়তে থাকা গরু আর ছাগলের দঙ্গল।
এই সব সাত পাঁচ দেখতে দেখতেই মিনিট দশেক কেটে গেছে, খানিকটা অন্যমনস্ক হয়ে পরেছিলাম, একটু পরে ঘার কাত করে দেখি গাড়ী কখন হাওড়ার চত্বর ছাড়িয়ে এগিয়ে গেছে, চারিদিকে কেমন সবুজ মাঠ, মাঝে মাঝে পানা পুকুর আর তার পাশেই কিছু বসতবাড়ী … মানুষজন, দু একটা কুকুর আর বাড়ীর দাওয়ায় নতুন জন্মানো শিশুর দল। কেউ ছিপ ফেলেছে, কেউ বাড়ীর দাওয়ায় বসে গল্প করছে, শিশুরা হুড়োহুড়ি করে খেলছে, কিশোর কিশোরীরা ব্যাগ নিয়ে স্কুলে যাচ্ছে … চিরন্তন বাংলার গ্রাম।
দেখতে দেখতে বেশ সময় কেটে যাচ্ছিল, এমন সময় কানের কাছে ডাক ভেসে এলো – “চায়, গরম চায় …”। ব্যাস, ধ্যান ভঙ্গ। বাইরের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে কামরার মধ্যে তাকালাম। সবাই বেশ নিজের জায়গায় আরাম করে বসেছে, সেরকম ভিড় বলে আর মনে হচ্ছে না, গোটা কয়েক ফেরিওয়ালা নিজের নিজের বেসাতি করে বেড়াচ্ছে। চা, চানাচুর, ঘর গেরস্থালীর টুকিটাকি জিনিস চিরুনি, আলতা, সেপটিপিন বিক্রি হচ্ছে।
আমি প্লাস্টিকের কাপে এক কাপ চা নিয়ে একটা চুমুক দিয়ে কামরার মানুষগুলোর দিকে তাকালাম। নানা বয়সের নানান প্রকৃতির মানুষ, কেউ পাশের লোকের সাথে গল্প করছে, কেউ মুখের সামনে খবরের কাগজ ধরে মগ্ন, অনেকেই মোবাইলে নিজের কোন প্রিয়জনের সাথে গল্পে ব্যাস্ত। আমি আবার একটু পুরনোপন্থী, কাজেই ওসব কিছুই না করে আমি চায়ে চুমুক দিতে দিতে এর ওর মুখের দিকে তাকাতে লাগলাম। মানুষের মুখ একটা আশ্চর্য জিনিস, দুজনের মুখ কোনদিন এক হয় না।
তিন চার জনের মুখ পার হয়ে আমার দৃষ্টিটা একজনের মুখের ওপর গিয়ে দাঁড়িয়ে পরলো। একটু গোলগাল মুখ, বয়স প্রায় আমাদেরই মতো, পঞ্চাশের আশেপাশে, মাথায় চুল কম, যা আছে তাও কিছুটা কাঁচাপাকা। কেমন যেন চেনাচেনা লাগছে, কোথাও আগে দেখেছি বলে মনে হচ্ছে। অদ্ভুত ব্যাপার, ভদ্রলোকও আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন বলে মনে হোল, আমি তাকাতেই কেমন চোখাচোখি হয়ে গেল। আমার মনের ভুল কিনা জানি না, ভদ্রলোকের মুখেও মনে হোল সামান্য একটু হাসি খেলে গেল। মজার ব্যাপার তো, ওনারও কি আমাকে চেনা মনে হচ্ছে নাকি?
আমি কেমন বোকা হয়ে গিয়ে চায়ে মনোযোগ দিলাম। এই সময় ট্রেন একটা স্টেশানে এসে থামলো, আমার ঠিক সামনে থেকে একজন যাত্রী নেমে গেলেন আর গোলগাল ভদ্রলোক একটু সরে এসে ঠিক আমার সামনের সিটটা পেয়ে গেলেন। আবার আর চোখে একটু চাইলাম, ভদ্রলোক ঠিক আগের মতো আমার দিকেই তাকিয়ে। কি মুশকিল, আমি কি শাহারুখ খান না আমির খান, আমার মুখে দেখবার কি আছে? বিরক্ত হয়ে চায়ের কাপটা জানলার বাইরে ছুঁড়ে ফেলে বইটা নাকের ওপর তুলে ধরলাম। কিন্তু তাতে নিরস্ত না হয়ে ভদ্রলোক মাথাটাকে সামনের দিকে ঝুঁকিয়ে একটু ফিসফিস করে বললেন – “কি রে, চিনতে পারলি না তো?”
