প্রেমেন মিত্তিরের ঘনাদা আর নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের টেনিদার নাম তো আমরা সবাই জানি। কিন্তু কারও কি তাঁদের চোখে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে? আমি জানি সবাই না-ই বলবেন। কিন্তু তাঁদের না দেখলেও, তাঁদেরই অধমগোত্রীয় একজনকে দেখবার সৌভাগ্য…না না, দুর্ভাগ্য আমার হয়েছিল। দুর্ভাগ্যই বলতে হলো, কারণ দুর্ভোগ তো কম ভোগ করিনি। যাই হোক, উপস্থাপনা তো হলো, এবার মূল কাহিনীতে আসি।
তা, সেই অধমগোত্রীয়ের নাম হলো সত্যবান চাকলাদার। এ যেন কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন! যে লোক জীবনে একটাও সত্যি কথা বলেছে কিনা সন্দেহ, তার নাম সত্যবান! হেসে বাঁচিনে! তা সেই সত্যবান আমাকে ফেসবুকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠালো। প্রোফাইল খুলে দেখি, ও বাবা! এ তো দেখছি আমারই স্কুলের বন্ধু! ছবি দেখে যদিও কস্মিনকালেও দেখেছি বলে মনে পড়লো না, কিন্তু তাতে কিছু আসে যায় না। সেই কত বছর আগে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেছি, সবার মুখ কি আর মনে থাকা সম্ভব রে বাপু? ফ্রেন্ড লিস্টে আমার পরিচিত ক’জন স্কুলের বন্ধুর নামও তো দেখলাম। অতএব, করে নিলাম এ্যাক্সেপ্ট।
ওমা, ক’দিন পর সেই সত্যবান দেখি আমার বরকেও ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছে। বলি ব্যাপারটা কি? আমার গুষ্টিশুদ্ধুর সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে চায় কেন? কেন, সেটা কদিন পর টের পেলাম।
প্রথমেই বলে রাখি, আমি কিন্তু দিনরাত ফেসবুকে পড়ে থাকি না। আর মেসেঞ্জার তো খুলেই দেখি না। ঘন্টা ধরে চ্যাট করার সময় কোথায়? আর হোয়াটসএ্যাপ আসার পর তো মেসেঞ্জারকে আনইন্সটলই করে দিলাম। সেই কারণে বারবার মেসেঞ্জারে মেসেজাঘাত করেও সত্যবান কোনো উত্তর পেলো না। তখন বাধ্য হয়ে সে আমার বর অনিকে মেসেজ করলো। অনিবাবুর আবার রেগুলার মেসেজ খুলে দেখার অভ্যাস আছে। সামাজিক ভদ্রলোক আর কি। সে উত্তর দিলো। কদিন পর দুজনে মোবাইল নাম্বারও এক্সচেঞ্জ করলো।
শুরু হলো দুজনের মোবাইলালাপ ও হোয়াটসএ্যাপে চ্যাট করা। মাঝে মধ্যে আমিও কথা বলতাম। কথা বলতাম বললে ভুল হবে, বলা উচিত কথা শুনতাম। কারণ, সত্যবান একবার কথা বলতে শুরু করলে আর কাউকে কথা বলার সুযোগ দিতো না। তার সেই একতরফা আলাপে শুধুই থাকতো তার নিজের সম্পর্কে বড় বড় কথা বলা, যাকে বলে বাতেলা মারা। সে নাকি দক্ষিণ আমেরিকার এক বিশাল নামকরা আই টি কোম্পানীতে ডিরেক্টর হিসেবে চাকরি করে। বিশাল অংকের তার মাইনে, রাজকীয় বাংলোয় থাকে, লেটেস্ট