ছোট বা মাঝারি অফিসের তথাকথিত বড় সাহেবদের নিয়ে অসংখ্য গালগল্প বাতাসে ভেসে বেড়ায়| তাঁদের চিন্তা-ভাবনা, চাল-চলন ইত্যাদি একটু অন্যরকম হয়, ঠিক সাধারণ-বোধ্য হয় না| কথা তাঁদের দুর্বোধ্য; আর কথার মধ্যে থাকা বার্তা অবোধ্য হয়|

সারাদিনে অনেক কাজের মধ্যে সাহেবদের মূল কাজ হল কাজের ‘প্ল্যান’ বানানো, আদপে তাসের ঘর বানানোর চেষ্টা| ম্যানেজমেন্ট ট্রেনিং-এ গেলেই মালুম পড়বে ছবি-আঁকা তাস সাজিয়ে কিভাবে কাজের পরিকল্পনা করতে হয়| ‘রিপোর্ট’ তৈরি আরও বড় দায়িত্ব, যা আসলে চালে-বালি বা দুধে-জল মেশানোর হিসেব| আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল – ‘ক্যাশ ফ্লো’, যার তুলনা কেবল নল-চৌবাচ্চার অংক| বাঁদর আর তেলমাখা বাঁশের কাছাকাছি থাকবে ‘টার্গেট’ আর ‘ফলো আপ’| ছুটন্ত ট্রেন মাইল ফলক পেরিয়ে যাক বা লম্বা সেতু, ‘ক্রিটিকাল পাথ’ আর ‘মাইল স্টোন’-এর জটিলতা তাতে একবিন্দু কমে না| ‘টিম মিটিং’-এ রাম, শ্যাম, যদু, মধু আর হরিকে একসঙ্গে জ্ঞানদান করাটাও একটা কাজ| মাঝে মাঝে ‘রিভিউ মিটিং’ ও করতে হয়, সাদা বাংলায় যার মানে ‘পূর্বপাঠের পুনরনুশীলন’; ওই অঙ্কগুলো অজানাই থেকে গেছে বরাবর সরস্বতী পুজো, স্পোর্টস আর পিকনিকের চাপে| সে যাই হোক, এসব আধুনিক পাটিগণিতে দাঁত ফোটানো যার তার কর্ম নয়; ‘যাদবায়-কেশবায়’ স্মরণ করেও উদ্ধার নেই|

বকমবাজি ছেড়ে একটু অংক বোঝার চেষ্টা করলে লাভ হতে পারে|

একবার একটা মেশিন বসানো হলো এক কারখানায়; কারখানা-কর্তৃপক্ষ খুব শক্ত ধাতের| শর্ত অনুযায়ী দেড়শ ঘন্টা মেশিন চালিয়ে দেখার পরে সব ঠিকঠাক থাকলে সেই রিপোর্ট সহ বিল করা যাবে| তার তিন চার দিন পরে সমস্ত নিয়মকানুনের বেড়া পেরিয়ে হাতে টাকা আসবে| বেশ বড়সড় অংকের এই টাকাটা এমাসের হিসেবে ধরা আছে| সাহেবরা জোর গলায় সেটা বলেছেন আরও বড় সাহেবদের কাছে, তাঁরা আবার আরও উঁচুতে গলা তুলেছেন| গলার জোরে টাকার কথাটা ফানুসের মতো বিনা বাধায় অনেক উঁচুতে উঠে গেছে; এদিকে ঘাড় উঁচু করে ব্যাংক, ট্যাক্স অফিস, পাওনাদার, সাপ্লায়ার সবাই তাকিয়ে আছে ওটার ঝলমলে রঙের দিকে| মালিকপক্ষ গোঁফে তেল লাগিয়ে বসে ভাবছেন ঠোঁটের কোণ দিয়ে গড়িয়ে পড়া তেলটাকে কিভাবে কাজে লাগানো যায়| অথচ মাস শেষ হতে মাত্র এক হপ্তা বাকি, ওদিকে তখনও মেশিনের নাট-বোল্ট টাইট করা চলছে|