আমি নাকের ওপর চশমাটা একটু এঁটে এবার ভালো করে তাকালাম, মুখটা আবার ভীষণ চেনা বলে মনে হোল কিন্তু তাও ঠিক মনে করতে পারলাম না। একটু রুক্ষ স্বরে বললাম –“আপনি আমাকে চেনেন নাকি? আপনাকে তো চিনতে পারলাম না”।
-“তুই সুমিত তো? মানে যাদবপুরের কেমিকাল ইঞ্জিনীয়ারিং, পঁচাশির পাস আউট?”
এবার আমার খাবি খাওয়ার পালা, কথাটা একদম ঠিক। আমি অবাক চোখে তাকিয়ে নিজের স্মৃতির সমুদ্রে ডুবে গেলাম। ভদ্রলোক আবার ফিসফিস করে বললেন – “আমি সহদেব”।
আবার খাবি খেলাম … সহদেব, মানে আমাদের দেবু। আবার তাকালাম, ঠিকই তো, সেই গোলপানা মুখ, এখন আবার গালে আর থুতনিতে বেশ চর্বি জমে গেছে। চোখের তলায় বেশ বড় দুটো ফ্যাট ব্যাগস, মাথার ঘন চুল উধাও, নাকের দুপাশে বয়সের গভীর দাগ। ওর চোখে যাদবপুরে কোন চশমা ছিল না, এখন দুটো মোটা লেন্সের চশমা।
-“মাই গড, দেবু, কি চেহারা করেছিস?”
-“আমার থেকে তোর চেহারা আরো বেশি পালটেছে সুমু”।
-“কি রকম।”
-“অত সুন্দর কোঁকড়ানো চুল ছিল, এখন মাথা ভর্তি টাক। সুন্দর টানা চোখ ছিল, সারা যাদবপুরের মেয়েরা তাকাতো, এখন মোটা ভুরু, চোখ দুটোর নিচে চর্বি। সুন্দর সাদা দাঁত গুলোর বারোটা বাজিয়েছিস, কেমন ছোপ পরে গেছে … আর কত শুনবি। অবশ্য তোকে চেনা যায়”।
-“ভাই সবই বয়সের গুনাগার, এই পৃথিবীতে তো কমদিন হোল না। ছাড় ও কথা, কতদিন পরে দেখা, কোথায় আছিস বল”।
-“আরে ভাই, সে এক ইতিহাস। নানা জায়গায় ঘুরে এখন বছর পাঁচেক এশিয়ান পেইন্টস-এ আছি, মোটামুটি ভালো একটা পজিশন দিয়েছে।“
-“যাদবপুরের ক্যাম্পাস থেকে তো তুই বোধহয় শালিমার পেইন্টস-এ পেয়েছিলি?”।
-“হ্যাঁ, সে তো প্রায় এক যুগ আগের ব্যাপার। তোর কি খবর?”।
-“আরে, আমি তো দাদিনা কনসাল্টিং থেকে শুরু করেছিলাম, জানিস বোধহয়। তারপর যা হয়, এদিক ওদিক ঘুরতে ঘুরতে স্লামবার্জারে একটা ম্যানেজারিয়াল পজিশনে আছি। সে তো হোল, তা ঘর সংসারের কি অবস্থা? বিয়ে সাদি করেছিস তো?”
সহদেব বেশ একটু হাসলো। আমি ওর হাতে একটা চাপর মেরে একটু নিচু গলায় বললাম – “এই ছোট্ট একটা কথায় এতো হাঁসি কেন, শালা?”
সহদেব আবার একটু খিক খিক করে হেসে বললো – “নাঃ, আসলে তোর আর জয়ন্তীর সেই লুকিয়ে লুকিয়ে লাইব্রেরীর পিছনে প্রেমের ব্যাপারটা মনে পরে গেল। সে যাক, আমি তো পাশ করার বছর দুয়েক বাদেই বিয়ের ব্যাপারটা সেরে ফেলেছিলাম। তোর?”