মডেলের গাড়িতে চড়ে। তাকে ছাড়া তার অফিস নাকি একেবারেই অচল, কোম্পানীর চেয়ারম্যান তাকে অত্যন্ত ভালোবাসেন, ইত্যাদি, ইত্যাদি। হোয়াটসএ্যাপে সে কয়েকটা ছবিও পাঠিয়েছিল। একটাতে এক রিসোর্টের সুইমিং পুলের ধারে রঙিন জাঙিয়া পরে ল্যাকপ্যাকে ঠ্যাং দেখিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, আর পেছনে বিকিনি সুন্দরীরা জলকেলী করছে। আর একটা ছবিতে বিদেশি গাড়ির সামনে সানগ্লাস পরে পোজ মেরে দাঁড়িয়ে আছে। অবশ্য এতে প্রমাণ হয়না যে সে দক্ষিণ আমেরিকাতেই থাকে। আমাদের দেশেও পাঁচতারা রিসোর্টের অভাব নেই আর বিদেশি গাড়ি তো রাস্তাঘাটে হামেশাই দেখা যায়। তার সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তোলা কি আর এমন হাতিঘোড়া ব্যাপার। কিন্তু ভদ্রতার খাতিরে এসব কথা তো আর মুখের ওপর তাকে বলা যায়না। তাই চুপচাপ তার চালবাজি শুনে যেতে হতো।
তারপর হঠাৎ একদিন শুনলাম যে সে কলকাতায় আসছে, আর আমাদের বাড়িতেই উঠছে। শুনে ভারী অবাক হলাম। কই, আমি তো কিছু জানি না। অনি বললো,
“কি করবো, ও নিজে থেকেই বললো যে তোমাদের বাড়ি কদিন থাকবো। তোমার স্কুলের বন্ধু, তাকে মুখের ওপর না বলি কি করে? তাই বাধ্য হয়েই রাজি হতে হলো।”
কি কাণ্ড দেখেছো! অথচ সত্যবান আমাকে বলেছিলো,
“তোর বর আমাকে তোদের বাড়িতে থাকার জন্য বারবার ইনভাইট করছে। তাই প্রথম তিনদিন তোদের বাড়িতেই থাকবো। কিন্তু তার বেশি একদিনও থাকতে পারবো না। কারণ বাকি বন্ধুরাও তো তাদের বাড়িতে নিয়ে যাবার জন্য ঝোলাঝুলি করছে। এত কম দিনের মধ্যে কজনের ইনভিটেশন রাখতে পারবো জানি না।”
কেমন ডাহা মিথ্যে কথাটা বললো! চালিয়াতির আর জায়গা পায় না! সবাই নাকি ওকে নিয়ে যাবার জন্য ঝোলাঝুলি করছে। লোকের তো আর খেয়েবসে কাজ নেই! হুঁঃ!
এর দুদিন পর রাত ন’টা নাগাদ একটা হলুদ ট্যাক্সিতে চেপে সত্যবান এসে হাজির হলো। বললো যে এয়ারপোর্ট থেকে আসছে। ব্যাটা যেরকম গুলবাজ, এয়ারপোর্ট না হয়ে খিদিরপুর পোর্ট থেকে এলেও আশ্চর্য হবার ছিল না। যাই হোক, ক্লান্ত ছিল বলে সেদিন আর বিশেষ কথাবার্তা হলো না। তাড়াতাড়ি ডিনার করে গেস্টরুমে শুয়ে পড়লো।
পরদিন সকালে ব্রেকফাস্টের পর সত্যবান বেশ কয়েকটা ফোন করলো। তারপর আমাকে ডেকে বললো,
“আজ রাতে শ্যাম আমার অনারে ওর ক্লাবে একটা পার্টি রেখেছে। তুইও আমার সঙ্গে চল।”
শ্যাম আমাদের স্কুলের বন্ধু। আমি বললাম,
“ওরে বাবা, শ্যামের ক্লাব তো এখান থেকে অনেকটাই দূরে। ফিরতে তো অনেক রাত হয়ে যাবে।”
“চিন্তা করছিস কেন? আমি তো সঙ্গে থাকবো, না কি? ট্যাক্সি করে যাবো-আসবো, অসুবিধে কোথায়?”