অফিস কাছারিতে চাপ আবার নিচের দিকেই নামে| শিরে-সংক্রান্তি পড়তে শুরু হল ‘ফলো-আপ মিটিং’ আর ‘রিকভারি প্ল্যান’| সঙ্গে তর্জনীর ঘন ঘন দিক বদল আর বাথরুমের মেঝেতে ছোট হয়ে যাওয়া সাবানের মত পিছলে বেড়ানো শুরু হল| “কাম উইথ সলিউশান, নট উইথ প্রবলেম”, “প্রবলেমস আর দেয়ার, দ্যাট’স হোয়াই ইউ আর হেয়ার”, “থিঙ্ক পজিটিভ, বি প্রো-অ্যাকটিভ”, ইত্যাদি ইংরেজি শব্দবাজি ব্যাপারটাকে আরও প্যাঁচালো করে তুলল| সবাই প্যাঁচ কাটা নাটের মত ঘুরেই চলল বোল্টের ওপর, টাইট আর হল না| অচিরেই কাজের চেয়ে কাজের হিসেব বেশি জরুরি হয়ে উঠলো| নিচুতলায় শুরু হয়ে গেল ঝগড়াঝাটি| সেটা আবার বাড়াবাড়ির পর্যায়ে গেলে কাজ ছেড়ে সবাইকে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে নরমে গরমে শুনতে হল – “ইউনাইটেড উই স্ট্যান্ড, ডিভাইডেড উই ফল”|

ছোট সাহেব মিটিং ডেকে শুরু করলেন ‘মগজ-ঝড়’; মাঝ পথে মেজ সাহেব এসে বললেন – “ইম্পসিবল ইটসেল্ফ টেলস আই অ্যাম পসিবল” (I’m possible)| বড় সাহেব আরও বড় মিটিং সেরে শেষ দিকে এসে ছোটখাটো গা গরম করা জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিলেন; নিন্দুকেরা অবশ্য বলে গা-জ্বালানো লেকচার| তাতে ম্যালোরি সাহেবের “বিকজ ইট ইজ দেয়ার”, মার্টিন সাহেবের “আই হ্যাভ আ ড্রিম”, ম্যান্ডেলা সাহেবের “আই অ্যাম প্রিপেয়ার্ড টু ডাই”, চার্চিল সাহেবের “ভিকট্রি অ্যাট অল কস্ট” ইত্যাদির টক-ঝাল-নোনতা স্বাদের মশলা মাখানো ছিল| সবশেষে গলা খুলে সিগার সাহেবের “উই শ্যাল ওভারকাম” গাওয়াটাই শুধু বাকি রইলো| মশলা মুড়ি শেষ হলে সাহেব সবার উপরে একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন; তারপর চিবিয়ে চিবিয়ে টেনে টেনে বললেন – “নাউ ইউ টেল মি দ্য ওয়ে আউট”|

ঘরের সবাই চুপ, একদম ‘পিন ড্রপ সাইলেন্স’| জানা কথা, এইবার ‘ইউ’টা বহুবচন থেকে একবচনে নেমে আসবে; সাহেব যে কোনও একজনকে সরাসরি প্রশ্ন করবেন| সাজা শোনার অপেক্ষায় থাকা আসামীর মত দমবন্ধ করে বসে আড়চোখে বাকিদের দেখা ছাড়া উপায় নেই| মেশিন চালানো, পেমেন্ট পাওয়া নিয়ে আদপেই কেউ তখন ভাবছে না; সবাই অপেক্ষা করছে মিটিং শেষ হলে কত তাড়াতাড়ি সাহেবের জ্বলন্ত দৃষ্টির বাইরে পালানো যায়| ‘জ্বালামুখ’ থেকে কখন কার চাকরি খাওয়ার নির্দেশ বেরিয়ে আসবে জানা নেই| এ.সি’র মধ্যেও বিনবিনে ঘাম নিয়ে বেশ খানিকটা অপেক্ষার পরে বিবেকবাবু একটু নড়েচড়ে বসতে সবাই আশাভরে সেদিকে নজর ঘোরালো| বহুবার তিনিই উদ্ধার করেছেন এমন পরিস্থিতি থেকে|