-“আমি তো জয়ন্তীর কাছে ধাক্কা খেয়ে প্রায় বছর পাঁচেক বিয়ে করবো না বলে জেদ করে বসেছিলাম। তারপর মা কান্নাকাটি করায় ধ্যারাকসে একটা নামিয়ে দিলাম। সব বাবা মায়ের পছন্দ, আমি ফটো পর্যন্ত দেখিনি। কলকাতার বাইরে পোস্টেড ছিলাম, বাড়ীতে পৌঁছই বিয়ের আগেরদিন। যাক, আমার তো এক মেয়ে, তোর ইস্যু কটা?”
-“এক ছেলে, এক মেয়ে”।
-“কি পড়ছে?”
-“ছেলেটা সেন্টজেভিয়ার্সে ফিজিক্স নিয়ে মাস্টার্সে ঢুকেছে। মেয়ে সাইন্স কলেজে বায়োতে গ্র্যাজুয়েট করছে, ফাইনাল ইয়ার। তোর মেয়ে কোন লাইনে গেলো?”
-“ওকে বি.ই. কলেজে দিয়েছিলাম, সিভিল ইঞ্জিনীয়ারিং পাশ করে এখন ডি.সি.এল.-এ আছে। গত বছর বিয়েও দিয়েছি, জামাই আর মেয়ে দুজনেই খড়গপুরে পোস্টেড, ওদের ওখানেই যাচ্ছি। তা তুই এতো হন্তদন্ত হোয়ে কোথায় চললি?”
উত্তরটা শোনার আগেই মোবাইলে একটা ফোন এলো, জামাই দেবাংশুর, শ্বশুরমশাইয়ের খোঁজ খবর।
-“কি বাবা, এখন কোথায়? ট্রেন ঠিক সময়ে ছেড়েছে তো?”
-“হ্যাঁ দেবাংশু, ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে, তবে তোমাদের ওখানে পৌঁছতে পৌঁছতে একটার বেশি হয়ে যাবে। আমার জন্য ব্যাস্ত হয়ো না, রিক্সা নিয়ে নেব”।
-“আপনি খড়গপুরের আগের স্টেশানে পৌঁছে একটা মিসড কল দিয়ে দেবেন, আমি গাড়ী নিয়ে অফিস থেকে চলে যাব। সময় হলে সুকু-ও আস্তে পারে, নাহলে ও সোজা বাড়ীতে চলে আসবে। ঠিক আছে?”
-“আরে অত ব্যাস্ত হবার কিছু ছিল না। অফিস থেকে আবার কস্ট করে নিতে আসবে। কি দরকার?”
-“না না, কিছু অসুবিধা নেই, বাবা”।
-“ঠিক আছে, আমি মিসড কল দিয়ে দেব। তাহলে একটু পরে দেখা হচ্ছে”।
_”বাই …”।
সহদেব কথা-বার্তা শুনছিল। আমি মোবাইলটা বন্ধ করে পাশে বইয়ের ওপর রেখে ওর দিকে তাকালাম। সহদেব বললো – “কি, মেয়ে জামাই নাকি?”
-“আরে কি আর করবো। জামাই গাড়ী নিয়ে স্টেশানে আসবে, তাই এক দু স্টেশান আগে মিসড কল দিতে বললো, তা সে যাক, তুই চললি কোথায়?”
-“আরে ভাই, হঠাৎ পাঁশকুরায় একটা ইন্সপেকশান পরে গেছে। স্টেশান থেকে বেশ দূরে, তাই ট্রেনে রেল স্টেশান অবধি যাব, তারপর ওখানকার স্টাফদের সাথে জীপে বেশ ভেতরে, ঘন্টা দুয়েকের জার্নি”।
আমি মুখ দিয়ে সেই আগের মতো জোরে একটা শিসের মতো “ফুইইই” গোছের শব্দ করে বললাম – “ওরে শালা, তাহলে তো তোর আজ বড় খ্যাঁট। সাইটে যাবি, ঘন্টা কয়েক হাবিজাবি ডিসকাস করবি সাইট ইঞ্জিনীয়ারদের সাথে, তারপর নিশ্চয়ই গেস্ট হাউসে ফিরে রাত্রে বড়া খানা, তাই না?”