অনি ফোনে সব শুনে বললো, “আচ্ছা যাও, কিন্তু খুব বেশি রাত করো না। জায়গাটা ভালো নয়।”
শ্যামের ক্লাবে পৌঁছতে পৌঁছতে রাত আটটা বেজে গেল। গিয়ে দেখি সেখানে লোক গিজগিজ করছে। এরা সবাই নাকি আমাদের ব্যাচমেটস। হবে বা! কিন্তু আমি তো অনেককেই চিনতে পারছি না। কি কাণ্ড! এ্যামনেশিয়া হলো নাকি! সত্যবান অবশ্য সবাইকেই চেনে দেখলাম। সত্যি, ছেলেটার জনপ্রিয়তা আছে বলতে হবে। সবার সঙ্গেই কেমন হেসে হেসে কথা বলছে, আর টকাটক মদের গ্লাস শেষ করছে। শ্যাম তো দেখলাম এলাহী আয়োজন করেছে। সত্যি, সত্যবান নিশ্চয়ই ওর অত্যন্ত কাছের বন্ধু। যাকে বলে জিগরী দোস্ত। নইলে খামোকা কেউ এত খরচ করে?
শুনলাম কেউ একজন বলছে,
“দ্বাপরে ছিল কৃষ্ণ-সুদামা দুই সখা,
কলিতে পেলাম শ্যাম-সত্যবানের দেখা।”
উত্তরে আরেকজন বললো,
“যা বলেছিস মাইরি! আহা, এদের ভালোবাসা দেখে চক্ষু সার্থক হলো।”
আমি, দিব্যা আর মীনা ঘরের কোনে একটা সোফায় বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম। দশটা বাজতে না বাজতেই ওরা দুজন “টাটা বাই বাই” করে চলে গেল। সত্যবানের দিকে চেয়ে দেখি তার হাতে উপছে পড়া হুইস্কির গ্লাস, আর পা দুটো টলমল করছে। মরেছে রে! এ তো এক্ষুনি উল্টে পড়বে মনে হচ্ছে। এখন আমি বাড়ি পৌঁছই কি করে? এত রাতে ওলা বা উবেরে একা একা যাওয়াটা কি ঠিক হবে? সাতপাঁচ ভাবছি, এমন সময় অভি এসে বললো,
“নে ওঠ। অনেক রাত হয়েছে। চল তোকে বাড়ি পৌঁছে দিচ্ছি।”
আহা! অভিটা চিরকালই বড় ভালো ছেলে। আমি দাঁড়িয়ে উঠে বললাম, “আর সত্যবান?”
অভি ঠোঁট বেঁকিয়ে বললো, “থাক ব্যাটা এখানে পড়ে। মদ খেয়ে আউট হয়ে মাটিতে গড়াগড়ি দিক। তুই চ’ দিকি। ও ঠিক কারো না কারো থেকে লিফ্ট ম্যানেজ করে নেবে।”
গাড়িতে যেতে যেতে অভি বললো, “তুই ওই বোগাস হামবড়াটাকে তোর বাড়িতে থাকতে দিয়েছিস কেন?”
বললাম, “আমি না, অনি থাকতে দিয়েছে।”
“তুই আপত্তি করিসনি কেন?”
“আপত্তি করার আর সুযোগ পেলাম কোথায়? ভালো করে সবকিছু বোঝার আগেই তো ধপাস করে ঘাড়ের ওপর এসে পড়লো।”
“দেখ এখন কবে বিদেয় হয়।”
সে রাতে সত্যবান ফিরলো রাত সাড়ে বারোটার সময়। কে ওকে লিফ্ট দিয়েছে, নেশার ঘোরে সেটাও মনে করতে পারলো না। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে তারস্বরে বেসুরো গলায় গান গাইতে লাগলো। অনি তো রেগে কাঁই! আমাকে ডেকে বললো,
“তোমার বন্ধুকে বলো নিজেকে কন্ট্রোল করতে। এটা ভদ্রলোকের পাড়া।”
আমি হাসতে হাসতে বললাম,
“ও তো তোমার গেস্ট। তুমি সামলাও।”
যাই হোক ভেতরে আসার পর আর বেশি ঝামেলা না করে ঘরে ঢুকে গেল।
পরদিন সত্যবান অনেক দেরি করে ঘুম থেকে উঠলো। এদিনও ব্রেকফাস্টের পর অনেকগুলো ফোন করলো। আর আবার কারো ঘাড় ভেঙে লেক ক্লাবে একটা ডিনার পার্টি জোগাড় করে ফেললো। বাবা, ক্ষমতা আছে বলতে হবে! তবে সেদিনের পার্টিতে আমি আর যাইনি, কারণ বিকেলে আমার টিউটোরিয়াল ছিল।
সেই রাতে সত্যবান বেশ তাড়াতাড়ি ফিরে এলো। তাকে দেখে তেমন মাতাল হয়েছে বলেও মনে হলো না। মনে হলো সেদিনের পার্টি তেমন জমেনি। জামাকাপড় ছেড়ে সত্যবান ড্রইং রুমে এসে আমাদের সঙ্গে বসলো। আর বসেই বললো, “অনি, একটু হুইস্কি হবে?”
অনি গেস্ট রুমের কাবার্ড থেকে নতুন হুইস্কির বোতল বার করে দিলো। তার থেকে তিনটে পাতিয়ালা পেগ টপাটপ শেষ করে সত্যবান ঘুমোতে গেল। আধা খালি বোতলটা দেখে অনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
“রোজ রোজ তোমার বন্ধুকে মদ খাওয়াতে পারবো না বলে দিচ্ছি। বাপরে বাপ! আদেখলের মতো হুইস্কি খেলো।”
আমি বললাম,
“ও কিন্তু তোমার বন্ধু হিসেবেই এসেছে। হুঁ হুঁ বাবা! ও তোমার গেস্ট, এখন ঠ্যালা সামলাও।”
উত্তরে অনি প্যাঁচার মতো মুখ করে বললো,
“উফ, কি যন্ত্রণাতেই যে পড়েছি!”
কিন্তু যন্ত্রণার তখনো হয়েছেটা কি! সত্যবান তো এদিকে অনির ড্রিঙ্কসের বোতল রাখার জায়গাটা দেখে ফেলেছে। কাবার্ডটায় চাবিও দেওয়া ছিল না। মুরগির খাঁচা খোলা পেলে শিয়াল কি করবে সে কথা কি আর বলার অপেক্ষা রাখে? বেচারা অনির ড্রিঙ্কসের বোতলগুলোরও সেই একই রকম করুণ হাল হলো। রোজ রাতে সত্যবান একটা করে বোতলের অর্ধেক খালি করতো, তারপর তার মধ্যে জল ভরে রেখে দিতো।
অনি আবার শনি-রবিবার ছাড়া ড্রিংক করে না। তাই পরের শনিবারের আগে হুইস্কি চুরি ধরা পড়লো না। অনি গ্লাসে চুমুক দিয়েই বললো,
“আজ হুইস্কিটা এত জোলো লাগছে কেন? আর নতুন বোতলের ছিপিটাই বা কে খুললো?”
আমি বললাম,
“কে আর খুলবে? গেস্টরুমে এখন যে থাকে সে ছাড়া?”
“মানে সত্যবান??”
“আবার কে?”
সত্যবান তখন বাড়িতে ছিলো না। সেই সুযোগে অনি পত্রপাঠ বাকি বোতলগুলো গেস্টরুমের কাবার্ড থেকে সরিয়ে ফেললো। সত্যবান ফেরার পর আমরা এই নিয়ে তাকে একটা কথাও বললাম না।
কিন্তু সেই রাতে কাবার্ডে বোতল না পেয়ে সত্যবান বুঝতে পারলো যে সেগুলো সব সরিয়ে ফেলা হয়েছে। তখন তার অবস্থা সহজেই অনুমেয়। পরদিন থেকে সে দাবি করা শুরু করলো। কখনো অনির কাছে, কখনো আমার কাছে এটা ওটা চেয়ে জীবন অতিষ্ঠ করে তুললো।
তিন দিন থাকবে বলে এসেছিল। এদিকে দশ দিন পার হয়ে গেল, এখনো যাবার নাম নেই। একেবারে হিমালয় পর্বতের মতো অনড় হয়ে বসে আছে। ইদানিং দেখছি সুযোগ পেলেই ফ্রিজ খুলে টুকটাক খাবার জিনিস যা পায় তাই খেয়ে নেয়। আমার মেয়ে ফ্রিজে আধখানা ফিশ ফ্রাই তুলে রেখেছিল পরে খাবে বলে। বিকেলবেলা সে কলেজ থেকে ফিরে দেখে সেটা গায়েব! ভাবা যায়!
অনি একদিন জিজ্ঞেস করলো,
“তোমার বন্ধু বাড়ি যাবে না? দু সপ্তাহ তো পার হতে চললো। জয়পুরে ওর বউ আর মেয়ের কাছে কবে যাবে?”
ব্যাজার মুখে বললাম,
“আমি কি করে বলবো? সেদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম, এড়িয়ে যাওয়া উত্তর দিল।”
“আচ্ছা, ওর বউ আর মেয়ে আদৌ আছে তো? নাকি তারাও দক্ষিণ আমেরিকার মতো আষাঢ়ে গল্প?”
“তা হতেও পারে। কদিন আগেই আমি ওর বউ আর মেয়ের ফেসবুক এ্যাকাউন্ট চেক করছিলাম। দুটোর কোনোটাতেই কিন্তু ওর একটাও ছবি নেই। শুধু তাই নয়, দুজনের কেউই ওর ফ্রেন্ড লিস্টে নেই।”
“বলো কি! তাহলে তো সত্যিই ভারী সন্দেহজনক ব্যাপার।”
“সে আর বলতে! এদিকে চাল মারার তো অন্ত নেই। এই তো, গতকালই বলছিল জয়পুরে ও নাকি ডিলাক্স ডুপ্লে এ্যাপার্টমেন্ট কিনেছে। সেখানে কিচেন আর ওয়াশরুমেও নাকি এসি লাগানো আছে।”
“সে তো বেশ ভালো কথা। তা সেই ডিলাক্স এ্যাপার্টমেন্ট ছেড়ে আমাদের এই গরীবখানায় পড়ে আছে কেন? সেখানে চলে গেলেই তো পারে।”
“সেটাই তো কথা।”
এদিকে আমার বন্ধুরাও মাঝে মধ্যেই ফোন করে জিজ্ঞেস করছে, “কি রে, সে আপদ বিদায় হলো?” এখনো যায়নি শুনে তারা সত্যবানকে বিতাড়ন করার নানা বুদ্ধি দিতে লাগলো।
শ্যাম বললো, “তোর বাড়ির চারতলার ছাদ থেকে রাস্তায় ঠেলে ফেলে দে।”
(বোঝো ব্যাপার! পুলিশ কেস হয়ে যাবে যে!)
প্রসূন বললো, “সিঁড়ির ওপর থেকে ধাক্কা মেরে নিচে ফেলে দে।”
(এরা আমাকে জেল হাজতে পুরেই ছাড়বে দেখছি।)
অভি বললো, “পুলিশ ডেকে ট্রেসপাসার বলে ধরিয়ে দে।”
(ইস, ব্যাপারটা এতই সহজ বুঝি?)
বুবাই বললো, “ওর সামনে হোম থিয়েটারে ‘অতিথি তুম কব যাওগে’ মুভিটা চালিয়ে দে।”
(একটা মুভি দেখে চলে যাবে, অত বোকা ও নয় বাপু!)