সামান্য গলা খাঁকরি দিয়ে বিবেকবাবু বলতে শুরু করলেন – “স্যার, চিন্তা করবেন না”| সাহেবের গনগনে মুখে কোনও পরিবর্তন হয়তো তাঁর নজরে পড়ায় আরও আত্মবিশ্বাসী গলায় বিবেকবাবু ভরসার বাণী শোনাতে থাকলেন|

বেশ বিশদেই তাঁর পরিকল্পনা বুঝিয়ে দিলেন – “আমাদের হাতে মাত্র সাতদিন সময়| আজ থেকেই পুরো দলবল নিয়ে কারখানাতেই ক্যাম্প করা হবে| কালকের মধ্যেই মেশিনের সমস্ত ফিটিংস সেরে ফেলতে হবে| কাল সন্ধে থেকে প্রাথমিক পরীক্ষানিরীক্ষা শুরু হয়ে যাবে| সুইচ অন করলে মেসিনটা চলছে কিনা প্রথমেই দেখে নিতে হবে| মেশিন হেলে পড়ছে কিনা, চলার সময় কাঁপছে কিনা ওসব পরে দেখা যাবে| টুকিটাকি সবকিছু গোছানোর কাজগুলো সেরে রাখব বিকেলেই| রিপোর্টগুলো যতটা ভরে রাখা যায় ভরে রাখতে হবে কাল রাত্রেই| পরশু ভোর থেকে মেশিন চালু করে দেব, দিনরাত মেশিন চলবে|”

সমবেত সবার অবাক দৃষ্টিকে পাত্তা না দিয়ে, সাহেবের দিকে তাকিয়ে আবার শুরু হল – “পেমেন্ট প্রোসেসিং-এর জন্য ধরুন তিনদিন, তার মানে আজকের দিনটা বাদ দিয়ে হাতে আরও তিনদিন রইল| রাতদিন টানা মেশিন চালিয়ে যাব; টার্গেট থাকবে দুদিনে দেড়শ ঘন্টা চালানোর| নেহাৎ ‘শিডিউল বার্স্ট’ করলে বা কোনও গড়বড় ধরা পড়লে বাকি একদিনটা কাজে লাগবে| রিপেয়ারিং টিমকে ওখানেই টানা থাকতে বলে দেব| আমার তো বেশ মনে হচ্ছে কাজটা নির্বিঘ্নে হয়ে যাবে|”

সাহেবের মুখে খুশির ঝিলিক দেখে একধাপ এগিয়ে আবার বক্তব্য শুরু হল – “প্রতি ঘন্টায় আপনাকে রিপোর্ট দেব স্যার| টানা কাজ চলবে তো, লজিস্টিক প্ল্যানটা ঠিক মতো করা চাই| চা, বিস্কুট, জল, প্যাকেট-খাবারের ব্যবস্থা রাখতে হবে| একটা প্রিন্টার, গোটা দুই ল্যাপটপ, একটা গাড়ি সবসময় ওখানে থাকবে| সবার মোবাইল তো থাকবেই, চার্জার নিতে কেউ যেন ভুল না করে| একটু খরচা ধরে রাখতে হবে, খুচরো জিনিষের জন্য কাজ না থেমে যায়”|

বড় সাহেবের আঙুল বাহিত নির্দেশ দেখে ছোট সাহেব প্যাডে নোট করে নিলেন – প্রিন্টার, ল্যাপটপ, গাড়ি| তারপরে তাঁর চোখের ইশারায় বাকি সবাই লিখল – মোবাইল, চার্জার| মেজ সাহেব মুখ বাড়িয়ে জ্ঞান দিতে এসে আটকে পড়েছেন, হাতে প্যাড, ডায়রি কিছুই ছিল না| মোবাইল খুলে পটাপট লিখলেন – স্ট্যাম্প প্যাড, সীল, স্টেপলার, হাইলাইটার, পেপার ক্লিপ, খুচরো টাকা|