সহদেব প্রান খুলে খানিক্ষণ হাসলো, তারপর বললো – “সেটা ঠিকই বলেছিস, আজ আর ফিরতে পারবো না। কাজেই রাত্রে তো পাঁশকুরার কোন গেস্ট হাউসেই থাকতে হবে, খাওয়া দাওয়া নিশ্চয়ই ভালোই হবে, ব্যাপারটা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম”।
পাঁশকুরা আসতে অবশ্য বিশেষ দূরে নেই। আমরা দুজনে যেন সেই তিরিশ বছর আগের যাদবপুরের দিনগুলোয় ফিরে গিয়েছিলাম। সেই সত্যেন্দার ক্যান্টিনে বসে আড্ডা, সেকেন্ড বা থার্ড ইয়ারে নিজের পৌরুষ দেখাতে দু একটা হাল্কা প্রেম ট্রেমের ব্যাপার, জয়ন্তীর সাথে আমারটা অবশ্য একটু জমে গিয়েছিল। কখনো চ্যানাচুর, কখনো চালমুগরা খেতে খেতে এই সব চললো। এতোদিন পরে সেই হারিয়ে যাওয়া যাদবপুরিয়ানের এক স্যাঙাতকে পেয়ে মন উজার করে পিছনে ফেলে আশা সময়ের উত্তাপ নিচ্ছিলাম। এর মধ্যেই নিজেদের মোবাইলের নাম্বার বদল হোল।
এক সময়ে পাঁশকুরা স্টেশান এসে গেল, সহদেব আমাকে জড়িয়ে ধরে বিদায় জানিয়ে নেমে গেল। ভিষণ ভালো লাগলো, ব্যাচমেটদের প্রায় সবাইকেই তো হারিয়ে ফেলেছি, তাই এতোদিন পর একজনকে পেয়ে মনে হোল অন্তত একজনের সাথে রিটায়ারমেন্টের পরেও যোগাযোগ রাখা যাবে। মাঝে সাঝে ওর বাড়ীতে যাওয়াও যায়, মেয়ের বিয়ের পর আমি আর আমার স্ত্রী একাই তো থাকি।
ঢিকির ঢিকির করে গাড়ী খড়গপুরের কাছে চলে এলো। এবার আমার মিসড কল দেওয়ার পালা। বাঁ পাশে বইয়ের ওপর মোবাইলটা হাতে নিতে গিয়েই অবাক, কোথায় মোবাইল! বই আর মোবাইল জানলার ধারেই ছিল, কাজেই পাশের লোকের নেওয়ার প্রশ্ন নেই, জানলার বাইরে থেকে নেওয়ার তো সুযোগই নেই। ব্যাগটা হাতড়ালাম, নেই, পকেটে … নেই। ভুরু কুঁচকে কি হোল তাই ভাবছি, হঠাৎ একটা পুরনো কথা মনে পরলো, বুকটা একটু কেঁপে উঠলো।
সহদেব। আর কে। ওর যাদবপুরেও এই ব্যাপারটা ছিল, নিজের অজান্তেই এর ওর জিনিস সরিয়ে নিত। পরে নিজের ব্যাগ থেকেই আবার লাজুক মুখে ফেরত দিত। আমরা সবাই জানতাম, ঠাট্টা ইয়ার্কি প্রচুর মারতাম কিন্তু ছেলেটার সত্যিই কোন দোষ ছিল না। এটা একটা রোগ, ডাক্তারী ভাষায় যাকে বলে “ক্লেপটোম্যানিয়াক”। মুখটা কেমন তেতো হয়ে গেল, চানাচুর আর চালমুগরার গন্ধ নিয়ে যেন একটা চোঁয়া ঢেকুর গলা দিয়ে ঠেলে বেরিয়ে এলো।
ধ্যাত, এতো বছর পরেও সহদেবের কোন চেঞ্জ নেই, তিরিশ বছর পরেও একদম অরিজিনাল।
শেষ