মোদ্দা কথা, কাজের পরামর্শ কেউই দিতে পারলো না।
সত্যবানের ফোন করার ঘটা না কমলেও দিনে দিনে তার নিমন্ত্রণ পাওয়ার সংখ্যা কিন্তু শূন্যে নেমে এল। সেই প্রথম দুটো রাতেই সে যা ঘাড় মটকানোর সুযোগ পেয়েছিল। তা সেই সব ঘটনা বন্ধুমহলে বেশ চাউর হয়ে গেছে। তাই কেউই আর ওকে বিশেষ পাত্তা দিতে চাইছে না। এদিকে দু সপ্তাহ হয়ে গেলো, আমার বাড়ি থেকে নড়বার নাম অবধি করছে না। কি বিপদেই যে পড়া গেল!
সেদিন দুপুরে সত্যবান এক মহিলাকে কোনো ভাবে পটিয়ে লাঞ্চের নিমন্ত্রণ জোগাড় করে ফেললো। বেশ সাজুগুজু করে দুপুর সাড়ে বারোটা নাগাদ সে বেরিয়ে গেল। ভাবলাম সন্ধ্যের আগে নিশ্চয়ই ফিরবে না। এই সুযোগে কাজকর্ম সেরে নিশ্চিন্তে একটু গড়িয়ে নিই। কিন্তু হা হতোস্মি! তিনটে নাগাদ সবে খেয়ে উঠেছি, এমন সময় বাবু ফিরে এলেন। হাতে আবার একটা সাদা রঙের খাবারের প্যাকেট। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
“কি ব্যাপার, এত তাড়াতাড়ি লাঞ্চ হয়ে গেল?”
উত্তরে তোম্বার মতো মুখ করে বললো,
“নাঃ! পারমিতা আসেনি।”
“সে কি! কেন আসলো না সেটা ফোন করে জানায়নি?”
“না। আমি ফোন করেছিলাম। কিন্তু ওর মোবাইল সুইচড অফ ছিল।”
“কি কাণ্ড! দুপুরে লাঞ্চ করিসনি তার মানে? কিছু খাবি?”
“না না, রাস্তার ধারে একটা চাইনিজ রেস্তোরাঁ থেকে লাঞ্চ করে নিয়েছি। এই নে, তোর ছেলেমেয়ের জন্যও নিয়ে এসেছি।”
ডাইনিং টেবিলে খাবারের প্যাকেটটা রেখে ও ঘরে চলে গেল। সত্যবানের জন্য আমার একটু খারাপই লাগছিলো। বেচারা নেমন্তন্ন খেতে গিয়ে হ্যাটা খেয়ে ফিরে এলো। না না, এটা ওই পারমিতা নামের মহিলা ঠিক কাজ করেনি। তাছাড়া আমরা ওকে যতটা খারাপ বলে ভাবছি, ও বোধহয় অতটা খারাপ নয়। নইলে কি আর মনে করে আমার ছেলেমেয়ের জন্য কিছু নিয়ে আসতো? ভাবলাম, কি খাদ্যবস্তু নিয়ে এসেছে একটু খুলে দেখি তো?
প্যাকেটটা খুলে কিন্তু হতভম্ব হয়ে গেলাম। ও হরি! এ তো দেখছি প্যাকেটের তলায় দু-তিন চামচ মতো ন্যাতানো চাউমিন পড়ে আছে। ব্যাপারটা বুঝলাম। সত্যবান রেস্তোরাঁয় গিয়ে এক প্লেট চাউমিন নিয়েছিল। তার যেটুকু খেতে পারেনি সেটা ডাস্টবিনে ফেলে না দিয়ে আমার ছেলেমেয়ের জন্য ডগি প্যাক করিয়ে এনেছে। ছি ছি! আমি ভাবতেই পারিনি যে মানুষের মন এতটা নীচু হতে পারে! লোকটার স্পর্ধা দেখে রাগে আমার গা রি রি করে জ্বলতে লাগলো। আমি বাক্সটা রান্নাঘরের ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলে দিলাম।
এর দুদিন পর আমি আর অনি শলাপরামর্শ করে একটা মতলব ঠিক করলাম। অনি সত্যবানকে ডেকে বললো,
“পরশু আমার মা আসছেন। তুমি এখন যে ঘরে আছো, ওটা আসলে মায়ের ঘর। মা আসার আগে তো ওই ঘর ছাড়তে হবে। তুমি কালকের মধ্যেই অন্য কোনো ব্যবস্থা দেখে নাও।”
ভেবেছিলাম এই কথা শুনে সত্যবান নিশ্চয়ই চলে যাবার তোড়জোড় শুরু করবে। কিন্তু কোথায় কি! সে দিব্যি হাসিমুখে বললো,
“মাসীমা আসছেন সে তো খুব ভালো কথা। উনি এলে আমার কোনো অসুবিধা হবে না। আমি দিব্যি ড্রইং রুমের কার্পেটের ওপর মাদুর পেতে ঘুমিয়ে পড়বো।”
হায় ভগবান! এ যে দেখি ছিনে জোঁক! বিরক্ত হয়ে বললাম,
“বাজে কথা বলিস না। সেটা হয় না। তাছাড়া বাড়ির মধ্যে বাইরের লোক থাকা আমার শাশুড়ী মা একেবারেই পছন্দ করেন না।”
“মাসীমার ব্যাপারে তোদের চিন্তা করতে হবে না। ওনাকে আমি ঠিক ম্যানেজ করে নেবো।”
অনি বললো,
“আসার আগে যে বলছিলে যে তোমার বন্ধুরা সব তোমাকে তাদের বাড়িতে নিয়ে যাবার জন্য ঝোলাঝুলি করছে। তা, তাদেরই কারও বাড়িতে গিয়ে কদিন থাকো না।”
“যাবো তো নিশ্চয়ই। কিন্তু তার আগে জয়পুরে যেতে হবে।”
“কবে যাবে?”
“এয়ার টিকিট তো কাটি আগে। তারপর যাবো।”
“সে কি! এদ্দিন হয়ে গেল, এখনো টিকিট কাটোনি?”
“ইয়ে, মানে, এইবার কাটবো।”
“দাঁড়াও, আমি আজই তোমার টিকিটের ব্যবস্থা করছি।”
অনি ফটাফট ল্যাপটপ খুলে দশ মিনিটের মধ্যে পরের দিনের জয়পুরের এয়ার টিকিট বুক করে দিলো। সত্যবানকে বাধ্য হয়ে ক্রেডিট কার্ডে টিকিটের দাম দিতে হলো। পুরো ব্যাপারটা এমন হঠাৎ করে হয়ে গেল যে সত্যবান কিছুক্ষণ থ’ মেরে বসে রইলো। তারপর ব্যাজার মুখে ঘরে চলে গেল।
পরের দিন সকাল এগারোটায় ফ্লাইট। আটটার মধ্যে ব্রেকফাস্ট সেরে সত্যবান বেরিয়ে গেল। যাবার আগে উভয় পক্ষেই ভালো ভালো কথার আদান প্রদান হলো। সত্যবান বললো,
“খুব আনন্দ করলাম। শিগগিরই আবার আসবো।”
আমরা মুখে বললাম,
“নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই।”
আর মনে মনে বললাম, ‘বাড়ির ধারে কাছে ঘেঁষলে ঠ্যাং ভেঙে দেবো!’
সত্যবান চলে যাবার পর বেশ কয়েকটা ফোন এসেছিলো। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল শ্যামের ফোন।
শ্যামের প্রথম কথাই ছিল,
“তোর পায়ের ধুলো দে বস্! আর সঙ্গে একটা অটোগ্রাফ করা ফটো। বাঁধিয়ে রেখে দেবো। তোর নামে আমরা মন্দির প্রতিষ্ঠা করবো।”
বললাম,
“বাজে কথা না বলে কি বলবি তাই বল।”
“আমি বাজে কথা বলছি? কি বলছিস তুই? উনিশ দিন ধরে সত্যবান চাকলাদারকে সহ্য করেছিস! উঃ! তুই মহিয়সী! জানিস, আমরা সবাই মিলে তোর নাম দিয়েছি ধৈর্যের দেবী!”
কিছুক্ষণ ঠাট্টা ইয়ার্কি চলার পর অজানা কিছু ঘটনার কথা জানতে পারলাম। আমাদের বাড়িতে আসার পরদিনই সত্যবান শ্যামকে ফোন করে বলেছিল, ‘ভাই, বহু বছর পর কলকাতায় এসেছি। বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে খুব দেখা করতে ইচ্ছে করছে। তোর অফিসের ক্লাবে একটা গেট টুগেদারের বন্দোবস্ত করবি? যা বিল হবে আমরা সবাই মিলে ভাগ করে দিয়ে দেবো।’ শ্যাম এমনিতেই বন্ধুবৎসল। তাই রাজি হয়ে গিয়েছিল। সত্যবান মুড়িমুড়কির মতো ফোন করে লোকজনকে ডাকতে লাগলো। কিন্তু পার্টিটা যে ডাচ পলিসিতে হচ্ছে, অর্থাৎ নিজেদের বিল নিজেদেরই মেটাতে হবে, এ কথাটা কাউকে জানালো না। সবাই এলো, খাদ্য পানীয় ধ্বংস করলো ও একটি পয়সাও না দিয়ে বাড়ি চলে গেল। তাদের দোষ দেওয়া যায় না, কারণ তারা তো ব্যাপারটা জানতোই না। বেচারা শ্যামকেই দশ হাজার টাকার বিল পেমেন্ট করতে হলো। পরদিন সকালে যখন শ্যাম সত্যবানকে ফোন করলো, তখন সে বললো, ‘ইস, খুব ভুল হয়ে গেছে রে। আসলে গতকাল আমি এত ড্রাঙ্ক হয়ে গিয়েছিলাম যে বিলের ব্যাপারটা মাথা থেকে একদম বেরিয়ে গিয়েছিল। আজ লেক ক্লাবে আরেকটা পার্টি এ্যারেঞ্জ কর, আমি দুদিনের বিলের টাকা একসঙ্গে আদায় করে দেবো।’ শ্যাম আবার বোকার মতো ওর ফাঁদে পা দিলো। সেদিন সত্যবান শ্যামকে এড়াতে চালাকি করে পার্টি থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এসেছিল। সে রাতেও শ্যামকে ছ’ হাজার টাকার বিল মেটাতে হয়েছিল। তারপর থেকে শ্যাম ফোন করলে সত্যবান আর ধরেইনি।
এই হচ্ছে সেই দুই পার্টির নেপথ্যের কাহিনী।
আমি তো সব শুনে থ! এইভাবে ঠকিয়ে দিল! এ তো পুরো ফ্রড কেস।
তারপর খানিকক্ষণ শ্যামের পেছনে লাগলাম।
“কিরে, আমাকে ধৈর্যের দেবী বলেছিলি না? আর তুই নিজে কি? মুরগী শিরোমণি! ষোলো হাজার টাকার ডিম পেড়েছিস, আর কথা বলিস না! ছ্যা ছ্যা! দু’ দু’বার মুরগী হলি কি করে?”
ঘটনার মোটামুটি এখানেই শেষ। হোয়াটসএ্যাপে সত্যবান কয়েকবার আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু ওর মেসেজের কোনো উত্তর না দেওয়ায় বুঝে গিয়েছিল যে আমরা ওর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে ইচ্ছুক নই। এর মাসখানেক পর সত্যবান উত্তমের সঙ্গে ফেসবুকে বন্ধুত্ব করে ওর হায়দ্রাবাদের বাড়িতে যাবার ধান্দা করেছিল। কিন্তু শ্যাম আর আমার অভিজ্ঞতা জানার পর উত্তম পত্রপাঠ ওকে ব্লক করে দিলো।
আরো ক’জনের মাথায় সত্যবান কাঁঠাল ভেঙেছে, বা এখনো ভেঙে চলেছে সে খবর আমার জানা নেই। জানার প্রয়োজনও নেই। আর ভবিষ্যতে এই ধরনের চরিত্রের সান্নিধ্যে আসার কোনো ইচ্ছেও নেই।
*********************