সবার আগ্রহ আর বড়সাহেবের মুখের তাপ কমতে দেখে বিবেকবাবু এখনি করণীয় কাজের তালিকা পেশ করলেন – “একটা ডিটেল আওয়ার-ওয়াইজ শিডিউল তৈরি করে ফেলছি ঘন্টাখানেকের মধ্যে, উইথ রিসোর্স নেম অ্যান্ড স্পেসিফিক রোলস-রেসপন্সিবিলিটিজ| ওটাতে একটা ভালো ফরওয়ার্ডিং লেটার জুড়ে আপনি কারখানা-কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠিয়ে দিন স্যার| আমাদের উপরমহলে পুরো ব্যাপারটা জানিয়ে রাখবেন, ওই চিঠিটার কপিও পাঠিয়ে দিতে পারেন| সন্ধের দিকে আরেকবার সবাই বসে ডিটেল গুলো আলোচনা করে নেব| আপনাকে টেনশান করতে হবে না স্যার, আমরা সবাই মিলে উৎরে দেব|”

সাহেবের হাসি মুখ দেখে এবার আর্জি পেশ করলেন – “ওই শেষের একদিনটা যদি কাজে না লাগে তবে সবাইকে একটা ডে-অফ দিয়ে দেবেন স্যার| আর অ্যাকাউন্টস-এ একটু বলে দিন যেন টাকাপয়সা বিল-ভাউচার নিয়ে বেশি ঝামেলা না করে|”

সাহেব উঠে দাঁড়িয়ে হাত বাড়ালেন উল্টো দিকে বসা বিবেকবাবুর দিকে, হ্যান্ডশেকের ভঙ্গিতে হাতটা ধরে বললেন – “কীপ ইট আপ| সবাই কাজটাকে নিজের ভাবতে শিখুন, তবেই কাজ এগোবে; আপনারাও এগোতে পারবেন| কাজের ডিটেলে না ঢুকলে সমস্যার সমাধান পাবেন কি করে!” তারপরে ধরে থাকা হাতটা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বললেন – “থ্যাঙ্ক ইউ বিবেক, দিস ইস কলড এফেকটিভ লিডারশিপ| গো অ্যাহেড| তুমি ডিটেলগুলো রেডি করে ফেল, আমাকে আবার একটা মিটিং এ যেতে হবে| আমি কাস্টমার আর আমাদের ওপরওয়ালাদের ব্যাপারটা একটু ব্রিফ করেই বেরিয়ে যাব| হোপ ইউ ক্যান ম্যানেজ নাউ (এটা মেজ সাহেব আর ছোট সাহেবের উদ্দেশ্যে)| আই’ল বি ইন টাচ উইথ ইউ ওভার ফোন|”

থ্যাঙ্ক ইউ, বাই করে সাহেব হন্তদন্ত হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন ওপরওয়ালাদের ব্রিফ করতে| দুদিনে দেড়শ ঘন্টার হিসেব ঐকিক নিয়ম, ত্রৈরাশিক আর ভগ্নাংশে মিলিয়ে দেওয়া যেমন তেমন কর্ম নয়! তবে এই পাটিগণিত পুরো শিখে ফেলতে পারলে অফিসে সিঁড়িভাঙ্গার অংক খুব সহজ হয়ে যায়|

 

~ অফিসের পাটিগণিত ~

Print Friendly, PDF & Email
Previous articleInternational Yoga Day -2nd year
Next articleSOUND
SUBHAMOY MISRA
জন্ম আর বড় হওয়া অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলায় হলেও কলকাতায় ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া আর চাকরির সুবাদে এখন হাওড়ার বাসিন্দা। দেওয়াল পত্রিকায় লেখা শুরুর পরে স্কুল কলেজের পত্রিকা ছাড়াও অন্যান্য বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হয়েছে। বই পড়া, নাটক দেখা, গান শোনারও নেশা আছে। পেশাসূত্রে লব্ধ অভিজ্ঞতা লেখার মধ্যে দিয়ে একটু একটু করে সবার সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার ইচ্ছে আছে মনের মধ্যে।
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments